#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি
২৬.
খবরের কাগজ পরতে পরতে চায়ে চুমুক বসাতেই নাক মুখ কুঁচকে ফেলল সাহেদ। অত্যন্ত তিক্ত স্বাদ যুক্ত এই চা তার স্ত্রী নিজ হাতে তার জন্য বানিয়েছে। সাহেদ বুঝতে পারেনা নাহার ভালোবেসে তার জন্য চা বানালেই কেন সেটা তিক্ত হয়! ভালোবাসা মিষ্টি হতে হয় কিন্তু তার স্ত্রীর ভালোবাসা তিক্ত। এতটাই তিক্ত যা মুখে তোলা ভার হয়ে যায়। হাত থেকে চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে নাহারকে ডাকেন তিনি। নাহার তখন রান্নাঘরে পারুকে আজকের কাজ বুঝিয়ে দিতে ব্যস্ত। স্বামীর ডাক পেতেই শাড়ির আঁচল কোমর থেকে ছাড়িয়ে বসার রুমে পা বাড়ান। যেতে যেতে পারুকে হুঁশিয়ারি ভাবে বলেন,
‘আগ বাড়িয়ে কিছু করবি না। বাকিটা আমি এসে বুঝিয়ে দেব।’
পারু অসন্তোষ চিত্তে মাথা নাড়ায়। নাহারের এমন হুঁশিয়ারি বার্তা তার পছন্দ না। নাহার যেতেই মুখ বাঁকিয়ে বলে,
‘মায়ের প্যাটেত্তে পড়তেই কাজ শুরু করছি। এহন ও কাজ সেখন লাগবে নাকি!’
বিদ্ধস্ত মেজাজ নিয়ে সবজি ঝুড়িতে গোছাতে লাগলো। সাথে সমানভাবে বেজে চলছে তার একান্ত রেডিও। যা বর্তমানে নাহারের বিরুদ্ধে বাজছে।
শীতের সকালের রোদটা ভিষণ মিষ্টি। অন্তিদের লিভিংরুমের বড় জানালাটা থেকে সরাসরি রোদ এসে সোফায় পড়ে। হাল্কা ঠান্ডা সকালে এমন রোদে বসে চা খেতে ভারী আনন্দ। সাহেদ সেই রোদ গায়ে মাখতেই এখানে বসেছে। নাহার আসতেই সে ভিষণ আফসোসের সুরে বললেন,
‘চা টা ঠান্ডা হয়ে গেছে নাহার। বেশি চিনি দিয়ে আর এক কাপ চা হবে?’
‘চা থেকে যে ধোঁয়া উঠছে?’
‘ওটুকু গরম কিছুনা। আর এক কাপ চা করে দাও না! সাথে মেয়েকেও ডেকে দাও।’
ততক্ষণে অন্তিও ফ্রেস হয়ে চলে এসেছে। বাবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে মাকে বলে,
‘আমাকে এক মগ কফি।’
টেবিল থেকে চায়ের কাপ তুলে নাহার মেকি হেসে বলে,
‘আর কিছু লাগবেনা তোমাদের? আমিতো সকাল সকাল এ বাড়িতে হোটেল খুলে বসেছি! আর কি কি লাগবে বলো, এনে দেই!’
সাহেদ চুপ করে থাকেন। গত রাগ থেকেই নাহারের মেজাজ ক্ষিপ্ত হয়ে আছে। এখন জবাব দেওয়া মানেই অথৈ সাগরে ঝাঁপ দেওয়া। নাহার থমথমে মুখ নিয়ে রুম ছাড়তেই সাহেদ আয়েশ করে বসেন। খবরের কাগজটা মেয়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেন,
‘দেখো তো রাশি চিহ্ন আছে নাকি এটায়। আমি আমার রাশিটা চেক করতে চাই।’
অন্তি বাবার উপহাস বুঝতে পেরে খিলখিল করে হেসে ফেলে। বাবা মেয়ের হাসির পর্ব শেষ হতে সাহেদ কিছুটা সিরিয়াস ভাবে নড়েচড়ে বসেন। গতরাতের ব্যাপারটা নিয়ে মেয়ের সাথে সরাসরি আলোচনায় বসার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। কিভাবে কথা শুরু করবেন খুঁজে না পেলে মেয়ের দিকে ফিরে অগোছালো ভাবেই বলেন,
‘গতরাতের ব্যাপারে কিছু বলো? তোমার সমস্যাটা আমাদের জানাতে হবে তো মা। না বললে বুঝে নেওয়ার মতো ক্ষমতা পৃথিবীর কারোর নেই। আমাদের বললে তবেই আমরা বুঝবো।’
অন্তি চুপ হয়ে যায়। হাতের পেপারটা সুন্দর করে ভাঁজ করে টেবিলের নিচের তাকে রাখে। সেখানে এমন ভাঁজ করা আরো অনেক পেপার জমে আছে। গত মাসের পেপারগুলো এখনো এখান থেকে সরানো হয়নি। পেপার সরানোর কাজটা প্রতিমাসে পারু নিজ দায়িত্বে করে থাকে। সামনের মুদিদোকানে বিক্রি করে অতিক্ষুদ্র সংখ্যক টাকা পায় সে। তাতেই মহাখুশি মেয়েটা। এ মাসে হয়তো ভুলে গেছে!
‘কি ভাবছ?’
অন্তি সোজা হয়ে বসে। এবার সে কিছুতেই পূর্বের ন্যায় ভুল করবে না। কিছুটা সংকোচ নিয়েই সে বলে ওঠে,
‘বিয়েটা এখন না হলেই কি নয় বাবা? আমাকে কিছুদিন সময় দাও প্লিজ। আমি এখনি মানসিক ভাবে প্রস্তুত না।’
অন্তি এটুকু বলে থামে। টলমলে দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে বাবার দিকে। নাহার কখন দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে তা দুজনের কেউই টের পায়নি। গতরাতে মেয়ের আচরণে রেগে ছিলেন তিনি। এখন অন্তির মুখে এমন কথায় চেপে থাকা রাগটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। দিক দিশা হারিয়ে ছুটে এসে মেয়েকে টেনে তুলে জোর হাতে থাপ্পর দেন। চিৎকার করে বলে ওঠেন,
‘বেশি বুঝতে শিখে গেছিস? এই বয়সেই এত বুঝতে শিখে গেছিস? সব ঐ বখাটেটার জন্য তাই না? আমি কিছু জানিনা ভেবেছিস? কাল কোথায় গিয়েছিলি সেটা আমি জানিনা ভেবেছিস। তোকে ভালো হতে সুযোগ দিয়েছি আমি। নিজের ভুল বোঝার সুযোগ দিয়েছি। কিন্তু তুই? যে পথে ছিলি সে পথেই চলছিস।’
রাগে শ্বাস তুলতে পারছে না নাহার। গতকাল তন্নিদের বাড়িতে মেয়েকে না পেয়ে সে বাড়ি ফিরে এসেছে। সে গিয়েছিল এ ব্যাপারে তন্নিও জানেনা। তখন থেকেই মেয়ের উপর সন্দেহ ছিল তার। মেয়েটা এখন লুকিয়ে ঐ বখাটের সাথে দেখা করে। সাহস কত!
হঠাৎ এমন কিছু ঘটে যাবে সাহেদ বুঝতে পারেনি। আচানক ঘটনায় থমকে গেছিলো সে। সম্বিত ফিরে পেতেই কড়া গলায় স্ত্রীকে বলেন,
‘নাহার তুমি এখান থেকে যাও। মেয়ের সাথে আমি কথা বলছি।’
‘কি বলবে তুমি? জানোয়ার ধরেছি পেটে। আমাদের কথা বুঝবে না ও। ও ওর বোধ হারিয়ে ফেলেছে।’
সাহেদ চিৎকার করে ধমক দেন এবার।
‘সেটা বোঝার জন্য এখনো আমি বেঁচে আছি। তোমাকে বিচার করতে হবে না। ভেতরে যাও। দ্বিতীয়বার না বলতে হয়!’
স্বামীর কথার উপর কথা বলার সাহস পেল না নাহার। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আরো একবার মেয়েকে দেখে নিয়ে রুম ছাড়লেন। অন্তি থম ধরে বসে আছে। চোখে পানি নেই তার। এসব কিছু যেন তাকে ছুঁতে পারেনি। পাথরের মতো হয়ে গেছে তার মন। আজ মায়ের কথার জবাব দিতেও তার ইচ্ছা হয়নি। সাহেদ চেয়েও আর কিছু বলতে পারলো না। নরম গরায় মেয়েকে রুমে যেতে বলে সে নিজেও নিজ রুমের দিকে অগ্রসর হলেন। অন্তি মুচকি হেসে বললো,
‘গতকাল আমি দিহানের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম বাবা।’
সাহেদ দাঁড়িয়ে পড়ে। পেছন ফিরে মেয়ের দিকে তাকান। অন্তি খুব স্বাভাবিক ভাবে বলে ওঠে,
‘কিন্তু সে আসলো না বাবা। আমি অনেকক্ষন অপেক্ষা করার পরও সে আসলো না। কাল থেকে তাকে কল করছি, কিন্তু সে ফোন ধরছে না। ব্যাপারটা ভিষণ মজার তাই না? তোমরা সকলে একসাথে আমাকে ত্যাগ করার চিন্তা করছো! তোমরা চাচ্ছো আমায় বিয়ে দিয়ে দূরে সরাতে; দিহান ও হয়তো তাই চায়!’
অন্তির চোখ ছলছল করে ওঠে। সাহেদ মেয়ের মানষিক অবস্থা বুঝতে পেরে আহত হয়। তার চঞ্চল মেয়েটা কোথায়? কেমন করে কি হয়ে গেলো? বুক ধরে আসে। ফাঁকা ফাঁকা লাগে ভেতরটা। কোমল গলায় বলে,
‘রুমে যাও। বিশ্রাম নাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
সব ঠিক হয়ে যাবে, এই কথাটা অন্তির কাছে কৌতুক ঠেকলো। আদেও কিছু ঠিক হওয়ার আছে?
______________
দিহানের জ্ঞান ফিরেছে। রেহানা সকাল সকাল চলে এসেছেন। তাকে না জানাতে চাইলেও ছেলের মায়ের কাছ থেকে এত বড় কথা লুকিয়ে যাওয়া অন্যায় হবে ভেবে পরে রেজওয়ান নিজেই জানান তাকে। ছেলের অবস্থা দেখে তিনবার জ্ঞান হারিয়েছেন তিনি। বর্তমানে দিহানের পাশের বেডে সেলাইন হাতে সুইয়ে রাখা হয়ে তাকে। রেজওয়ান মির্জার কপালে ভাঁজ সূক্ষ্ম হয়েছে। তাকে দেখে অত্যন্ত চিন্তিত মনে হচ্ছে। নাহারের পায়ের কাছে বসে মিণু নাহারের পায়ে তেল মালিশ করছে। সাথে বিলাপ করে গুণগুণ করে কাঁদছে।
‘স্যার ছোট সাহেব ডাকেন আপনাকে।’
মাহবুবের কথায় চেয়ার ছেড়ে উঠে কেবিনে প্রবেশ করেন রেজওয়ান মির্জা। দিহান পিঠে বালিশ ঠেস দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছে। পাশে নুহাশ গ্লাসে করে বেদানার রস খাওয়াচ্ছে তাকে। এক হাতে সেলাইন অন্যহাতে চোট থাকায় নিজ হাতে খাবার তুলে খেতে অক্ষম সে। দিহানের এমন করুণ অবস্থা দেখে নুহাশ না চাইতেই চোখ থেকে দু ফোটা পানি ঝরিয়ে ফেলেছে। তা দেখে দিহান সময় ব্যায় না করেই ধমকে উঠে বলেছে,
‘মাইয়্যাদের মতো ফ্যাচ ফ্যাচ করলে লাথি মাইরে কেবিনের বাইরে ফেলবো। তোর ঐ ফ্যাচকাদুনি গার্লফ্রেন্ডের স্বভাব পাইছো? কান্না থামা ডাফার।’
দিহানের ধমকে চোখের পানি থামলেও মুখে আঁধার নেমে আসে তার। গার্লফ্রেন্ডের কথা বলতেই তার তন্নির কথা মনে পড়ে। আজ সকালেই তো সে ইতি টেনে এলো সবকিছুর। গার্লফ্রেন্ড আর হলো কোথায়? তাদের সম্পরৃকের একটা নাম দেওয়ার আগেই সমাপ্তি ঘটেছে। মেয়েটার চাহনি কতটা নিথর হয়ে পড়েছিল ভাবতেই কষ্ট হয় তার। মুখে অন্যকথা বললেও তার চোখ নুহাশকে এভাবে যেতে না করছিলো। বোকা মেয়েটা বোধহয় এতদিনে তার অনুভূতি বুঝতে পেরেছিলো!
‘এভাবে মুর্তির মতো বসে আছো কেন? একটা কাজ অন্তত মন দিয়ে কর। কোনো কাজেই দেখছি তোমার মন নেই।’
রাশভারী গলার ধমকে নুহাশ নড়েচড়ে উঠে। রেজওয়ান মির্জাকে দেখা মাত্র চেড়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। তা দেখে তিনি কপালে ভাঁজ ফেলে বলেন,
‘স্কুলের হেডমাস্টার না আমি। বসো। নিঝের কাজে মন দাও।’
নুহাশ দাঁত চেপে স্বল্প হাসার চেষ্টা করে। দিহানের দিকে তাকালে দেখা যায় সে কিছু দেখেনি এমন ভাবে বসে আছে। কতবড় মিরজাফর হলে বন্ধুর সাথে এমন আচরণ করতে পারে? এই যে নিজে না খেয়ে বসে বসে খাওয়ায় দিচ্ছে এর জন্য সামান্যতম সিমপ্যাথি তো সে ডিজার্ভ করে! নুহাশ চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে মুচকি হেসে বলে,
‘আঙ্কেল ওর পেট ফুল। এখন আর খাবেনা বলেছে। আপনারা কথা বলেন। ঘন্টাখানেক পর আবার কিছু খাওয়ায় দিবোনি।’
কথাটা বলে গ্লাসের বাকিটুকু জুস নিজে খেয়ে ফেলে দিহানকে চোখ টিপি দেয়। বিছানায় শুয়ে থেকে তার সাথে পাঙ্গা নিতে এলে এভাবেই না খাইয়ে সাস্থি দিবে সে। হাত পায়ের যে অবস্থা তাতে দিহান কেবল মুখের কথা দ্বারাই তাকে মারতে পারবে হাত পা চালানোর ক্ষমতা নেই। নুহাশ বুক ফুলিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। দিহান সূক্ষ্ম চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। কি হলো? সে খাবেনা তা কখন বললো?
_______________
‘তোমার কারো উপর সন্দেহ আছে যারা এমন করতে পারে?’
‘না।’
‘যারা তোমাকে মেরেছে তাদের কাউকে চেনো?’
‘না।’
রেজওয়ান অধৈর্য হয়ে ওঠেন। ওকালতি জবটাকে তার এতদিন নিতান্ত আন্ডাররেটেড জব বলে মনে হতো। কিন্তু ছেলের থেকে তার দুর্ঘটনার কথা শুনতে যেয়ে তার মনে হচ্ছে ওকালতি আসলে উচ্চসম্মান যোগ্য একটা পেশা। এই পেশাধারী সকল পুরুষকে অস্কার প্রদান করা উচিত।
রেজওয়ান মির্জা ছেলের উপর চরম হতাশ হয়ে বলেন,
‘তোমার নিজের জীবনের চিন্তা না থাকতে পারে কিন্তু তোমার মায়ের চিন্তাটা একটু করো। তোমার মা কতটা নরম মনের সেটা তুমি জানো।’
দিহান সোজা গলায় উল্টো প্রশ্ন করে,
‘মাকে এখানে আনার মতো খাটো বুদ্ধিটা কে দিয়েছে আপনায়?’
রেজওয়ান মির্জার মুখ চুপসে যায়। এ বুদ্ধিটা তাকে কেউ দেয়নি। কিন্তু ছেলের অপমান জনক চাহনির শিকার হওয়ার ভয়ে তিনি চেপে গেলেন। তাকে বাঁচাতে মাহবুব প্রসঙ্গটাকে বদলাতে নিজ কদম এগিয়ে বললেন,
‘দিহান সাহেব আপনার উচিত কিছুটা সময় বাড়িতে কাটানো। সারাদিন বাড়ির বাহিরে থাকলে ম্যাডাম এমনিতেও আপনার চিন্তায় বুদ হয়ে থাকে।’
চতুর বুদ্ধিধারী দিহান মাহবুব সাহেবের কথাটাকে কাজে লাগিয়েই নিজ কার্য হাসিলের পথ বের করে নিলো। সময় এবং সুযোগ এর যথাযথ ব্যাবহারের দক্ষতাধারী দিহান বাঁকা হেসে রেজওয়ান মির্জার চোখে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলে ওঠে,
‘বাবা হয়ে ছেলেকে ঘরে আটকাতে পারছেন না? ব্যাপারটা হাস্যকর। আমাকে ঘরে আটকানোর ব্যবস্থা করুণ। সুযোগ কিন্তু বারবার আসবে না। লিমিটেড অফার।’
চলবে……….
(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)