#শুধু_তোমাকেই_চাই
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব৩৮
নতুন বউকে বরণ করে নিয়ে ড্রয়িং রুমে বসানো হয়। জাহানারা বেগম লিয়ার মিষ্টি মুখটা দেখে অস্পষ্ট স্বরে “মাশআল্লাহ”বলেন।তারপর হাসিমুখে শান্ত কন্ঠে বলেন,,
“আজ থেকে আমার তিনটে মেয়ে। জেরিন এখন এবাড়ির মেহমান।আর জারা অন্যর বাড়ির আমানত।আর তুমি আমার বাড়ির সম্পদ।এই সংসার টা এখন থেকে তোমার। এই পরিবারের সবাইকে আপন করে নিও।তুমি আমাকে নিজের মায়ের মতোই ভাবতে পারো। মনে করো আমি তোমার আরেক মা।”
কথাগুলো শুনে লিয়া মুখটা তুলে জাহানারা বেগম এর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকায়। জাহানারা বেগম নিজ হাতে লিয়াকে মিষ্টি মুখ করায়।লিয়া একবার মিষ্টি মুখে নিয়ে চিবুতে চিবুতেই বলে,,”আর নয় আম্মু।”
জাহানারা বেগম অমায়িক হেসে বলে,,”ঠিক আছে।”
কিয়ৎক্ষন পরেই জারা জেরিন কে ডেকে বলেন,,”জারা জেরিন বৌমাকে রুমে নিয়ে যা। ফ্রেশ হবে।বৌমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে।”
জারা দৌড়ে এসে বলে,,”ওকে।ভাবি চলো।”
এরমধ্যেই জেরিন এসে বলে,,”এই জারা ওয়েট ওয়েট।এইভাবে রুমে যাওয়া যাবে না।ভাইয়া কোথায়?ভাইয়াকে ডাক।আমি ডোর লকড করে রেখেছি।বাসর ঘর সাজানোর টাকা আমাদেরকে দিতে হবে তারপর ঘরের চাবি পাবে।এর আগে নয়,হু।”
জারা জেরিন কে উদ্দেশ্য করে বলে,,”আচ্ছা ঠিক আছে।তুই ভাবিকে রুমের দিকে নিয়ে যেতে থাক আমি ভাইয়াকে ডেকে আনছি।”
এরমধ্যেই জারিফ ফ্রেশ হবে সেইজন্য নিজের রুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে যেতে থাকে।এমন সময় জারা গলা ছেড়ে ডেকে বলে,,”এই ভাইয়া দাঁড়া দাঁড়া।”
জারিফ থেমে যায়। হঠাৎ জারা লিয়ার হাত ধরে ইশারায় উঠতে বলে।লিয়া বসা থেকে উঠে দাঁড়াতেই জারা জারিফের একটা হাত ধরে লিয়ার হাতে রেখে আনন্দিত কন্ঠে বলে,,”ভাইয়া তুই ভাবির সাথে একসাথে রুমে যাবি কেমন।”
জারিফ লিয়ার হাতটা শক্ত করে ধরে লিয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,,”ওকে।”
তারপর ইশারায় লিয়াকে আগাতে বলে। রুমের দরজার সামনে আসতেই জারিফের কপালে ভাঁজ পড়ে।জারিফ জারাকে ডেকে বলে,,”জারা দরজা লকড করা কেনো?আর চাবি কই?”
জারা জেরিন সহ আরো কয়েকটা কাজিন এসে দরজার পাশে দাঁড়ায়।জেরিন এক আঙ্গুলে চাবি ঘুরিয়ে নিয়ে হাতের মুঠোয় করে গমগমে স্বরে বলে,,”আমাদের আবদারটা পূরণ করতে হবে ভাইয়া।আমরা বাসর ঘর সাজিয়েছি। আমাদের সম্মানী টা আমাদেরকে দিয়ে দিলেই তুই চাবিটা পেয়ে যাবি।আর তখনই রুমে ঢুকতে পারবি।”
জারিফ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,,”আমার নিজের রুমে আমি যাবো।আমার বউকে নিয়ে যাবো।তারজন্য আমাকে টাকা দেওয়া লাগবে। ইটস্ নট ফেয়ার সিস।”
জেরিন দুইহাত বুকে গুঁজে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে,,”সরি ব্রো। সম্ভব নয়।টাকা ছাড়া আজ চাবি পাচ্ছিস না।ছোটবোনদের আবদারটা রাখ।”
এরমধ্যে রোহান ভিতরে যেতে গিয়ে এখানে হইচই শুনে এগিয়ে এসে কপাল কুঁচকে বলে,,”এখানে এত হইচই কিসের?আর এত লেডিস সমাবেশ চলছে কিসের?”
রোহানের কথা শুনে জেরিন ভ্রু কুঁচকে রোহানের দিকে রা’গি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।জারিফ রোহানের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,,”এই রোহান কোথায় থাকিস তুই?ছোটোবেলা থেকে দেখে আসছি।বিয়ের একসকল বিষয়ের সব খরচ বোনের হ্যাজবেন্ডরা বেয়ার করে।আর তুই তো খরচের সময় লাপাত্তা হয়ে যাস।”
জারিফের কথাটা শুনে লিয়া মাথাটা তুলে জারিফের দিকে তাকায় আর মনে মনে আওড়ায়,, মাস্টার মশাই তো দেখছি খুব কিপটে। টাকাগুলো দিয়ে দিলেই হয়ে যায়।তা না করে এত কথা বাড়াচ্ছে।আর অন্যের ঘাড়ে চাপাচ্ছে।এদিকে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার পা লেগে যাচ্ছে।
রোহান আরেকটু এগিয়ে আসে। তারপর ভাব নিয়ে বলে,,”হে গাইস!তোমাদের ডিমান্ড কত বলো?আমি বেয়ার করবো।পুরো টাকাটা আমিই দিচ্ছি।জলদি তোমরা আ্যমাউন্টটা বলে ফেলো।”
রোহানের কথাটা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই পাশ থেকে জারা উত্তেজিত কন্ঠে বলে,,”অনলি টুয়েন্টি থাউজেন্ডস।”
কথাটা শুনে রোহানের মাথা এক চক্কর দেয়।রোহান ঠোঁট নেড়ে রিপিট করে বলে,,”টুয়েন্টি থাউজেন্ড।তাও আবার মাত্র।মাথা খা’রাপ হয়েছে তোমাদের।ভেবে চিন্তে বলছো।”
জেরিন দাঁতে দাঁত পিষে বলে,,”আমাদের মাথা ঠিকই আছে। তোমার মাথাটা ঠিক করো।আর বেশি কথা না বলে আমাদের দাবিটা পূরণ করো।”
রোহান অসহায় ফেস করে করুণ গলায় বলে,,”এই জেরিন। তোমার ভাই তো আমাকে ফাঁসিয়ে দিলো।তুমি তোমার বরের উপর একটু সহৃদয় হও , প্লিজ। প্লিজ আ্যমাউন্ট টা একটু কমাও।”
জেরিন দুদিকে মাথা ঘুরিয়ে বলে,,”উহুম! সম্ভব নয়।”
রোহান করুণ গলায়-ই বলে,,”ও বাড়িতে গেইটে বিশ হাজার টাকা দেওয়া লেগেছে।ভাবির জিন্স প্যান্ট পড়া ফ্রেন্ড টা একচুলও ছাড় দেয়নি।কড়ায় গন্ডায় বিশ হাজার টাকাই উসুল করে ছেড়েছে।আবার এদিকে তুমি ও একই কথা বলছো।তোমারই তো বর হই।তাই একটু দয়া তো করাই যায়।টাকার পরিমাণটা অর্ধেকে আসলে হয় না।”
জেরিন কাটকাট গলায় বলে,,”নেভার।আর এখানে বারবার বর বর বলে কোনো লাভ নেই।আমার একটাই মাত্র ভাইয়া।তার বিয়েতে এতটুকু যদি তুমি নাই করতে পারো।আর কিযেনো বলছিলে? ওহ্!হ্যা।মনে পড়েছে।খুব তো মনে রেখেছো।কোন মেয়ে কি পড়েছে না পড়েছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মেয়েদেরকে দেখে বেড়াও তাইনা।”
রোহান মুখটা কাচুমাচু করে।বেশ বুঝতে পেরেছে জেরিন এমনিতেই গেইটে অরিনের সাথে কথা বলা নিয়ে রেগে আছে।আবার তার মধ্যে এখনকার এই কথায় যেনো আগুনে ঘি ঢালা হলো।
জারিফ রোহান কে উদ্দেশ্য করে বলে,,”এই রোহান এমনভাবে বলছিস গেইটের টাকা মনে হয় তুই নিজে দিয়েছিস।আমি তোর কাছে আগে থেকে টাকাটা দিয়ে রেখেছিলাম না।”
হঠাৎ জারা বলে উঠে,,”এই তোমরা সবাই এত কথা বলা বন্ধ করবে, প্লিজ।ভাবি কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে।সেদিকে খেয়াল আছে তোমাদের।”
লিয়ার কথা উঠতেই জারিফ আর কোনো বাক্য ব্যয় না করে।পকেট থেকে টাকা বের করে জেরিনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,,”এই নে।আর চাবিটা দে।”
জেরিন চাবিটা একহাতে দিয়ে অন্যহাতে টাকা নিয়ে হাস্যজ্বল মুখে বলে,,”থেংকিউ ভাইয়া।আর সরি ভাবী।তোমাকে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে রাখার জন্য।”
জারিফ জারার গাল টেনে দিয়ে বলে,,”আমি জানতাম।আর তোদের ডিমান্ড অনুযায়ী টাকা দেবো আগেই প্লান ছিলো আমার।মাঝখানে এমনি একটু তোদের কে পরীক্ষা করলাম।”
ভাইবোনের খুনশুটি দেখে লিয়ার খুব ভালো লাগে।জারিফ লক খুলে লিয়াকে ইশারায় ভেতরে যেতে বলে।জেরিন লিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,,”ভাবি রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।তোমাকে ট্রায়ার্ড দেখাচ্ছে। কোনো দরকার পরলে আমাকে বা জারাকে ডেকো কেমন।তোমার দুই ননদিনী সাথে সাথেই হাজির হবে।”
লিয়া ঘাড় নাড়িয়ে বলে,,”ঠিক আছে।”
বাকিরা সবাই যার যার মতো চলে যায়।লিয়া এক পা দু পা করে রুমে প্রবেশ করে।রুমের ভেতর গিয়ে লিয়া চারিদিকে দৃষ্টি বুলাতে থাকে।পুরো রুম জুড়ে রজনীগন্ধার সুবাস বইছে।লাল গোলাপ আর রজনীগন্ধা দিয়ে রুমটা খুব সুন্দর করে ডেকোরেট করা। বিছানার চাদর টা সাদা, পর্দা গুলো সফেদ রঙের।রুমে হালকা সবুজ রঙের ডিস্টেম্বার করা।সবুজের মাঝে সাদা মনে হচ্ছে শুভ্র শান্তিময় পরিবেশ।রুমটা খুব সুন্দর পরিপাটি করা। মাঝখানে বেড,একপাশে একটা ওয়্যারডোব,ড্রেসি়ং টেবিল একটা, সিঙ্গেল সোফা আর একটা এট্যাস্ট বুকশেলফ প্লাস টেবিল।লিয়া খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখতে থাকে। আজ থেকে এই রুমটা শুধু জারিফেরই নয়।আজ থেকে জারিফের প্রতিটি জিনিসেরই ভাগিদার লিয়াও।
জারিফ হাত থেকে রিচ ওয়াচটা খুলে ড্রেসি়ং টেবিলের উপর রাখে। শেরওয়ানির বোতাম খুলতে খুলতে লিয়ার দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলে,,”জানি আমার বাড়িটা তোমাদের মতো অত বড় নয়।তোমার হয়ত এখানকার পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে, মানিয়ে নিতে কষ্ট হবে।”
লিয়া জারিফের দিকে শীতল চাহুনিতে চেয়ে বলে,,”কে বলেছে আপনাকে?আমি মানিয়ে থাকতে পারবো না।”
জারিফ কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে বলে,,”থাকতে পারবে না।আমি সেটা বলিনি তো।আমি বলতে চেয়েছি মানিয়ে চলতে কষ্ট হতে পারে হয়ত।”
লিয়া মুখটা ম্লান করে বলে,,”এই আপনি আমাকে চেনেন – জানেন।আমাকে জেনে বুঝে আপনার এরকমটা মনে হলো। পরিবারের সবার সাথে মিলেমিশে থাকতে আমার কষ্ট হবে।আপনি বোঝাতে চাচ্ছেন আমি সেলফিশ সবার সাথে মিলেমিশে থাকতে গড়িমসি করবো।”
জারিফ আচমকা লিয়ার কোমড় জড়িয়ে ধরে।তারপর গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলে,,”সরি।তুমি ভুল বুঝছো।আমি ওভাবে মিন করিনি। আর তোমাকে আমি ভালো করেই চিনি-জানি ।তুমি কি পারবে আর না পারবে। আমার থেকে ভালো করে তোমাকে কেউ জানে না।তাই তোমার সম্পর্কে ওরকম আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।আমি শুধু বলতে চেয়েছিলাম,তোমার দাদুবাড়িতো বিশাল সেই তুলনায় আমাদের বাড়িটা ছোটো।তাই বলছি
জারিফের কথার মাঝেই লিয়া বলে,,”ভালো থাকা বা সুখে থাকার জন্য কখনো রাজপ্রাসাদের প্রয়োজন পড়ে না। বিশ্বস্ত একজন মানুষের বুক-টাই এনাফ।”
লিয়া একহাত আলতো করে জারিফের বুকের উপর রেখে দৃঢ় কন্ঠে বলে,,”আপনার বুক-টাই আমার প্যালেস।মাই হোম ইস ইন ইউর হার্ট,হোয়্যার আই লিভ ইন ফরএভার।”
জারিফ লিয়ার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়।লিয়া নিজেকে জারিফের বাহু বন্ধন থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত চঞ্চল গলায় বলে,,”ফ্রেশ হবো।ভারি ভারি গহনা আর এই পোশাক আমি আর ক্যারি করতে পারছি না।”
“ওকে ফ্রেশ হয়ে নাও।কোনো হেল্প লাগলে আমাকে বলো।বিবিজানের খেদমতে হাজির হবে এই অধম।”
কথাটা শেষ করে জারিফ সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে।লিয়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমে পিন ছাড়িয়ে মাথার উপর দেওয়া ওড়নাটা খুলে।তারপর হাতের চুড়ি গুলো খুলতে থাকে।এক এক করে সব গহনা খুলে নেয়।চুলের ক্লিপ খুলতে থাকে।সেই সময় ওয়াশরুম থেকে জারিফ বের হয়। পড়নে নেভি ব্লু কালারের ট্রিশার্ট।আর অফ হোয়াইট কালারের টাউজার। চুলগুলো থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। টাওয়েল দিয়ে চুলগুলো মুছতে মুছতে লিয়ার পিছনে দাঁড়িয়ে লিয়াকে পরখ করে বলে,,”ওয়েট করো আমি জেরিন কিংবা জারা কে ডেকে দিচ্ছি।তোমার চুলগুলো তো জট পাকিয়ে গিয়েছে।”
লিয়া বিরক্তিকর ফেস করে বলে,,”এইজন্য আমি স্টাইলিশ হেয়ার বাঁধতে চাইনি।জট খুলতে গিয়ে আমার মাথা ব্যাথা হয়ে আসছে তো।”
জারিফ জেরিনকে ডেকে দেয় লিয়াকে হেল্প করার জন্য।জারা জেরিন দুইজনই এসে খুবই আস্তে আস্তে জট খুলতে থাকে।জারিফ রুম থেকে বেরিয়ে আসে।বাইরে গিয়ে ফ্রেন্ডদের সাথে গল্পে জয়েন করে।
সারাদিন ভারী পোশাক পড়ে ভ্যাপসা গরমে লিয়ার ভালো লাগছিলো না।তাই শাওয়ার নেয়। শাওয়ার নিয়ে একটা সুতি শাড়ি পেঁচিয়ে বের হয়।শাড়িটা ঠিকঠাক মতো পড়তে জেরিন সাহায্য করে।শাড়ি ঠিক করে নিয়ে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুলগুলো শুকাতে থাকে। চুলগুলো চিরুনি করে নিয়ে ছেড়ে দিয়ে রাখে।বাড়ির সবার কথা মনে হতেই লিয়ার ফর্সা গালে আমাবস্যা নেমে আসে।লিয়া ফোনটা হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে রাজিয়া সুলতানার কাছে কল করে।রাজিয়া সুলতানা লিয়ার কল দেখে ব্যতিব্যস্ত হয়ে রিসিভ করে।
রাজিয়া সুলতানা চিন্তিত স্বরে বলেন,,”লিয়া আম্মু আমার,কেমন আছিস?কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?নতুন পরিবেশে সবার সাথে মানিয়ে নিতে।”
লিয়া ধরে আসা গলায় বলে,,”নাহ্ আম্মু।আমি ঠিক আছি।তবে তোমাদের সবার কথা খুব করে মনে পড়ছে।তোমাদের সবাইকে খুব মিস করছি।”
“মন খা’রাপ করে না সোনা।কালকেই তো আসছিস।আর এটাই নিয়ম।বিয়ের পর স্বামী-স্বামীর বাড়িই সব। স্বামী যেখানে থাকবে সেখানেই মেয়েদেরকে থাকতে হয়। এরমানে এই নয়যে বাবার বাড়ির সাথে কোনো সম্পর্ক থাকবে না।তা নয় ।তবুও বিয়ের পর বাবার বাড়ি আসা কথাটা যেনো দিনক্ষণ বেঁধে দেয়। মেহমানের মতো সফরে আসার মতো হয়ে যায়।সোনা মা আমার মন খা’রাপ করিস না। সময়ের সাথে সাথে সব সয়ে যাবে।সবার সাথে ভালো ব্যবহার করে মিলেমিশে থাকিস।তোর শ্বাশুড়ি মায়ের সাথে সদাচরণ করিস।ইভেন সবার সাথেই সব সময় হাসি মুখে কথা বলিস।ভালো ব্যবহার করিস।”
লিয়া ম্লান স্বরে বলে,,”নিশ্চয়। তোমার মেয়ে তোমার শিক্ষায় শিক্ষিত আম্মু।তোমার দেওয়া আদব-কায়দার, ইটিকেট আমার মধ্যে আছে।তুমি টেনশন নিও না আম্মু। আব্বু, রাহবার কি করে?”
রাজিয়া সুলতানা ভেজা গলায় বলেন,,”এইতো আমি রাহবারের রুমেই আছি।রাহবার কান্নাকাটি করে ঘুমিয়ে পড়েছে মাত্রই।আমাকে বললো ওর একদম ভালো লাগছে না।আমাকে কাছেই থাকতে বললো।আর তোর আব্বু নিচে আছে।”
“দাদিমনি কেমন আছেন? বাড়ির সবাই কি করে?”
রাজিয়া সুলতানা দীর্ঘ শ্বাস টেনে নিয়ে ঠোঁট মেলে বলেন,,”তোকে বিদায় দিয়ে সবারই মন খা’রাপ। সবাই এখন যার যার রুমেই আছে হয়তো। আম্মার শরীরটা ভালো নেই।বিপি টা বেড়েছে।তোর বড়মা স্লিপিং পিল দিয়েছে।মেডিসিন নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।তুই চিন্তা করিস না।আর মন খা’রাপ করিস না।জারিফ কি করে?”
“জানিনা আমি।আমি রুমে আছি।স্যার বাইরে আছে হয়তো।”
আরো কিছুক্ষণ ভালো-মন্দ কথা বলে ফোন রেখে দেয়।লিয়া ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকে। দৃষ্টি লোহার গ্রিল ভেদ করে দূরে অন্ধকারে।রুমের আলো দরজা দিয়ে হালকা ব্যালকনিতে আসছে।হালকা আলো – অন্ধকারে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে লিয়ার বেশ ভালো লাগছে।লিয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উদাস মনে বাড়ির স্মৃতি গুলো মনে করতে থাকে।লিয়া ভাবতে থাকে বাড়িতে থাকলে এই সময় কি কি করত।এটা সেটা ভাবনায় লিয়া মশগুল থাকে।
লিয়ার ভাবনার মাঝেই এমন সময়,লিয়ার শাড়ির আঁচল ভেদ করে পেটে স্পর্শ পায়।ঘাড়ে গরম নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ে।তবুও লিয়া নির্বিকার ভঙ্গিতেই নিশ্চুপ রয়।জারিফ পেছন হতে লিয়ার কোমড় জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুজে শীতল কন্ঠে বলতে থাকে,,”এখানে কি করছো অন্ধকারে?”
লিয়া একহাত জারিফের হাতের উপর রেখে বলে,,”কিছু না এমনি। আম্মুর সাথে কথা বললাম।”
“ওহ্।মন খা’রাপ করছে?”
“উঁহু।”
“বাই দ্যা ওয়ে।এখানে অন্ধকারে একা একা দাঁড়িয়ে আছো ভ’য় করছে না।আর হুট করে এসে তোমাকে জড়িয়ে ধরলাম। অন্যদিক ঘুরে থেকেই তুমি কি করে বুঝলে যে আমি?”
লিয়া জারিফের দিকে ঘুরে দুইহাতে জারিফের গলা জড়িয়ে ধরে ভাব নিয়ে বলে,,”আপনার পারফিউমের স্মেলের সাথে আমি খুব ভালো করেই পরিচিত। আর আপনি ছাড়া অন্যকারো সাহস হবে না লিয়াকে স্পর্শ করার। ক্লিয়ার?আর কি যেনো বলছিলেন?উহম,মনে পড়েছে। অন্ধকারে ভ’য় করছে কি-না।আমি খুব ব্রেভ এন্ড স্ট্রং।তাই ভয় পাওয়ার প্রশ্নই আসে না। আপনার বউয়ের হার্ট এত দুর্বল নয় মিস্টার।হুটহাট করেই ভয় পাওয়া কাঁপাকাপি করা এসব দুর্বল হার্টের অধিকারী মিসেস জারিফ নয়।মিসেস জারিফ যথেষ্ট স্ট্রং।বুঝলেন জনাব?”
জারিফ লিয়ার দিকে কিছুটা ঝুঁকে লিয়ার কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে বলে,,”গুড।এটা তো আমার নিজের জন্যই ভালো।আর আজ রাতেই প্রুভ হবে কতটা স্ট্রং তুমি।দেখি তোমার বরকে কতটা সামলাতে পারো।”
লজ্জায় লিয়ার দুই গালে গোলাপী আভা ছড়িয়ে পড়ে। লজ্জা রাঙা মুখটা লুকাতে লিয়া জারিফের বুকে মুখ গুঁজে থাকে।জারিফ ঠোঁট মেলে কিছু বলতে যাবে।সেই সময় দরজার দাড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে হাঁক ছেড়ে জারা ডাকতে থাকে,,”ভাবি,ভাইয়া ডিনার করবে আসো।”
লিয়া দ্রুত ছিটকে দূরে সরে দাঁড়ায়।জারিফ জারাকে “আসছি” বলে তারপর লিয়াকে ডিনার করতে যেতে বলে।
লিয়া ঠোঁট মেলে বলে,,”আমার একদম খাবার খেতে ইচ্ছে করছে না।আমার ক্ষুধা নেই।”
“সবাই হয়তো আমাদের জন্য ওয়েট করছে।চলো হালকা কিছু খাবে।আর তুমি না গেলে আম্মু চিন্তা করবে।তাই বলছি জাস্ট হালকা কিছু খেয়ো।”
লিয়া ঠোঁট উল্টে বলে,,”ওকে।চলুন।”
অন্যান্য অতিথিদের খাওয়া দাওয়া কিছুক্ষণ আগেই শেষ হয়েছে।এখন বাড়ির লোকজন একসাথে খাবে।ডায়নিং এ জারা জেরিন আর রোহান বসে আছে।জারিফ আর লিয়া যায়। জাহানারা বেগমের পাশে গিয়ে লিয়া সার্ভ করতে চাইলে। জাহানারা বেগম না করে লিয়াকে ওদের সাথে বসতে বলেন।জারিফ চেয়ার টেনে বসে পাশের চেয়ারে ইশারায় লিয়াকে বসতে বলে।লিয়া জারিফের পাশের চেয়ারে বসে হালকা কিছু খায়।খাওয়া দাওয়া পর্ব শেষে জারিফ আর রোহান আগেই উঠে যায়।লিয়া কিছুক্ষণ বসে জেরিন জারার সাথে খোশগল্প করতে থাকে। কিছুক্ষণ গল্প করা শেষে জেরিন বলে,,”অনেক রাত হয়েছে।ভাবি রুমে যাও।আমার প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে।”
জেরিনের কথার পাশাপাশি জারা বলে,,”আমারো দুইচোখ ভেঙ্গে ঘুম নেমে আসছে।আমি ঘুমোতে গেলাম।”
লিয়া ওয়াটারবোটল টা হাতে নিয়ে রুমে চলে আসে।হাতে থাকা ওয়াটারবোটল টা নামিয়ে রাখে।এমন সময় ব্যালকনি থেকে জারিফ রুমে এসে দরজা লক করে।দুই হাত পকেটে গুঁজে লিয়ার দিকে এক পা দু পা এগিয়ে আসতে থাকে।কাছে এসে জারিফ মুখাবয়ব গম্ভীর করে বলে,,”এই তোমার আসার সময় হলো।এদিকে তোমার জন্য ওয়েট করতে করতে আমি শহীদ হয়ে যাচ্ছি।”
লিয়া বড় হামি দিয়ে বলে,,”আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।”
জারিফ হতাশ স্বরে বলে,,”আজকে রাতে আপাতত ঘুমকে টাটা বাই বাই জানাও।আজকের রাতটা টোটালি আমার আর তোমার।সেখানে ঘুম-টুমের জায়গা আজ আর নেই।”
কথাটা ফিনিশ করে জারিফ পকেট থেকে।একটা লাল বক্স বের করে। বক্সের থেকে একটা লকেট সহ স্বর্ণের চেইন লিয়ার গলায় পড়িয়ে দেয়।তারপর লিয়াকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলে,,”এটা তোমার বাসর রাতের গিফট।আর লিয়া তোমার দেনমোহরের সব টাকা কিন্তু পরিশোধ করেছি।”
“কি দরকার ছিলো?আমি অত টাকা দিয়ে কি করবো?”
“সেটা আমি জানিনা।তোমার যা ইচ্ছে হয় তাই করো। আমার দায়িত্ব ছিলো। আর মোহরানা টা তোমার প্রাপ্য অধিকার।”
চেইনটা পড়িয়ে দিয়ে লিয়াকে জানালার পাশে নিয়ে দাঁড়ায়।জারিফ একহাতে জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়।আজকের আকাশে থালার মতো চাঁদ উঠেছে।আজকে পূর্ণিমা না হলেও চাঁদের আলো যেনো উপচে পড়ছে ধরণীতে। অন্ধকার ধরণীতে চাঁদের আলোতে সব কিছু হালকা আলোয় আলোকিত হয়েছে। চাঁদের জোছনায় স্বামী নামক মানবটাকে পাশে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে লিয়ার খুব ভালো লাগছে। প্রত্যেক টা মেয়ের কাছেই স্বামী শব্দ টাই অন্যরকম অনুভূতির জন্ম দেয়। স্বামী শব্দটাই যেনো কত আপন,কত ভালোবাসাময় আর প্রেমময়।জারিফ পেছন থেকে লিয়ার কোমড় জড়িয়ে ধরে লিয়ার গলায় মুখ ডুবিয়ে দেয়।একহাতে লিয়ার চুলের কাঠিটা খুলে দেয়। লম্বা চুলগুলো পিঠজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।জারিফের গরম নিঃশ্বাস লিয়ার ঘাড়ে পড়ছে।লিয়ার হৃদস্পন্দন স্বাভাবিকের তুলনায় কয়েকগুণ বেড়ে যায়।লিয়ার গলা শুকিয়ে আসছে।লিয়া বারকয়েক শুকনো ঢুক গিলে নেয়।
জারিফ এক হাত দিয়ে লিয়াকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে লিয়ার চোখে চোখ রাখে।গরম নিঃশ্বাসের বর্ষণ তুলে নেশাক্ত কন্ঠে বলতে থাকে,,”চাঁদের জোছনা কে সাক্ষী রেখে আজ এক পৃথিবী ভালোবাসা দিয়ে তোমাকে আমার করে নিতে চাই। আজ থেকে শুরু হবে আমাদের জীবনের নতুন এক অধ্যায়।আমাদের ভালোবাসার কাহিনী পরিপূর্ণতা পাবে।লিয়া একান্ত ভাবে আমার শুধু তোমাকেই চাই।আই ওয়ান্ট ইউ,লিয়া।মে আই।”
লিয়ার গলা দিয়ে যেনো কোনো কথাই বের হচ্ছে না। কথাগুলো পেটেই জমে আসছে। কন্ঠনালী ভেদ করে বেরুতে পারছে না।লিয়া লাজুক হেসে লজ্জায় রাঙানো মুখটা জারিফের বুকে লুকায়।জারিফ লিয়ার কপালে গভীর চুম্বন আঁকে।জারিফের স্পর্শ গভীর থেকে গভীর হতে থাকে।
পৃথিবী নামক গ্রহের রুটিন অনুযায়ী নতুন একটি দিনের সূচনা হয়।নতুন জীবনের প্রথম দিনের সূচনা হয় জারিফ লিয়া দু’জনের ও।চারিদিক থেকে পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে।ধরণী থেকে অন্ধকারকে মুড়ে দিতে হালকা আলো ছড়াতে থাকে সূর্য মামা।লিয়ার ঘুম ভেঙ্গে যায়।চোখ মেলে নিজেকে জারিফের বাহুডোরে আবিষ্কার করে লিয়া।নিজের গাঁয়ের সাথে লেপ্টে আছে স্বামী নামক ভালোবাসার মানুষটির শরীর।লিয়া এক হাত বালিশের উপর রেখে। হাতের উপর মাথা দিয়ে জারিফের ঘুমন্ত ইন্নোসেন্ট ফেসের দিকে নিষ্পলক চাহুনিতে চেয়ে থাকে।লিয়ার ইচ্ছে করছে জারিফের কপালে ঠোঁট ছোঁয়াতে।লিয়া দুই পাঁচ না ভেবে।হুট করেই মনের ইচ্ছেটাকেই প্রাধান্য দেয়। লিয়া আলতো করে জারিফের কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়।লিয়ার স্পর্শে জারিফ ঘুমের মধ্যে নড়ে চড়ে চোখ বন্ধ করেই শুয়ে থাকে।লিয়া একহাত দিয়ে জারিফের ঘন চুলগুলো এলোমেলো করতে থাকে।
জারিফ লিয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।চোখ বন্ধ করেই ঘুমুঘুম কন্ঠে বলে,,”ঘুমাও লিয়া।”
লিয়া নড়াচড়া করে বলে,,”আমার ঘুম আসছে না।আপনি ঘুমান।আমি উঠবো।”
জারিফ ভাবলেশহীন ভাবে বলে,,”চুপটি করে শুয়ে থাকো।আর আমাকে অন্তত ঘুমাতে দাও ।”
লিয়া কপাল কুঁচকে বলে,,”আপনি ঘুমান।আপনাকে ঘুমোতে নিষেধ করছে কে? আশ্চর্য।আপাতত আমাকে উঠতে দিন।”
জারিফ লিয়াকে পেঁচিয়ে ধরে বলে,,”ওহ্!লিয়া।ডিস্টার্ব করো না তো ঘুমোতে দাও।তুমি উঠে গেলে আমার ঠিকঠাক ঘুম হবে না।”
লিয়া কপাল কুঁচকে ভাবে,,আমি কোথায় ডিস্টার্ব করলাম ঘুমের।আর কোন বইয়ে লেখা আছে বউ উঠলে স্বামীর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটবে। আশ্চর্য মানুষ একটা। মানুষ নয় এলিয়েন একটা।এসব কথা মনে মনেই আওড়ায় লিয়া।
লিয়া কঠোরভাবে বলে,,”এবার উঠতে হবে তো। সবাই কি ভাববে।বেলা করে উঠলে। বাড়িতে অনেক মেহমান আছে তো।একবার আপনিই ভেবে দেখুন। প্লিজ স্যার ছাড়ুন।”
এরমধ্যে জারিফ চোখের পাতা টেনে টুনে তুলে লিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখে।লিয়া জারিফের দিকেই তাকিয়ে।জারিফের চোখে মুখে দুষ্টু হাসি খেলে যায়।জারিফ ফিচেল হেসে বলে,,”লিয়া তুমি তো দেখছি চোখ দিয়েই আমার ভার্জিনিটি শেষ করে দিলে।আর ছাত্রী হয়ে কিনা স্যারের ভার্জিনিটি কেড়ে নিলে। ইটস্ নট ফেয়ার লিয়া।একদম ঠিক করোনি তুমি।”
লিয়া মৃদু রা’গ দেখিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বলে,,”একদম উল্টো কথা বলবেন না।মনে করে দেখুন স্যার হয়ে আপনি ছাত্রীর সাথে কি করেছেন?”
কথাটা শেষ করেই লিয়া জিহ্বায় কামুড় দেয়।জারিফ মুচকি হেসে বাম ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় বোঝায় “থেমে গেলে কেনো?”
লিয়া দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে থাকে।জারিফ লিয়ার গলায় হালকা বাইট দিয়ে বলে,,”স্যার হিসেবে আমি যথেষ্ট ভদ্র ছিলাম। প্রেমিক হিসেবেও যথেষ্ট সভ্য ছিলাম।আর বর হিসেবে তো আমাকে এতটুকু অসভ্য হতেই হতো।কি বলো তুমি? তোমার বর হিসেবে এতটুকু অসভ্য না হলে বেবি ডাউনলোড কি করে হবে?বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বেবির পাপা কি করে হবো।টেল মি,লিয়া।টেল মি।”
[চলবে…ইন শা আল্লাহ]