ছায়া মানব ২
৪৬.
রাত অনেকটা গভীর হয়েছে। মেহমানরা সব বিদায় নিয়েছে। এতক্ষণে সবার জানা হয়ে গেছে মাহতিম আর অহনা উপস্থিত নেই। নিহা ক্লান্ত থাকায় নিজের ঘরে চলে গেল। কিন্তু বর্ষণ গেল না। সে চিন্তিত মাহতিমকে নিয়ে। কয়েকবার কল করেছে। ব্যস্ততার কারণে মাহতিম কল রিসিভ করেনি। মোহনা সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। অহনার মা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে। মামুন বলল,‘থানায় ডায়রি করা উচিত ছিল।’
মোহনা বলল,‘ভাই আর ইমন গিয়েছে যেহেতু একটা না একটা কিছু করবেই। শান্ত হও সবাই।’
মামুন তবুও কথা শুনল না। থানায় ডায়রি করতে ছুটলো। বর্ষণও থেমে নেই। সে সিসি টিভি ফোটেজ চ্যাক করতে গেল। তবে কিছুই পেল না। বারবার একজন ছদ্মবেশী লোককে দেখতে পেল কিন্তু তাকে শনাক্ত করতে পারল না। কারণ প্রতিবার সিসি ক্যামেরার নজরে এসেই সে উল্টো হেঁটেছে। শুধুমাত্র তার পেছনের দিকই দেখা গেছে। তবে এটা আন্দাজ করতে পেরেছে যে এই ছদ্মবেশী লোক সে জানে কোন কোন জায়গায় ক্যামেরা রয়েছে। অর্থাৎ সে পরিচিত কেউ, যে বাড়িটা সম্পর্কে সকল তথ্য জানে। অনেকবার দেখেও কিছুই বুঝতে পারল না বর্ষণ। সে দেরি করল না। দ্রুত নিচে আসতেই কিছু একটা তার নজরে পড়ে। একটা কার্ড! সেটা হাতে নিতেই দেখল পেছনের দিকে একটা মেসেজ লেখা,‘ডোন্ট প্লে উইথ মি!’
এমন একটা মেসেজ দেখে বেশ অবাক হলো বর্ষণ। কারো পার্স থেকে হয়ত পড়ে গেছে কিন্তু মেসেজটা তাকে ভাবাচ্ছে। তাই সাথেই রাখল।
অনেকক্ষণ খুঁজেও মাহতিম অহনাকে পেল না। অসাবধানতার কারণে গাড়িটাও ড্যামেজ হয়ে যায়। হালকাভাবেই একটা গাছের সাথে গিয়ে পড়ল। ইমন কোনোরকমে মাহতিমকে সাহায্য করল। মাহতিমের ফোনে কল আসলো আশিশের। ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে আশিশ বলল,‘তোদের বাড়ি থেকে আসার সময় খুঁজে পাইনি। কোথায় গিয়েছিস?’
‘অহনাকে খুঁজে পাচ্ছি না। হঠাৎ করেই কোথাও উধাও হয়ে গেল যেন। ফোনটাও খুব বাজে অবস্থায় পেলাম। ধারণা হচ্ছে কেউ অপহরণ করেছে। কিন্তু ওরতো কোনো শত্রু নেই। চেনাজানা কেউ নেই। কেউ কেন এমনটা করবে?’
‘হতেও পারে, অন্যকাউকে নিতে এসে ওকে নিয়ে গেল।’
‘জানি না। তবে থানায় ডায়রি করা উচিত হবে। পাশাপাশি আমিও দেখি।’
‘থানায় যাওয়া ঠিক হবে না। খুঁজে দেখ। আশেপাশেই আছে। আচ্ছা দাঁড়া, আমিও আসছি।’
‘না, তোকে আর লাগবে না। আমি ম্যানেজ করে নেব।’
আশিশ কলটা রেখে দেয়। মাহতিম মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। ইমন শান্ত করার জন্য বলল,‘চিন্তা করবেন না। অহনা ম্যাম খুব সাহসী। ঠিক নিজেকে রক্ষা করতে পারবে। আপনি বরং তার পরিচিত জায়গাগুলোতে খুঁজে দেখুন।’
‘শহরে তার পরিচিত কেউ নেই। আমি কার কাছে যাব?’
ভীষণ ভেঙে পড়েছে মাহতিম। চোখ লাল হয়ে এসেছে। হঠাৎ করেই প্রাইভেট একটা নাম্বার থেকে মেসেজ আসে মাহতিমের ফোনে,
‘রিসাইন ফ্রম দ্য জব। ইউ হ্যাভ টু লিভ ইউর আর্মি পোস্ট টু সেইভ দ্য গার্ল!’
মাথা ঘুরে গেল মাহতিমের। কেউ তার চাকরির পেছনে পড়েছে এটা অন্তত বুঝেছে। কিন্তু কে হতে পারে? ইমন ভাবুক হয়ে বলল,‘আপনার কোনো সহপাঠী হতে পারে! এটাতো সোজা হুমকি। আপনি এখন কী করবেন?’
‘হাজারজন আছে, যারা আমাকে পছন্দ করেনা। আমি ঠিক কার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনবো? যে হুমকি দিয়েছে সে অন্তত আমার সম্পর্কে খুব ভালো করেই জানে। তবুও তার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি। যে আমাকে হয়রানি করছে, তাকে পেলে জানে মেরে দেব। এখনো হয়ত আমাকে চিনে উঠতে পারেনি।’
পর পরই আবার একটি মেসেজ আসলো,‘ডোন্ট প্লে উইথ মি।’
মাহতিম সাথে সাথে অনুজকে নাম্বারটা পাঠিয়ে বলল,‘এই নাম্বারের ডিটেইলস্ বের কর। কোথা থেকে মেসেজটা এসেছে দ্রুত জানা।’
মাহতিম সাথে সাথেই জয়ন্তকে কল করে। লাইনে ছিল না জয়ন্ত। যোগাযোগ করতে পারেনি। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে অফিসের দিকে রওনা দিল। কিছুটা সময় পরেই অনুজের মেসেজ আসে। কিছুই খবর দিতে পারেনি সে। এটা একটা প্রাইভেট নাম্বার। লোকেশন দেখাচ্ছে ভারতের রাজস্থানে। এমনটা শুনে অবাক হলো না মাহতিম। আন্দাজ করেছিল এমনটা।
বর্ষণ মাহতিমকে খুঁজে পেল না ঠিকই তবে কার্ডটা একবার দেখল। সেখানে একটা ঠিকানা ছিল। সে আগে খেয়াল করেনি। ভালো করে দেখল। কার্ডটাকে তার অনেক ভারী মনে হলো। তাই সে সেটা ছিঁড়ে ফেলল। মুহূর্তেই একটা চিরকুট পড়ল সেটা থেকে। আগ্রহ নিয়েই সেটা দেখল সে। লেখা ছিল,‘ইফ ইউ ডোন্ট রিসাইন, ইউ উইল লস দ্য গার্ল ফর লাইফ।’
অপহরণকারী এটা মাহতিমের জন্যই রেখেছে তবে সামান্য ভুলে সেটা বর্ষণের কাছে। হাতের লেখনী বোঝারও কোনো সুযোগ নেই। প্রিন্ট করা ছিল। তবে ঠিকানা অনুযায়ীই রওনা দিল বর্ষণ। তার বুঝে আসছে না কেন লিখেছে এমনটা, রিসাইন না করলে মেয়েটিকে হারাবে? অর্থাৎ অহনার কথাই হয়ত। কিন্তু কেন?
মাহতিম দেরি করল না। তার কাছে আর কোনো উপায় নেই রিসাইন করা ছাড়া। সে অহনাকে হারাতে চায় না। মাহতিমের ফোনে আবার মেসেজ এলো। যদি সে রিসাইন করে নেয় তবে দশ মিনিটের মাঝে অহনাকে সুন্দরভাবেই বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হবে।
মাহতিম সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। ইমনকে বলল,‘তোমার কাছে কি কোনো উপায় আছে? আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না। অহনাকে হারাতে পারব না। তার জন্য যদি রিসাইন করতে হয় তবে করব।’
ইমন নিজেও বুঝতে পারছে না কী করা উচিত। বলল,‘আমরা চালাকি করতে পারি।’
‘না, যে মাঠে নেমেছে সে সাধারণ নয়। আমার সাথে পায়ে পা মিলিয়ে চলা লোক। খেলতে গেলে বিপদ হবে। রিসাইন করলে হয়ত নাম থাকবে না। তবে দেশকে কিছু দিতে হলে পদবী লাগে না। আমি এমনিতেই দেশের হয়ে লড়াই করব।’
‘আপনার যা মর্জি।’
অহনার আচমকা জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে আবিষ্কার করল অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা কক্ষে। ভয়ে আত্মা শুকিয়ে এলো। কয়েকবার ডাকল,‘কেউ আছে এখানে?’
কোনো সাড়া এলো না। উল্টো নিজের কথার প্রতিধ্বনিতে কেঁপে উঠে ঘরটা। মনে হচ্ছে কোনো পরিত্যক্ত ফ্যাক্টরি এটা। অনেকদিন ধরে অব্যবহৃত হয়ে পড়ে আছে। চারিদিক থেকে কেমন বিদঘুটে একটা গন্ধ ভেসে আসছে। কিছুই চোখে পড়ছে না। অন্ধকার এতটাই ভয়াবহ যে নিজের শরীরটাকেও দেখতে পাচ্ছে না অহনা। ভয়ে, আতঙ্কে চঞ্চল হয়ে ওঠে। বুঝতে পারছে না, কে তাকে এমন জায়গায় এনেছে। কিছুক্ষণ আগের কথা মনে হলো। ছদ্মবেশী লোকটা কে? ভাবতে ভাবতেই কয়েকবার হাঁক ছাড়ল। তেমন কিছুই হলো না। উল্টো নিজের প্রতিধ্বনিতে আত্মা কেঁপে উঠার জোগাড়। শান্তও হতে পারছে না। এমন একটা জায়গায় কেউ শান্ত থাকবে না। ফুঁপিয়ে উঠে অহনা। ভয় হচ্ছে ভীষণ।
ঠিকানা ফলো করে বর্ষণ একটা খালি জায়গায় এসে হাজির হলো। ইলেকট্রিসিটি নেই এখানে। জায়গাটাও ততটা ভালো নয়। মাহতিমকে জানাবে কিনা দ্বিধায় পড়ে যায়। কিছু একটা ভেবে আর কল করেনি মাহতিমকে। নিজেই সবটা সামলে নেবে বলে ঠিক করে। কিন্তু পরক্ষণেই প্রশ্ন এলো, অহনার কাছে তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ মাহতিম। তাই জানানোটাই উত্তম হবে। পরবর্তীতে অবিশ্বাসের একটা বেড়াজাল থাকতে পারে। তাই সে কল করেই বসে। অনেকবার কল করার পরও কোনো উত্তর এলো না। তাই মেসেজ করে দেয় যেন মাহতিম ফোন খুললে দেখতে পায়।
অফিসে কে. এম. ফাত্তাহ আর জয়ন্ত কুমার ছিল। তারা কোনো স্টেরয়েড নিয়ে কথা বলছিল। মাঝে মাঝেই তাদের মধ্যে গোপন বৈঠক হয়। অনেকটাই একান্তে। মাহতিম সহসাই তাদের কাজে ব্যাঘাত ঘটায়। তবে তার করুণ অবস্থা দেখে জয়ন্ত এগিয়ে এলো,
‘মাহতিম! এতরাতে তুমি এখানে কেন?’
‘আপনাকে অনেকবার কল করেও পাইনি।’
‘কোনো দরকার ছিল কি?’
‘আমি রিসাইন করতে চাই এবং সেটা এখনই। এই মুহূর্তে আমি পদত্যাগ করতে চাই।’
জয়ন্ত এবং ফাত্তাহ বেশ অবাক হলো। অবাকের চরম পর্যায়ে থেকেই ফাত্তাহ বলল,‘তুমি সিউর, তুমি রিসাইন করতে চাও?’
‘আমি ভেবেই এসেছি। এই মুহূর্তে পদত্যাগ না করলে আমি আমার জীবনসঙ্গীকে হারাবো। আমি তাকে হারাতে চাই না।’
‘কী বলছ এসব? কেউ হুমকি দিয়েছে? পুরো বিষয় ক্লিয়ার করে বলো। আমরা পদক্ষেপ নিতে পারি।’
‘আমার সময় নেই। শুধু জানি রিসাইন করতে হবে।’
‘এভাবে বললেই তুমি রিসাইন করতে পারো না। কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে। সমস্যা থাকলে তার থেকে পরিত্রাণের উপায়ও রয়েছে।’
‘পরিত্রাণের উপায় একটাই, রিসাইন।’
জয়ন্ত আর কিছু জানতে চাইল না। বলল,‘তবে তাই হোক। আশা করি তোমার সিদ্ধান্ত যথোপযুক্ত। বিশ্বাস রয়েছে আমার।’
চলবে….
Sathi Islam : সাথী ইসলাম