#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_৩০
#ইশরাত_জাহান
🦋
কেয়াকে সাজানো শুরু করা হয়েছে।পার্লারের মেয়েরা এসে সাজিয়ে দিচ্ছে।সবাই নামাজ পড়ে সাজতে বসেছে।দ্বীপ নীরব অভ্রকে নিয়ে জুম্মার নামাজ আদায় করতে গেছে।পুরুষ মানুষ সবাই সেখানে।রিক নিজেও জুম্মার সালাত আদায় করে কমিউনিটি সেন্টারে আসবে। রিককে ওয়েলকাম করার জন্য কমিউনিটি সেন্টারের সামনে ফিতা বেধে রাখা হয়েছে।কেয়ার কোনো কাজিন নেই।কেয়ার বাবা একা ও কেয়ার মামা বিদেশে থাকেন পুরো পরিবার সহ।রিকের খালামণিরা এসেছে।কিন্তু তাদের সন্তানেরা ব্যাস্ত থাকেন তাই আসতে পারেনি।এই জন্য সবকিছু দ্বীপ ও নীরাদের করতে হয়।রিকের মায়ের সাথে নীরার মায়ের ভালো বন্ধুত্ব ছিলো এখন দ্বীপের মায়ের সাথেও হয়েছে।দ্বীপের পরিবার এক কথায় সরল সহজ এক পরিবার।সবাই বলেন মিস্টার সমুদ্র ইচ্ছা করে নিজে ঠকে যাবেন কিন্তু কোনো ঝামেলাতে জড়াবেন না।ঠিক তেমন হয়েছে দ্বীপ। কারো সাথে কোনো ঝগড়া ঝামেলা করে না বরং কারো বিপদে দুই হাত ভরে দিবে।বিশেষ করে তামান্নার বেলায় লোকজন দ্বীপদের বিষয়ে বেশি বেশি অবগত হয়েছেন।একদিকে যেমন সমাজ অভ্রর দিকে আঙুল তুলে ঠিক তেমন মা না হয়েও দীপান্বিতার মাতৃত্বের ভালোবাসার জন্য সেই সমাজ বাহবা দেয়।প্রথম প্রথম অনেকেই বলতেন,”দীপান্বিতা ঠিক করছে না।পরের সন্তানকে নিজের করে মানুষ করা ঠিক না। যার সন্তান তাকে দিয়ে দিলেই হয়।”
বাইরের লোক তো বলতো সাথে করে বলতো পিংকির মা।পিংকি নিজেও অভ্রকে ভালোবেসেছে।কিন্তু মিসেস সাদিয়া সবসময় অভ্রকে কথা শুনিয়ে দিতেন।এমনি সম্পত্তি ভাগাভাগি হবে তার উপর পরের ছেলে।তার ক্ষোভ ছিলো এখানে।কিন্তু এত হেয় কথার বিপরীতেও অভ্রকে ভালোবেসেছে দীপান্বিতা।মিস্টার সমুদ্র ও মিসেস সাবিনা মিলে সাপোর্ট করেছেন দীপান্বিতাকে।মুখে দুই একবার বলেছিলো অভ্রকে আশ্রমে রাখতে।কিন্তু কোল থেকে ওই ছোট তুলতুলে নরম বাচ্চাকে সরাতেই পারছিলো না দীপান্বিতা।বারবার মনে হতে থাকে তামান্না দেখছে তার সন্তানের বেড়ে ওঠা।একজন মৃত মা তার সন্তানের সুখ হয়তো দুর থেকে দেখছে।দুর থেকে নাহয় এই সুখ দেখুক।দীপান্বিতা সবাইকে বলে,”অভ্র বড় হলে ওকে সোজা আমি বোর্ডিংয়ে ভর্তি করবো।তারপর গ্র্যাজুয়েশন করাতে বিদেশ পাঠাবো। যাতে ওর মনে এটা না আসে যে আমি ওকে আপন সন্তান ভাবি না। হ্যাঁ জীবনে চলতে গেলে নিজের সুখ দেখতে হবে তাই আমিও ওর চার বছর হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবো।আমার ততদিনে গ্র্যাজুয়েশন হয়ে যাবে।আমার গ্র্যাজুয়েশন শেষে নাহয় তোমরা আমার বিয়ে ঠিক করলে।”
বাসা থেকে সবাই মেনে নেয় দীপান্বিতার কথা।সবার প্রথমে সাপোর্ট করে দ্বীপ।তারপর দীপান্বিতার বাবা মা।প্রতিবেশী হয়ে নীরার বাবা মাও দীপান্বিতাকে অনেক সাপোর্ট করে।আশেপাশে থেকে মানুষ যখন অভ্রকে দেখে ক্ষিপ্ত হতে থাকে মিসেস নাজনীন তখন অভ্রকে কোলে নিয়ে পুরো এলাকা ঘোরাঘুরি করে। প্রায় প্রায় দীপান্বিতার কাছ থেকে অভ্রকে নিয়ে সকালের রোদ পোহাতে যায়।এদের সবার এই ভালোবাসা দেখে আস্তে আস্তে মুখ বন্ধ হয় সমাজের।নীরা ছোট হলেও চঞ্চল ছিলো খুব।নীরাকে সবাই একটু বেশি ভয় পেতো।মুখের উপর উচিত জবাব দেওয়া নীরার অভ্যাস।সবার এত এত সাপোর্ট ভালোবাসায় আজ অভ্র চোখের মণি। আর সমাজের কাছে দ্বীপের পরিবার সরল সহজ নামে পরিচিত।
___
জুম্মার নামাজ পড়ে সবাই চলে এসেছে। পাঞ্জাবী পরেই নামাজ পড়তে বের হয়েছিলো সবাই।তাই তাদের আর সাজগোজ করা লাগেনি।ছেলেরা সবাই বরকে নিয়ে এসে দেখে মেইন গেটের সামনে ফিতা দেওয়া।সবাই বুঝে যায় এটা বরের জন্য করা।কেয়াকে এখনও সাজানো হচ্ছে।কেয়ার পাশে দীপান্বিতা বসে সাজ দেখছে।নীরা ও কিছু প্রতিবেশী মেয়ে মিলে গেছে বরকে ওয়েলকাম করতে।
হাতে মিষ্টি ও শরবতের ট্রে নিয়ে নীরা বলে,”জামাইবাবু আগে আপনাকে ফিতা কাটতে হবে।”
রিকের বাবা বলেন,”তোমাদের কোনো ডিমান্ড নেই?”
“ওটা এখন না আংকেল।সময় হোক উশুল করবো।”
সবাই হেসে দেয়।রিক ফিতা কেটে দেয়।তারপর নীরা শরবতের গ্লাস নিয়ে রিকের সামনে ধরে।রিক শরবতে চুমুক দিতে যাবে তার আগে দ্বীপ গ্লাস কেরে নিয়ে রিকের সামনে ধরে।নীরা চোখ ছোট ছোট করে মনে মনে বলে,”জেলাস,ক্যাডার সাহেব।”
রিক দ্বীপের হাতেই গ্লাসে চুমুক দেয়।মিস্টার রবিন বলেন,”মেয়ে আমার সেরা জামাই পেয়েছে।কি সুন্দর করে গ্লাস নিয়ে বুঝিয়ে দিলো।”
মিস্টার সমুদ্র বলেন,”আপনি তো ট্রেইলার দেখেছেন আর আমি দেখি ফুল মুভি।”
সবাই অট্টহাসিতে মেতে ওঠে।নীরা দ্বীপের দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচি দিয়ে পাশে থাকা মেয়েকে বলে,”জামাইবাবুকে মিষ্টি খাইয়ে দে।আমার উনি আবার জেলাস আছেন।বলা তো যায় না মিষ্টি খাওয়াতে গেলে আবার কোনো এক জায়গা থেকে পোড়া গন্ধ ভেসে আসে।”
বলেই মিষ্টির প্লেট দিয়ে দেয় পাশে থাকা মেয়েটির হাতে। রিককে মিষ্টি খাওয়ানোর পর ছেলেরা মিলে রিককে উচু করে নিয়ে যায় বরের আসনে।বাকিরা হাত তালি দিতে থাকে।নীরা চলে আসে কেয়ার কাছে।কেয়ার সাজানো কমপ্লিট।এখন শুধু গহনাগুলো পরিয়ে দেওয়া বাকি।একে একে সবাই মিলে কেয়ার গহনা দ্রুত পরিয়ে দেয়।সবার খুদা লেগেছে।বিয়ে পড়ানো হয়ে গেলেই খাওয়া দাওয়ার পালা।কাজী এসেছেন বিয়ে পড়াতে সাথে একজন রেজিষ্টার।বিয়ে পড়ানো সম্পূর্ণ হলো।বর বউ দুজন দুই রুমে বসেই একে অপরকে কবুল বলে গ্রহণ করে নিলো।বড়রা সবাই খেতে বসেছে।নীরা দীপান্বিতা ও বাকি মেয়েরা বড় রক থালা নিয়ে এসেছে রিকের কাছে।রিকের পাশে বর সেজে বসে আছে ছোট অভ্র বাবু।দীপান্বিতাকে দেখে অভ্র হাত উচু করে বলে,”আম্মু আমি এখানে।”
দীপান্বিতা মিষ্টি হাসি দেয় অভ্রকে দেখে।নীরা বলে,”হ্যাঁ হ্যাঁ আমাদের ছোট বর বাবুকে তো আমরা দেখেছি।”
নীরব তাকিয়ে আছে দীপান্বিতার দিকে। রানি গোলাপী ও সবুজের মিশ্রণে খুব সুন্দর শাড়ি পরেছে দীপান্বিতা।মাথায় গোলাপী হিজাব।মুখে কোনো প্রকার মেকআপ না দিয়ে শুধু একটু ক্রিম লাগানো আর চোখে চিকন কাজল ঠোঁটে গোলাপী লিপস্টিক।এই সাজেই দীপান্বিতার প্রতি নেশা ধরে গেছে নীরবের।নীরা নীরবের দিকে তাকিয়ে শব্দ করে,”উহু উহু।”
নীরব তাকায় বোনের দিকে।নীরা বলে,”বেটার লাক নেক্সট টাইম ভাই।আপাতত বরকে খাওয়াও সবাই মিলে।আফসোস কেয়ার বিয়েটা আমার আগে হতো।আমিও মজা করতে পারতাম।”
দ্বীপের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে।দ্বীপ বলে,”খুব শখ হয়েছে না!পরের বরকে খাইয়ে দেওয়ার?”
নীরা নাক মুখ উচু করে অভিনয় করে বলে,”কোথা থেকে জানি পোড়া পোড়া গন্ধ আসছে!”
অভ্র বলে,”কিছু পুড়েছে মামী?”
“হ্যাঁ বাবাই,তোমার মামুর মন।”
অভ্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দ্বীপকে দেখতে থাকে।কোথাও আগুন বা ধোয়া না দেখে বলে,”কোথায়?দেখতে পাচ্ছি না তো?”
“এটা দেখা যায় না বাবাই।আমি স্পেশাল মেজিক দিয়ে বুঝতেছি।”
সবাই আবার হেসে দেয়।অভ্র বেচারা হা করে তাকিয়ে আছে।তার মাথায় ঢুকছে না কোনো কিছুই।নীরব অভ্রর পাশে বসে বলে,”ওসব তোমাকে বুঝতে হবে না বাবাই।আসো আমরা একসাথে তোমার রিক আংকেলকে খাইয়ে দেই।”
“আচ্ছা।”
বলেই সবাই মিকে রিককে খাইয়ে দেয়।দ্বীপ নীরার হাত ধরে নিয়ে আসে এক কোনায়।নীরাকে দেওয়ালের সাথে আটকিয়ে বলে,”খুব শখ না বর বাদেঅন্য ছেলেকে খাইয়ে দেওয়ার?”
মিটমিট হেসে নীরা বলে,”হ্যাঁ,খুব শখ আমার।”
দ্বীপ নীরার হাত জোরে চেপে ধরে বলে,”নিজের বরকে তো খাইয়ে দেওয়ার ইচ্ছা জাগে না।”
“আউচ।লাগছে তো!”
“লিসেন দুষ্টুমি করো কিন্তু ওভার হলে…”
“কি?ওভার হলে কি করবেন?”
“এক সাথে যমজ না একসাথে এক ডজন বাবু এনে দিবো তোমার এই ছোট পেটে।”
নীরা যেনো এবার ভ্রমে চলে গেলো।কল্পনা করছে তার পেট ফুলে উঠেছে বারোটা বাবু তার এই পেটে।ডেলিভারির সময় যখন নার্স আসবে তার পেট কাটতে তখন ঘন্টাখানিক ধরে খালি বাবু বেড় হতেই থাকবে আর নীরা বেচারি বাবু গুলোকে বেড় হতে দেখবে।একসাথে বারোটা বাবু পুষবে কিভাবে?তাড়াতাড়ি নীরা কল্পনা থেকে বেড়িয়ে বলে,”বলছি কি একসাথে এতগুলো না দিয়ে বরং আস্তে আস্তে দুই একটা করে বাবু দিলে হয়না?”
দ্বীপ ঠোঁট কামড়ে হেসে দেয়।বউ তো না যেন কুবুদ্ধির ড্রাম।নীরার নাকের সাথে নিজের নাকের ঘষা দিয়ে বলে,”দুষ্টু চন্দ্রপাখি আমার।”
_____
রিকের খাওয়া দাওয়া শেষ।অন্যদিকে কেয়াকে ওর মা খাইয়ে দিয়েছে।এখন রিকের হাত ধোয়ানো হয়েছে। নীরব দ্বীপ ও বাকি ছেলেরা মিলে রিকের হাত ধুয়ে দিচ্ছে।তারপর রিক ও কেয়াকে একসাথে করে বড় স্টেজে বসিয়ে দেওয়া হলো।কেয়া মুখের উপর পাতলা ঘোমটা দেওয়া।নীরা একটি আয়না এনে কেয়া ও রিক বরাবর ধরে।তারপর বলে,”আয়নায় কি দেখছেন জামাইবাবু?”
রিক কেয়ার প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমার কিউট গুলুমুলু চশমিশ।”
“আরে বাহ।”
সবাই হেসে দেয়।নীরা বলে,”নেন আপনার চশমিশ বউয়ের ঘোমটা আপনি নিজেই সরিয়ে মুখোদর্ষণ করেন।”
রিক কেয়ার মুখ থেকে ঘোমটা সরায়।সাথে সাথে নীরব দীপান্বিতা অভ্র ও আরো ছেলে মেয়েরা মিলে লাল গোলাপের পাপড়ি ছিটাতে থাকে।রিক ও কেয়া দুজন দুজনকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে থাকে।নীরা দ্বীপ ও বড়রা মিলে হাত তালি দেয়।মিসেস শিউলি এসে মজা করে বলেন,”হুনো নাতিন,বউয়ের দিকে সারাজীবন চাইয়া থাইকো।এখন একটু আমাগো দেখতে দেও। আর আজ রাইতে তো বউ তোমার হইয়াই যাইবো।আমার নাতিনের মতো আবার দেরি করে বউরে ভালোবাইসো না।”
দ্বীপ ও নীরা লজ্জায় এদিক ওদিক করে।মিস্টার সমুদ্র বলেন,”আহ মা সবাই আছে তো।”
রিকের বাবা বলেন,”নানী দাদিদের কাজই তো এমন মজা করা।”
সবাই মিলে এখন নাচ গান শুরু করবে।সন্ধার দিকে বিদায় ব্যাবস্থা হবে।দীপান্বিতা ও অভ্র মিলে পাশাপাশি দাড়িয়ে আনন্দ করছে।অভ্রর শরবত খেতে ইচ্ছা করে।দীপান্বিতা অভ্রকে শরবত খাইয়ে দেয়।শরবতের গ্লাস অভ্রর হাত থেকে পড়ে দীপান্বিতার শাড়ির কিছু অংশ ভিজে যায়।দীপান্বিতা অভ্রকে দ্বীপের কাছে দিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যায়।শাড়ি ওয়াশ করার সময় দীপান্বিতা পাশে তাকিয়ে ভয় পেয়ে জোরে এক চিৎকার দেয়….
চলবে…?