#তোমার_খোঁজে_এই_শহরে
#পর্বঃ১৮
#নবনী_নীলা
” বলেছিলাম না এরপর থেকে আমি তোমাকে শাড়ি পরিয়ে দিবো। দেখি এদিকে এসো।” বলেই হাসলো ইয়াদ।
টয়া শাড়ি হাতে মূর্তির মতন দাড়িয়ে আছে। বৃষ্টিতে ভেজা তার একদম উচিৎ হয় নি। এ আবার কোন বিপদে পড়লো সে। ড্রাইভার অনেক খুজে তারপর রাত কাটানোর জন্য এই বাড়ির মালিককে পেয়েছে। আজ রাত তাদের এই ঘরেই কাটাতে হবে। ভরে তারা রওনা দিবে ঢাকার উদ্দেশ্যে। বাড়িটা একজন বয়স্ক মহিলার।জামা কাপড় ভিজে যাওয়ায় টয়াকে তিনি একটা সিল্কের শাড়ি পরতে দিয়েছেন। শাড়ি হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকে ইয়াদকে বের হয়ে যেতে বলবে এই সময়ে পড়েছে আরেক বিপদে। হাতে শাড়ি দেখেই ইয়াদ বললো সে শাড়ি পরিয়ে দিবে। শুনেই যেনো টয়ার পিলে চমকে উঠে।
ইয়াদ পকেটে হাত ভরে টয়ার দিকে এগিয়ে আসছে। টয়া পিছিয়ে যেতে চাইলো কিন্তু ইয়াদ টয়ার কোমড় জড়িয়ে কাছে নিয়ে আসলো। টয়ার ভিতরে ধুক পুক শুরু হয়ে গেছে। শরীরটা যেনো বরফ হয়ে আছে।
ইয়াদ টয়ার গালের পাশের চুল গুলো সরিয়ে বললো,” অনেক জ্বালিয়েছো আমায় এবার তো তোমায় ভুগতে হবে। ইয়াদ আরফিন তো এতো সহজে তোমায় ছাড়বে না।”
ইয়াদের কথায় টয়ার গলা শুকিয়ে এলো। সত্যিই কি এমন কিছু করবে ইয়াদ ভাবতেই লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করছে তার।
টয়া কাপা কাপা গলায় বলল,” আমি জামা চেঞ্জ করবো না। দরকার নেই আমার শাড়ির। এভাবেই থাকবো”
ইয়াদ টয়ার দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে বললো,” তোমার দরকার নেই কিন্তু আমার তো আছে।”
টয়া চোখ বন্ধ করে চেঁচিয়ে বললো,” বললাম তো দরকার নেই।” ইয়াদ টয়ার মুখের আঙ্গুল সামনে ধরে বললো,” আস্তে!”
ইয়াদ কাছে আসতেই টয়া চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে ফেললো। এইভাবে টয়াকে নাস্তানাবুদ করতে ইয়াদের বেশ ভালো লাগছে। সে টয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,” পাঁচ মিনিট দিলাম শাড়িটা পরে ফেলো। ঠিক পাঁচ মিনিট পর আমি এই রূমে আসবো ততক্ষনে পড়তে না পারলে, আমি তো আছি।”বলেই ইয়াদ রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
টয়া যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। যেভাবে এগিয়ে এসেছিলো টয়ার তো মনে হয়েছিলো সত্যি সত্যি বুঝি এমন কিছু করবে সে। টয়া হাপাতে লাগলো। অসহ্য লাগছে এই ঘরে আবার ছিটকিনিটা এতো উপরে যে টয়ার নাগালের বাইরে। টয়া দরজার সামনে আপাদত একটা চেয়ার রেখে বন্ধ করে রাখলো। জলদি এই শাড়ি পড়ে বের হতে হবে কখন আবার হুট করে চলে আসবে কে জানে? লজ্জা তো একেবারেই নেই ছেলেটার।
টয়া ঘরের এক চিপায় গিয়ে জামা বদলে শাড়িটা কোনোভাবে পেঁচিয়ে পড়ে নিলো। সিল্কের শাড়ি পড়া আরেক জ্বালা খালি মনে হয় খুলে যাবে। বুড়িটা নিজের ব্লাউজও দিয়েছে সেটা এতো ঢিলে আর ব্লাউজের গলা তো মাশাল্লাহ। এতো বড় আর পিঠের দিকটা অনেকখানি খোলা তার উপর পিঠের উপরে একটা ফিতে।
সব ঠিক করে নিয়েছে মোটামুটি কিন্তু এই ফিতা কীভাবে লাগাবে সে। ফিতা না লাগলে কখন আবার কাধ থেকে পরে যায়। অসহ্য সব অসহ্য। কোন দুঃখে যে বৃষ্টিতে ভিজতে গিয়েছিল কে জানে। শয়তানে কামড়ে ছিলো আমাকে। বির বির করলো টয়া।
টয়া ফিতাটা লাগানোর চেষ্টা করছে এমন সময় ইয়াদ দরজা খুলতেই ধপাস করে চেয়ার পরে যাওয়ার আওয়াজে ভয় পেয়ে টয়া লাফিয়ে উঠলো। ইয়াদ ভ্রু কুচকে চেয়ারের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,” তোমার কি উল্টা পাল্টা কাজ না করলে ভাল্লাগে না?”
ইয়াদকে দেখে টয়া চটজলদি শাড়ির আঁচলটা গায়ে জড়িয়ে নিলো। ইয়াদকে দেখেই আবার ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেছে।
ইয়াদ টয়ার দিকে তাকিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বললো,” বলেছিলাম আমি পরিয়ে দেই শুনলে না তো। এইটা কীভাবে শাড়ি পড়েছ হাটতে গেলেই উষ্ঠা খেয়ে পরে হাত পা ভাঙবে।” বলে কাছে আসতেই টয়া শাসিয়ে বললো,” থামুন, একদম এদিকে আসবেন না। আমি কিন্তু চিৎকার করবো।”
” চিৎকার চেঁচামেচি করা তো তোমার একটা প্রতিভা। সে আমি কাছে আসলেও চেঁচামেচি করবে না আসলেও করবে।”, বলতে বলতে এগিয়ে এলো।
টয়া পিছাতে লাগলো পিছাতে পিছাতে একসময়ে আয়নার সামনে এসে দাড়িয়ে পড়লো। টয়ার পিছে টিনের সাথে ঝোলানো একটা মাঝারি সাইজের আয়না। আয়নার সাথে ধাক্কা লাগতেই ইয়াদ টয়ার হাত ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসলো এমন সময় টয়ার পিঠের উপর থেকে শাড়ির আঁচলটা সরে যায়। টয়া সেটা বুঝতে পেরে ইয়াদকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে পিছনে আটিসাটি মেরে দাড়িয়ে রইলো।
ইয়াদের চোখ পিছনের আয়নার দিকে যেতেই ইয়াদ ঘটনাটা বুঝতে পারলো। টয়া ভয়ার্ত গলায় বললো,” আপনি এই রুম থেকে যান। প্লীজ”
ইয়াদ টয়ার কাছে গিয়ে ওর হাতটা ধরে আয়নার কাছ থেকে সরিয়ে আনতেই টয়া হকচকিয়ে গেল তারপর নিচু স্বরে বললো,” আপনি প্লিজ যান।”
ইয়াদ টয়ার পিঠের দিকে হাত বাড়াতেই টয়া ইয়াদের হাত ধরে মাথা নিচু করে রাখে। লজ্জায় লাল হয়ে গেছে সে। টয়া কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছেনা। ইয়াদ চোখ বন্ধ করে বললো,” আচ্ছা চোখ বন্ধ করে রাখলাম এবার হেল্প করি?”
টয়া ঠোঁট কামড়ে ইয়াদের দিকে তাকালো সত্যি সত্যি লোকটা চোখ বন্ধ করে আছে। টয়া কি করবে বুঝতে পারছে না। ফিতা না লাগাতে পারলে অসস্তিতে থাকতে হবে। উপায় না পেয়ে টয়া ইয়াদকে বিশ্বাস করলো।
ইয়াদ বন্ধ রেখে বলল,” কি হলো হেল্প লাগবে না?”
” দেখুন আপনি একদম চোখ খুলবেন না।”, শাসিয়ে বললো টয়া।
” তোমার হেল্প লাগবে কি লাগবে না সেটা বলো?”, ইয়াদ তাড়া দিয়ে বললো।
“আচ্ছা দাড়ান”,বলে টয়া ইয়াদের হাতে ফিতা দুটো দিলো।
ইয়াদ চোখ বন্ধ করে ফিতা বাধার সময় টয়ার পিঠে একটু হাতের ছোঁয়া লাগতেই টয়া কেপে উঠলো। সেটা বুঝতে পেরে ইয়াদের ঠোঁটের কোণে হাসি নিলো বললো,” কী হলো কাপাকাপি করছো কেনো?”
টয়ার ইয়াদের হাসি দেখে মনে মনে বললো আবার হাসছে। ইচ্ছে করে এসব করছে আমি বুঝিনা ভেবেছে। ইয়াদ ফিতা বেধে দিতেই টয়া ইয়াদ থেকে দশ হাত দূরে সরে গেল। ইয়াদ কিছু বলার আগেই টয়া রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিবে বুড়ি মহিলাটা ঘরে ঢুকে পড়লো। টয়া আর রুম থেকে বেরিয়ে আসতে পারলো না। মহিলাটা টয়াকে দেখে বললো,” আয় হায় কইরচ্ছে কি মাইয়াডায়। আরে মাইয়্যা শাড়ি কি এমনে ফিন্দ্দে?”
ইয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো,” বাবাজি তুমি আখণ রুম থেইকা যাও তোমার বউরে শাড়িখান ফিন্দাই দি।”ইয়াদ হা সূচক মাথা নেড়ে অপ্রস্তুত হয়ে চলে গেলো।
বুড়িকে দেখে টয়ার এবার মনে হচ্ছে ফিতা চাইলে এনার কাছে গিয়ে বেধে নেওয়া যেতো। কি যে বোকামি করে বসলো সে। মাঝখান দিয়ে লোকটার সুবিধা হয়ে গেছে।
বুড়ি টয়ার হাত ধরে ঘরের মাঝে এনে দার করিয়ে টয়ার শাড়ির কুচি করতে করতে বললেন,” এইডা তোমার দাদার আমারে দেওইন্না প্রথম শাড়ি, শাড়িখানা আইন্না আমারে নিজের হাতে ফিন্দ্দাইয়া দিসিলো। বড়ো রসিক আসিল সে।”
বুড়ির কথা শুনে টয়ার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। বুড়ি কুচি করা শেষে সেগুলো টয়ার হাতে ধরে রাখতে দিয়ে আঁচলের মাপ নিয়ে বললো,” এমনে শাড়ি ফিন্দবা কোমড়ের দিক খোলা রাইখ্যা। তারপর দেখব বেডা মানুষ কেমনে লাড্ডু হয়।”, বুড়ির কথা কানে যাওয়ার সাথে সাথে টয়ার গলা শুকিয়ে গেলো।
এই রকম ভয়ানক কথা তাকে এ জীবনে শুনতে হবে সে কল্পনাও করে নি। বুড়ি যেতে যেতে বলল,” কিছু লাগলে আমারে কইবা কেমন ?” টয়া হা সূচক মাথা নাড়ল।
বুড়ি চলে যাবার কিছুক্ষন পরই ঘরে ইয়াদ ঢুকলো। ইয়াদকে দেখে টয়া অবাক হয়ে বললো “আপনি আবার এ ঘরে এসেছেন কেন?” টয়ার প্রশ্নের জবাব দিতে যাবে এমন সময় ইয়াদের চোখ টয়ার দিকে পড়লো। ইয়াদ টয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অসম্ভব সুন্দর লাগছে তাকে। টয়া একটু ঘাবড়ে গিয়ে নিজের কোমরের কাপড়টা ঠিক আছে কিনা দেখে নিলো। না ঠিক আছে বুড়ি চলে যাবার সাথে সাথে সে ঠিক করে ফেলেছিলো।
টয়া চেঁচিয়ে বলল,” কি বললাম শুনতে পান নি? এ ঘরে এসেছে কেনো আমি এখন ঘুমাবো।”খাওয়া দাওয়া আগেই সেরে নিয়েছিলো তারা বৃষ্টির টিপ টিপ ফোঁটা টিনের চাল বেয়ে পড়ছে সব মিলিয়ে অনেক সুন্দর একটা পরিবেশ। টয়ার ঘুমে চোখ জরিয়ে এসেছে।
এখন আবার ইয়াদ কেনো তাকে জ্বালাতে চলে এলো।
ইয়াদ খাটে বসে বললো,” ঘুম তো আমারও পেয়েছে।”
” তো গিয়ে ঘুমান এখানে এসেছেন কেনো?”, রাগে কটমট করে বললো টয়া।
” তোমার মনে হচ্ছে না যে তুমি কিছু একটা কথা ভুলে যাচ্ছ। আমি তোমার হাজব্যান্ড তাই আমিও আজ এখানেই ঘুমাবো।” বলে বিছানার মাঝে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল।
” এখানে ঘুমাবেন মানে!!!!! উঠুন এক্ষুনি, অসম্ভব আমি আপনার সাথে এক ঘরে থাকবো না।” বলে ইয়াদের পাশে এসে হাত ধরে টেনে তাকে উঠানোর চেষ্টা করছে।
” আমি বিয়ের আগে শর্ত দিয়েছিলাম যে আমি আপনার সাথে থাকবো না আর এক ঘরে থাকা তো অসম্ভব ব্যাপার।”, ইয়াদ টয়ার কোনো কথায় কান না দিয়ে শুয়ে আছে। টয়া তাকে টেনেও তুলতে পারছেনা।
টয়া হাল ছেড়ে দিয়ে বললো,” ঠিক আছে আপনি উঠবেন না তাই তো। তাহলে ঘুমান এ রুমে আমি গিয়ে দাদীর কাছে ঘুমাচ্ছি।”
টয়া চলে যেতে পা বাড়াবে এমন সময়ে ইয়াদ টয়ার হাত ধরে টেনে ওকে বিছানায় নিজের পাশে শুইয়ে দিতেই টয়া ব্যালেন্স হারিয়ে ইয়াদের উপর পরে যায়।
টয়া রাগে ফেটে যাচ্ছে। সে রেগে বলল,” আপনার সমস্যা কি? আমি আপনার সাথে থাকবো না বলেছি না।”
ইয়াদ টয়ার হাত বিছানার সাথে শক্ত করে ধরে বললো,” তুমি থাকবেনা তোমার ঘাড় ও থাকবে। অনেক জ্বালিয়েছি আজ আমায়। এতো সহজে তোমায় ছেড়ে দিবো ভেবেছো? চুপ চাপ আমার পাশে শুয়ে থাকো নইলে ।” ইয়াদ কথা শেষ করবে তার আগেই টয়া চেঁচিয়ে বলল,” নইলে কি করবেন? আপনি….. আপনি আমাকে মারবেন? আপনি এটা করতে পারবেন? এই ছিলো আপনার মনে।”
টয়ার বক বক শুনে ইয়াদের মেজাজ বিগড়ে গেলো ইয়াদ টয়ার ঘাড়ে হাত ডুবিয়ে দিলো তারপর বললো,” আমার মনে কি আছে দেখতে চাও?” ইয়াদের স্পর্শে টয়ার শরীরে শীতল শিহরন বয়ে গেল। টয়া হা করে ইয়াদের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইয়াদ টয়ার দিকে এগিয়ে আসতেই টয়া চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে ফেললো। আত্মাটা মনে হচ্ছে বেরিয়ে আসবে তার। টয়া চোখ মুখ বন্ধ করে আছে অনেক্ষন হলো কিন্তু কিছু হলো না। টয়া আস্তে করে চোখ খুলে দেখলো ইয়াদ ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। টয়া পিট পিট করে কয়েকবার তাকালো।
ইয়াদ মুখের হাসি বজায় রেখে বলল,” কিছু হয়নি? তাই না। এইটা তো শুধূ ট্রেইলার ছিলো যদি পুরো মুভিটা দেখতে না চাও চুপচাপ আমার পাশে শুয়ে থাকো।”
ইয়াদের কাজে টয়া প্রচুর ঘাবড়ে গেছে। বুকের ভিতরটা কেমন যে করছে তা বলে বোঝানো যাবে না। ইয়াদ টয়ার উপর থেকে সরে মাথার নীচে হাত রেখে টয়ার কাছাকাছি শুয়ে রইলো। টয়া কয়েকবার ঘন ঘন শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে গুটিসুটি মেরে শুয়ে রইলো। কিন্তু ইয়াদ ঠিক কাত হয়ে শুয়ে টয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।
[ চলবে ]