_ল্যাম্পপোস্টের_ঘোলাটে_বাতি । #_পর্ব = ১৪

0
287

#_ল্যাম্পপোস্টের_ঘোলাটে_বাতি ।
#_পর্ব = ১৪

— হ্যাঁ সজীব , বিষয় টা নিয়ে খুব টেনশনে থাকি বৃষ্টি অবশ্য এসব নাকি ভয় করে না । কিন্তু অবুঝ মেয়ে তো জানেনা যে হঠাৎ করে যদি তোমার সেই কেসের মতো কোন অঘটন ঘটে তাহলে কি যে হবে ?

— সজীব বললাে , স্যার এসব অলক্ষুণে কথা বলবেন না কখনো বৃষ্টির কিছু হবে না । আপনারা আপাতত কোন ঝামেলা করবেন না তার সাথে , আমি আজ বিকেলে গ্রামের বাড়িতে চলে যাবো তারপর এসে এসব বিষয় কথা হবে ।

— তোমার মামলার কি হলো ?

— এখনো কিছু হয়নি , এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে জামিনে বের হইছি । মামলার শুনানি যতদিন চলবে ততদিন কোর্টে হাজির হতে হবে ।

– এই জামিনটা যদি আরো আগে করা যেত তাহলে তোমার পড়াশোনা সমস্যা হতো না মনে হয় ।

– ভাগ্যে লেখা ছিল স্যার তাই ঘটে গেছে এ নিয়ে তো আফসোস করে লাভ হবে না ।

— হুম সবই ভাগ্য সজীব , নাহলে আজকে আমার স্ত্রী কন্যা গার্মেন্টসে চাকরি করে আর আমি অচল হয়ে বিছানায় পরে আছি । এতসব যদি কপালে না থাকে তাহলে কখনো ঘটে না তাই বাস্তবতা মেনে নিয়ে কল্পনার জগতে সুখ খুঁজে পাই ।

— সবকিছু আল্লাহর হাতে স্যার , তিনি মাঝে মাঝে আমাদের পরীক্ষা করেন ৷ পৃথিবীতে অনেক কিছু করার ক্ষমতা তিনি দিয়েছেন আবার অনেক কিছু নিজের কাছে রেখেছেন । কারণ বান্দা যখন তাকে ভুলে গিয়ে পৃথিবীর মায়ায় জড়িয়ে যাবে তখন তিনি তার ক্ষমতার অস্তিত্ব বোঝানোর জন্য আমাদের পরীক্ষা নেয়।

— বাড়ি থেকে কবে ফিরবে সজীব ?

— ৮/১০ দিনের মধ্যে ফেরার ইচ্ছে আছে কিন্তু বাকি কাজের উপর নির্ভর করবে স্যার ।

— কি কাজ ?

— বাবা যখন খুলনা গেছিলো তখন কে যেন বাবা কে ভয় দেখাচ্ছে । এখনো মাঝে মাঝে কল করে ভয় দেখায় তাই আমি নিশ্চিত এটা খুনিদের কাজ । তাই বাড়িতে গিয়ে ওই নাম্বারে কথা বলে তাকে ইঁদুরের গর্ত থেকে বের করতে হবে ।

— বাহহ অবশেষে একটা রাস্তা পাওয়া গেছে তাহলে ?

— জ্বী স্যার সেরকমই ।

— খুব ভালো করে অনুসন্ধান করতে হবে ।

— দোয়া করবেন স্যার ।

— তাতো অবশ্যই করবো ।

— আমি তাহলে আসি স্যার ? এখান থেকে সরাসরি কাউন্টারে গিয়ে বাগেরহাটের বাসের টিকিট সংগ্রহ করবো । তারপর বাসায় গিয়ে টুকটাক কিছু কাপড় নিয়ে রওনা দেবো আমি ।

— আচ্ছা ঠিক আছে সাবধানে যেও আর বৃষ্টির কথা টা মাথায় রেখো । আমাদের এই পৃথিবীতে আত্মীয় স্বজনরা কেউ বিপদের সময় পাশে থাকে না তাই বিপদ এলো সবাই কে চেনা যায় ।

— জ্বি স্যার জানি আমি ।

— আচ্ছা ঠিক আছে ভালো থেকো সবসময় ।

— আপনিও নিজের খেয়াল রাখবেন ।

— আল্লাহ হাফেজ ।

★★
★★

দুই নং মাইলের মাথা স্থান থেকে “দিদার পরিবহন” এর টিকিট সংগ্রহ করল সজীব । এখান থেকে বাস ছেড়ে যাবে বিকাল তিনটা বাজে , তাই তাকে পনের মিনিট আগে মানে ২ঃ৪৫ মিনিটে থাকতে হবে । কাউন্টারের লোকটা তার পরিচিত তার বাড়ি পিরোজপুরের জিয়ানগর উপজেলার বালিপাড়া বাজারের পাশে । সজীব এর সাথে তার মোটামুটি ভালো সম্পর্ক ছিল আগে তবে এখনো আছে ।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সাড়ে দশটার কাছাকাছি বেজে গেছে । রাস্তার বাম দিকের ফুটপাত দিয়ে হাঁটা শুরু করলো , শরৎকালের কাশফুল দোলা মিষ্টি রোদ আর দক্ষিণা মৃদু বাতাসে উদাস করা মন বাড়িতে যাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে গেছে ।

হঠাৎ করে রকি ফোন দিল ! রিসিভ করে সজীব এর বাড়ি যাবার খবরটা দিল তাকে ।

— রকি বললো , সমস্যা নেই তাহলে চলে যা বেতন দেবার আগেই আসতে হবে কিন্তু ।

— সজীব বললো , আচ্ছা ঠিক আছে তাই হবে ।

— তাহলে রুমের চাবি ওটা তোর সাথে নিয়ে যা , আমার কাছে একটা আছে সেটা আমার কাছে থাকুক ।

— সজীব বললো , ঠিক আছে বন্ধু বাড়ি থেকে ফিরলে কথা হবে ।

হাঁটতে হাঁটতে ফ্রি পোর্ট মোড়ে এসে ফুট ওভার ব্রিজের নিচে দাঁড়াল সজীব । ব্রীজের নিচে সামান্য ফাঁকা যায়গা আর যায়গা জুড়ে একটা লোক বিভিন্ন প্রকারের বই বিক্রি করে । সজীব বিগত ৫/৬ বছর ধরে এই দোকনটা দেখছে , এখান থেকে সজীব একটা উপন্যাস কিনেছিল তার নাম শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর “দেনাপাওনা” । সেই উপন্যাসের নায়ক জমিদার জীবনানন্দ চৌধুরী আর নায়িকা ঠাকুরের পুজো করা ষোড়শী ।

★★
★★

এদিকে সকাল থেকে বৃষ্টি মন খারাপ করে বসে বসে কাজ করছে । আশেপাশের সবাই খেয়াল করেছে কিনা জানিনা তবে মরিয়ম বিষয়টা বুঝতে পেরেছে । তাই মরিয়ম বেলা দশটার দিকে ওয়াশরুম থেকে ফেরার পথে বৃষ্টির মেশিনের সামনে দাঁড়াল ।

— তাকে জিজ্ঞেস করলো , কিরে বৃষ্টি ? সকাল থেকে দেখি তোর মন খারাপ ঘটনা কি ?

— বৃষ্টি বললো , তেমন কিছু না ।

— সজীব ভাই কত তলায় ডিউটি করে ?

— সে অফিসে আসে নাই ।

— কেন কেন কেন ?

— আমি তার ভালবাসা গ্রহণ করিনি তাই সে নাকি চাকরি করবে না ।

— বুঝতে পারছি সেই জন্য মন খারাপ তাই না ?

— ২৫% ।

— বাকি ৭৫% কিসের জন্য খারাপ জানতে পারি ?

— ২৫% হচ্ছে , সজীব আজকে বিকেলে বাড়িতে চলে যাবে । ২৫% হচ্ছে বাসার পাশের মামুন নামের ছেলেটা দিন দিন বেড়ে গেছে । আর বাকি ২৫% হচ্ছে এ মাসে আরো ৫০০ টাকা ধার করতে হবে । এখন সবকিছু মিলিয়ে শুধু মাথা ভর্তি টেনশনে আমার চোখ ব্যথা করে ।

— সজীব ভাইয়ের বিষয় ৫০% তুই নিজেই সমাধান করতে পারবি সমস্যা নেই । মামুনের বিষয়টা সজীব কে বললে মিটমাট হয়ে যাবে কারণ সে যেন বুঝতে পারে যে তুই একজনকে ভালবেসে ফেলেছিস । আর টাকার বিষয়টা নাহয় আমি দিলাম আরো ৫০০ টাকা তাহলে তো সবকিছু ক্লিয়ার ?

— তবুও চিন্তা কেমন করে যায় ? সজীবকে চাইলেই আমি কাছে টেনে নিতে পারছি না মরিয়ম ।

— চাইলেই পারবি সমস্যা হবে না আশা করি ।

— নারেহহ হবে না ।

— আচ্ছা তুই কাজ কর আমরা দুপুরে লান্স টাইমে এ বিষয় আলোচনা করবো ।

— আচ্ছা ঠিক আছে ।

** কিন্তু লান্সের সময় এ বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে কোন আলোচনা হলো না । বৃষ্টি খাওয়া দাওয়া শেষ করে নিজের মেশিনের উপর এসে বসে বসে কতক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইল । মরিয়ম কার সাথে যেন তৃতীয় তলায় গেছে তাই সে এখন ফ্লোরে নেই । ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে সজীব কে কল দিল বৃষ্টি , সজীব কল কেটে কলব্যাক করলো । বৃষ্টি অবশ্য ভালোই হয়েছে কারণ তার মোবাইলে টাকাও প্রায় শেষ তাই যেখানে বাজার করতে কষ্ট হচ্ছে সেখানে ফ্লেক্সিলড করবে কিভাবে ?

— হ্যালো বৃষ্টি ? (সজীব)

— কোই তুমি ? (বৃষ্টি)

— বাসায় গোসল করে তোয়ালে পরিহিত অবস্থায় বসে আছি । তুমি কি করো ?

— লান্স করে বসে আছি , সকাল থেকে এ পর্যন্ত কি কি করলে জানতে পারি ?

— তোমার সাথে কথা বলে ফ্রেশ হয়ে তোমাদের বাসায় গিয়ে স্যার এর সাথে দেখা করলাম । তারপর মাইলের মাথা গিয়ে বাগেরহাটের বাসের টিকিট সংগ্রহ করলাম । এরপর হাঁটতে হাঁটতে বাসায় চলে আসলাম আর মাত্র গোসল করে বের হলাম একটু পরে খাবার খেয়ে বের হবো ।

— কখন যাচ্ছো ?

— তিনটা বাজে গাড়ি ছাড়বে ।

— যদি জানতাম আজকেই আবার শহর ছেড়ে হারিয়ে যাবে তাহলে কাল রাতে অত তাড়াতাড়ি তোমাকে আসতে দিতাম না । আরো অনেকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখে দুচোখ ভরে দেখে রাখতাম ।

— কেন জানতে পারি আমি ?

— কোন কারণ নেই ।

— কারণ তো একটা নিশ্চয়ই আছে ।

— ধুর আবার কি ভাবছো ? আমি তোমার প্রেমের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছি সেটা ভাবছো ?

— না না তা কেন হবে ?

— সেটাই ভাবছো আমি জানি , আচ্ছা ঠিক আছে তুমি ভাবতে থাকো আমি রাখলাম ।

— শোনো বৃষ্টি ! টুট টুট টুট ।

কল কেটে দিয়ে বৃষ্টি কিছুক্ষণ রাগে জোরে জোরে নিশ্বাস ফুঁকে নিল তারপর বসা থেকে উঠে পানির বোতল নিয়ে খাবার পানি আনতে গেল । যাবার পথে পাশের লাইন থেকে দু একটা ছেলে তাকে দেখে শিষ দিচ্ছে । কেউ কেউ অস্ফুটে খারাপ কিছু শব্দ মনে হয় ব্যবহার করছে । বৃষ্টি এসব সহ্য করে নিয়েছে কারণ এটা গার্মেন্টস তাই এখানে প্রতিবাদ করে লাভ নেই । মনুষ্যত্ব যাদের মস্তিষ্কের মধ্যে আসবে না তারা বোঝালে সহজে বুঝতে পারবে না । পানি নিয়ে ফিরে এসে দেখে তার চেয়ারে সুপারভাইজার বসে আছে ।

— বৃষ্টি বললো , ভাইয়া উঠে ওই সামনের ফাঁকা চেয়ারে বসেন আমি এখন একটু কাজ করবো ।

— সুপারভাইজার বললো , তোমার সুন্দর শরীরের স্পর্শ তো কপালে নেই তাই তোমার স্পর্শ করা চেয়ারে বসে স্বাধ মিটাই ।

— আমি কিন্তু আগেও কতবার বলেছি যে এসব আমার একদম ভালো লাগে না । এ ধরনের কথা আমি খুবই অপছন্দ করি তাই দয়া এসব ভাষা আমার সাথে ব্যবহার করবেন না ।

— আচ্ছা সমস্যা কি বলো তো বৃষ্টি ? আমি তো তোমাকে পছন্দ করি তাই না ?

— ভাইয়া প্লিজ …!

— বৃষ্টি কিছু একটা বলার আগেই পিছন থেকে মরিয়ম এসে গেল । লাইনের সকল বাতি জ্বালিয়ে দেয়া হলো আর সবাই যার যার মেশিনে বসে কাজ শুরু করলো । আবারও অপেক্ষা করতে লাগলো সন্ধ্যা বেলা ছুটির অপেক্ষা ।

|
|

রকির বাসায় এসে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে বৃষ্টির সঙ্গে কথা শেষ করে সামান্য কিছু কাপড় গুছিয়ে নিল সজীব । ঘড়িতে এখনো দুটো বাজে নাই তাই কিছুটা সময় রুমের মধ্যে কাটিয়ে গেলে মনে হয় ভালো হতো । মোবাইল বের করে তার খালার কাছে ফোন দিয়ে বাড়িতে যাবার কথা জানালো । ছোট খালা তো শুনার সাথে সাথে আফসোস শুরু করলেন কারণ বাড়িতে পাঠানোর জন্য অনেক কিছু বাসায় আছে । কিন্তু এখন তো আর কিছু করা যাবে না তাই আফসোস করে লাভ নেই ।

দুইটো বেজে গেছে তাই মিনিট খানিক পরে সজীব রুমের দরজা তালা দিয়ে বেরিয়ে পরলো । রাস্তায় বেড়িয়ে গলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তায় আসলাে তারপর রাস্তা পার হয়ে সিটি করপোরেশন অফিসের সামনে এসে দাঁড়াল । রিক্সায় উঠবে নাকি বাসে উঠবে সেই সিদ্ধান্ত নেবার জন্য পাঁচ মিনিট ব্যয় করলো । ভাবনা চিন্তা করে রিক্সা করে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো কারণ , এখনো হাতে অনেক সময় আছে । আর দ্বিতীয়ত লোকাল বাস গুলো বড্ড পাঁজি , কারা এখান থেকে ফ্রি পোর্ট মোড় গিয়ে আধ ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে৷ আর লোকাল বাসে বসে ফাঁকা যায়গায় শুধু শুধু অপেক্ষা করতে খুব বিরক্ত লাগে ৷ মাঝে মাঝে অনেক লোক থাকে তবুও তারা দাঁড়িয়ে থাকে । আবার মাঝে মাঝে সিট ভর্তি হয়ে যায় তবুও লোক ডেকে ডেকে বলে সিট আছে । অবশ্য তার কথা সত্যি কারণ বাসের ভিতরে সিট ঠিকই আছে কিন্তু খালি নেই ।

রিক্সা নিয়ে যাবার সময় মাঝপথে রিক্সা দাঁড় করিয়ে সজীব রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে এক কাপ চা খেল । সে রিক্সাওয়ালাকে চা খেতে বলেছিল কিন্তু তিনি খাবে না কারণ ঢাকা শহরে এমন করে চায়ের সঙ্গে কিছু মিশিয়ে অজ্ঞান করে রিক্সা সিএনজি ছিনতাই করা হয়েছে । সজীব বুঝতে পারছে না যে তার চেহারা কি ছিনতাই করির মতো নাকি ?

নির্ধারিত সময়ের ১০ মিনিট আগে বাস চলে এসেছে তাই সজীব বাসের ভিতরে গিয়ে বসলো । তার সিট নাম্বার (D=4) জানালার পাশে, সজীব এটাই চেয়েছে কারণ রাতের বেলা জানালা দিয়ে বাহিরের গাড়ি চলা দেখতে খুব ভালো লাগে তার । যখন নিজেদের গাড়ি সামনের চলমান একটা গাড়িকে ওভারটেক করে এগিয়ে যায় তখন খুব মজা লাগে ।

গাড়ি স্টার্ট করেছে মনে হয় একটু পরেই গাড়ি ছেড়ে দেবে ঠিক তখনই একটা মেয়ে উঠলো গাড়ির মধ্যে ।
মেয়েটা দেখতে খুব সুন্দরী , সজীব বৃষ্টির পরে এই প্রথম আরেকটা মেয়ে দেখে অবাক হলো । কারণ বৃষ্টিকে দেখার পরে সে অনেক মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখেছে ঠিকই কিন্তু মনের মধ্যে নাড়া দিয়ে যায় নাই কখনো ।

— সজীব এর পাশে এসে জিজ্ঞেস করলাে , ভাই আপনি যে সিটে বসে আছেন সেটা কি D-4 ?

— সজীব বললো , জ্বি হ্যাঁ ।

— ওটা আমার সিট আপনি এদিকে আসুন আমি আমার সিটে বসবো ?

— মানে কি ? আপনাকে কে দিয়েছে সিট ?

— কে দিয়েছে মানে ? কাউন্টার থেকে টিকিট সংগ্রহ করে তারপর বাসে উঠেছি ৷

— তাহলে সেই কাউন্টারের লোককে নিয়ে আসুন আর বলবেন যে আমার কাছেও একই টিকিট বিক্রি করেছে কেন ?

— আশ্চর্য আমি কেন যাবো ? আপনার সমস্যা আপনি যাবেন ।

— আমার কোন সমস্যা নেই , আমি আমার সিটে বসে আছি ।

— কিন্তু ওটা আমার সিট ।

— সুপারভাইজারকে ডাক দেন তাহলে !

— তাই করবো ।

সুপারভাইজার এসে দেখে সত্যি সত্যি দুজনের কাছে একই টিকিট বিক্রি করা হয়েছে । তখন সে মেয়েটি কে বললো , ” মেডাম যেহেতু একই সিট দুজনের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে তাই যিনি আগে এসেছেন তিনি বসবেন । এখন আপনি D-3 তে বসুন ।

— মেয়েটি বললো , অসম্ভব তাহলে আমি যাবো না আপনাদের গাড়িতে ।

— দেখুন সেটা আপনার ইচ্ছে কিন্তু আমরা তাকে কিছু বলতে পারি না । কারণ তিনিও আপনার মতো টিকিট কেটে এসেছে তবে আপনি যদি উত্তেজিত না হয়ে তার কাছে অনুরোধ করে বসতে পারেন সেটা খুব ভালো হবে ।

— মেয়ে বললো , সে তো ট্রেনিং প্রাপ্ত উন্নত মানের ঘাড়ত্যাড়া দেখলো যে আমার মতো অসহায় একটা মেয়ে বসতে চাইছে । তবুও বলে কিনা কাউন্টারে গিয়ে যোগাযোগ করুন , তার কাছে অনুরোধ করবো আমি ?

— তাহলে চুপচাপ বসে পরুন , একথা বলেই সে চলে গেছে সামনের দিকে ।

মেয়েটি মনে মনে সজীবের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করতে করতে নিজের ব্যাগটা উপরে বাক্সে রেখে ধপ করে আমার পাশে বসে পরলো । সজীব জানালার সাদা গ্লাসের মধ্যে আবছা আবছা দেখতে পাচ্ছে যে সেই মেয়েটা সজীব এর দিকে তাকিয়ে আছে ।

— আর বিড়বিড় করে বলছে , ” মানবতা বলতে কিছু নেই , একটা সুন্দরী মেয়ে তার পাশে বসেছে একটু দেখাশোনা করবে তা না করে নিজেই ভালো সিট দখল করে বসে আছে । ”

— এবার সজীব মাথা ঘুড়িয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেখে রাগে গজগজ করতে করতে মেয়েটির নাক কপাল ঘেমে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমে আছে । সুন্দরী মেয়েদের চেহারার উপর ঘামের বিন্দু বিন্দু কনা দেখলে দয়া হবারই কথা । তাই বললো , ঠিক আছে আপনি জানালার পাশেই বসুন তবে শর্ত হচ্ছে সারা পথে কোন কথা বলতে পারবেন না ।

— মেয়েটা একটা বিশাল হাসি দিয়ে বললো , আচ্ছা ঠিক আছে কথা দিচ্ছি কোন কথা বলবো না ।

|
|

গাড়ি চলতে শুরু করলো , সল্টগোলা রেল ক্রসিং , কাস্টমস , নিমতলা বিশ্বরোড , তালতলা , ইস্ট কলোনি , পোর্ট কলোনি , বড়োপোল , এসি মসজিদ , নয়াবাজার বিশ্বরোড ও সাগরিকা মোড় পেরিয়ে গাড়ি অলংকার বাস স্টেশন এর অলংকার শপিং কমপ্লেক্স এর সামনে দাড়াল । সজীব চোখ বন্ধ করে বসে আছে , একবার মন চাচ্ছে ইয়ার ফোন লাগিয়ে গান শুনবে কিন্তু হাত বাড়িয়ে নিতে ইচ্ছে করছে না ।

— গাড়ি প্রায় মিনিট বিশেক সময় ধরে দাঁড়িয়ে আছে কারণ এটা লাস্ট স্টপেজ । এখান থেকে সবাই কে নিয়ে গাড়ি ছেড়ে দেবে আর কোথাও দাঁড়াবে না তাই দেরি হচ্ছে । সজীব এর পাশের সিটের মেয়েটা সজীব কে আস্তে করে ধাক্কা দিচ্ছে কিন্তু কিছু বলে না ।

— সজীব ঠিকই টের পাচ্ছে কিন্তু ইচ্ছে করে জবাব দিচ্ছে না ।

— মেয়ে টা আবারও ধাক্কা দিচ্ছে কিন্তু মুখ দিয়ে কিছু বলে না । এর পর শরীর থেকে হাত সরিয়ে আস্তে আস্তে বলছে , রাতে কি চুরি করেছে নাকি ? এখনই ঘুম পাচ্ছে ? পাশের সিটে একটা মেয়ে বসে আছে তার যে ওয়াশরুমের দরকার হতে পারে সেই জ্ঞানটুকুও নেই ।

— এবার সজীব চোখ মেলে জিজ্ঞেস করলাে , কি হইছে সমস্যা কি আপনার ? শর্ত ছিল কোন কথা হবে না মনে নেই ?

— আপনার সাথে তো কথা বলিনি , প্রথমে ধাক্কা দিলাম তারপর আবার ধাক্কা দিয়ে নিজে নিজে কথা বলছি । আপনার সাথে কে বললো ?

— ওয়াশরুমে যাবেন ?

— হ্যাঁ খুব চেপেছে ।

— বাসা থেকে পানি কম খেয়ে আসা উচিত ছিল কারণ মহিলা মানুষ যেখানে সেখানে চাপ কমাতে পারে না ।

— আমি পানি কম খেতে পারি না , ব্যাগের ভেতর দুই লিটার পানি নিয়ে এসেছি কারণ আমি প্রচুর পানি পান করি ।

— উদ্ধার করেছেন আমাকে , আচ্ছা শুনুন এখানে একটা পাবলিক টয়লেট আছে কিন্তু পরিবেশ ভালো না , চলবে ?

— দৌড়বে , আপনি তাড়াতাড়ি নিয়ে চলুন ।

— অসহ্য ।

— কি বললেন ?

— প্রশংসা করলাম ।

অলংকার শপিং কমপ্লেক্স এর পশ্চিম পাশে ঠিক বেজমেন্টে একটা রেস্টুরেন্ট আছে । সেই রেস্টুরেন্ট এর বিপরীত পাশে রাস্তার ওপারে পাবলিক টয়লেট আছে একটা বিভিন্ন যাত্রী ও ড্রাইভার সেটা ব্যবহার করে । মেয়েটাকে ভিতরে পাঠিয়ে সজীব রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে , কিছুক্ষণ পরে মেয়েটা আসলো । সজীব চৌরাস্তায় হতে সামনে তাকিয়ে নিজে নিজে একটা মুচকি হাসি দিল ।

— সজীব কে হাসতে দেখে মেয়েটা বললো , আপনি হাসছেন কেন ? আমার কোন কিছু দেখে ফেলেছেন নাকি ?

— সজীব বললো , লে হালুয়া আমি আপনার কি দেখবো আবার ?

— তাহলে হাসলেন কেন ?

— এমনি , তবে একটা লজ্জিত কারণ আছে ।

— মানে কি ?

— আসলে বছর তিনেক আগে একবার আমি এই সামনের রাস্তা দিয়ে পাহাড়তলী হয়ে দেওয়ানহাট গিয়ে বেড়িয়ে ছিলাম ।

— তাতে হাসির কি হইছে ?

— অনেক কিছু ।

— পাগল নাকি আপনি ?

— হ্যাঁ পাগল , দেখুন আপনার চাপ এসেছিল তাই নিয়ে এসেছি , এখন কাজ শেষ তাই বাসের ভিতরে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকুন ।

— ঠিক আছে ঠিক আছে যাচ্ছি ।

বাস ছাড়ার আগ পর্যন্ত সজীব অনেকক্ষণ বাহিরে দাঁড়িয়ে সারা বাংলাদেশের মানুষের ভিড় দেখল । চট্টগ্রামের অলংকার বাস স্টেশন এমন একটা স্থান যেখান থেকে ৬৪ জেলার সব যায়গার বাস আসে যায় । সজীব গাড়িতে উঠে বসলো , ঠিক পাঁচটা বাজে গাড়ি অলংকার থেকে বের হলো । আস্তে আস্তে সিটি গেট পার হয়ে বাসের গতি বেড়ে গেল আর জানালা দিয়ে প্রচুর বাতাস বইছে । সজীব চোখ বন্ধ করে সিটের সাথে মাথা এলিয়ে দিয়ে বসে আছে মনে হয় সুষুপ্ত ঘিরে আসছে ।

— বাস সীতাকুণ্ড পার হয়ে গেছে তখন পাশের সিটের মেয়েটা আবার সজীবকে ধাক্কা দিচ্ছে , সজীব চোখ বন্ধ করে বললো , কি হইছে ?

— মেয়েটা বললো , আমার একটা সমস্যা আছে ।

— এবার চোখ মেলে তাকিয়ে বললো , কি হইছে ? আবার চাপ এসেছে নাকি ?

— চাপ তো এসেছে ঠিকই কিন্তু যেহেতু যাবার স্থান নেই তাই বলবো না । কিন্তু সমস্যা টা অন্যকিছু ।

— কি সমস্যা ?

— আমি কথা না বলে থাকতে পারি না , যদি ঘুমাতে পারতাম তাহলে সমস্যা ছিল না । কিন্তু একটা ভয়ের জন্য ঘুমাতেও পারছি না , কি করবো বলেন তো ?

— কিসের ভয় ?

— এই যে আপনার মতো একটা যুবক আমার পাশে বসে আছে , আমি ঘুমালে আপনি যদি আমার শরীরে হাত দিয়ে কিছু করেন ?

— মানে কি ? আমারে দেখে কি সেরকম মনে হয় ?

— আজব তো , চ্যাতেন কেন হুম ? আপনি কি আমার বাবা , চাচা , মামা বা বড় ভাই নাকি ? বিশ্বাস করতে হবে ?

— তাহলে আমি পিছনে ছয় ছিট ফাঁকা আছে সেখানে গিয়ে বসি ?

— আমার খুব উপকার হতো তাহলে ?

— দুঃখিত আমি খুলনা শহরে হাজি মুহাম্মদ মুহসিন কলেজের পাশে চার বছর ছিলাম কিন্তু আমার মধ্যে তার মতো দানশীল কোন চরিত্র নেই । সুতরাং উপকার করতে পারছি না ।

— জানতাম তা করবেন না , আসলে পাশের সিটে মেয়ে বসেছে তো তাই মাঝে মাঝে ঘষা লাগাতে মন চায় তাই না ?

— আপনি চুপ করবেন ?

— আমার নামঃ- মোহতারিমাহ আক্তার মিতু ,
থানা নাজিরপুর , শেখমাটিয়া ইউনিয়ন গ্রামের নাম রামনগর । 2014 সালে এসএসসি পরীক্ষায় দুই সাবজেক্টে ফেল করেছি । বাড়ি থেকে রাগারাগি করেছে তাই লজ্জায় আর জিদে চট্টগ্রাম চলে আসলাম । গ্রামের এক বান্ধবী ছিল এখানে তার সাথে গার্মেন্টসে চাকরি নিলাম 2014 সালের নভেম্বর মাসে । আড়াই বছর পেরিয়ে গেছে আজও বাড়িতে যাইনি আমি । সবাই ভেবেছে আমি মনে হয় বিয়ে করে সংসার শুরু করেছি । কিন্তু আমি তো এখনো বিয়ে করিনি সেটা কেউ বিশ্বাস করতে চায় না । কিন্তু দুদিন ধরে মা খুব অসুস্থ তাই এখন বাধ্যতামূলক ভাবে বাড়িতে যেতে হচ্ছে ।

— আপনি যে বেশি কথা বলেন এটাই তার প্রমাণ ।

— মানে ?

— এতকিছু কে জানতে চেয়েছে ?

— আপনি তো আমাকে সহ্য করতে পারেন না তাই জিজ্ঞেস না করতেই বলে দিলাম । আর কোন কথা বলবো না আপনার সাথে , নিরামিষ মানুষ ।

— কি বললেন ?

— মোবাইল মোবাইল ।

— মানে কি ?

— আপনার ফোন বাজে রিসিভ করুন ।

— ওহহহ ।

|
|

– মোবাইল বের করে দেখে বৃষ্টি কল করেছে , তাই কল কেটে দিয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে সজীব পিছনে চলে গেল । কলব্যাক করলে সাথে সাথে বৃষ্টি রিসিভ করে বললো , কোই আছো তুমি ?

— সজীব বললো , মিরসরাইয়ের কাছাকাছি চলে এসেছি মনে হয় ।

— পাশের সিটে কি ছেলে নাকি মেয়ে ?

— মেয়ে ।

— নাম কি তার ?

— মোহতারিমা আক্তার মিতু ।

— বিবাহিতা নাকি অবিবাহিতা ?

— অবিবাহিতা , চট্টগ্রামে থাকে গার্মেন্টসে চাকরি করে , বাড়িতে মা অসুস্থ তাই তাকে দেখতে যাচ্ছে ।

— নাম , ঠিকানা , পেশা , বাড়িতে যাবার উদ্দেশ্য ইত্যাদি সবকিছু জানা হয়ে গেছে । তাই তো বলি বাবু আমার সেই দুপুর থেকে একবারও কল দিল না কেন ? কখন গাড়ি ছাড়লো , কতদূরে গেল ? কিছু বলার নাম নেই । পাশের সিটে সুন্দরী মেয়ে থাকলে বৃষ্টির কথা মনে আসবে কিভাবে তাই না সজীব ভাইয়া ?

— ধুর কি বলো এগুলো ?

— চোপ একদম কথা বলবি না , তুই থাক তোর মিতুরে নিয়ে আর আমাকে কল দিবি না । চট্টগ্রামে আর ভুলেও পা রাখবি না তাহলে কি করবো বুঝতে পারছো তো ? রাখলাম বায় ।

— বৃষ্টি শোনো ! টুট টুট টুট ।

— সজীব আবার কল দিল , আর ওপাশ থেকে মিষ্টি কণ্ঠে বললো ” আপনার ডায়াল কৃত নাম্বারে এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না । ”

চলবে…..

লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম সজীব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here