#স্মৃতির_শেষ_অধ্যায়ে_তুমি
#পর্ব_৩২(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
গানের তালে তালে নৃত্য করছে ছেলে মেয়েরা। এই দিকে কারো হৃদস্পন্দনের গতিবেগ ঝড় তুলে দিয়েছে। স্মৃতির পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। বিস্ময় নয়নে বাবার দিকে দৃষ্টিপাত করে রয়েছে। আঁখি জোড়া নত হয়ে গিয়েছে। স্মৃতির বাবা সবার সামনে সজোরে মেয়ের গালে ক’ষে থা’প্প’ড় বসিয়ে দিল। স্মৃতি রক্তিম আঁখি জোড়া মেলে বাবার প্রাণে চেয়ে আছে। স্মৃতির বাবা শাসিত কণ্ঠে বলে গেল,
–আমি কারো বাবা নই। আমার কোনো মেয়ে নেই। কথা গুলো বলেই বিলম্ব করল না। দ্রুত পায়ে ক্লাব থেকে বের হয়ে গেল। স্মৃতির মা-ও মেয়ের সাথে একটা কথা ও বললেন না। স্বামীর পেছনে ছুটলেন তিনি। শুধু মাত্র আরাভ থেকে গেল। স্মৃতি ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে আরাভের দিয়ে চেয়ে রয়েছে। স্মৃতি রাগান্বিত হয়ে বলল,
–এবার আপনার শান্তি হয়েছে। একবার আমার জীবন নষ্ট করে দিয়েছেন। এখন আমার বাবা-মায়ের কাছে আমাকে খারাপ প্রমানিত করে দিলেন! আমার জীবন টা নষ্ট করে আপনার শান্তি হয়নি। আমাকে খেয়ে আপনি খান্ত হবেন। বলে ছিলাম না। আপনার এই মুখ আমি কোনোদিন দেখতে চাই না৷ তবু্ও এই কুৎসিত মুখশ্রী নিয়ে কেনো আমার সামনে এসেছেন? আপনাকে আমি কোনোদিন ক্ষমা করবো না। আরাভ অপরাধীর ন্যায় স্মৃতির দিকে তাকিয়ে আছে। কণ্ঠস্বর দিয়ে কোনো বাক্য উচ্চারিত হচ্ছে না। তবুও জোর করে উচ্চারিত করেই ফেলল,
–যাকে ক্ষমা করলে তোমার হৃদয় ভরে উঠত। তাকে ঘৃণা করে মন কে কেনো পাথর বানালে স্মৃতি? আমি তো তোমার ভালো চেয়েছিলেন। তুমি কিভাবে পারলে নিজেকে ধংস করে দিতে! রক্তে মিশলে কি ছিন্ন করা যায়! তুমি ভাবো উদাসীনতা। কিন্তু আমিটা তো নিরুপায় ছিলাম। কখনো জানতে ও চাওনি কেনো চলে গিয়ে ছিলাম। এসব জেনে তোমার কাজ ও নেই। কেনই বা খবর নিবে। আমি বোকার মতো আশা করে ছিলাম। আরাভের কথায় স্পষ্ট অভিমান দেখতে পাচ্ছে স্মৃতি। আরাভের অভিমানে মনটা ভিষণ ভাবে গলে যেতে চাইছে৷ কিন্তু অন্য দিক থেকে কেউ একজন ডেকে বলছে। ক্ষমা করিস না স্মৃতি। মানুষ টা তোকে নির্মম ভাবে ভেঙে দিয়েছে। তোকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়ে, সে অপরাধ বোধে ভুগেনি। তোকে দুঃসময়ে একা ফেলে পালিয়ে গিয়েছে। খারাপ সময়ে তোর পাশে থাকেনি তোর খোঁজ নেয়নি। মানুষ টাকে এত সহজে ক্ষমা করে দিস না৷ যতটা আঘাত তুই পেয়েছিস। তার আংশিক হলে-ও মানুষটাকে অনুভব করা। অদ্ভুত ভাবে স্মৃতির মনটা পাষাণ হয়ে গেল। আরাভকে পাত্তা না দিয়ে সে হনহন করে বের হয়ে গেল। এখন বাবা-মায়ের কাছে যাওয়া টা গুরুত্বপূর্ণ। আরাভ স্মৃতির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। সে-ও বিলম্ব করল না। দ্রুত পায়ে ক্লাব থেকে বের হয়ে গেল। সবাই চলে যেতেই মেঘলা গ্লাস ফ্লোরে ফেলে দিল মুহুর্তের মধ্যে গ্লাস টা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। সবাই মেঘলার করা ঘটনায় অবাক হয়েছে বেশ! মেঘলা রাগান্বিত হয়ে ক্লাব থেকে বের হয়ে গেল।
বুক ভরা হাহাকার মনের মাঝে, একরাশ ভয় নিয়ে স্মৃতি বাসার কলিং বেলে চাপ দিল। দীর্ঘ ২০ মিনিট পরে মুনতাসীর এসে দরজা খুলে দিল৷ স্মৃতি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে মুনতাসীরের দিকে তাকিয়ে আছে। মুনতাসীর গম্ভীর আঁখি জোড়া মেলে স্মৃতির দিকে চেয়ে আছে। কিছুটা বিস্ময় ও হয়েছে বটে! সে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,
–এত রাত করে কোথায় থেকে আসছিস? তুই তো রাত করে বাসার বাহিরে থাকার মতো মেয়ে না! সন্ধ্যায় বাসায় আসলাম। মামা-মামি ঠিকই ছিল। একটু আগেই বাসায় প্রবেশ করে কক্ষে গিয়ে দরজা দিল। আর বেরই হচ্ছে না। তারা কি আমার ওপরে কোনো কারনে রেগে আছে? স্মৃতি বিষন্ন মন দিয়ে ধীর কণ্ঠে বলল,
–না আমার ওপরে রেগে আছে। কথা গুলো বলেই নিজের কক্ষের দিকে দৌড়ে গেল স্মৃতি। ভিষণ কান্না পাচ্ছে তার। জীবন প্রথম বাবা-মাকে এতটা কষ্ট দিয়ে ফেলল সে। মানুষ টা এতটা খারাপ কেনো? তার বাবা-মাকে জানানোর খুব দরকার ছিল। হয়তো দরকার ছিল। না হলে ভুল পথ থেকে ফিরে আসার উপায় ছিল না। বাবার কাছে গিয়ে বাবার হাত ধরে ভিষণ কান্না করতে ইচ্ছে করছে। উচ্চ স্বরে বলতে ইচ্ছে করছে। আব্বু আমাকে মাফ করে দাও। আমি আর এমন ভুল কখনো করবো না৷ আমি বাঁচতে চাই আব্বু। আমি ভিষণ ভাবে নিজেই নিজের কাছে ঠকে গিয়েছি। কথা গুলো আওরাতে আওরাতে স্মৃতির আঁখি জোড়া দিয়ে অশ্রুকণা গুলো গড়িয়ে পড়ছে।
ঘড়ির কাঁটায় রাত একটা ছুঁই ছুঁই। আরাভ বিধস্ত হয়ে বাসায় ফিরছে। সবাই আরাভের চিন্তায় মগ্ন ছিল। অভ্র সবাইকে বুঝিয়ে ঘুমোতে পাঠিয়ে দিয়েছে। অভ্র ড্রয়িং রুমে বসে আরাভের জন্য অপেক্ষা করছিল। এমন সময় বাসার কলিং বেল টা জানান দেয় কেউ এসেছে। অভ্র বুঝলো কে আসতে পারে। তাই সে বিলম্ব করল না একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে দরজা খুলতে চলে গেল। আরাভকে বিধস্ত অবস্থায় দেখে অভ্রের বুক কেঁপে উঠলো। হাজার হলে-ও নিজের ভাই। কিভাবে ভাইয়ের এই তীব্র যন্ত্রনা সহ্য করবে? বুক টা খাঁ খাঁ করে উঠলো। অভ্র আরাভকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–আব্বু আম্মুকে বলেছিস স্মৃতির কথা? ভাইয়ের কথায় রাগান্বিত হয়ে গেল আরাভ। বজ্রকণ্ঠ বলে উঠলো,
–এখন ভালোমানুষি দেখিয়ে কি হবে? স্মৃতি সুস্থ হয়ে যাবে! কয়েকবছর আগে স্মৃতির বিপথে যাবার খবর টা আমাকে আগে দিলে কি হতো? অন্তত মেয়েটাকে বিপথে যাওয়া থেকে আটকানো যেত। আমার যদি সাধ্যি থাকত তাহলে জীবন থেকে চারটা বছর মুছে ফেলতাম। যার ভালোর আশা এতকিছু করলাম। তার ভালো হলো সাথে খারাপ টাও হলো। তার খারাপ তো আমি চাইনি। তাহলে এমনটা কেনো হলো ভাইয়া? কেনো জানাওনি আমায়?
–দেখ অভ্র যারা স্মৃতিকে নেশার জগতে নিয়ে আসছে। তারা ভিষণ চালাক ও ধুরন্ধর খুব কৌশলে মেয়েটাকে নেশার পথে পরিচালিত করেছে। মেয়েটা একা একা এমন হয়নি। আমি নিজেই এক মাস আগে জেনেছি। আমার মেয়েটা অসুস্থ থাকায় তাকে নিয়ে হসপিটালে ছোটাছুটি করতে গিয়ে আমার খেয়াল ছিল না। কথাটা আমার স্মরনে আসতেই, তোকে কল দিয়ে সাথে সাথে জানিয়েছি। এখানে আমার কি দোষ বলতে পারিস?
–তোমার কোনো দোষ নেই ভাইয়া। সব দোষ আমার ভাগ্যের। আমি যাদের দিয়ে স্মৃতির খোঁজ খবর নিতাম। তারা সবাই আস্তে আস্তে সবাই নিখোঁজ হতে শুরু করেছিল। আমার তখনই বোঝা উচিত ছিল। আমি ভেবেছি আমি তাদের যা পারিশ্রমিক দেই। তা গিয়ে তাদের পোষায় না। তা না হলে হারিয়ে যায়৷ কিন্তু এই হারানোর মাঝে যে এত বড় সত্য হারিয়ে গিয়েছে। তা আমি গুন অক্ষরেও টের পেলাম না ভাইয়া। সব সময় আমার জীবন টাই কেন এমন এলোমেলো হয়ে যায়। সুখ কি আমায় চোখে দেখে না। আমার সহ্য ক্ষমতা শেষ ভাইয়া। এবার বুঝি বেলা শেষ। আরাভের হাহাকার ভরা প্রতিটি কথা অভ্রের হৃদয় ছেদ করে বেড়িয়ে গেল। সে ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাগান্বিত হয়ে বলল,
–একদম বাজে কথা বলবি না। তুই জানিস তোর ভাই রেগে গেলে কি হয়। আমাকে রাগাস না আরাভ ফলাফল ভালো হবে না। তোর ভাগ্যেও সুখ আছে৷ সেটা খুব তাড়াতাড়ি আসবে। তোর আর স্মৃতির ছোট্ট সংসার হবে। সেখানে ছোট্ট একটা রাজকন্যা আসবে। পৃথিবীর সেরা সুখী মানুষ হবি তোরা। সেদিন আর দুঃখ তোদের ছুঁতে পারবে না। ভাইয়ের কথা দেরিতে হলে-ও মিলে যায়। এটা তো মানিস নাকি। আরাভ আর কোনো কথা বলল না। সে নিঃশব্দে কক্ষের মধ্যে চলে গেল। অভ্র আরাভের দিকে তাকিয়ে হতাশার শ্বাস ছাড়লো।
গোধুলির আলো চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গোধুলির বেলায় ছাদে আসলে স্মৃতির মন ভালো হয়ে যায়। আজ থেকে স্মৃতির বাহিরে বের হওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সারাদিন চার দেওয়ালের আবদ্ধ কক্ষে থাকতে থাকতে বিষাদ এসে ধরা দিয়েছে মনে। মায়ের অনুমতি নিয়ে ছাদে এসেছে সে। মুনিয়া বেগম মেয়েকে ভরসা পাননি। মেয়েকে ছাদে পাঠিয়ে দিয়ে দুই মিনিটের মধ্যে মেয়ের পেছনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। স্মৃতি অনেক আগেই মায়ের উপস্থিতি টের পেয়েছে। বুক ভরা হাহাকার নিয়ে এই সুন্দর ধরনী পর্যবেক্ষণ করছে। মৃদু হাওয়া এসে স্মৃতির শরীরসহ মন স্পর্শ করে গেল। যে মা তাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করত আজ সেই মা তাকে সন্দেহ করছে। তাকে নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে আছে। কতই না বিশ্বাস ছিল কিছু সময়ের ব্যবধানে সবকিছুর চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে। স্মৃতি কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে ছাদ থেকে নেমে আসলো। মুনিয়া বেগম মেয়ের পেছনে পেছনে আসলো।
কক্ষে এসে ড্রা’গ’স নেশায় স্মৃতির শরীর অস্থির হয়ে উঠছে। কেমন উন্মাদ হয়ে উঠেছে স্মৃতি। দৌড়ে বাসার বাহিরে যেতে চাইলে স্মৃতির মা স্মৃতির পথে বাঁধা সাধে,
–আমাদের আর কত অশান্তি দিয়ে মারবি? আমাদের বিশ্বাস চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়ে তোর শান্তি হয় নাই! আবার কোথায় যাচ্ছিস? লোক জানাজানি করতে দেখো সবাই আবিদ রহমানের মেয়ে নেশায় জর্জরিত হয়েছে। আবিদ রহমান তার মেয়েকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারেনি। আর কি করে থামবি তুমি? আমাদের মৃ’ত্যু’তে তোর মন খান্ত হবে। তোর বাবা কালকে দু-চোখের পাতা এক করেনি। মানুষটার সাথে এতগুলো বছর সংসার করেছি। কখনো এতটা গভীর ভাবে আহত হতে দেখেনি। গভীর রাতে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেছে জানিস। এতকিছুর পরে-ও তুই কোন মুখে বাসার বাহিরে যাওয়ার মতো স্পর্ধা দেখাস! তুই যদি এখন বাহিরে যাস তাহলে তোর বাবা-মায়ের লা’শে’র ওপরে দিয়ে যাবি। এই কথা টা মাথায় রেখে যা করার করবি। মায়ের কোনো কথাই যেন স্মৃতিকে কাবু করতে পারলো না। ছুটে চলে যেতে চাইছে বাহিরে, মুনিয়া বেগম মেয়ের অবস্থা বুঝতে পেরে মেয়েকে নিজের কক্ষে নিয়ে গেল। স্মৃতিকে কক্ষে রেখে চলে আসতে যাবে, তখনই স্মৃতি মুনিয়া বেগমের পা জড়িয়ে ধরলো,
–মা আমাকে আজকে শুধু যেতে দাও কথা দিচ্ছে আর কখনো যেতে চাইবো না। আমি আর পারছি না মা আমার ভিষণ কষ্ট হচ্ছে, এই বুঝি দম বন্ধ হয়ে মারা যাব। আমি মরতে চাই না মা তুমি আমাকে বাঁচাও। মেয়ের আর্তনাদ মুনিয়া বেগমের কলিজা কেঁপে উঠলো। কোন মা তার সন্তানের ক্ষতি চায়। মুনিয়া বেগম ও তার ব্যতিক্রম নয়। সে চায় তার মেয়ে সুস্থ থাকুক। মুনিয়া বেগম স্মৃতিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। তারপর বাহিরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিল। দরজার ওপাশ থেকে স্মৃতির আর্তনাদ ভেসে আসছে। মুনিয়া বেগম বুকে হাত দিয়ে কান্না করছেন। ভেতরটা জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে।
স্মৃতি কক্ষ থেকে বের হবার জন্য রাস্তা খুঁজছে। কোনো রাস্তা সে খুঁজে পাচ্ছে না। অস্থির হয়ে ওয়াশরুমে গেল সেখানে গিয়েও ব্যর্থ হলো। নিজেকে পাগল পাগল লাগছে স্মৃতির। এত যন্ত্রনা কি যে যন্ত্রনা সহ্য করার মতো নয়। যন্ত্রনায় ভেতরটা ছটফট করছে। স্মৃতির আর ধরনীর কোনোদিকে হুস নেই। দু’হাতে পেট চেপে ধরে ফ্লোরে বসে পড়ল স্মৃতি। সব চেষ্টা বৃথা গেল। আর সহ্য করা যাচ্ছে না। স্মৃতি সাত-পাঁচ না ভেবে নিজের গলার ওড়না না সিলিং ফ্যানের সাথে বাঁধতে শুরু করল। বাঁধা হয়ে গেল ওড়না টা গলায় পেঁচিয়ে নিল।
চলবে…..
(আসসালামু আলাইকুম। সবাই কেমন আছেন? এই অসম কে কি ভুলে গিয়েছেন? পরীক্ষা শেষ করে এক মাসে ও বেশি সময় পর ফিরলাম লেখালেখির জগতে। আমার হাতের লিখা এমনিতেই কাঁচা। দীর্ঘ দিন না লিখার কারনে তা রসাতলে চলে গিয়েছে। ভুল ত্রুটি থাকলে ধরিয়ে দিবেন। সবাই আগের মতো রেসপন্স করবেন। এতদিন অনেক অপেক্ষা করিয়েছি। এখন থেকে নিয়মিত গল্প দেওয়ার চেষ্টা করবো। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন।)