#স্মৃতির_শেষ_অধ্যায়ে_তুমি
#পর্ব_৩৫(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
উত্তপ্ত রৌদ্রের প্রখরতার মতো রুপ নিয়েছে আরাভের কোমল হৃদয়। চৈত্র মাসের মাঝের সময় টা গরমে বাহিরের সাথে ভেতরটাও জ্বালিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। মনটা ভীষণ জ্বলছে। আপন মানুষ গুলো ভিষণ আঘাত দিয়েছে। দূর আকাশে কালো মেঘে ঢেকে যাওয়া মায়াবী চাঁদটার মতো তোমাকে পাওয়ার তীব্র ইচ্ছে টাও ঢেকে গেল আমার অপ্রত্যাশিত অবহেলায়। তুমি অনেক সুখী হও স্মৃতি। তুমি মন খুলে বাঁচো আমাকে পেয়ে কোনো কিছুর থেকে পিছনে না যাও। আমাকে ছাড়াই তোমার জীবন সুন্দর হোক। প্রত্যেক মানুষের জীবনে কিছু শব্দহীন কষ্ট থাকে, যার সাক্ষী শুধু সে নিজেই। কথা গুলো ভাবতেই হাহাকার নেমে এলো আরাভের বুকে। বুকের মাঝখানে ভিষণ চিনচিন করে ব্যথা করছে। বুকটা ভিষণ খালি খালি লাগছে। আঁখি জোড়া রক্তিম বর্ন হয়ে এসেছে। এ যেন একটু পরেই বৃষ্টি ঝরতে শুরু করবে।
ইমনের সামনে বসে আছে আবিদ রহমান। আবিদ রহমানকে দেখে ইমন ও বেশ খুশি। এই বুঝি তার এত দিনের স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। আবিদ রহমান কোনো ভনিতা ছাড়াই ইমনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–তুমি স্মৃতিকে পছন্দ কর?
–জি আংকেল করি। আমি কোনো রকম ভনিতা করতে পছন্দ করি না। আমি কয়েক বছর আগে থেকে স্মৃতিকে ভালোবাসি। আম্মুকে দিয়ে আপনাদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব ও পাঠিয়েছি। কিন্তু আপনি মুখের ওপরে নাকচ করে দিয়েছেন। সেদিন আমি ভিষণ কষ্ট পেয়েছিলাম। কিন্তু আশা ছাড়ি নাই। সেজন্য আমি আজ ও স্মৃতির জন্য অপেক্ষা করি। আমার বিশ্বাস ছিল স্মৃতি একদিন আমার হবে।
–এজন্য তোমাকে আমার এত ভালো লাগে। তুমি স্মৃতিকে বিয়ে করতে চাও?
–জি আংকেল চাই।
–যদি বলি চারদিনের মধ্যে স্মৃতিকে বিয়ে করতে হবে। তাহলে পারবে স্মৃতিকে বিয়ে করতে?
–আপনি যদি বলেন আজকে স্মৃতিকে বিয়ে করতে হবে। তাহলে আমি আজই আব্বু আম্মু কে নিয়ে আপনাদের বাসায় যাব।
–তার আগে তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। আগে সেসব কথা শুনে নাও। তারপরে না হয় তোমার বাবা-মাকে নিয়ে এসো। ইমন আর কোনো কথা বলল না। আবিদ রহমান আর ইমন দু’জন একটা নির্জন স্থানে গিয়ে বসল।
মুঠোফোন টা হাতে নিয়ে বসে আছে আরাভ। দীর্ঘক্ষণ ধরে হাসফাস করে যাচ্ছে। স্মৃতির থেকে শেষ একটা সুযোগ চাইবে। কিন্তু ভেতরে ভিষণ অপরাধবোধ কাজ করছে। কোন মুখ নিয়ে তার সাথে কথা বলবে। কিন্তু স্মৃতি অন্য কারো হয়ে যাবে। কথা টা স্মরন হতেই মনটা ভিষণ জ্বলছে। আরাভ বিষন্ন মন নিয়ে স্মৃতিকে ফোন দিল। প্রথম স্মৃতিকে নিজ ফোন থেকে কল করছে আরাভ। স্মৃতি বিষন্ন মাখা মন নিয়ে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে কোলাহলপূর্ন পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। স্মৃতির খালি মনে হচ্ছে আগে কি ছিলাম। আর এখন কি হয়ে গেলাম। কথা গুলো ভাবতেই বুকটা ভারি হয়ে আসতে শুরু করল। স্মৃতির ভাবনার মাঝেই ফোনটা বেজে উঠল। স্মৃতি সেদিকে গুরুত্ব দিল না। আজকাল কোনো কিছুই তার ভালো লাগে না। সবকিছু বিষাদে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। পর পর দশবার ফোনটা বেজে উঠল। এগারো বারের বেলায় স্মৃতি বিরক্ত হয়ে এসে ফোনটা রিসিভ করল। সাথে সাথে কারো রাগান্বিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
–ফোন কিনেছো কিসের জন্য? সময় মতো যদি ফোন রিসিভ করতে না পারো। তাহলে ও ফোন রেখো না ফেলে দাও। আরাভের কণ্ঠস্বর কর্ণকুহরে আসতেই অভিমানের দানা গুলো মনে এসে হানা দিল। মানুষ টার সাথে সে কিছুতেই কথা বলতে চায় না। আজ এই মানুষটার জন্য তার সম্পূর্ণ জীবন এলোমেলো গিয়েছে। সে হয়েছে ছন্নছাড়া মনের অধিকারী। স্মৃতির থেকে কোনো উত্তর আসছে না দেখে, আরাভ শান্ত হলো। সে বুঝতে পারছে ভুল জায়গায় ভুল কাজ করে বসেছে। স্মৃতি কোনো কথা না বলে ফোন কেটে দিতে যাবে, তখনই আরাভ অস্থির হয়ে বলল,
–স্মৃতি প্লিজ ফোন কেটে দিও না। তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। আমি জানি আমি অনেক বড় ভুল করেছি। যে ভুলের কখনো ক্ষমা হয় না৷ আমি চাই তুমি সর্বদা সুখী হও। তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করবে, তাতেও আমার কোনো সমস্যা নেই। নিজেকে তো ঠিক সামলে নিতে পারি। কিন্তু মনটাকে কি করে সামলাই বল তো? নিজেকে সামলাতে পারলেও মনটাকে কিছুতেই সামলাতে পারছি না। আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না স্মৃতি। শেষ একটা সুযোগ দিয়ে দেখ কথা দিলাম অভিযোগ করার সুযোগ পাবে না। আরাভের কথা শেষ হবার সাথে সাথে স্মৃতি কলটা কেটে দিল। মুঠোফোনটা ছুটে মারল বিছানায়। বুকটা ভারি হয়ে আসছে। সাথে প্রচন্ড রাগ হচ্ছে মানুষটা সেই পথেই আসলো। কিন্তু দেরি করে আসলো। কয়টা বছর আগে আসলেই আজ তার জীবন টা পরিপূর্ণ থাকতো। আমি যে কষ্ট গুলো অনুভব করেছি। নিজের জীবন থেকে অনেক গুলো বছর নষ্ট করেছি। তার আংশিক হলে-ও তোমাকে উপলব্ধি করাব আরভ মুনতাসীর।
পরের দিন প্রভাতের আলো ফুটতেই স্মৃতি বাসার বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিল। কালকে রাতে ইমন স্মৃতিকে সকালে দাঁড়াতে বলেছিল। স্মৃতির সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা রয়েছে। স্মৃতি ইমনের জন্য অপেক্ষা করছিল। তখনই আরাভ আর অভ্র নামাজ পড়ে কিছু দূর হেঁটে বাড়ি ফিরছিল। স্মৃতিকে দেখে থেমে যায় আরাভের দু’টি চরন। আরাভকে স্মৃতির দিকে দৃষ্টিপাত করতে দেখে, অভ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাসার দিয়ে অগ্রসর হলো। আরাভ স্মৃতির দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা আগের থেকে রোগা পাতলা হয়ে গিয়েছে। আগের সুন্দর্য টা কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে। আঁখি জোড়ার নিয়ে কালো দাগ গুলো চিৎকার করে বলছে। মেয়েটা কত রজনী নির্ঘুম কাটিয়েছে। স্মৃতির মলিন মুখটা দেখে আরাভের বুকটা কেপে উঠল। মনের শহরে হাহাকার নেম এলো। এই সুন্দর মেয়ের জীবন নষ্ট সে নিজ হাতে করেছে। আরাভ স্মৃতির দিকে এগিয়ে গেল। আরাভকে দেখে স্মৃতি অন্য পাশে চলে গেল। স্মৃতিকে অন্য পাশে যেতে দেখে আরাভ মলিন হাসল,
–এতটা ঘৃণা জমেছে!
–চলে যান এখান থেকে আপনার মুখ দেখতে চাই না।
–তাহলে কার মুখ দেখতে ইচ্ছে করে?
–আপনাকে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই।
–স্মৃতি আই এম স্যরি প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও। আরাভের কথায় স্মৃতি বাসার মধ্যে চলে গেল। আরাভ অসহায় দৃষ্টিতে স্মৃতির যাওয়ার দিকে চেয়ে আছে। আরাভকে অবাক করে দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে স্মৃতি একটা কাঁচের গ্লাস হাতে নিয়ে বাহিরে আসলো। গ্লাসটা আরাভের সামনে ধরে বলল,
–এটা ধরুন। আরাভ বিনা বাক্যে গ্লাসটা হাতে নিল। স্মৃতির বিরক্তি মাখা মুখশ্রী করে বলল,
–এবার এটা নিচে ফেলে দিন।
–কেন?
–আপনাকে যা বলেছি তাই করুন।
–এভাবে একটা ভালো গ্লাস নষ্ট করা ঠিক হবে না।
–তাহলে মুখের সামনে থেকে চলে যান। আরাভ আর কোনো কথা বলল না। স্মৃতির কথা মতো গ্লাসটা ফেলে দিল। মুহুর্তের মধ্যে গ্লাসটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। এবার স্মৃতি আরাভের দিকে তাকিয়ে বলল,
–এবার এটা আগের মতো করে দিন। যদি এটাকে পানি খাওয়ার গ্রহণ যোগ্য করে দিতে পারেন। তাহলে আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিব।
–এটা কিভাবে সম্ভব! যে জিনিস একবার ভেঙে যায় তা কখনো জোড়া দেওয়া যায় না। যদিও চেষ্টা করে জোড়া তালি দিয়ে দেখার মতো বানানো যায়। কিন্তু এটা পানি খাওয়ার গ্রহণ যোগ্য হবে না। নষ্ট জিনিসে কে-ই বা পানি খেতে চায়। আরাভের কথায় স্মৃতি তাচ্ছিল্য করে বলল,
–ঠিক এইভাবে আপনি আমার মনটা ভেঙেছেন। আমাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছেন। আমাকে নিজ হাতে ধংসের পথে ঠেলে দিয়েছেন। স্যরি বললেই সমস্যার সমাধান হয়তো হয়ে যায়। কিন্তু মনের মধ্যে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে। সেটা কিভাবে ঠিক করে দিবেন। আপনি এখান থেকে চলে যান। সামনে আমার আর ইমনের বিয়ে আমি চাই না৷ আপনার জন্য ইমন আমাকে ভুল বুঝুক।
–আমি জানি আমি তোমার মনের ক্ষত দূর করে দিতে পারব না। কিন্তু সুযোগ দিলে ভালোবাসার চাদরে সব ক্ষত ঢেকে দিতে পারি। আমাকে এত বড় শাস্তি দিও না স্মৃতি। বিশ্বাস কর আমি বাঁচতে পারব না। জীবন যুদ্ধে আমি হেরে গিয়েছি। তুমি আমার মৃত্যু চেও। কিন্তু আমাদের দুরত্ব চেও না।
–আপনি বাঁচলেই কি আর মরলেই কি তাতে আমার কোনো যায় আসে না। আপনি আমার সামনে থেকে চলে যান। আপনাকে দেখলে ঘৃণায় আমার পুরো শরীর রি রি করে।
আরাভ কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইমন চলে আসে। আরাভকে দেখেও না দেখান ভান করে, স্মৃতিকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সামনের দিকে চলে গেল। আরাভ তাদের চাওয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। বুকের মাঝখানটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। সে কি অসহনীয় যন্ত্রনা। থাকবে না সে এই শহরে। তেলের মাথায় তেল সবাই দিতে পারে। আজ যদি তার মাথায় তেল থাকত। তাহলে স্মৃতি তার থেকে এতটা দূরে সরে যেত না। সব সময় সবকিছুর দায় আমি কেন নেব? আমি কি স্মৃতিকে বলেছিলাম। তুমি নেশার জগতে প্রবেশ কর। সে নিজ ইচ্ছায় নেশায় আসক্ত হয়েছে। তাহলে দোষী কেন আমি হচ্ছি। আমার ভাগ্যে কি ভালোবাসি নেই। সবাই আমাকে ঘৃণা করে। আমি সত্যিই একজন বিরক্তিকর মানুষ। আমি বোধহয় কারো ভালোবাসা পাবার যোগ্যতা রাখি না। আমাকে বোধহয় ঘৃণা করা যায় ভালোবাসা যায় না। আমি সর্বদা ঘৃণা পাবার যোগ্যতা রাখি। বুকটা ভারি হয়ে আসতে শুরু করল। আরাভ বাসার দিকে যাচ্ছিল। তখনই বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে আবিদ রহমান বের হচ্ছিল। আরাভের আজ ভিষণ নির্লজ্জ হতে ইচ্ছে করছে। নিজের ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখলো না। আবিদ রহমানের কাছে গিয়ে বলল,
–আংকেল আর একটা বার ভেবে দেখা যায় না। আমাকে শেষ একটা সুযোগ দেওয়া যায় না। আমি মানছি আমি ভুল করেছি। কিন্তু এতটা শাস্তি পাবার যোগ্যতা আমি রাখি না। আমি চাইলেই স্মৃতিকে জোর করে বিয়ে করতে পারি। কিন্তু আমি আপনাদের আর স্মৃতিকে সন্মান করি। তাই সবকিছু চুপচাপ সহ্য করছি। সবার ভালো থাকার অধিকার আছে। আমার ভালো থাকার অধিকার নেই আংকেল?
–দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বুঝতে হয়। দাঁত চলে গেলে বুঝে লাভ নেই। একটা সময় তোমাকে পাবার জন্য আমার মেয়েটা উন্মাদ হয়েছিল। তখন তুমি আমার মেয়েটাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিলে। ভাগ্যের পরিহাসে আজ আমার মেয়েকে পাবার জন্য তুমি ছটফট করছ। আর আমার মেয়েটা তোমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে। জীবন তোমাকে একটা জিনিস শেখালো সময় কারো জন্য থেমে থাকে না। ঠিক তেমনই স্মৃতি ও তোমার জন্য তার জীবন থামিয়ে রাখবে না। আমার মেয়েটাকে বাঁচতে দাও। স্মৃতি রাজি হলে আমি তোমার সাথে তার বিয়ে অবশ্যই দিতাম। তোমাকে এত করে বলতেই হতো না। আবিদ রহমানের কথায় আরাভ শান্ত পাখির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। আঁখি জোড়া মাটির দিকে বিদ্যমান। কথা না থাকলে মানুষ যেমন নিরব হয়ে যায়। ঠিক তেমনই কথা রেখেও মানুষ নিরবতা বেছে নেয়। আরাভ আর কোনো কথা বলতে পারল না। নিঃশব্দে স্থান করে বাসার মধ্যে চলে গেল। আবিদ রহমান আরাভের দিকে তাকিয়ে আছে। আরাভের পাগলামি দেখে স্মৃতিকে বোঝাতে ইচ্ছে করছে। তবে সে বাবা নিজের মেয়ের ইচ্ছেকেই বেশি গুরুত্ব দিবে। স্মৃতির জন্য আরাভের চোখে গভীর ভালোবাসা দেখেছে সে। স্মৃতির জন্য তার মস্তিষ্ক জুড়ে সে কি আকলতা। আহা জীবন কখন কাকে কোন মোড়ে নিয়ে যায়। তা বোঝা বড়ই মুসকিল। আবিদ রহমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিয়ের বাজারের জন্য চলে গেলেন।
চলবে…..