#নিশীভাতি
#৬ষ্ঠ_পর্ব
“তোমার তো আমাকেই ভালো লাগে না হুমায়রা। আচ্ছা তোমার আমাকে কেন ভালো লাগে না? আমি কি মানুষটি খুব খারাপ?”
কাতর স্বরে কথাটা বললো আমান। হুমায়রা কিছুসময় চুপ করে রইলো। কিছু প্রশ্নের উত্তর এতোটা সহজ হয় না। সে হ্যা বা না তে উত্তর দিতে পারবে না। আমান আবার শুধালো,
“তোমার আমার প্রতি এতো অনীহা কেনো হুমায়রা?”
“আমি আপনার মধ্যে আমার বাবার প্রতিচ্ছবি দেখি আমান ভাই। মেয়েরা চায় তার জীবনসঙ্গী যেনো তার বাবার মতো হয়, কিন্তু আমি চাই না। আমার ভয় হয়”
হুমায়রা খুব শান্তচিত্তে কথাটা বললো। তার কণ্ঠে স্পষ্ট বিষাদ, বিষন্নতা লুকিয়ে ছিলো। আমান বিক্ষুদ্ধ কণ্ঠে বললো,
“আমি সব ছেড়ে দিবো হুমায়রা”
হুমায়রা মৃদু হাসলো। তীব্র তাচ্ছিল্য ছিলো সেই এক টুকরো হাসিতে। আমান বুঝলো কিশোরী তাকে বিশ্বাস করে না। করবেই বা কেনো, এটা তো প্রথম নয়। এর পূর্বেও সে বহুবার তার বদ অভ্যাস ছাড়তে চেয়েছে কিন্তু পারে নি। আমানের খুব বাজে স্বভাব আছে নেশা করার। তার সঙ্গপাঙ্গও খুব ভালো নয়। যতবার ই এই বিশ্রী অভ্যাসটি পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয় তখন ই তার সঙ্গপাঙ্গগুলো তাকে জোর করে তাকে আরো নেশায় ডুবায়। বাবার অঢেল অর্থ টাকার কারণে কাম কাজও তেমন করে না। পড়াশোনা শেষ করে আজ তিনবছর বেকার বসে বাবার অন্নে আগুন জ্বালাচ্ছে। আমান এবং কাওছারের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই বলে ধারণা হুমায়রার। যে মানুষ কাওছারকে দেখেছে সে তার প্রতিচ্ছবি থেকে নিজেকে পৃথক রাখতে চায়। ছোটবেলা থেকে কাওছারের মাঝে শুধু একজন দায়িত্বহীন, মাতাল, নিম্ম মানসিকতার মানুষকেই দেখেছে। কখন সে তার স্ত্রীকে ভালোবাসে নি। জুবাইদার বাবার অবস্থা শামসু মিঞা থেকে ভালোই ছিলো। ফলে লোভে পরে বিয়ে করেছিলো জুবাইদাকে। কিন্তু জুবাইদার বাবা মারা যাবার পর থেকে তার ভাইরা সব আত্মস্থ করেছে। জুবাইদা কিছুই পায় নি। সেই ক্ষোভেই হয়তো কখনো নসীবের ভালোবাসাটা পায় নি জুবাইদা। নেশা করে রাত করে বাড়ি ফিরতো কাওছার। তারপর এক কথায় দুকথায় কোন্দল বাধতো জুবাইদার সাথে। একটা সময় পুরুষত্ব দেখাতো লাথি, থাপ্পড় মেরে। প্রায় সময়ে তাকে আটকাতো রাশাদ এবং শামসু মিঞা। নিজের নেশাখোর ছেলেকে শাসন করতেন। কিন্তু সেই শাসনের খুব ফল পেত না সে। সারা সকাল ব্যাথায় কাতরাতো জুবাইদা। হুমায়রা দেখতো নিষ্পলক চোখে। মায়ের সেই আর্তনাদ, কান্নারত মুখ, বিষাদের অশ্রু ফেলা এখন স্পষ্ট গেথে আছে চিত্তে। তাই আমানকে তার অপছন্দ। সে মায়ের মত পরিণতি চায় না। বিয়ে নিয়ে খুব আহামরি স্বপ্ন নেই তার। তবে মেয়ে হয়ে জন্মেছে, বিয়ে করা তার বিধির বিধান। শুধু আল্লাহ তা’আলার কাছে একটাই দাবি, যেনো স্বামী নামক পুরুষটি তাকে সম্মান দেয়। যেখানে সম্মান নেই সেখানে ভালোবাসার ঠ্যাং খোড়া। যতই আদরের চাদরের রাখুন আধা আনার সম্মান না থাকলে সেই ভালোবাসায় ঘুন ধরতে সময় লাগে না। হয়তো আমান তাকে ভালোবাসে, কিন্তু তার বদ গুনগুলো তাকে হীন ব্যাক্তির কাতারে রেখেছে হুমায়রার মনে। হুমায়রা খুব শান্ত স্বরে বললো,
“এগুলো সব আপনার কথার কথা, আপনি কখনোই এই বদ গুন গুলো ছাড়তে পারবেন না। ছাড়লে নিজের মা-বাবার জন্যই ছাড়তেন। আর আমার নারকেল লাগবে না”
একমূহুর্ত অপেক্ষা করলো না হুমায়রা। গন্তব্যের দিকে পা বাড়ালো। পাছে কাতর নয়নে তার যাবার দিকে চেয়ে রইলো আমান। চেয়ারম্যান বাংলো থেকে বের হবার সময় হুমায়রার সাথে দেখা হলো সেই বদরাগী, অহংকারী মানুষটির সাথে। ফাইজানের কানে ফোন। সে কথা বলতে ব্যস্ত। হুমায়রা তার থেকে বেশি দুরত্বে ছিলো না ফলে একনজর হুমায়রাকে দেখতে ভুললো না। গতদিনের মত আজ পাঞ্জাবী, কোট পড়া নেই। একটা সাদামাটা টিশার্ট পড়া, সাথে কালো একটি ট্রাউজার। চোখে চশমাটা আছে। চশমার ভেতর থেকেই হুমায়রা লক্ষ করলো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। মিঠু অবশ্য সালাম দিলো, তার বিপরীতে মৃদু হাসলো ফাইজান। ব্যাপারটা নজর এড়ালো না। অথচ হুমায়রাকে দেখেও না চেনার একটা ভাব নিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। এমন আচারণে কিছুটা বিরক্ত হলো হুমায়রা। কিসের অহংকার এই ব্যক্তির। হ্যা, তার কাছ থেকে খুব একটা আন্তরিকতা আশা করে না। কিন্তু একেবারে রুক্ষ্ণ দৃষ্টিও আশা করে না। মিঠু তখন পাশ থেকে বললো,
“এমপি মানুষ কিন্তু বোঝার উপায় নাই, এক্কেবারে মাটির মানুষ”
মিঠুর কথায় হতবাক হলো হুমায়রা। বিস্মিত স্বরে বললো,
“মাটির মানুষ? কে? ওই লোক?”
“হ, আমাদের গ্রামে কলেজ করতেছে তো। নিজের জায়গা দান করে দিছে মসজিদ আর কলেজের জন্য। আর কি অমায়িক ব্যবহার”
মিঠুর কথায় তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো হুমায়রা। বিড়বিড় করে বললো,
“সব ঢঙ, রাজনীতিবিদরা কি ভালো হয়?”
*******
এশা আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে দূর মসজিদের মাইক থেকে। রাত নিগূঢ় হচ্ছে সময়ের সহিত। সেই সাথে বাড়ছে নিস্তব্ধতা। শামসু মিঞা এখন ওয়ার্ডে এসেছেন। একটু টাকা পয়সা খাওয়িয়ে রাশাদ ব্যবস্থা করেছে। এখানে তেমন শব্দ হয় না। বাহিরের কলরব অতোটা শোনা যায় না। পাশের রোগীগুলো এখন ঘুমে। রাশাদ বাহিরের দিকে তাকালো। দাদার খাওয়া দাওয়া শেষ। তিনি ঔষধ খেয়ে এখন ঘুমাবেন। শরীর বেশ ভালো। কিছুদিন বাদে তাকে বাড়ি নেবার ব্যবস্থা করবে রাশাদ। পাগলীটা ভাইজানের জন্য মনে করে ডাবের পানি পাঠিয়েছে আজ। তাই না খেয়ে উপায় নাই। রাশাদ ডাবের পানির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। অর্ধেকটা পানি খেলো। এরপর পাশের বেডের চাচীকে বললো,
“চাচী, আপনি কি জেগে রইবেন?”
“হ্যা, আব্বা”
“তাহলে দাদার দিকে খেয়াল রাইখেন। আমি একটু নামায পড়ে চা খেয়ে আসছি”
“আচ্ছা, যাও”
চাচী তার স্বামীর সাথে এসেছে। তার স্বামীর পিত্তথলিতে পাথর হয়েছে। সেই চিকিৎসা চলছে। এখানে প্রতিদিন থাকতে থাকতে খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে রাশাদের সাথে। হাসপাতাল জায়গাটি খুব অদ্ভুত, অপরিচিত মানুষও এখানে পরিচিত হয়ে যায়। কারণ সবার একটাই কামনা, তার মানুষটি যেনো সুস্থভাবে ঘরে ফিরে। কিন্তু আসলেই কি সুস্থ ভাবে ফিরতে পারে সবাই? কেউ সেই হাসপাতাল থেকে নিথর দেহেই ফিরে।
*******
অগ্রহায়ণ মাস, অথচ কুয়াশা পড়ছে ভালোই। চাদর আনা উচিত ছিলো। রাশাদের শীত করছে। এখন গরম চা পেলে একটু রেহাই পাওয়া যাবে। দোকানের ছেলেটাকে বলতেই যাবে তখন ই পাশ থেকে চিক্কন কন্ঠ কানে এলো,
“এই বিট্টু এক কাপ কফি দাও তো”
কন্ঠ পরিচিত লাগলো। রাশাদ পাশ ফিরতেই দেখলো সেই ডাক্তার নারীটি তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ইলহা মেয়েটিকে পাঁচদিন বাদে দেখছে রাশাদ। আজ মেয়েটিকে আগের দিনের মত লাগছে না। বরং বেশ ফুরফুরে লাগছে। মুখে ক্লান্তি নেই। রাশাদ খেয়াল করলো মেয়েটিকে আজ বেশ সুন্দর লাগছে। কড়া লিপস্টিক দিয়েছে সে। পড়ণে ইস্ত্রী করা জামা। চুল পরিপাটি করে খোপায় বাঁধা। রাশাদ চোখ নামিয়ে নিলো। পরনারীকে এভাবে দেখা উচিত নয়। তখন ই কানে এলো,
“নাতী সাহেব যে, কেমন আছেন?”
রাশাদ বিস্মিত নয়নে তাকালো মেয়েটির দিকে। তার কি মনে আছে রাশাদকে? অবাক কন্ঠে শুধালো,
“আপনার মনে আছে আমাকে?”
“আমার ব্রেইন অনেক শার্প। আর অটপটে রোগী এবং তার এটেন্ডেন্সদের আমি ভুলি না”
হাসিমুখে কথাটা বললো সে। তার চোখ ও হাসছে যেন। রাশাদ কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। ইলহা নিজ থেকেই বললো,
“কেমন আছেন আপনার দাদা?”
“ভালো”
“উনি বেশ স্ট্রং”
“জি, আসলে কৃষক তো। তাদের হাড্ডি শক্ত ই থাকে”
“কফি খাবেন?”
“আমি কফি খাই না, আমি চায়ের ভক্ত। তিতো জিনিস ভালো লাগে না”
“সে কি! তাহলে তো আমাদের মাঝে আকাশ পাতাল ফারাক। আমি মিষ্টির মতো তিতো জিনিস খেতে পারি”
বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলো সে। রাশাদ ও হাসলো। কি অদ্ভুত না! অপরিচিত মানুষও মাঝে মাঝে আনন্দের উৎস হয়। রাশাদ শুধালো,
“আপনি আজ খুব খুশি?”
“জি, অনেক খুশি। আজ আমার ইন্টার্নির শেষ দিন। শেষ ডিউটি। এর পর আমি সনদ পেয়ে যাবো”
হুট করেই রাশাদ অনুভব করলো তার মনটা খারাপ হয়ে গেছে। বিড়বিড় করে বললো,
“আর এখানে কাজ করবেন না?”
“জি না, এটা সরকারী হাসপাতাল। আমাকে সরকারী ক্যাডার হয়েই এখানে কাজ করতে হবে। তাই আর এখানে কাজ করবো না আপাতত। দোয়া করিয়েন। যেনো আবার কাজ করার সুযোগ পাই”
রাশাদ হাসলো। মলিন স্বরে বললো,
“তাহলে এটা আমাদের শেষ দেখা?”
“হ্যা, তবে জীবন বড় বিচিত্র। বলা যায় না কোথায় কোনমোড়ে দেখা হয়ে যায়”
“না হবে না। আমরা পৃথক ট্রেনের যাত্রী, ক্রসিং বাদে আমাদের আর দেখা হবে না”
ইলহার হাসি এবার মিলিয়ে গেলো। কথাটা যেনো মস্তিষ্কে ঝংকার তুললো। একজন গ্রামের বাজারের দোকানীর কাছ থেকে এমন গভীর কথা আশা করে নি। কিছু বলতে যাবে, তখন ই পেছন থেকে ডাক পড়লো। এখন রোগী দেখতে যেতে হবে। রাশাদকে যেতে হবে দাদার কাছে। কি ছোট্ট মোলাকাত, কিন্তু ইলহার মনে হলো একটু দীর্ঘ হলে হয়তো মন্দ হতো না।
********
দেলওয়ার সাহেব সবে খাবার শেষে নিজ ঘরে আরাম কেদারায় বসলেন। পাশে পানের বাটা। পান সাজিয়ে রাখা আছে। তিনি আয়েশ করে পান খেলেন। শরীফা তখন দরজায় টোকা দিলো। দেলওয়ার রাশভারী স্বরে বললো,
“কে?”
“ভাইছা আমি”
“আসো”
শরীফা ঘরে প্রবেশ করে খাটে বসলো। দেলওয়ার সাহেব উঠে বসে বললেন,
“কিছু বলবে”
“হ্যা, ভাইছা। আপনি তো জানেন আমি এখানে কেন এসেছি। আমার স্বার্থ সিদ্ধি হয়েছে। ফাইজানের জন্য একেবারে উপযুক্ত মেয়ে পেয়েছি আমি”
শরীফার কথা শুনতেই দেলওয়ার ভ্রুকুটি কাটলো। অবাক স্বরে বললো,
“কে?”
“আপনাদের গ্রামের ই মেয়ে। নাম হুমায়রা…………………
চলবে
[মুসলিম পাড়ার দুটি বাড়ি, নাম শান্তিকানন এবং সুখনীড়। কিন্তু সেখানে অশান্তির বাস আর সুখের ছিটেফুটেও নেই। আছে শুধু ঝগড়া কলহ, বিদ্বেষ। বড়রা তো বড়রা, ছোটরাও এই কোন্দলে ঝাঝড়া। সকালবেলায় বল এসে ভেঙ্গে ফেললো আয়াতের শখের চুড়ি। ক্রোধ বর্ষণ হলো এই পাশ থেকে। কিন্তু ওপাশের সৌম্য পুরুষ, সাফওয়ান কেবল ই হাসলো। ফলে আরেকদফা ঝগড়া লাগলোই। আর দর্শক হলো মুসলিম পাড়া। এই বিদ্বেষ, কলহের বাতাসে প্রেমপুষ্প ফোটাবার দুঃসাহস পোষন করেছে এক জোড়া কপোত-কপোতী, প্রভা-ইশতিয়াক। আঠারো বছর ধরে সঞ্চিত প্রণয় পরিণয়ে পৌছাবে তো? নাকি তার পূর্বেই দু-বাড়ির কোন্দল পিষিয়ে দিবে প্রেম? সাফওয়ান-আয়াতের ঝগড়া কি কখনো শেষ হবে? নাকি চাঁদ কখনো বলবে হাতটি ধরতে?
ই-বই : চাঁদ বলে হাতটি ধরো (অংশ বিশেষ)
পুরো গল্পটা পাবেন শুধুমাত্র বইটই এপে। দাম মাত্র ৬০ টাকা!বইটি পড়তে হলে অবশ্যই গুগল প্লে স্টোর থেকে বইটই এপ ডাউনলোড করে নিজের একাউন্ট রেজিস্টার করতে হবে]
মুশফিকা রহমান মৈথি