মিফতাহুল ভাইয়ার রুমে যাচ্ছিলাম যেমন রোজকার মত যাই। কিন্তু এবার গিয়ে একটা বিপত্তি বাঁধে। ভাইয়ার রুমে ঢুকেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। কেননা ভাইয়ার রুমে এক সুদর্শন যুবক বসে আছেন। আমি আবার একটু লম্বা, চওড়া, সুঠামদেহী পুরুষদের প্রতি একটা টান অনুভব করি। এই অতিরিক্ত সুন্দর পুরুষটাকেও আমার বেশ মনে ধরল। আমি যেহেতু রুমে ঢুকেই পড়েছি তাই ভাইয়ার চোখে পড়ে গেলাম। সে হেসে বলল,
-“কিরে অর্নি? কখন এসেছিস?”
ভাইয়ার প্রশ্নে ছেলেটাও আমার দিকে এবার তাঁকায়। তার দৃষ্টিতে আমি কেমন এলোমেলো হয়ে পড়লাম। মৃদু হেসে ভাইয়ার মুখপানে চেয়ে বললাম,
-“পনেরো মিনিটের মত হয়েছে। তোমার থেকে একটা বই নিতে এসেছিলাম।”
-“বই? কোন বই!”
-“আমি জানিনা। নিতুন আপু বলল এই কাগজটা তোমাকে দিতে। এইখানে বইয়ের নাম আছে।”
-“আচ্ছা তাহলে তুই নামটা পড়ে বল। আমি দেখছি আছে কিনা!”
আমি কাগজ খুলে নামটা দেখেই অকপটে বলে দিলাম,
-“ফিফটি শেডস্ অব গ্রে।”
নামটা শুনেই ভাইয়া কেমন করে চেয়ে রইল। এমনকি সেই ছেলেটার চোখও এত বড় হয়ে গেল। আমি বুঝলাম না তারা কেন এমন করছে? বইয়ের মধ্যে কোনো ঘাপলা আছে নাকি আমার কথার মধ্যে? আমি ভাইয়াকে বললাম,
-“ঐরকম ভ্যাবলাকান্তের মত চেয়ে আছো কেন? সমস্যা কী? বই আছে না নাই!”
ভাইয়া কিছুটা ইতস্ত বোধ করে বলল,
-“তা আছে। বই কি আসলে ওটাই লাগবে?”
-“হ্যাঁ! এই যে দেখো এইখানে তো সেটাই লিখা আছে।”
কাগজটা ভাইয়ার চোখের সামনে মেলে ধরলাম। ভাইয়া কিছুক্ষণ সেখানে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে বলল,
-“দাঁড়া আনছি।”
ভাইয়া একটা টুল টেনে বুকশেল্ফের এক্কেবারে উপরের কোণা থেকে একটা মোটা বই বের করলেন। এবং সাথে সাথেই তা কাপড়ের ব্যাগে ভরে ফেললেন। আমাকে দিয়ে বললেন,
-“যেভাবে দিলাম সেভাবে দিয়ে আসবি। এই ব্যাগের বাহিরে যাতে বই একটুও উঁকি না মারে। বুঝলি?”
-“কেন? কী হবে তাতে! অন্যবার তো এমনেই দিয়ে দাও। আজ কী হলো?”
-“এটা স্পেশাল তো তাই। আমার বইগুলোর সাথে আমার অনেক ইমোশন জড়ানো। তুই বুঝবিনা। তোর তো আর বই পড়ার শখ নেই।”
-“কে বলল নেই? আমিও তো পড়ি। ডায়েরী ও লিখি।”
-“নিজে কিনেছিস কখনো? একটা বইও নিজে কিনেছিস?”
আমি আমতা আমতা করতে লাগলাম। আসলেই তো নিজে কিনি নাই। তাই হয়তো আমি কদর বুঝিনা। আমি তো নিতুন আপুর আর মিফতা ভাইয়ার বই পড়েই অভ্যস্ত। আমি বইটা নিয়ে চলে আসতে নিলেই ভাইয়া বলল,
-“এই শোন! নিতুন কে বলিস তো আমাকে যেন একটা কল করে বইটা হাতে পেলেই।”
-“আচ্ছা।”
আমি চলে এলাম। আসার আগে ছেলেটার দিকে একবার আড়চোখে চাইলাম। দেখলাম সে ল্যাপটপে ব্যস্ত। আমি বেশি তাঁকালাম না। ধরা পড়ে গেলে কী না কী ভাববে? দরকার আছে অযথা এতসব ভাবাভাবির মধ্যে জড়ানোর? আমি চলে এলাম গুনগুন করতে করতে। তবে মন থেকে ঐ গাঢ় বাদামী চোখের মালিককে মুছে ফেলতে পারলাম না।
২.
নিতুন আপুরা আমাদের উপর তলার ফ্ল্যাটে থাকেন। আমরা নয়তলা আর তারা দশতলায়। আমি নিজের বাসা নয়তলা ফেলে দশতলা গেলাম কেবল নিতুন আপুর জন্য। তাকে বইটা না দেওয়া পর্যন্ত আমার হাত পা বোধহয় থামবে না! এই মেয়েটার সাথে আমার রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই। তবুও আমার ওকে এতটা ভালো লাগে কেন আমি নিজেই বুঝে পাইনা। নিতুন আপু খুব ভালো। পড়ালেখায়, রান্নাবান্নায় এবং সৌন্দর্যের দিক থেকেও মহল্লার সবমেয়েকে ছাড়িয়ে গেছে। আমি পড়ালেখায় এভারেজ, রান্নাবান্না ভালো পারি, নিজের সৌন্দর্য নিয়ে কিছু বলতে পারিনা। একবছর আগেও নব্বই কেজি ছিলাম। ডায়েট আর ব্যায়াম করে এখন ষাটের মধ্যে এসেছি। খাওয়া দাওয়া মেইন্টেইন করতে হয় খুব। যেই আমার দুধ চা ছাড়া চলতোই না সেই আমি এখন গ্রীনটি কে নিত্যদিনের সঙ্গী করলাম। করোনার বন্ধ এই একদিক দিয়ে আমার উপকার করেছে। আগে খুব খারাপ লাগত নিজের মোটা শরীর নিয়ে। এখনো মোটা ভাব আছে তবে আমার উচ্চতা ভালো হওয়ার কারণে বোঝা যায়না। খালামণি সেদিন মাকে বলেছে,
-“অর্নিটা দিনদিন সুন্দর হয়ে যাচ্ছে খুব। ইশ! মেয়েটার অতিরিক্ত স্বাস্থ্যটা কতগুলো বছর ওকে জ্বালিয়েছে! শোন নিপা আমার মিফতা বা মৃদুলের জন্য আমি অর্নিকে নিয়ে নিব। তোর আপত্তি নেই তো!”
মা নির্দ্বিধায় বলে দিল,
-“আপা কী যে বল! আপত্তি কীসের! ধরে নাও সে তোমারই মেয়ে। তার বিয়ে আর তার স্বামী বাছাইয়ে তোমার একচ্ছত্র মর্জি চলবে।”
আমি সেদিন আড়ালে সব শুনেছিলাম। রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে এত কেঁদেছিলাম! আমি মিফতা ভাই আর মৃদুল ভাইকে বিয়ে করব না। এমন না যে তারা আমার ভাই লাগে আসলে মূল কারণ আমার তখন ক্রাশ একটা হয়েছিল নতুন করে। অবশ্য দশদিনের বেশি সে আমার ক্রাশ জোনে টিকতে পারেনি। আমার চিরস্থায়ী ক্রাশ নেই বললেই চলে। সবই দশ-বারোদিনের অতিথি। আমিও সবাইকে এই দশ-বারোদিন সাদরে গ্রহণ করি। এবং সর্বাত্মক চেষ্টা করি তাদের আপ্যায়নের। আমার দিলে আবার অনেক জায়গা!
মিফতা ভাইদের বাসা আমাদের বাসা থেকে হেঁটে গেলে তিন মিনিটের মত লাগে। হেলতে দুলতে গেলে লাগে চার মিনিটের মত। আমি বলতে গেলে প্রায়ই তাদের ঘরে হানা দেই। খালামণি আমার বান্ধবী তো তাই আমার অবসরে গিয়ে তার সাথে আড্ডা দেওয়াই লাগে! তাদের আমাদের মত ফ্ল্যাট বাসা না। তাদের সেই গলিতে সব ডুপ্লেক্স বা থ্রিপ্লেক্স বাসা পাওয়া যায়। সেখানে যে যার নিজস্ব জমিতে ঘর তুলে থাকেন। আমাদের এগুলো তো আমরা অন্যের জমিতে তাদের পছন্দমত করা ফ্ল্যাট কিনেছি। ফ্ল্যাট আমাদের নিজস্ব। এই এড়িয়া বাসা ভাড়া নেই বললেই চলে। যে যার নিজ বাসায় থাকে। পার্থক্য একটাই! কেউ কিনে নেয়, কেউ নিজে গড়ে। আমার খালুদের বড় ব্যবসা। খালু বাড়িতে কম থাকেন। মাঝেমাঝেই সে ট্যুরে বের হোন। আর তার সঙ্গী হয় মৃদুল ভাই। মিফতা ভাই যায়না কখনো। ভাইকে আমি আর নিতুন আপু ঘরকুণো স্বভাবের বলে থাকি। সে ঘরেই থাকে বেশিরভাগ সময়ে। করোনার উপদ্রব যখন বেড়ে গিয়েছিল, অফিস ঘরে বসেই করতে হতো। আমাদের মিফতা ভাই তখন হাতে আকাশে চাঁদ পেয়ে গিয়েছিল। আগে যাও অফিস করতে বের হতেন তখন থেকে সেটাও অফ। এরপর থেকে ভাইয়া আরো বেশি ঘরের ভেতর বন্ধী হয়ে পড়েন। অফিসে রোজ যায়না নিজেদের কোম্পানী বলে তার এইদিক থেকে খুব ফায়দা হয়। মিফতা ভাইয়ের বই পড়ার খুব শখ। কয়দিন পরপরই বই কিনেন। আমাকেও কিনে দেন। উনি আমাকে খুব স্নেহ করেন। আমার বড় ভাই থাকলেও হয়তো এমন করতেন। আমি বুঝিনা খালামণি আমাদের এত সুন্দর সম্পর্কটাকে জটিল করতে চায় কেন? আমি মাঝেমাঝে ভাবতে থাকি যে আমার আর মিফতা ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে। আমরা ঘনিষ্ঠ হলাম, আমার গর্ভে তার সন্তান এলো। এসব ভাবতেই গায়ে কাঁটা দেয়। ছিঃ ভাবতেই তো কেমন লাগে! সত্যি হলে না জানি কি বাজে একটা পরিস্থিতি তৈরি হবে? নিতুন আপু মিফতা ভাইকে ভালোবাসেন। আমাকে মুখে কিছু বলেননি তবে আমি বুঝতে পারি। এইযে রোজ রোজ বই আনায় আমাকে দিয়ে সেগুলো ফেরত দেওয়ার সময় বইয়ের ভেতর রঙিন কাগজ কেন রাখে? আমি কী বুঝিনা সেগুলো কী? সেগুলো তো চিরকুট। প্রেমময় চিরকুট। সেইখানে কী থাকে আমি জানিনা, আমি কখনো সেগুলো ছুঁয়েও দেখিনি, তবে ভেতরে কী কথা থাকতে পারে আমি জানি। সেখানে কেবল প্রেম প্রেম কথা থাকে। ইশ! আমি কাউকে এমন প্রেম প্রেম চিরকুট কেন লিখতে পারিনা? আমার কি প্রেম প্রেম চিরকুট লেখার সাধ হয়না! হয়তো, খুব করে হয়। কিন্তু চিরকুট লেখার মানুষ নেই যে তাই লিখতে পারিনা।
বিকেলে আসরের নামাযটা পড়ে একটু ঘুমাতে গেলাম। জানি এটা ঘুমানোর সঠিক সময় না তবুও আমার কেন যেন এই সময়ে ঘুমাতেই বেশি ভালো লাগে। আমি তখন সবে চোখ বন্ধ করলাম ওমনি আমার দরজায় জোরে জোরে কেউ বারি মারে। ব্যাস! মেজাজ চটে গেল খুব করে। উঠতে উঠতেই চিৎকার করে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দরজা খুললাম। দেখি মৃদুল ভাই চোখ গরম করে আমার দিকে তাঁকিয়ে আছেন। আমি তো হা হয়ে গেলাম। এই পাজি লোকের তো আরো ছয়দিন পর আসার কথা ছিল। প্রথম রমজানে। তবে এত তাড়াতাড়ি এলো কেন? এলোই যখন আমার দরজায় বারি দিল কেন? কি চাই তার!
#চলবে!
#কাননে_এত_ফুল (পর্ব-১)
লেখক– ইনশিয়াহ ইসলাম।
(একটু লেখার মুড চেঞ্জ করলাম। সিন্ধুর নীল এখন একটু অলসতা করে লিখছি। কারণ কাহিনি থেকে একটু সরে গিয়েছি তাই। নিজের মুড আর লেখার আনন্দ আনতেই নতুন লেখা আনলাম। বেশি বড় হবে না আবার ছোটও হবেনা। এই রমজান মাস চলে যাবে কোনোরকমে। আশা করছি সাপোর্ট করবেন। গল্পের নাম রবি ঠাকুরের গীতবিতান থেকে নিলাম।)