নব_প্রেমের_সূচনা #Sumaiya_Akter_Bristy #পর্ব_৪৪

0
767

#নব_প্রেমের_সূচনা
#Sumaiya_Akter_Bristy
#পর্ব_৪৪

রাত হওয়া সত্বেও বাড়িতে এখন রমরমা পরিবেশ বিরাজ করছে। কিছু লোক বাড়ির লাইটিং এ ব্যাস্ত। ফলস্বরূপ বাহিরে দারুন কোলাহল সৃষ্টি হয়ে আছে। আর তাই কানে ইয়ারফোন গুজে ফুল ভলিউমে গান শুনে চলেছে আরভী।
হঠাৎ দরজা খুলে কেউ ভেতরে প্রবেশ করলে আরভী সেদিকটায় তাকায়। দেখতে পায় ম্যানেজমেন্টের একজন স্টাফ হাতে জুসের ট্রে নিয়ে আরভীর ঘরে প্রবেশ করেছে। মুখের সামনে ট্রে ধরে আছে বিধায় আরভী লোকটার মুখ দেখতে পারছে না। তবে এভাবে হুট করে অনুমতি না নিয়েই ঘরে প্রবেশ করার জন্য আরভী কান থেকে ইয়ারফোন খুলে ঝাঝালো স্বরে শুধালো,”উইথ আউট পারমিশন আপনি আমার ঘরে এলেন কি করে? এর জন্য আপনার জবটাই চলে যেতে পারে তা কি আপনি জানেন?”

“আপনার জন্য আমি আমার জব অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি ললনা। তাই আমার আর জব হারানোর ভয় নেই।” কথাটি বলে সমুদ্র মুখের সামনে থেকে ট্রে’টা সরালো।

এদিকে সমুদ্রকে দেখেই আরভী হকচকিয়ে উঠলো। সমুদ্র কি করে বাড়িতে প্রবেশ করলো তা বুঝতে পারলো না। আরভী তো এবার বেশ কড়া সিকিউরিটির ব্যবস্থা করেছে। তাও কিভাবে ভেতরে এলো?

“আপনি? বাড়িতে প্রবেশ করলেন কিভাবে?”

“সে অনেক লম্বা কাহিনি। আপাতত বলার মুড নেই।” বলে আরভীর বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়লো সমুদ্র। সমুদ্রকে দেখে মনে হচ্ছে বড্ড ক্লান্ত ছেলেটা। সারাদিন হয়তো কিছু মুখে তুলে নি। চোখ-মুখ একদম শুকিয়ে গেছে।

সমুদ্রকে বিছানায় শুতে দেখে আরভী তড়িৎ গতিতে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ঝাঝালো স্বরে শুধালো,”কেন এসেছেন?”

“আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি ললনা। আর পারছি না এই দূরত্ব মেনে নিতে।” মলিন স্বরে বললো সমুদ্র।

“এখন’ই এই অবস্থা? যখন আমার বিয়ে হয়ে যাবে তখন কি হবে আপনার?”

“তাই তো বলছি, একটু রহম করুন আমার উপর। একটু মোহ-মায়ার দৃষ্টিতে তাকান আমার দিকে। আমার ভেতরকার উথাল-পাতাল একটু বুঝার চেষ্টা করুন।” এ কথাগুলো বলতে বলতে শুয়া থেকে উঠে বসলো সমুদ্র।

“ভালোবাসা মানে ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পাওয়া নয় সমুদ্র। ভালোবাসা মানে ভালোবাসার মানুষটাকে ভালো থাকতে দেওয়া। এখন আপনি যদি সত্যিই আমাকে ভালোবেসে থাকেন তবে আশা করছি আমার বিয়েতে কোনো প্রকার অনাচার সৃষ্টি করবেন না।”

“এ কেমন অগ্নিপরীক্ষায় ফেললেন আমায়! না পারছি কিছু করতে আর না পারছি এই দহন সইতে।”

“আপনার জন্য এখন আমার সত্যি মায়া হচ্ছে সমুদ্র। একদিনেই এ কি হাল হয়েছে আপনার! সারাদিন কিছু খান নি?”

সমুদ্র শব্দ করে হেসে উঠলো আরভীর এ কথায়। প্রাণহীন এ হাসি। সমুদ্রকে দেখে মনে হচ্ছে জোর করে হাসছে সমুদ্র।

হাসি থামিয়ে সমুদ্র এবার উঠে দাঁড়ালো। আরভীর সামনে গিয়ে চোখে চোখ রেখে বললো,”খুব হাসি পাচ্ছে আমার এ অবস্থা দেখে তাই না? সে জন্যই তো কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিচ্ছেন।”

“না না, সত্যি বলছি আমি। আপনাকে দেখে সত্যিই মায়া লাগছে আমার।”

“এতোই যখন মায়া লাগছে তখন আমাকে বিয়ে করে নিন না ললনা! আমি পুরানো সব কিছু ভুলে যাবো। আপনিও ভুলে যান। প্লিজ ললনা, একটু অনুগ্রহ করুন আমার উপর। চলুন না দুজন মিলে সুন্দর এক সংসার গড়ি। যেই সংসারে সুখ ব্যাতিত দুঃখের কোনো ছায়া থাকবে না। যে সংসারে আলো ব্যাতিত আধারের কোনো মায়া থাকবে না।”

কি স্বচ্ছ আবদার সমুদ্রের! মায়া মাখা সব কথা। তবুও আরভী সমুদ্রের কথায় সম্মতি জানালো না। উল্টো রাশভারি স্বরে বললো,”আবেগ সায়রে ভেসে বেড়াবেন না সমুদ্র। বাস্তবে ফিরে আসুন।”

আরভীর কথায় সমুদ্র মলিন হেসে বললো,”জানেন ললনা, এই আট বছরে একটা কথা বেশ ভালো ভাবে বুঝতে শিখেছি।”

“তা কি শিখেছেন আপনি?” কৌতুহলী চোখে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে এ প্রশ্ন করলো আরভী।

“প্রেম বিষ সমতুল্য। যা গ্রহণ করা মানে মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়া।”

সমুদ্রের কথায় আরভী চমৎকার হেসে বললো,”প্রেমে তো পড়েছিলেন। তারমানে বিষও পান করেছেন। তবুও তো আমার সামনে জীবিত দাঁড়িয়ে আছেন। মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়া হলো কি করে?”

“এ বিষ যে সাধারণ কোনো বিষ নয়, এ বিষকে বলা হয় প্রেম বিষ। এ বিষে দেহের মৃত্যু না ঘটলেও মনের মৃত্যু ঠিকি ঘটে।”

সমুদ্রের প্রতিত্তোর আরভী কিছু বলতে পারলো না। কেবল সমুদ্রের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো ।

আরভীকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সমুদ্র আরভীর দু বাহু হালকা করে চেপে ধরে কপালে কপাল ঠেকিয়ে পুনরায় বললো,”এ বিষ গ্রহণ করলে ভেতরে অসহ্য যন্ত্রণা হয়, ছটফট করে মনটা। স্বস্তি খুঁজে বেড়ায় পাগলপ্রায় হয়ে। কিন্তু স্বস্তি মেলে না। পরিশেষে সেই যন্ত্রণা সহ্য করতে শিখে যায় মনের মৃত্যুর মাধ্যমে।”

সমুদ্রকে এতো কাছাকাছি দেখে আরভী নিজের চোখ যুগল বন্ধ করে নেয়। বৃদ্ধি পায় আরভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের হার।

“বলেছিলাম আপনি আমার নন তো কারো নন। ফিরিয়ে নিলাম এ কথা। আপনি সুখে থাকুন, ভালো থাকুন। এখন থেকে এটাই আমার শেষ চাওয়া।” বলে আরভীর দু বাহু ছেড়ে দেয় সমুদ্র। আরভী এখনো চোখ বন্ধ করে আছে। সমুদ্র আরভীর কপালে হালকা ভাবে নিজের ওষ্ঠ ছুইয়ে দূরে সরে যায়। মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে বলে,”ভালোবাসি, খুব বেশি ভালোবাসি।”

——–

কাল সারা রাত ঘুমোয় নি সমুদ্র। ঘুমোবে’ই-বা কি করে? তিনদিন পর যে আরভীর বিয়ে। তিনদিন পর থেকে আরভীর উপর আর কোনো প্রকার জোর খাটাতে পারবে না সমুদ্র। তিন দিন পর আরভীর দিকে মোহনীয়-ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকাতে পারবে না।
এখন বাজে সকাল দশটা। সমুদ্র এখনো ঘর থেকে বের হয় নি। ঘুমের ভান ধরে নিজের বিছানায় শুয়ে আছে। সমুদ্রের ভেতরে যে ঝর বইছে তা পরিবারের কাউকে বুঝতে দিতে চায় না সমুদ্র। থাকুক না কিছু যন্ত্রণা একান্ত সমুদ্রের হয়ে!

বাহিরে নোমান আহমেদ, ইয়াসমিন ও নিলু চিন্তিত হয়ে বসার ঘরে বসে আছে। আর একটু পর পর সমুদ্রের ঘরের দরজার দিকে তাকাচ্ছে। কেননা উনারা সবাই জানেন সমুদ্র ভালো নেই। একদম’ই ভালো নেই। সমুদ্রকে নিয়ে বড্ড চিন্তা হচ্ছে সবার। অথচ কেউই কিছু করতে পারছেন না। মাঝেমধ্যে না চাইতেও পীড়িত মানুষদের একটু একাকী থাকতে দিতে হয়। তাদের যন্ত্রণা অনুভবের সুযোগ দিতে হয়। এতেই হয়তো সবার ভালো লুকিয়ে থাকে। তা ভেবেই নোমান আহমেদ, ইয়াসমিন ও নিলু চুপচাপ বসে আছে। কিন্তু ইয়াসমিন বেশিক্ষণ চুপচাপ বসে থাকতে পারলেন না। মায়ের মন তো! ছেলেকে কি করে এরকম কষ্টে জর্জরিত হতে দেখতে পারেন? তাই তো নোমান আহমেদকে উদ্দেশ্য করে বললেন,”শুনুন না, আমার বড্ড ভয় হচ্ছে ছেলেটাকে নিয়ে। আমি বরং বাবুকে একটু দেখে আসি।”

“নাহ, তার কোনো প্রয়োজন নেই। সমুদ্রকে একটু একা থাকতে দাও। জীবনের কিছু হিসেব-নিকেশ বুঝে নিতে দাও।” নোমান আহমেদ ইয়াসমিনকে বাঁধা দিয়ে বললেন।

নোমান আহমেদের বাঁধা পেয়ে ইয়াসমিনও আর কিছু বললেন না। চুপ করে বসে রইলেন বসার ঘরে।

কিছুক্ষণ পর’ই সমুদ্রের মোবাইলটা শব্দ করে বেজে উঠে। সমুদ্র মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো আরভী কল করেছে। সমুদ্র বুঝতে পারলো না আরভী কেন সমুদ্রকে কল করেছে। মনের ভেতরকার কৌতুহল দমন করতে সমুদ্র কলটা রিসিভড করে কানে ধরতেই আরভীর মিহি কন্ঠ সমুদ্রের কানে ভেসে এলো।

“হ্যালো সমুদ্র! আপনি কি ফ্রি আছেন?”

“হুম, কেন? কোনো প্রয়োজন ছিলো?” মলিন স্বরে প্রতিত্তোর করে সমুদ্র।

“হ্যাঁ ছিলো তো। জলদি জারা শপিং মলের সামনে চলে আসুন।”

“এখনি?”

“হ্যাঁ এখনি। আমি অপেক্ষা করছি কিন্তু।”

“আচ্ছা আমি আসছি।” বলে কল কাট করে দিলো সমুদ্র। হঠাৎ শপিং মলের সামনে কেন ডাকলো আরভী? সমুদ্রকে পুড়াতে? সমুদ্রকে সাথে নিয়ে বিয়ের শপিং করতে? মনে মনে এসব ভেবে মিনিট দুয়েক চুপচাপ বসে রইলো সমুদ্র। তারপর উঠে চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে নিলো। গায়ে শার্ট পড়ে ঘর থেকে বের হলো জারা শপিং মলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।

সমুদ্রকে হঠাৎ ঘরের দরজা খুলতে দেখে সবার দৃষ্টি যায় সমুদ্রের ঘরের দরজার দিকে।
সমুদ্রকে বের হতে দেখে ইয়াসমিন সমুদ্রের কাছে যেতে যেতে বললেন,”বাবু তুই বস, আমি তোর জন্য খাবার বাড়ছি।”

“খাবো না মা, একজায়গায় যেতে হবে।” সমুদ্র তাড়া দেখিয়ে বললো।

“কিন্তু বাবু তুই কাল রাতেও কিছু খাস নি।”

“এসে খেয়ে নিবো।”

“তুই ঠিক আছিস তো বাবু!”

“হুম।” বলে সমুদ্র সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। আর ইয়াসমিন চুপচাপ সমুদ্রের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলেন। নোমান আহমেদ বা নিলুও কিছু বললো না সমুদ্রকে।

জারা শপিং মলের সামনে যেতে বিশ মিনিট সময় লাগলো সমুদ্রের। সমুদ্র সেখানে পৌছে আরভীকে কোথাও খুজে পেলো না। এছাড়া আরভী চাইলেই পাঁচ-দশটা সাধারণ মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। হয়তো আশেপাশেই লোকজনের আড়ালে রয়েছে। তা ভেবেই আরভীকে কল করতে নেয়। কিন্তু তার আগেই ফায়াজ এসে বলে,”আমার সাথে চলুন।”

সমুদ্র কিছু না বলে মাথা উপর-নিচে নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। তারপর ফায়াজের পিছু পিছু চলতে আরম্ভ করে।

মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ফায়াজ সমুদ্রকে আরভীর কাছে নিয়ে যায়। একটা শাড়ির দোকানেই আরভী বসে ছিলো। সাথে ছিলো পিয়াস। যে কিনা বসে বসে কফি খাচ্ছিলো।

সমুদ্র পিয়াসের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালে পিয়াস এর বিনিময়ে দাঁত কেলিয়ে সুন্দর এক হাসি উপহার দেয় সমুদ্রকে। অতঃপর সমুদ্র পিয়াসের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আরভীর দিকে তাকায়। আর জিজ্ঞেস করে,”আমাকে এখানে কেন ডেকেছেন?”

সমুদ্রের ধারণা সত্যি করে দিয়ে আরভী বলে উঠে,”আসলে আমরা দু’জনেই বেনারসির রঙ নিয়ে বিভ্রান্তিতে ভুগছিলাম। তাই ভাবলাম আপনাকে ডেকে নেই। এছাড়া আমার ফিয়ন্সির গায়ে হাত তুলে আপনি এখনো তাকে সরি বলেন নি। আর এটা আমার একদমই ভালো লাগছে না।”

সমুদ্র গভীর শ্বাস টেনে পিয়াসের সামনে এসে দাঁড়ায়। পিয়াসের দিকে তাকিয়ে মলিন কন্ঠে বলে,”সরি।”

“এইরকম শুকনো সরি দিয়ে আমি কি করবো?” প্রতিত্তোরে পিয়াস বলে।

“শুকনো সরির সাথে যে আমি আমার জীবনের প্রথম ও শেষ ভালোবাসা তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি তা দেখলে না?”

“এ কথা বলে কি বুঝাতে চাইছো?”

“কিছু না, ছাড়ো এসব। তোমরা এনজয় করো। যেই কাজের জন্য আমাকে এখানে ডাকা হয়েছিলো সেই কাজ শেষ। এখন আমি যাই।”

সমুদ্র নিজের কথা শেষ করে আরভীর প্রথম কথাটি এড়িয়ে চলে যেতে চাইলে আরভী সমুদ্রকে বাঁধা দিয়ে দ্রুত গতিতে বলে উঠে,”কিন্তু সমুদ্র বেনারসির রঙটা?”

সমুদ্র থেমে যায়। কিছু না বলে চুপচাপ আরভীর পাশে গিয়ে বসে। আস্তে করে বলে,”আমাকে জ্বালিয়ে মজা লুটছেন?”

“অনেক। সেজন্যেই তো এরকম সুবর্ণ সুযোগ হাত ছাড়া করতে ইচ্ছে করছিলো না।” আরভীও আস্তে-ধীরে কথাটি বললো সমুদ্রকে যেনো কারো কানে না যায়।

“আপনি বরং এই লাল রঙের বেনারসিটাই পড়ুন বিয়েতে। আমার বুকে রক্তক্ষরণ করে আপনি নতুন করে জীবন শুরু করতে যাচ্ছেন। এই লাল রঙটা না হয় সে কথার’ই সাক্ষী থাকুক!”

চলবে….

বি.দ্র. : পরবর্তী পর্বে সমাপ্তি ঘটবে। আপনারা প্রস্তুত তো? এন্ড একটা অনুরোধ রইলো সবার কাছে। যেহেতু এতোদিন আমার অদক্ষ হাতের গল্পটা পড়েছেন সেহেতু কষ্ট করে সমাপ্তি পর্বটা পড়ে নিবেন। ধন্যবাদ সবাইকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here