মৃগতৃষ্ণা #পর্ব:২

0
533

#মৃগতৃষ্ণা
#পর্ব:২

কবিরাজকে একান্তে ডেকে সুলায়মান কিছু কথা বললেন। যা শুনে কবিরাজ ভীষণ রেগে গেলেন আর বললেন – কিহ! কচি ছাগলের কলিজা দিয়ে আমার ঔষধ সেবন করিয়েছেন!!??
এই কাজ আপনি কেমনে করলেন বড় বাবু বলেনতো?? আপনাকে আমি আগেই সাবধান করেছিলাম যে আপনি এই চিকিৎসা করাতে পারবেন না তবুও আপনি জোড় করে আমাকে দিয়ে এত সব সাধনার কাজ করালেন, সবই এখন বৃথা গেলো।

সুলায়মান মুখটা মলিন ও করুন কন্ঠে বলে উঠলো কবিরাজ মশাই আমি অনেক বড় ভুল করেছি সেটা আমি জানি কিন্তু দয়া করে আপনি এর একটা সমাধান দেন তা নাহলে যে আমার বেগমকে বাঁচাতে পারবো না।
আপনার যা চাই তাই দেব তবুও কিছু একটা উপায় বের করুন কবিরাজ মশাই। ( কবিরাজের দুহাত জাপ্টে ধরে কথাগুলো বললো)

কবিরাজ আবার বলা শুরু করলেন যেহেতু আমি দেড় মাসের (৪৫ দিন) কথা বলেছিলাম তাহলে বাকি রইলো আর মাত্র ১৫ দিন কিন্তুুুউউউ আপনার করা ভুলের জন্য এই সাধনা আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। মানে আরও ৪৫টা বাচ্চার কলিজা খা*ওয়াতে হবে আপনার বেগমকে।

সুলায়মান নিজই নিজের কপাল চাপড়াতে লাগলো। সে কিভাবে করলো এই ভুল। আবার প্রথম থেকে শুরু করাটা সম্ভব নয় তাই সে কবিরাজকে আবার অনুরোধ করতে লাগলো দেখুন না কবিরাজ মশাই এর বিকল্প কোনো ব্যবস্থা করা যায় কিনা!!
কবিরাজ চুপ করে আছে, কিছু একটা ভাবছে তন্মধ্যেই সুলায়মান নিজের হাতে থাকা হীরার আংটি টা খুলে কবিরাজের হাতে তুলে দিল।
কবিরাজ নিজের হাতে সেই আংটিটা পড়তে পড়তে বললো হ্যা বড় বাবু একটা উপায় আছে বটে। তবে সেজন্য প্রয়োজন ৩টা বাচ্চার কলিজা তবে সেটা আজ রাতের মধ্যেই।
সুলায়মান জানালো তার পক্ষে তিনটে বাচ্চা একদিনে জোগাড় করা সম্ভব নয় যেখানে সে একটা বাচ্চাই জোগাড় করতে হিমশিম খায়।
কবিরাজ মশাই সেকথা চিন্তা করে বলে উঠলেন আজকের পর এই ভুল যেন ২য় বার না হয়। তাহলে কিন্তু আর আপনার বেগমকে বাঁচানো সম্ভব হবেনা। যদি কখনো আপনি বাচ্চার কলিজা জোগাড় করতে না পারেন তবে সেটা আমাকে প্রথমে জানাবেন, আমি ঠিক এর কোনো একটা ব্যবস্থা করতে পারবো, শুধু আমার দিকটা একটু ভেবে দেখবেন বড় বাবু।

সুলায়মান কবিরাজকে বললেন আমি আপনার এই ঋণ কোনোদিন হয়তো শোধ করতে পারবো না। তবুও বলছি আমি আপনাকে ঠিক খুশি করিয়ে দিবো।

কবিরাজ সুলায়মানকে জানালো যে সে ২টা বাচ্চার কলিজার জোগান দিতে পারবে আর বাকি ১টা বাচ্চার কলিজা সুলায়মানকে জোগাড় করে দিতে হবে।

কবিরাজকে বিদায় দিয়ে সুলায়মান জুলেখার কাছে গেলো জুলেখা কাতর হয়ে বিছানায় লেপ্টে আছে, কি অসহায় চাহনি তার। যার চোখে সুলায়মান সুখ খুজে পেতো সেই চোখ দু:খে ভরা সেটা সহ্য করার ক্ষমতা তার নেই। সুলায়মানের চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝড়ছে।
জুলেখাকে দেখে সে বেরিয়ে পরলো ছদ্মবেশ নিয়ে তার নিত্যদিনের গন্তব্যে। আজ কেন যেন কোনো বাচ্চাকে ধরতে গেলে তার বুকে ধরফর করছে। হাত পা কাঁপছে।
তবে পাতালঘরে রেখে আসা বাচ্চা মেয়েটাকে আর তার বেগমকে বাচাতে হলে তাকে আরেকটি বাচ্চাকে চুরি করতেই হবে। অবশেষে সে অনেক কষ্ট নিয়ে হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে সে একটি বাচ্চা চুরি করে নিয়ে গেলেন।
রাজবাড়ীতে ঢুকেই সুলায়মান জুলেখার কপালে চুমু খেয়ে পাতালঘরে ঢুকে জল্লাদকে দিয়ে বাচ্চাটাকে মে*রে তার কলিজা সংগ্রহ করে তুলে দিলেন কবিরাজের হাতে। সে আরও দুটো কলিজা নিয়ে এসেছেন সাথে করে। কবিরাজের সাধনায় ৩টে বাচ্চার কলিজা দিয়ে ঔষধ তৈরি করে রাধুনিকে দিয়ে রান্না করে খাওয়ার জন্য প্রস্তুত করলো।
জুলেখাকে আজ সুলায়মান নিজের হাতে খাওয়ালো, খেতেও কষ্ট হচ্ছে তার তবুও বাঁচার আকুতিতে সে সবটা খেয়ে নিলো। খাওয়ার পর পরই জুলেখার শরীর আস্তে আস্তে ভালো হওয়ার দিকে ধাবিত হচ্ছে।
সুলায়মানের চোখ মুখে আনন্দের আভা ফুটে উঠলো।
এবারের মতো সবটা তবে সামলে নেওয়া গেলো।

খুশি হয়ে কবিরাজকে সুলায়মান তার প্রিয় একটি সোনার অলংকার উপহার দিলো।
সুলায়মান পাতালঘরে প্রবেশ করলো জুলেখাকে ঘুম পাড়িয়ে। জল্লাদকে ডেকে বললো বাচ্চা মেয়েটি কোথায়??
— বড় বাবু মেয়েটা শুধু আপনার কথাই জিজ্ঞেস করছিলো, কি যে সুন্দর কইরা কথা কয়, জানেন আমার সে একটা নাম দিছে ” কালু”। আমি কালা তো তাই হয়তোবা।
সুলায়মান হাসলো আর বললো আমায় কি বলে ডাকে?
– আমারে বলে ওই বুড়ো দাদু কই? আমি তার কাছে যাবো।
এবার সুলায়মান তো ছদ্মবেশ নেননি তাই তিনি ভাবলেন মেয়েটি যদি তাকে না চেনে তাই তিনি আবার ছদ্মবেশ ধারণ করলেন আর বাচ্চা মেয়েটির সামনে উপস্থিত হলেন। গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন – তোমার নাম কি সোনা?
– আ আমার নাম সোনা না তো “রূপা”। আর তোমার নাম কি বুড়ো দাদু??
সুলায়মান হেসে উত্তর দিল বাহ বেশ সুন্দর নাম তো তোমার পাকাবুড়ি। আমার নাম সুলায়মান। কিন্তু তুমি আমায় তোমার ইচ্ছেমতো নামে ডাকতে পারো।

— আচ্ছা তোমার নাম দিলাম ভালো দাদু।

সুলায়মানের চোখ মুখে হাসির ছায়া, – রূপা তোমায় একটা যাদুর খেলা দেখাই দাঁড়াও, এই বলেই ছদ্মবেশ খুলতে খুলতে বলল দেখোতো কেমন যাদু দেখালাম।

রূপা অবাক হয়ে চেয়ে আছে সুলায়মানের দিকে এ তো যেন রাজপুত্র দেখছে সে।
আসলেই সুলায়মান রাজ বংশীয় ছেলে। তার পিতামহ ছিলেন একজন রাজা আর ১০টি রাজ্য ছিলো তার অধীনে। তিনি এমন এক শাসক ছিলেন তার হুংকারে অন্য রাজারা কাপতেন। সুলায়মানের বাবার সময়কালে রাজত্ব প্রথা বিলুপ্ত হতে থাকে। আর অন্য রাজ্যের শাসক রাজা হিসেবে নির্বাচিত হন। সুলায়মান ও তার ছোট ভাইকে রাজবংশীয় ছেলে বলেই চেনেন বিভিন্ন গ্রামের মানুষ। এখনও অবশ্য সুলায়মান রাজা না হলেও তার চেয়ে কম নয় তার কথায় চলে এমন ৮-১০টি গ্রাম প্রধান। কোনো সমস্যা বা সিদ্ধান্ত নিতে বড় বড় ক্ষমতা বান লোকেরা আসেন রাজবাড়ীর সুলায়মানের কাছে।
রূপাকে পাতালঘরে রাখাটাই সবচেয়ে নিরাপদ। কেননা পাতালঘরে জল্লাদ আর সুলায়মান ছাড়া অন্য কারো প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। এমনকি জুলেখা ও কোনোদিন পাতালঘরে পা রাখেনি।
সুলায়মানের বিয়ে হয়েছে ২০ বছর তবে এখনো কোনো সন্তান হয়নি তাদের। সুলায়মানের খুব ইচ্ছে ছিল তাদের একটা পরীর মতো রাজকন্যা হবে। কিন্তু সেটা আর হয়নি।
রূপাকে সুলায়মান জিজ্ঞেস করলো- তোমার বাড়িতে কে কে আছে রূপা?
— আমার সবাই আছে শুধু মা নেই গো রাজপুত্র।
সুলায়মান বলল- তোমার বাবা?
— বাবা আমায় তেমন ভালোবাসেনা আমার জন্য সৎ মা নিয়ে এসেছে কিন্তু সে আমাকে একটুও ভালোবাসে না বরং আমায় অনেক মা*রে যানো।
৬ বছরের বাচ্চা মেয়ের এমন দু:খের কথা সুলায়মানকে কাঁদিয়ে দিলো কারন তার ছোটোবেলায়ও তার মা মারা গেছেন তার ছোটো ভাইকে জন্ম দিতে গিয়ে।
সুলায়মান জিজ্ঞেস করলো তুমি কি তোমার বাড়িতে ফিরতে চাও রূপা?
— না না আমি যেতে চাইনা রাজপুত্র। আমায় তোমার কাছে রেখে দাও না গো।
— সত্যি বলছো??
— হ্যা গো রাখোনা আমায়। আমাকে তুমি যাদু দেখাবে আর আমি হাত তালি দিবো। হা হা হা হি হি হি

সুলায়মান মনস্থির করলো সে জুলেখা কে গিয়ে বলবে সে এই মেয়েটাকে তাদের মেয়ে বলে স্বীকৃতি দিতে চায়। আবার ভয়ও হয় যদি জুলেখা রাজি না হয় তবে।
পাতালঘর থেকে বেরিয়ে সুলায়মান গেলো জুলেখার কাছে —
বিছানা থেকে উঠে বসে পরল জুলেখা আর বলল – কি জনাব! ভেবেছেন আমি মরে যাবো??
সুলায়মান মুখ চেপে ধরে আর বলে চুপ করো! এ কথা ভাবার বা মনে আনার মতো দুঃসাহস আমার নেই বেগম।
জুলেখা মুখ থেকে হাত ছাড়িয়ে বলল আমি জানি আপনি আমায় মরতে দেবেন না। আপনার ভালোবাসাই আমাকে আজীবন বাচিয়ে রাখবে, আমি ছাড়া আপনার অস্তিত্ব অর্থহীন, তা আমি বেশ বুঝতে পারি।

সুলায়মান তার বেগমের দুটো হাত শক্ত করে তার হাতে আবদ্ধ করে বলল আমি তোমার কাছে একটা জিনিস চাইবো বেগম, তুমি দেবে আমায়??
জুলেখা অবাক চাহনি নিয়ে জিজ্ঞেস করলো কি চান বলুন না জনাব?? আমি তো আপনার জন্য আমার প্রানটাও দিয়ে দিতে পারি।

— বেগম আমি একটা ফুটফুটে পরীর মতো রাজকন্যা চাই।!!

সুলায়মানের কথায় জুলেখার অবাক চাহনি ক্ষান্ত দিয়ে করুন চাহনি নিয়ে বললো আমায় ক্ষমা করবেন, আমি হয়তো তা আর কোনোদিনই পারবো না, যদি পারতাম তবে ২০ বছর আপনাকে সন্তানহীন থাকতে হতো না।

— আমি একটা পরীর মতো রাজকন্যা পেয়েছি বেগম, তুমি না করবে না বলো। আমি ওকে আমাদের সন্তানের স্বীকৃতি দিতে চাই। আমি কোনোদিন আর তোমার কাছে আর কিচ্ছু চাইবো না।।

জুলেখার চেহারায় এক অজানা রহস্যময় হাসি ফুটে উঠলো। সে বললো – আপনি আমার জন্য যা করছেন তার কাছে এই চাওয়া তো সামান্য। আমি আপনার কথায় রাজি।
সুলায়মান খুশিতে আত্মহারা, জুলেখাকে জড়িয়ে ধরলো তার বাহুতে।
রূপাকে জুলেখার সামনে উপস্থিত করা হলো, জুলেখা হা করে তাকিয়ে আছে এ যেন তাদেরই মেয়ে, মেয়ে হলে ঠিক এমন দেখতে হতো।

রূপা জুলেখাকে দেখে ভয়ে কাপছে। এত সুন্দর রমনীকে দেখে কেউ কখনো এভাবে ভয় পায়নি বরং বিস্মিত হয়েছে।

চলবে,,,,
#লেখা: মুন্নি ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here