প্রজাপতির_রং🦋
Part_19
#Writer_NOVA
রক্তচোখে তাজ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখের দিকে আমার তাকানোর সাহস নেই। আমাকে এখন বোধহয় খুনই করে ফেলবে।আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। তাজ খুব শব্দ করে দরজাটা লাগিয়ে আমার মুখোমুখি দাঁড়ালো।
তাজঃ রোশান দেওয়ানের সাথে তোমার কিসের সম্পর্ক? ওর সাথে এতো ঢলাঢলি কিসের?
তাজের এসব উল্টো পাল্টা কথা শুনে মাথায় চিনচিন করে রাগ উঠে গেলো।সবাই পেয়েছেটা কি?কোন ছেলের সাথে আমাকে দেখেলেই আজেবাজে মন্তব্য করছে।আমি কি এতটাই মূল্যহীন নাকি।মনের মধ্যে একটা ত্যাড়ামী ভাব চলে এলো।আমাকে এভাবে প্রশ্ন না করে অন্যভাবেও তো বলতে পারতো।আমি এখন কিছু বলবো না।
তাজঃ উত্তর দিচ্ছো না কেন? রোশান দেওয়ান কে হয় তোমার? ওর সাথে এক রুমে কি করছিলে? চুপ করে থাকবে না নোভা? আমার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে।
তার রাগ দেখে আমারো রাগ উঠলো।এত বছর খবর ছিলো না এখন এসে নজরদারি করা হচ্ছে। আমার খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে।তা এই ভালোবাসাগুলো আগে কোথায় ছিলো? আড়াই বছর আমি ঠিক কতটা কষ্ট করেছি তাতো শুধুমাত্র আমিই জানি।তখন আমার তার ভালোবাসার হাতের প্রয়োজন ছিল কিন্তু তখন তো আমি কাউকে পাইনি।আর এখন আড়াই বছর পর এসে আমার ওপর অধিকার দেখাচ্ছে। কিছু বলবো না আমি।দুই হাত মুঠ করে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছি।রাগের সময় আমার আবার কোন হুশ থাকে না। কাকে কি বলি, কি করি তার কোন কিছুই আমি জানি না।
তাজঃ কথার উত্তর দেও নোভা? চুপ করে থেকে আমাকে রাগিয়ো না।তাহলে কিন্তু এর ফল ভালো হবে না। এন্সার মি।
তাজ টেবিলের ওপর থেকে ফুলদানিটা দেয়ালে ছুঁড়ে মারতেই সেটা শব্দ করে ভেঙে এদিক সেদিক ছড়িয়ে পরলো।আমি কিছুটা চমকে উঠলেও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।এনাজ অল্প কিছুতে রেগে যাওয়ার মতো ছেলে নয়।এখন যেহেতু রেগে আছে তার মানে আমার খবর আছে। অন্য সময় হলে আমি ভয় পেতাম।কিন্তু এখন যেহেতু আমার নিজেরই রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে তাই ভয় পাওয়ার প্রশ্নই উঠে না।আমি আবার ছোটবেলা থেকে বিশ্ব ত্যারা।
তাজঃ তুমি চুপ করে এখনো কোন সাহসে আছো? আমার কথার উত্তর না দেওয়ার সাহস কোথা থেকে উদয় হলো তোমার? ও কি তোমার প্রেমিক?
আমিঃ রোশান দেওয়ান আমার যা খুশি তা হোক তাতে আপনার কি? কে হোন আপনি আমার?কোথা থেকে আপনি উদয় হয়েছেন? আমি তো আপনাকে চিনি না।আমার ওপর এত অধিকার খাটানোর সাহস আপনার কোথা থেকে আসে?
রাগে আমার শরীর থরথর করে কাঁপছে। তাজ তড়িৎ গতিতে আমার বাহু ধরে হেচকা টানে নিজের দিকে ঘুরিয়ে থুঁতনি ধরে আমার মুখ উঠালে।
তাজঃ কি বললে তুমি?
আমিঃ কেন আপনি শুনতে পাননি? ছাড়ুন আমায়।আমাকে স্পর্শ করার কোন অধিকার আপনার নেই। ডোন্ট টার্চ মি।
তাজঃ এতকিছুর পরেও কি তোমাকে আমার খোলসা করে বলতে হবে আমি তোমার স্বামী এনাজ।আমি তোমার এনাজ।
আমি এক ঝাটকায় তার হাত ছাড়িয়ে হাত তালি দিতে দিতে বললাম।
আমিঃ ওয়াও, ওয়াও মিস্টার তাজরান তাজওয়ার। এখন নিজের মুখেই কথা পাল্টে ফেললেন।আপনি কিন্তু প্রথমদিন আমায় বলেছিলেন আপনি তাজ, এনাজ নয়।আপনি সত্যি আমার এনাজ নন।আমার এনাজ কখনও এমন করতে পারতো না। আমার এনাজ সেদিনই মারা গেছে। এখন যে আমার সামনে দাড়িয়ে আছে সে হলো এই কোম্পানির ওনার তাজরান তাজওয়ার। যাকে আমি চিনি না। আমার এনাজ কখনো আমাকে ছেড়ে আড়াই বছর নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারতো না। আমাকে একা ফেলে চলে যেতো না।অন্য ছেলের সাথে দেখলে এরকম ব্যবহার করতো না। সো, ডোন্ট ক্রশ ইউর লিমিট।
তাজঃ আমিই তোমার এনাজ।(অসহায় মুখে)
আমিঃ আমি বিশ্বাস করি না।আমার এনাজ মারা গেছে। আপনি শুধু আমার অফিসের বস।
তাজঃ তুমি তো প্রথমদিনই আমাকে চিনে গিয়েছিলে।তারপরেও কেন এখন অস্বীকার করছো?
আমিঃ আমি তো ভেবেছিলাম চেহারা পাল্টে গেছে তো কি হয়েছে মানুষটাতো পাল্টায়নি।কিন্তু আমার ধারণা ভুল।এর মধ্যেও সে আমার খোজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি।আমি কোথায় আছি,কি করছি, কি খাচ্ছি তার খবর নেওয়ার গুরুত্ব সেই মানুষটার নেই। আমিই বেহায়ার মতো তার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছি।
তাজ অসহায় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। ওর চোখ দুটো ছলছল করছে।আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম।এর দিকে তাকালে এখন ইমোশনাল হয়ে যাবো।শত হোক আমার স্বামীতো।এত সহজে আমার অভিমানের পাহাড় ভাঙ্গবে না।আমি ছোট বাচ্চা ছেলেটাকে নিয়ে তো কম কষ্ট করিনি।সমাজের বিভিন্ন মানুষের কথায় মনটা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যেতো।তাও ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সব মুখ বুজে সহ্য করে নিতাম।সপ্তাহ খানিক আগেও তো নিজের চরিত্র সম্পর্কে বাজে কথা শুনতে হয়েছে। সে থাকলে কি কেউ এসব বলার সাহস পেতো।সমাজে সিঙ্গেল মাদারদের যে কতকিছু সহ্য করে বেঁচে থাকতে হয় তা সে বুঝবে কি করে? যখন বৈধ ছেলেটাকে জারয সন্তান বলে তখন একটা অসহায় মায়ের বুকটা যে কি করে ফাটে তা সে বুঝবে কি করে? দিনরাত এক করে কোলে,পিঠে করে বাচ্চাটাকে বড় করেছি।সে থাকলে তো আমার জীবনটা সুন্দর হতো।কিন্তু তখন সে লাপাত্তা ছিলো।তার জন্য নিজেকে সাদা রঙে রাঙিয়ে নিয়েছি।তার স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে আছি।তার সন্তান মানুষ করছি।আর সে এখন এসেছে দরদ দেখাতে।লাগবে না আমার কাউকে।
তাজঃ তুমি আমাকে এসব বলতে পারলে?
আমিঃ হ্যাঁ পারলাম।আরো কোন কথা আছে? যদি থাকে জলদী বলে ফেলুন।আমি আর আপনার কোম্পানিতে চাকরীটা করছি না।আপনার মুখটা আমি দেখতে চাই না।মুখও পাল্টে গেছে, মানুষটাও পাল্টে গেছে। আমি সত্যিই একটা বোকা।নয়তো এমন একটা মানুষের জন্য নিজের জীবন নষ্ট করতাম না।
ভেতর থেকে কান্না দলা পাকিয়ে গলার কাছে এসে আটকে গেছে। তাজের চোখ দিয়ে পানি পরছে। আমি নিজের চোখ দুটো নামিয়ে নিলাম।তাজ আমাকে ছেড়ে দূরে সরে গেলো।আমি জানি তাজ কাঁদছে। আমার কথায় সে অনেক হার্ট হয়েছে।কিন্তু এই কথাগুলো বলার প্রয়োজন ছিলো।আমি ধীর পায়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলাম।তাজ অন্য দিকে ঘুরে তাকিয়ে রইলো।এখানেও সে ইগো দেখালো।একবার আমাকে জড়িয়ে ধরে যদি বলতো আমাকে সবকিছুর জন্য মাফ করে দেও।তাহলে কি আমি করতাম না।সে কি জানে না তার সাথে আমি রাগ করে থাকতে পারি না।সে তো জানে আমি অনেক অভিমানী মেয়ে। আড়াই বছর ধরে তার প্রতি জমে থাকা অভিমান কি এত সহজে গলে যাবে? কিন্তু সে সব ভুলে আমাকে কাছে টেনে নিলে কি আমি ফিরিয়ে দিতাম? সে তো আমার বাচ্চার বাবা।নাভানের জন্য হলেও তো তাকে আমার প্রয়োজন। সেটাও সে বুঝলো না।বরং আমাকে দূরে সরিয়ে দিলো।আমি আসবো না তো তার কাছে।থাকুক সে এভাবেই। লাগবে না আমার তাকে। এই চাকরীটাও আমি করবো না।
🦋🦋🦋
নিজের ডেস্কের সামনে এসে চুপ করে চেয়ারে বসে পরলাম।মাথাটা ঘুরছে।সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত।আমি দুই হাতে মাথায় চেপে কিছু সময় আগের কথা মনে করতে লাগলাম।যার কারণে এতকিছু ঘটলো।
ফ্লাশব্যাক………..
নিজের কেবিনের দিকে যাচ্ছিলাম।তখুনি এক জোড়া হাত এসে হেচকা টানে আমাকে একটা রুমে নিয়ে গেল।আমি চিৎকার করতে নিলেই একটা বলিষ্ঠ হাত এসে আমার মুখ চেপে ধরলো।আমি সামনের ব্যাক্তিটার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই চমকে উঠলাম।ততক্ষণে সে আমার মুখ ছেড়ে দিয়েছে।
আমিঃ রোশান আপনি????
রোশানঃ হ্যাঁ আমি।
আমিঃ আপনি এখানে কি করছেন?
রোশানঃ আমারো সেম প্রশ্ন। তুমি এখানে কি করছো?
আমিঃ আমি এই অফিসে নতুন জয়েন করেছি দুই দিন আগে।
রোশানঃ ওহ আচ্ছা। আমি আজ এই অফিসে একটু কাজে এসেছিলাম।মুরাদ সাহেব আমার খুবই ক্লোজ। শুনলাম তার বড় ছেলে শেয়ার ব্যবসা শুরু করবে।যার জন্য আমাকে তার ছেলের সাথে একটু কথা বলতে বলেছিলো।আমার ছোট চাচ্চু আবার শেয়ার বিজনেস আছে অনেক।ছোট চাচ্চুর সাথে এসেছি।
আমিঃ আপনারাই তাহলে গেস্ট হিসেবে এসেছেন।আমি ভাবলাম কে না কে? কিন্তু আমাকে এভাবে এখানে আনার মানে কি?
রোশানঃ হুট করে তোমাকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।তোমার সাথে কিভাবে কথা বলবো তার উপায় খুঁজছিলাম।তোমাকে ডাকলে তো কথা বলতে না।তাই এভাবে নিয়ে এলাম।
আমিঃ আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম।কেউ এভাবে কাউকে হেচকা টান দেয়।
রোশানঃ সরি পাখি।অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। মাফ করে দেও।
রোশান কান ধরে ইনোসেন্ট ফেস করে আমাকে কথাগুলো বললো।ওর বলার ভঙ্গি দেখে আমি ফিক করে হেসে উঠলাম।ছেলেটা পুরো পৃথিবীর কাছে এক আর আমার কাছে আরেক। একে দেখলে আমার রাগ উঠলেও মাঝে মাঝে এর কান্ড দেখে ভীষণ ভালো লাগে। দুজন রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম। একসাথেই হাঁটছিলাম আর টুকটাক কথা বলছিলাম।আসলে রোশানই কথার ঝুলি খুলেছে। আমি মাথা নেড়ে শুধু হু হা করছি।হঠাৎ পা বাঁকিয়ে জুতা উল্টে পরতে নিলেই রোশান আমার বাহু ধরে ফেললো।
রোশানঃ ঠিক আছো তুমি? কোথাও লাগেনি তো?
আমিঃ আমি ঠিক আছি।
রোশান আমাকে সোজা করে দাঁড়া করাতেই আমার চোর গেলো সামনের দিকে। তাজ তীক্ষ্ম চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম তাজের চোখটা রোশানের হাতের দিকে।কারণ রোশান তখনও আমায় ধরে ছিলো।রাগে গটগট করে তাজ ওর কেবিনে চলে গেল।ঘন্টাখানিক পর রোশান চলে যেতেই আদর এলো।আমি তখন নিজের ডেস্কে কাজ করছিলাম।
আদরঃ স্যার আপনাকে ডেকেছে ম্যাম।
আমিঃ আসছি।
আমি আগে থেকেই জানতাম আমাকে তলব করা হবে। তার জন্য মানসিক প্রস্তুতিও নিয়ে নিয়েছি।কিন্তু তারপরেও ভয় করছিলো।কিন্তু তার ঐসব উদ্ভট কথা শুনে আমারও রাগ উঠেছিলো।কেবিনে ঢোকার পর কি হয়েছে তাতো বললামই।
ফ্লাশব্যাক এন্ড……………
পরের সময়গুলো একদম অসহ্য গিয়েছে। কোন মতে কাজগুলো সেরে বাসার দিকে রওনা দিলাম।আজ শো করার মতো কোন মন-মানসিকতা নেই। বাসার দরজায় এসে কোলিং বেল বাজাতেই হিমি এসে দরজা খুলে দিলো।ওর সাথে সাথে নাভানও এসেছে।
হিমিঃ এতো তাড়াতাড়ি ফিরে এলি যে? আজ শো করবি না?
আমিঃ না।
হিমিঃ তোর কি শরীর খারাপ? তোকে এরকম কেন দেখাচ্ছে? মুখ, চোখ শুকনো,চোখ লাল হয়ে আছে।
আমিঃ কিছু হয়নি।
ওদের পাশ কাটিয়ে রুমে ঢুকে গেলাম।হিমি আমার পিছু না এলেও নাভান আমার পিছু ঠিকই এলো।কারণ অন্য দিন বাসায় এলে ওকে কোলে তুলে নেই।
নাভানঃ আম্মু, বাবা কই?
তড়িৎ গতিতে ওর সামনে এগিয়ে গিয়েই গালের মধ্যে কষিয়ে একটা চড় বসিয়ে দিলাম।নবাবজাদার আবার বাবার কথা মনে পরে গেছে। নাভান কিছু সময় ঠোঁট উল্টে জোরে কান্না করে উঠলো।
আমিঃ বাবার জন্য আদিখ্যেতা দেখানো হচ্ছে? সারাদিন খেটে মরি আমি আর তোমার দরদ হয় বাবার জন্য? আসতে না আসতেই শুরু হয়ে গেছে বাবার গুণগান গাওয়া।কই তোর বাবা তো একবারও তোর খবর নিলো না।একটি বার আমায় প্রশ্নও করলো না তুই কেমন আছিস? সে তো তোর কথা মনে করে না।তাহলে তুই কেন সারাদিন বাবার গান গাস?
নাভান গালে হাত দিয়ে কান্না করেই যাচ্ছে। তা দেখে কেন জানি আরো রাগ উঠে গেল।নাভানের কান্না আর আমার চিৎকার চেঁচামেচি শুনে হিমি ছুটে এলো।আমাকে একদফা বকে নাভানকে নিয়ে অন্য রুমে চলে গেল।আমি খাটে ধপ করে বসেই মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পরলাম।আমার জীবনটা তো এমন না হলেও পারতো?
#চলবে
তাজ আড়াই বছর কোথায় ছিল?তার বাচ্চার কথা কেন জিজ্ঞেস করে না, নোভার খোঁজ-খবর কেন নেয়নি তা সামনের পর্বগুলোতেই জানতে পারবেন। এছাড়া আরো কিছু জানার থাকলে জিজ্ঞেস করতে পারেন।আসলে আমার একার পক্ষে সবগুলো দিক মাথায় রেখে লিখা সম্ভব হয়ে উঠে না।আমি খুব ভুলো মনের মানুষ। তাই আপনারা যদি কিছু বলেন তাহলে লিখতে সুবিধা হয়।কোন কোন টপিকগুলো এখনো বুঝেননি তা একটু কষ্ট করে জানিয়ে দিবেন প্লিজ।এতে আমার লিখতে সুবিধা হবে।রি-চেইক দেওয়া হয়নি।ভুল-ভ্রান্তিগুলো ক্ষমার চোখে দেখেন।