#মৃগতৃষ্ণিকা-০৩
মশালের আলো নিভে যাওয়াতে থরথর করে কাপছে আদ্রিয়ান। ভয়ে তার অন্তর আত্মা পর্যন্ত কেঁপে উঠলো শুকনো ঢোক গিলে চোখ জোড়া বন্ধ করে খিচ মেরে রইলো কিন্তু ওর মনে হতে লাগলো যেন কোনো আলো জলজল করছে চোখের সামনে কিন্তু এখানে তো বিদুৎ নেই তাই আলো হওয়ার কথা মৃদু কিন্তু আদ্রিয়ান চোখ না খুলে আর পারছেনা সে আচমকাই চোখ জোড়া খুলে ফেললো চোখের সামনে এক বোরকা পরিহিত অপরূপ সুন্দর রমনীকে আবিষ্কার করলো তবে মুহুর্তেই রমনী ভয়ংকর রূপে আদ্রিয়ান নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেনা সে একটা চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারালো।
এলিসা আদ্রিয়ানের চিৎকার শুনে ধরফরিয়ে ওঠে পালঙ্ক ছেড়ে লাফ দিয়ে ওঠে দৌড়ে যায় আদ্রিয়ানের কক্ষে কিন্তু দরজা খোলা অবস্থায় ছিলো ভেতরে ওকে দেখতে না পেয়ে খুঁজতে লাগলো হন্য হয়ে। অন্দরমহলের ওদিকটায় অন্ধকার দেখে এলিসা এক পা দু পা করে এগোতে লাগলো সেদিকে কারো শরীরের সাথে পা লেগে পড়েই যাচ্ছিলো ঠিক তখনই নিজেকে সামলে নিয়ে দৌড়ে চলে গেলো সেখান থেকে অন্য একটা মশাল নিয়ে সে অন্দরমহলে গেলো দেখলো আদ্রিয়ান পড়ে আছে নির্জীব হয়ে। এলিসা এবার অনবরত ডেকে যাচ্ছে আদ্রিয়ানকে কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ সে পাচ্ছে না। বুঝতে পারলো ও জ্ঞান হারিয়েছে এলিসা তড়িঘড়ি করে পানির পাত্র নিয়ে এসে অনবরত পানি ছিটাতে লাগলো কিন্তু আদ্রিয়ানের জ্ঞান ফিরছেনা। চিন্তায় পড়ে গেলো এলিসা কি করবে বুঝতে পারছেনা দৌড়ে রাজবাড়ীর বাইরে গেলো কাউকে পাওয়া যায় কিনা দেখতে কিন্তু না বাইরে কেবল অন্ধকার মশালগুলো জ্বলছে না।ঘুটঘুটে অন্ধকারে তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না এলিসা নিরাশ হয়ে রাজবাড়ীর ভেতরেই ঢুকতে যাবে ঠিক তখনই ভাঙা গলায় কেউ বলে উঠল – চলে যাও, চলে যাও বলছি।বাঁচতে চাইলে পালাও! পালাও!
এলিসা জোড়ে জোড়ে বলতে লাগলো কে ওখানে? কে? আসুন না একটু ভেতরে আমার ফিওন্সে জ্ঞান হারিয়েছে প্লিজ হেল্প।
আর কারো উপস্থিতি অনুভব করা যাচ্ছে না এলিসা পাগলের মতো ছোটাছুটি করছে কোথায় গেলেন আপনি? কে আপনি? কোথায় উধাও হয়ে গেলেন?
এলিসা এবার ক্লান্ত হয়ে পড়ে মুহূর্তেই মনে পড়ে আদ্রিয়ান একা সে আবার দৌড়ে সেখানে যায় পানি ছেটাতে থাকে কিন্তু কোনো কাজ হয় না।
– আদ্রিয়ান প্লিজ ওঠো না, কি হয়েছে তোমার কেন এমন করছো বলতো? ওঠো না প্লিজ।
ওপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ আসছে না।এলিসাও আর ডাকাডাকি করে না সে বসে থাকে আদ্রিয়ানের মাথার কাছে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে।
ভোরের আলো চারদিকে ফুটে ওঠেছে সকালের সূর্য যেনো আজ বেশ কড়া করে আলো দিচ্ছে। আদ্রিয়ানের জ্ঞান ফিরে এসেছে সে নিজেকে আবিষ্কার করলো মেঝেতে মাথার পাশেই দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে এলিসা বসে আছে। আদ্রিয়ান কিছুই বুঝতে পারছেনা সে এখানে কেন, আর এলিসাই বা এখানে বসে আছে কেন?
আদ্রিয়ান ডাকতে গিয়েও ডাকলো না বরং এলিসার মুখশ্রীর আদলে সে তাকে হারিয়ে ফেলছে। হঠাৎ করেই এলিসার ঘুম ভাঙলে আদ্রিয়ানকে তার দিকে অপলক চেয়ে থাকতে দেখে আৎকে ওঠে। তারপর যখন বুঝতে পারে এখন সকাল হয়ে গেছে আর আদ্রিয়ানেরও জ্ঞান ফিরেছে তখন সে উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করতে থাকে আদ্রিয়ানকে- কি হয়েছিলো তোমার? কেন মাঝরাতে অন্দরমহলের দিকে এসেছিলে? জ্ঞানই বা হারালে কি করে?
আদ্রিয়ানের মনেও ঠিক একই প্রশ্ন জাগে সত্যিসত্যিই তো কি করে এখানে এলো সে। মস্তিষ্ককে প্রচন্ড চাপ অনুভব করে দুহাত দিয়ে শক্ত করে মাথা ধরে রেখেছে কিছুতেই সে মনে করতে পারছেনা।
এলিসা বুঝতে পেরে বললো থাক জোর করে মনে করতে হবে না তুমি শান্ত হও প্লিজ। আদ্রিয়ান উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলো। এলিসা আনমনে ভেবেই চলেছে রাতের ওই লোকটা কে? ভাঙা গলায় কে কথা বলছিলো? কেন পালিয়ে যেতে বলছিলো? প্রশ্ন কেবল মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেয়েই যাচ্ছে হঠাৎ করেই কাজের মহিলার উপস্থিতিতে তার ভাবনায় বাঁধা পড়লো।কাজের মহিলা তনুয়া বেগম রান্না শালা দেখতে চাইলে এলিসা তাকে দেখিয়ে দেয় আর বাজার করার টাকাও দেয়।এই এতো বড় বাড়িতে কেবল দুজন মাত্র মানুষ থাকা যেন বিপদের মধ্যে থাকা।তবুও যেন সব বাঁধা উপেক্ষা করে এ বাড়িতেই রয়ে গেলো এলিসা।
এলিসা ও আদ্রিয়ান বাড়ির বাইরে বেরুলো সারা গায়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলো আজও একজন মহিলার পেটের বাচ্চাটা মারা গিয়েছে। প্রতিদিনের যেন নিয়ম হয়ে দাড়িয়েছে গর্ভবতী মহিলার গর্ভে বাচ্চার মৃত্যু।
বন্যার আতঙ্কে আতঙ্কিত না হয়ে বরং সবাই বাচ্চা মরে যাওয়ায় আতঙ্কে বেশি আতঙ্কিত।
এলিসারও ব্যাপারটা সুবিধাজনক মনে হয়না কারণ এভাবে প্রতিদিন একটি করে অনাগত শিশুর মৃত্যু যেন কোনো রহস্য। গ্রামের মোড়েই একটা টং দোকানে গেলো এলিসা ও আদ্রিয়ান। সেখানে যে চা বিক্রি করে সে লোকটার কম করে হলেও একশো কুড়ি বছর বয়স। তবুও লোকটা কর্ম করে দিন পার করছে লোকটা এখনও অনেক সতেজ এটা ওদের অনেক ভালো লাগে। লোকটার সাথে এক কথা দু কথায় এলিসা বলে ওঠে তারা রাজবাড়ীতে উঠেছে সপ্তাহ খানেক।
সপ্তাহ খানেকের কথা শুনে যেন লোকটি বিষম খেলেন – কিহ! তোমরা সপ্তাহ খানেক রাজবাড়ীতে অবস্থান করছো? কিন্তু এখনো তোমরা জীবিত আছো দেখে অবাক লাগছে।
এলিসা আদ্রিয়ান দুজনেই একসাথে প্রশ্ন করে উঠলো মানে? কেন জীবিত থাকবোনা?
লোকটি কিছুটা রহস্যের দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো এরপর বললো রাজবাড়ীতে গত একশো বছর ধইরা কেউ তিন চারদিনের বেশি টিকতে পারেনাই মানে জীবিত ফিরতে পারেনাই। যেই থাকতে গেছে তারই কোনো না কোনো বিপদ হইছে।কেউ নিখোঁজ কেউবা মৃত।
আদ্রিয়ান বেশ ঘাবড়ে গেলো লোকটিকে জিজ্ঞেস করলো চাচা এই গ্রামে আসার পর থেকেই শুনছি অনাগত শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। এটা যেনো নিত্যদিনের সঙ্গী। যদি মহামারী হতো তবে সবখানেই হতো কেবলমাত্র রাজবাড়ী গ্রামেই কেনো হচ্ছে?
লোকটার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ দেখা গেলো সে ভেজা ঢোক গিলে বলা শুরু করলো এর আগেও এই মহামারীতে আক্রান্ত হয়েছিলো এ গায়ের মহিলারা।কোনো গর্ভবতী মহিলাই আর বাচ্চা জন্ম দিতে পারতো না তার আগেই সে বাচ্চা পেটেই মারা যেতো। এমন করতে করতে গায়ের লোক যেন বিলুপ্ত হতে শুরু করলো ভয়ে।একেকজন ভয়ে একেক গ্রামে পালাতে লাগলো কিন্তু এভাবে আর কতদিন তারা আবার ফিরে এসেছিলো।এরপর এ খবর ছড়িয়ে পড়েছিলো দেশব্যাপী একজন মৌলবির সাহায্যে এ মৃত্যুখেলা বন্ধ হয়েছিলো। কিন্তু এতবছরে এর আর কোনো আলামত পাওয়া যায়নি তবে এখন যখন আবার এসব শুরু হয়েছে তারমানে নিশ্চয়ই ও ফিরে এসেছে আবার।
ও আবার এসেছে “!!
– এলিসা কৌতুহলের স্বরে জিজ্ঞেস করলো কে ফিরে এসেছে ?
লোকটি আর কোনো উত্তর দেয় না শুধু এটুকু বলে তোমরা ফিরে যাও। রাজবাড়ী থেকে চলে যাও বিপদ খুব সন্নিকটে।
আদ্রিয়ানের মনে ভয়ের সৃষ্টি হচ্ছে সে অনেক করে লোকটির থেকে জানতে চায় কি হয়েছে কিন্তু কিছুতেই লোকটা মুখ খোলেনা।কেবল বলে চলেছে চলে যাও নইলে মৃত্যু যে অনিবার্য।
এলিসা আদ্রিয়ান দুজনেই ফিরে এলো রাজবাড়ী, আদ্রিয়ান এমনিতেই ভীতু তারওপর ওই চা বিক্রেতা বৃদ্ধ লোকটির কথা তার মনে আরও ভয়ের সৃষ্টি করছে।এলিসারও যে ভয় করছে না ঠিক তা নয় তারও ভীষণ ভয় করছে।তবে সে দমে যায় নি এ রহস্যের উদঘাটন করার পণ করে মনে মনে। আজকে তনুয়া বেগমও রাজবাড়ীতে অবস্থান করছেন এলিসা তাকে বলে যদি কোনো প্রয়োজন হয় তবে যেন তাকে ডাকতে দ্বিধাবোধ না করে। তনুয়া বেগম লোকের মুখে এসব ভয়ংকর কথা শুনে ভয় পায় তার ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে এ ভুতুড়ে বাড়ি ছেড়ে কিন্তু পেটের দায়ে তাকে থাকতে হচ্ছে। কিছুতেই যেন তার চোখে ঘুম নেই সে মনে মনে দোয়া পরতে থাকে আর জিকির করতে থাকে।
এলিসার দুচোখের পাতা যেন এক করতে পারছেনা সে ভেবেই চলেছে এখানে আসার পর থেকে একের পর এক ঘটনার কথা।বাস্তবে কি সত্যিই এমন হতে পারে প্রশ্ন জাগে মনে।
কেটে গেলো দুইদিন।তনুয়া বেগমকে আজ কেমন যেন দেখাচ্ছে ঠুসঠাস করে একের পর এক জিনিস তার হাত থেকে পড়ে যাচ্ছে। কিছুতেই সে স্থির থাকতে পারছে না এমন আচরণে এলিসা তাকে প্রশ্ন করলে সে কোনো উত্তর দেয়না বরং এড়িয়ে যায়।
আজ সকালে হঠাৎ করেই তনুয়া বেগমকে কোথাও দেখতে পেলো না এলিসা।টেবিলে সকালের নাস্তাও নেই অন্যদিনের মতো। আদ্রিয়ান এলিসা মিলে পুরো বাড়ি খুঁজেও কোথাও তনুয়াকে পেলো না।ওরা ভাবলো হয়তো ও ওর পরিবারের কাছে ফিরে গেছে কিন্তু না সেখানে গিয়ে দেখে তনুয়া বেগম সেখানে ফিরে যায়নি।তাদেরকে এ কথা জানালে পুরো গ্রামজুড়ে খোঁজা হয় তাকে।কিন্তু কোথাও তার দেখা মিলে না। সারাদিন অক্লান্ত খোঁজাখুজির পরেও যখন তনুয়া বেগমকে পায় না তখন সবাই আদ্রিয়ান ও এলিসার দিকে সন্দেহের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। এলিসা সবাইকে বলে যে তারা কিছুই যানে না তনুয়ার নিখোঁজ হওয়ায় ব্যাপারে।কিন্তু সবাই বলাবলি করতে থাকে যে তোমরা ও তো আছো রাজবাড়ীতে অনেকদিন হলো কিন্তু তোমরা তো নিখোঁজ হলে না কিন্তু এ পর্যন্ত যারাই থাকতে এসেছে এখানে তাদের কোনো না কোনো ক্ষতি হয়েছে কিন্তু তোমাদের কিছুই হলো না এ পর্যন্ত। তনুয়া বেগম মাত্র তিনদিন হলো রাজবাড়ীতে থাকতে গেলো আর তাকে পাওয়া যাচ্ছে না!! কেন?? তোমরা আবার এর সাথে জড়িত নয়তো??
এলিসা আদ্রিয়ান তাদের কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারছেনা তারা কেবল বলে চলেছে তারা কিছুই জানেনা।
পরেরদিন থানায় ডায়েরি করা হলে তারা এসে তদন্ত করে কিন্তু তনুয়া বেগমের নিখোঁজ হওয়ার কোনো ক্লু ই খুঁজে পায় না তারা। এলিসা ও আদ্রিয়ানকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় কিন্তু তারা কিছুই জানে না বলে জানায়।
পুলিশ অফিসার অন্য একজন পুলিশকে ইশারা করে বলে – নজর রাখিস “!
আজও একজন গর্ভবতী মহিলার গর্ভে তার সন্তান মৃত অবস্থায় বের হয়েছে। দীর্ঘ বারো বছর পর এই দম্পতি বাবা- মা হতে চলছিলো কিন্তু না তারা বাবা মা হয়েও হতে পারলো না। মহিলার স্বামী বেশ ভেঙে পড়েছেন সে কিছুতেই মানতে পারছেনা তার বাচ্চা মা*রা গেছে।মহিলার জ্ঞান ফিরলেই সে তার বাচ্চার কথা জিজ্ঞেস করছে বার বার আর উত্তেজিত হয়ে জ্ঞান হারাচ্ছে বারংবার।
তদন্তে থাকা পুলিশ অফিসারকে ডেকে এলিসা এই বাচ্চার পোস্ট মর্টেম করতে বলে কেনই বা এত এত বাচ্চা মা*রা যাচ্ছে। পুলিশ অফিসার প্রথমে রাজি না হলেও ভাবতে থাকে সত্যিসত্যিই তো এমন কেনো হচ্ছে এ গ্রামে।
সে এবার বাচ্চাটাকে পোস্ট মর্টেম করে রিপোর্ট জানায় এলিসাকে যা শুনে ওর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে।বাচ্চাটার নাকি কলিজা নেই, তাই ওর মৃত্যু হয়েছে।
এলিসা পুলিশ অফিসারকে বলে এরপর যে বাচ্চা মারা যাবে তার পোস্ট মর্টেমও করবেন,এমন কথায় পুলিশ অফিসার বেশ ক্ষিপ্ত হয় কি করে সে একটা বাচ্চার মৃত্যু কামনা করতে পারে।কিন্তু এলিসা বলে আমার ধারণা যদি সত্যি হয় তবে প্রত্যেক বাচ্চার মৃত্যুর কারণ হবে একটাই।
এলিসার ধারণা সত্যি হতে বেশিদিন সময় নিলো না বরং তিনদিনের মাথায় জানা গেলো আরেকটি বাচ্চার মৃত্যুর কারণও কলিজা না থাকার কারনে।
এলিসার ধারণাই সত্যি হলো কোনো একটা যোগসূত্র নিশ্চয়ই আছে।
তবে আদ্রিয়ান এ সকল কিছু জানার পর আর এক মুহূর্তও এ বাড়িতে অবস্থান করতে চায় না। এলিসাকে সাথে নিয়ে চলে যেতে চায় কিন্তু এলিসা কিছুতেই যেতে রাজি হয় না সে বলে যদি আমাদের ক্ষতি হওয়ার থাকতো তবে এতদিনে হয়ে যেতো, যেহেতু আজও কোনো ক্ষতি হয়নি তবে হয়তো আর কোনো ক্ষতি হবেনা।
আদ্রিয়ান উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে – ” এতদিন যেহেতু ক্ষতি হয়নি তাই আর ক্ষতি হবে না এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল এরচেয়ে এটা ভাবো হয়তো সবচেয়ে কঠিন ক্ষতি আমাদের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে”।
এলিসা কিছুতেই রাজবাড়ি ছেড়ে যেতে রাজি হয় না বরং রেগে গিয়ে সে বলে বসে- তোমার ইচ্ছে হলে তুমি চলে যাওওও।আমাকে বিরক্ত করো না প্লিজ। আর তোমার মতো ভীতুকে আমি সহ্য করতে পারি না। যাও চলে যাও এখান থেকে।
আদ্রিয়ান আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না সে এলিসার কথায় মনে আঘাত পায় আর চলে যায় রাজবাড়ী থেকে।যেহেতু কেস সল্ভ হওয়া পর্যন্ত দেশের বাইরে যাওয়া নিষেধ তাই সে একটা হোটেল বুক করে থাকার জন্য।
কিন্তু রাজবাড়ীতে এলিসাকে একা রেখে আসায় তার অনেক দুশ্চিন্তা হতে থাকে। এই পুরো বাড়িটাতে এলিসা একা রয়েছে ভাবতেই গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে তার কিন্তু এখন চাইলেও সেখানে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয় অনেকটা রাত অতিক্রম হয়ে গেছে প্রায়।দুশ্চিন্তায় দুচোখের পাতা যেন এক করতে পারছেনা আদ্রিয়ান। নিজের প্রতিই নিজের খুব রাগ হতে থাকে তার।
এদিকে এলিসার রাজবাড়ীতে একা একা ভীষন ভয় হতে শুরু করে সে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকে কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না তার। হঠাৎ করেই ভয়ংকর রকমের শব্দ শুরু হয় এলিসা তার দুহাত দিয়ে কান চেপে ধরে রাখার চেষ্টা করে কিন্তু আওয়াজটা যেন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে।সে আর সহ্য করতে না পেরে পালঙ্ক ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। এবার শব্দ অনুসরণ করে হাটা দেয় সেই অন্দরমহলের দিকে তালাবদ্ধ কক্ষের ভেতর থেকেই আসছে এ শব্দ। এলিসার মনে ক্রোধ জন্মায় সে আজ ভেঙেই ফেলবে এই দরজা একটা লোহার রড দিয়ে ইচ্ছেমতো তালায় আঘাত করতে লাগলো হঠাৎ করেই এলিসা ও পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেতে লাগলো সেই বৃদ্ধ লোকটি যে বার বার তাকে চলে যেতে বলছে ভাঙা গলায় বলে উঠল – থামো এলিসা, তুমি নিজের বিপদ নিজে ডেকে এনো না আমি তোমাকে বলছি চলে যাও চলে যাও এই বাড়ী ছেড়ে ও তোমাকে ছাড়বে না আ আ আ আ আ
মুহূর্তেই বৃদ্ধ লোকটি অদৃশ্য হতে শুরু করলো মনে হতে লাগলো কেউ যেন তাকে টেনে অন্য এক দুনিয়ায় নিয়ে যাচ্ছে। চোখের পলকেই তাকে আর দেখা যাচ্ছে না কিন্তু একটু আগেই এখানে ছিলো সে। এলিসা যেনো নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছেনা তার সাথে কি হচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। সে এবার আরও ক্ষীপ্ত হয়ে বসে মাথার মধ্যে জেদ চেপে বসেছে সে আবারও দরজায় তালায় আঘাত করতে লাগলো অনবরত একপর্যায়ে সে সফল হয়, তালা ভেঙে যায় সে আর একমুহূর্ত দেরি না করে কক্ষের ভেতরে যেতে উদ্যত হয় তবে পুরো কক্ষ জুড়ে অন্ধকার বিরাজ করছে, ভেতরে ঢুকতেই হঠাৎ করে একটা আলো এসে উপস্থিত হয় যাতে পুরো কক্ষ আলোয় আলোকিত হয়ে যায়।এলিসা কিছুই বুঝতে পারছেনা তার সাথে কি হচ্ছে তবে পুরো কক্ষেই কাউকে সে দেখতে পায় না আচমকাই পালঙ্কের নিচে তাকাতেই একটা কুচকুচে কালো বিড়ালকে দেখতে পেয়ে সে চিৎকার করে ওঠে।
বুকের মধ্যে হার্টবিট লাফালাফি করতে লাগলো আরেকবার সাহস করে পালঙ্কের নিচে তাকাতেই দেখতে পায় সেখানে রক্তাক্ত হাড়গোড় মানুষের শরীরের কিছু অংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এসব দেখে এলিসা নিজেকে আর সামলাতে পারে না সে অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে।
______________________
১৮৯৮ সাল। আষাঢ় মাসের প্রকৃতি অপরূপ সৌন্দর্যে নিমজ্জিত হয়ে আছে।হেমন্তি রূপাকে নিয়ে নৌকায় ঘুরছে আর সিরাজ বৈঠা বাইছে।সিরাজ অপলক চেয়ে আছে হেমন্তির দিকে। হেমন্তি রূপার মন ভালো করার জন্য ওকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রূপার ক্রন্দনরত মুখ খানা দেখে বোঝাই যাচ্ছে সে আসলে খুশি হতে পারছে না কিছুতেই কেবল তার রাজপুত্রের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। রাজবাড়ীতে থাকলে হয়তো বা তার রাজপুত্রকে অনুভব করতে পারতো কিন্তু না সে উপায় নেই।হেমন্তি চায় না রূপা রাজবাড়ীর চৌকাঠ মারাক।
হেমন্তির বাবা মা অসন্তোষ ছিলেন রূপাকে নিয়ে একটা অবিবাহিত মেয়ে বাচ্চার দায়িত্ব নিচ্ছে এটা তো সমাজ ভালো চোখে দেখবে না। অনেকেই আনাগোনা করছে হয়তো রূপা হেমন্তিরই মেয়ে।
তড়িঘড়ি করে বিয়ের সমন্ধ দেখতে থাকে হেমন্তির বাবা মা কিন্তু কেউই রাজি হচ্ছিল না রূপার কথা শুনে। হেমন্তি সিরাজকে জানালে সে তার বাবা মাকে বলে হেমন্তির বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতে।
হেমন্তিকে দেখতে এলো সিরাজের বাবা মা হেমন্তিকে তাদের বেশ পছন্দ হয়েছে কিন্তু হেমন্তি প্রস্তাব দেয় তার সাথে রূপাকেও গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু সিরাজের বাবা মা কিছুতেই এ প্রস্তাবে রাজি হয় না তারা কেবল হেমন্তিকেই বউ হিসেবে নিতে চায় কিন্তু অন্যের বাচ্চাকে তারা কিছুতেই গ্রহণ করবে না।
সিরাজ তার বাবা মাকে অনেক বোঝাায় কিন্তু তারা কিছুতেই মানতে চায় না।
এদিকে সিরাজ এখনো কোনো কর্মক্ষেত্রে যুক্ত নেই অর্থাৎ বেকার হেমন্তির বাবাও রাজি হতে চান না সিরাজের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে। হেমন্তির বাবা জানান বড় বড় মেজিস্ট্রেট তার মেয়েকে বিয়ে করতে প্রস্তুত সেখানে সিরাজের মতো বেকার ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দেওয়া মোটেও সুখকর নয়।
চলবে,,,,,,
#লেখা: মুন্নি ইসলাম