#মৃগতৃষ্ণিকা
#পর্বঃ১৫
হেমন্তির প্রশ্নে মতি ঘাবড়ে গেলো তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে হাত দিয়ে মোছার অনেক চেষ্টা করেও পারছে না। তার হাত যেনো কপাল অব্দি উঠছেই না। তাকে বেশ অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে হেমন্তি সে আবারও প্রশ্ন করে বসলো – কোথায় গেছে আপনার স্ত্রী জোছনা??
মতি এবার ভালো করে তাকায় হেমন্তির মুখপানে মনে হচ্ছে যেন সে হাসছে তবে হাসছেও না কেমন যেন অদ্ভুত দেখতে মেয়েটা।সে একটা ভেজা ঢোক গিলে নিজেকে শান্ত করে বলল – তা তা তারে আমি তাড়ায় দিছি। জোছনা বাপের বাড়ি গেছে।
হেমন্তির মুখের সেই বাঁকা হাসি মিলিয়ে গেলো মুহুর্তেই তবে কি সে যা ভাবছিলো তা ভুল নাকি এই মতি তাকে পথভ্রষ্ট করতে চাইছে। স্থির হয়ে মনে মনে বলল না না আমাকে কোনোভাবেই সে পথভ্রষ্ট করতে পারবে না। আমি ঠিক রহস্য উন্মোচন করে ছারবো।
– কেন আপনি জোছনাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন?কি করেছে সে? কোনো অন্যায় করেনি তো?
হেমন্তির এতগুলো প্রশ্নে মতি যেন হাঁপিয়ে উঠেছে – দেখেন আমি আপনারে এত কিছু বলতে বাধ্য না।আপনি এখন এইখান থেকে চইলা যান। বুড়ি এখন ঘুমাইতাছে সে জাইগা গেলে সামলানো যাইবো না।
আব্দুল রাগান্বিত ভাব নিয়ে বলল – তুই কারে কি কস? তুই জানোস সে কে? সে হইলো আইনের লোক চাইলে তোরে জেলের ভাত খাওয়াইতে পারে।
মতি যেন একের পর এক চমক খাচ্ছে সে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছেনা। অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠল – আ আ আসলে বুড়ি জোছনা রে একদম সহ্য করতে পারে না। কিছুটা দম সঞ্চয় করে আবার বলা শুরু করলো –
বুড়ি ওরে দেখলেই ক্ষেইপা যায় তার মধ্যে জোছনা পোয়াতি।জানেনই তো গ্রামে অভিশাপ লাগছে কারো বাচ্চাই বাঁচবার পারে না জন্মাইবার আগেই মা*রা যায়।এমন এক পরিস্থিতির মাঝখানেও আমি তারে সামলায় রাখছি কিন্তু এখন বুড়িকে একদম সামলানো যাইতাছে না।সে এমন ভাব করে যেনো তার এই অবস্থার জন্য জোছনা দায়ী। এই শরীরে যদি সে কোনোভাবে আঘাত কইরা বসে তাইলে তো আর রক্ষা নাই।
এই জন্যই আমি জোছনারে কিছুদিনের জন্য হের বাপের বাড়ি পাঠাইছি।কিছুদিন গেলে যদি বুড়ি শান্ত হয় তখন না হয় নিয়া আসবো…..
আব্দুল মতিকে হাত দিয়ে ইশারা দিয়ে থামতে বলল নিচু স্বরে হেমন্তি কে বলল মতি সত্যই কইতাছে।
হেমন্তি ও মাথা নেড়ে এই কথায় সম্মতি জানালো। আব্দুল হেমন্তিকে নিয়ে সেইস্থান ত্যাগ করবে বলে পা বাড়ায় তাৎক্ষনাত রূঢ়ভাষী কেউ বলে উঠল -আ আ আমায় মে*রে ফেল নয়তো মুক্তি দে। আমি মুক্তি চাই আমি মুক্তি চাই!!!
হেমন্তি আর আব্দুল ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে দেখে পরি বানু চোখ দুটো বড় বড় করে অস্থির হয়ে কথাগুলো বলছে।তার মধ্যে এক অজানা ভয়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে। হেমন্তি এক পা দু পা করে পরিবানুর কাছে এগিয়ে যেতে লাগলো হাঁটু ভেঙে বসলো তার কাছে গিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলতে লাগলো- আপনার মুক্তি চাই?? আমি আপনাকে মুক্তি দিতে এসেছি।
পরিবানুও বাধ্যের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে হেমন্তির কথার জবাব দিলো।
– আপনি যে অবয়ব টা এঁকেছেন তা আর কেউ না বুঝতে পারলেও আমি বুঝতে পেরেছি। কি বলবো নাকি কি এঁকেছেন?
পরিবানু মাথা নাড়িয়ে না বোধক বাক্য বোঝায়।সে চায় না সবার সামনে এসব কথা বলতে হেমন্তিও তার কথা বুঝতে পেরেছে তাই মতিকে বলল পরিবানুর বাঁধন খুলে দিতে।
মতি ও আব্দুল দুজনেই অবাক হলো হেমন্তির কথা শুনে। পরিবানুকে ছেড়ে দিলে হয়তো তাকে আর সামলানো যাবে না আরও ক্ষেপে যেতে পারে উক্তিটি করে বসলো আব্দুল সাথে মতি যোগ করে সে বাঁধন খুলবে না কিছুতেই না পরিবানুর দ্বারা কারো কোন ক্ষতি হয়ে গেলে তার দায়ভার কে নিবে।
হেমন্তি আশ্বাস দেয় পরিবানু তার জিম্মাদারি তে থাকবে কোনো ক্ষতি হতে দিবে না কারো।
মতি রাজি হতে না চাইলে হেমন্তি বলে সে আইনের লোক তাকে তার কাজ ঠিকভাবে করতে না দিলে তাদের নামে মামলা জারিকৃত হতে পারে।
এবার আর মতি না করে না সে চুপ করে থাকে তবে আব্দুল কে দেখে মনে হচ্ছিল সে মোটেও চাইছে না বাঁধন খুলতে তবুও হেমন্তির জোড়াজুড়ি তে খুলে দিতে বাধ্য হয়।
হেমন্তি পরিবানু কে ধরে ধরে তার কক্ষের দিকে অগ্রসর হতে থাকলো ধীর গতিতে। পরিবানুও বেশ যাচ্ছে হেমন্তির কথামতো ঘরে ঢুকেই হেমন্তি দরজা বন্ধ করে দিলো। এবার পরিবানুকে বসালো চৌকিতে আর সে বসলো বেতের মোড়ায়।
– আপনি কি চান মুক্তি নাকি মৃত্যু?
হেমন্তির এহেন প্রশ্নে পরিবানু বেশ চিন্তিত হয়ে পরে সত্যিই তো সে কি চায়! সে কি চায় তা সে নিজেও জানে না।
হেমন্তি বলল- আমি জানি এই মুহুর্তে আপনি কোনটাই বেছে নিতে পারছেন না। তবে শুনুন আমি চাই আপনি এবং আপনার পরিবার সবাই ভালোভাবে মুক্তি ভাবে বাঁচুন। তাই আপনাকে আমায় সাহায্য করতে হবে বলুন আপনি এই অবয়ব কেন এঁকেছেন?
পরিবানু নিশ্চুপ হয়ে রইলো তার চোখেমুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠেছে স্পষ্ট।
– একজন মহিলার হাতে তাজা রক্তমাখা কলিজা একদম কচি সেই কলিজা। কি তাই না??
পরিবানু বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে পড়লো মাথা ঝাঁকাতে লাগলো হেমন্তিও দাড়িয়ে পড়লো প্রশ্ন করলো আবার কে সেই মহিলা? আপনি জানেন?
পরিবানু এদিক ওদিক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে যাচাই করলো আশে পাশে কেউ আছে কি না। এবার হেমন্তির দুই কাধে দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে বলল আ আ আমার কথা কেউ বুঝতে পারে নাই তু তু তুমি কেমনে বুঝলা মাইয়া? কেউ বাঁচবো না কেউ তার হাত থেইক্কা রেহাই পাইবো না সবাইরে শেষ কইরা দিবো। সবাইরেই…….
-আপনি দেখেছেন তাকে?
মাথা নাড়িয়ে সায় দিল পরিবানু।
হেমন্তির মনে আশার আলো জাগে সে উত্তেজিত হয়ে পড়লো জোর খাঁটিয়ে বললো – বলুন না কোথায় দেখেছেন তাকে দয়া করে বলুন।আমায় না বললে যে সর্বনাশ হয়ে যাবে তাড়াতাড়ি বলুন কি জানেন আপনি কলিজা খে*কো মানবী সম্পর্কে কি জানেন আপনি?
পরিবানু কথা বলে না একদম চুপ হয়ে আছে।
সে তো শুধু শিশুদের কলিজা খা*য় তাই না?
অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে পরি বানুর মাঝে সারা শরীর তার থরথর করে কাপছে মুখ থেকে শুধু একটা বাক্যই বেরিয়ে এলো – কি কি করে জানলে?
উহু আমাকে প্রশ্ন করার সময় এখন নয় আপনি আগে বলুন কি কি জানেন আপনি এ সম্পর্কে।
পরিবানু স্থির হয়ে বসলো একটা ঢোক গিলে বলা শুরু করলো – আ আমার নাতবউ পোয়াতি তার পেটে কালা একটা হাতের ছাপ কোনো অশরীরির হাতের ছাপ।কেমন যানি অদ্ভুত আচরণ করে ভুতপ্রেত ধরলে মানুষ যেমন করে তাই আমি এক ফকির বাবারে ডাকি সে আইসা নাতবউ রে দেখে এরপর বলে আমগো ঘোর বিপদ আগামী মঙ্গলবার আমার কাছে নিয়া যাইবেন আমিও রাজি ছিলাম আমার নাতি কিনা ভুতে ধরা মাইয়ার লগে সংসার করবো এইডা আমি মানবার পারুম না কিন্তু মতি ওর বউরে ফকির বাবার কাছে যাইতে দিবো না। একদিন মতিরে গলা টিপা ধরলো আর কইলো পরপুরুষ এর ছোয়া সে একদম সহ্য করবার পারে না।
হেমন্তি পরিবানু কে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলো – পরপুরুষ মানে? মতি তো জোছনার স্বামী হয়। তবে…
পরিবানু বলল-” হ”। হেরে মনে হয় ভুতে ধরছে তাই আমি ফকির বাবার কাছে মঙ্গলবারে এ নিয়া যাইতে চাইলাম।মতি কইলো ও এই কয়দিন জোছনার আচরণ লক্ষ্য করবো যদি ওর মনে হয় আমার ধারণাই ঠিক তাইলে যাইতে দিবো।
-তারপর ( হেমন্তি আগ্রহের স্বরে বলল)
মতি বাড়িতে আইলেই জোছনা দূরে দূরে থাকতো আমি কি করমু কিছুই বুঝবার পারছিলাম না তখন। মতি এতদিন যাইতে না করলেও সেদিন( মঙ্গলবার) কইলো যাও বুড়ি জোছনা রে ফকির বাবার কাছে নিয়া যাও।আমি কিছুটা অবাক হইলাম যেই পোলায় এতদিন এগুলি একদম সহ্য করবার পারেনাই সে এখন নিজে থেইকা কইতাছে ফকিরের কাছে যাইতে।
আমিও বেশি দেরি করলাম না কখন আবার মত ঘুইরা যায়। সারা রাস্তায় টু শব্দটি করলো না জোছনা আমিও করিনাই। আমি কেবলি ভাবতেছিলাম মতি কি এমন দেখলো যে জোছনা রে ফকির বাবার কাছে নিয়া যাইতে কইলো।
অবশেষে আমরা পৌছালাম ফকির বাবার কাছে। তখন বিকেল ফকির বাবা আমাদের তার ঘরে নিয়ে বসালেন সেই ঘরের ছোট্ট একখান খুপরি তে বিশাল আয়োজন করা হইছে এক রঙা হলুদ শাড়ি দিয়া পুরাটা খুপরি সাজাইছে।জোছনারে সেইখানে রাইখা আমারে বাইরে অপেক্ষা করতে কইলো আমিও কথামতো বাইরে বইলাম। মনে মনে দোয়া করতে লাগলাম যাতে মাইয়াডার কোনো ক্ষতি না হয় তার ভেতরেও তো আছে আরেক খান প্রাণ।
হেমন্তি অতি আগ্রহের স্বরে বলল – জোছনা কি তারপর ঠিক হয়নি? আর ফকির বাবা কি জানিয়েছেন কোন জ্বিন বা অতৃপ্ত আত্মা জোছনার শরীরে অবস্থান কি না?
– ফকির বাবা কইছে জোছনার শরীরে এখন আরেক জনের বাস।এই শরীর এখন তার দহলে।
– কে সে?জানেন কিছু….
পরিবানু কিছু একটা বলতে গিয়ে থমকে গেলেন তার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হেমন্তি, কখন সে পার করবে এই রহস্যের গণ্ডি সে আশায় প্রহর গুনছে।
এদিকে কারো অচেনা কন্ঠস্বর কানে এসে বাজলো হেমন্তির, মেয়েলি কন্ঠে বলে উঠল – ভেতরে কে আছে? কে আছে ভেতরে?
পরিবানুর ভয়ার্ত চোখমুখ দেখে হেমন্তি কিছুটা ঘাবড়ে গেলো ভয়ের কারণ সে উপলব্ধি করতে পারছেনা। পরিবানুকে পর্যবেক্ষণ করে বোঝা গেলো সে ভীষণ ভয় পাচ্ছে কারো উপস্থিতিতে তার হাত পা থরথরিয়ে কাঁপছে চোখের মনি এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে।
– আপনি ভয় পাচ্ছেন?? কি হয়েছে আপনার? কাঁপছেন তো??
– ও এসে গেছে। ও ও
– কে এসেছে বাড়িতে? কে এসেছে?
পরিবানু আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত লুকিয়ে পড়লো চৌকির নিচে যাতে তাকে দেখা না যায়।হেমন্তি কিঞ্চিৎ অবাক হলো সে আর দেরি না করে বাইরে বেরিয়ে এলো এসেই দেখে মতি আর সেই মেয়েটা কথা বলছে।দেখে মনে হচ্ছে অন্তঃস্বত্তা।
হেমন্তি প্রশ্ন করে বসলো – কে আপনি?
মেয়েটির উত্তরের অপেক্ষা না করেই মতি বলে উঠল – আমার বউ, আ আমার বউ জোছনা।।
হেমন্তি আশ্চর্য হয়ে বললো- আপনি না বললেন উনাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়েছেন!!পরি বানুর কাছাকাছি যাতে না থাকতে হয়! তবে উনি এখানে…..
চলবে,,,,,,
#লেখা:মুন্নি ইসলাম