মন_বাড়িয়ে_ছুঁই❤ #পর্বসংখ্যা_৫৭. #ফাবিয়াহ্_মমো .

0
288

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই❤
#পর্বসংখ্যা_৫৭.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

তীব্র উৎকন্ঠায় ঢোক গিললো মেহনূর। ভয়ে শিরদাঁড়া বেয়ে ঘাম চুয়ে নামছে। নৃশংস ঘটনার পরিকল্পনা শুনে মনের ভেতর মাহতিমকে নিয়ে ভয় ঘিরে ধরলো। চোখ তুলে ডানে তাকালো সে, সাথে-সাথে মাহতিমের কবজিটা পাঁচ আঙ্গুলে খাবলে ধরলো মেহনূর। বাইরে থেকে এখনো কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে, কিন্তু সেগুলো ভাসা-ভাসা, পুরোপুরি স্পষ্ট না। ওই কন্ঠটা বারবার কাউকে ‘ চাছা ‘ ডেকে যাচ্ছে। মনেহচ্ছে চাছা ডাকা লোকটার কাছে সাফাই দিচ্ছে সে। মেহনূর এবার পুরোপুরি নিশ্চিত মাহতিমের আহত হওয়ার পেছনে এই দলের কারসাজি আছে। প্রথমে ক্ষুরের কথা শুনেছে মেহনূর, আর মাহতিমের পিঠে ওরকমই নিশানা পেয়েছে সে। মেহনূর চুপ করে পুরো ছকটা ঠান্ডা মাথায় মিলাতে লাগলো। মাহতিম গাড়ি নিয়ে এ গ্রামে প্রবেশ করেছে, প্রবেশ করতেই তার উপরে অতর্কিত হামলা, সেই হামলার মূখ্য উদ্দেশ্য ছিলো তাকে জিন্দা মেরে ফেলা। মাহতিমও ছেড়ে কথা বলেনি, পালটা এ্যাকশন হয়তো সেও নিয়েছে, যার দরুন ক্ষুরের আঘাতটা তার পিঠ চিড়ে দিয়েছে। এরপরের ঘটনা অস্পষ্ট, যেটা এখন মাহতিমের মুখ থেকেই শুনতে ইচ্ছুক। নিজ বুদ্ধিতে প্রত্যেকটা ঘটনা খাপে-খাপে মিলিয়ে ফেললো মেহনূর, এরপর গভীর করে নিশ্বাস নিয়ে হাতদুটো মাথায় উঠালো। লম্বা কেশরাশি দুহাতের দক্ষ কায়দায় খোপা বানিয়ে মাহতিমের দিকে তাকালো সে, মাহতিম এখন দরজার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেও দরজার দিকে তাকালো। মাহতিম যে বেঁচে আছে সেটা নিশ্চয়ই ওই লোকগুলো জানে না। জানলে ব্যাপারটা ভালো হবেনা। কিন্তু তাদেরই গোয়ালঘরের সামনে দাঁড়িয়ে এ বাড়ির নাতজামাইকে মারার প্ল্যান? এতো বড় দুঃসাহস কিভাবে হলো জানা নেই। কিন্তু ‘ চাছা ‘ ডাকা লোকটিকে চেনার আগ্রহ মনের মধ্যে ঝড় তুলছিলো। মেহনূর চৌকি থেকে পাদুটো নিচে ফেললো। দৃষ্টিভঙ্গ হলো মাহতিমের, সে তৎক্ষণাৎ চোখ ঘুরিয়ে মেহনূরের দিকে তাকালো, ভ্রুঁ কুঁচকে ফিসফিসিয়ে বললো,

– কোথায় যাচ্ছো?

মাহতিমের দিকে তাকালো মেহনূর। তার দুচোখের মনিতে দৃষ্টি রেখে গালে হাত রাখলো। নির্ভার কন্ঠে আশ্বস্ত করলো,

– আসছি।

গাল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মেহনূর। গায়ের শাড়িটা ঠিকঠাক করে ধীরপায়ে এগুতে লাগলো। দরজার অনেকটা কাছাকাছি যেতেই হঠাৎ কিছু একটার সাথে হোঁচট খেলো সে, না-চাইতেই মুখ ফুসকে ‘ উঃ ‘ আওয়াজটা বেরিয়ে পরলো। সঙ্গে-সঙ্গে দামাল পায়ে ধুপধাপ কিছুর আওয়াজ হলো। প্রথমে কিছু না বুঝলেও শেষে চৈতন্য ফিরে পায়।ওমনেই দেরি না করে তাড়াতাড়ি দরজা খুললো মেহনূর! ঘুটঘুটে অন্ধকার চিড়ে কাউকে দেখতে পেলো না! কি তাজ্জব ব্যাপার! বাইরে এখন কেউই নেই? কিভাবে, মানে কিভাবে সম্ভব এটা? দরজার দুই দ্বার দাঁড়িয়ে থাকলে হঠাৎ পেছন থেকে বললো মাহতিম,

– লাভ নেই। ভেগেছে।

মুখ ফেরালো মেহনূর। অন্ধকারের যতদূর বোঝা সম্ভব, তাতেই মাহতিমের অবয়বটা ধরতে পারলো। ছোট্ট একটা ঢোক গিলে তার কাছে এগিয়ে গেলো সে। মাহতিম মেঝে থেকে উঠে চৌকিতে বসে বললো,

– শুধু শুধু উঠতে গেলে কেনো? পায়ে ব্যথা পেয়েছো না?

মেহনূর কোনো জবাব না দিয়ে শানাজের দেওয়া শার্টটা বালিশের কাছ থেকে নিলো। মেহনূরের হাতে নিজেরই ভালো শার্ট দেখে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো মাহতিম, সরু চোখে অকপটে বললো,

– আমার শার্ট এখানে কিভাবে আসলো?

প্রশ্ন শুনে শার্টের ডান স্লিভটা এগিয়ে ধরলো মেহনূর। স্মিত হাস্যে বললো,

– আমার ব্যাগে ছিলো। বুবুকে বলে ব্যবস্থা করেছি।

চরম আশ্চর্য হয়ে শার্টটা পরে নিলো মাহতিম। স্লিভগুলো গুটাতে-গুটাতে গোয়ালঘর থেকে বেরুলো। মেহনূর আগেভাগে বেরিয়ে গেলেও সে চারপাশে চোখ বুলিয়ে তারপর বেরুলো। উঠোন পেরিয়ে যেতেই অনেকগুলো জুতার ছাপ দেখলো সে, অন্ধকারে কাদামাটিতে খোদাই হয়ে আছে। হান্নান শেখ হয়তো বুঝতে পারেনি গোয়ালঘরে মেহনূর আছে। এজন্য দলবল নিয়ে রাতের অন্ধকারে একটুখানি ঢু মারতে এসেছিলেন, কিন্তু বেখাপ্পা কায়দায় ফেঁসে যাওয়ার আগেই সটকে পরেছেন। তিনটি সিড়ির প্রথম ধাপে পা ফেলতেই মাহতিম একটু ভদ্রস্থ ভাব ধারণ করলো। মুখের উপর থেকে ক্লান্তির ছাপ উঠিয়ে গম্ভীরতার মুখোশ বসালো। সিড়ি ডিঙিয়ে সেই পুরোনো স্মৃতিকে সতেজ করে মোল্লাবাড়িতে ঢুকলো মাহতিম। আজ এই বাড়িতে তার যুৎসই অধিকার আছে, তার চিরসঙ্গিনী, তার একমাত্র স্ত্রী, এই বাড়ির এক টুকরো প্রাণ। ঢুকতে-ঢুকতে সেদিনকার স্মৃতিগুলো মনে করতে লাগলো মাহতিমঞ, তার মায়ের টানাটানিতে ফেঁসে এই বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলো সে। অথচ, ভাগ্যের কি নির্মম খেলা! আজ এই বাড়ি, এই পরিবেশ তার একটুও অপরিচিত নয়। তার জীবনকে পালটে দিয়ে সমস্ত গোলকধাঁধা এখানেই জট খুলে বসে আছে। জীবন কতো রহস্যময়, পৃথিবী কেমন কুহেলী নিকাবে ঢেকে আছে, ভাবতেও নিজের কাছে অদ্ভুত লাগে। প্রবেশ করেই মুখোমুখি হলো মাহমুদার সাথে, এরপর সুজলা, সবশেষে সাবার সাথে। তিনজনই প্রফুল্লচিত্তে গ্রহণ করলো মাহতিমকে। মাহতিমের গভীর দৃষ্টি থেকে সুজলার অন্যমনষ্ক ভাবটা আড়াল হতে পারলো না, মাহমুদার ব্যাপারটাও কিন্ঞ্চিত উদ্ভট লাগছে। সবার সাথেই সহজ আচরণ এবং পিঠের ব্যথাকে অগ্রাহ্য করে মেহনূরের রুমে ঢুকলো। রুম খালি, মেহনূর নেই। সিলিংয়ে ফ্যান চলছে, এনার্জী বাল্বের সাদা আলোয় চর্তুদিক পরিচ্ছন্ন লাগছে। কোমর থেকে বেল্ট খুলে বিছানায় রাখলো, একটা পা বিছানায় তুলে মোজার কাছ থেকে পিস্তল বের করলো। প্যান্টের পকেট থেকে সদ্য কেনা নতুন সিম ও ফোনটা বের করে বিছানায় বসলো মাহতিম। একটু পরই দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো মেহনূর। হাতে প্লেটের উপর প্লেট ঢেকে মাহতিমের কাছে এসে বসলো। গোল প্লেটটা সরিয়ে ফেলতেই এক প্লেট খাবার দেখা গেলো। গরম ভাতগুলো যেনো এই মাত্র চুলা থেকে নেমেছে। একপাশে দেখা যাচ্ছে চারটে গোল-গোল ডালের বড়া, একটু লালচে রঙের শুটকি ভর্তা, একপিস সরষে মাখানো ইলিশ। প্লেটের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসলো মাহতিম, মেহনূরের দিকে চোখ তুলে বললো,

– খাবারগুলো মিস করতাম। ওখানে যদি পোলাও কোরমাও দিতো, বাড়িতে খাওয়ার মতো স্বাদ পেতাম না।

লাল-লাল শুটকি ভর্তায় গরম ভাত মাখাতে হাত জ্বলছিলো। তবুও ফু দিতে-দিতে ফ্যানের বাতাসে এক লোকমা মাখালো মেহনূর। মাহতিমের ঠোঁটের কাছে ধরতেই প্রথম প্রশ্নটা করলো,

– খাওয়ার সময় মিথ্যে বলতে নেই। এখন বলুন কি হয়েছিলো তখন? পিঠে ক্ষুরের আঘাত কিভাবে পেলেন?

মুখে খাবার নিয়ে চিবাতে লাগলো মাহতিম। চোখ নিচু করে বললো,

– ওই লোকটার শুনেও মুভির ক্লাইম্যাক্স বুঝোনি?

দুই ভ্রুঁ এক করে প্রশ্ন করলো মেহনূর,

– মানে?

খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে খাবার চিবাচ্ছিলো মাহতিম। খাবারটা গিলে এবার সোজাসুজি মেহনূরের দিকে তাকালো। গম্ভীর চাহনিতে চোয়াল শক্ত করে বললো,

– আমি গতকাল এসেছি, আজ নই। কথাটার মানে বুঝতে পারছো?

ক্রমশ ভাতের উপর আঙ্গুল থেমে গেলো, হতভম্ব দৃষ্টিতে মাহতিমের দিকে তাকালো মেহনূর। উদ্বিগ্ন কন্ঠে টেনে-টেনে বললো,

– মা-মা-নে কি?

আরো গম্ভীর হলো মাহতিম। যদি ওই কথাগুলো শুনে থাকে তাহলে এরকম বেকুবের মতো ‘ মানে-মানে ‘ করতো না। তার মানে মেহনূর কিছুই বুঝেনি। মাহতিম বুকভর্তি নিশ্বাস ছেড়ে ঘটনাবলী বলতে শুরু করলো,

– এখানে গতকাল সন্ধ্যায় পৌঁছছি। আজকে পৌঁছাইনি। সঙ্গে আমার ডিপার্টমেন্টের গাড়ি আর সালেহ ছিলো। নোমান পার্সোনাল ছুটিতে ছিলো, এজন্য সালেহকে সঙ্গে এনেছিলাম। তোমাদের বউবাজারের কাছ থেকে কেউ আমাদের ফলো করছিলো। নোট ডাউন, তাদের আমি চিনি না। আমার টার্গেট ছিলো গাড়ি ফিরিয়ে বউবাজারে নেমে যাব। এরপর গ্রামীণ দৃশ্য দেখতে-দেখতে হেঁটেই বাড়ি পৌঁছবো। চান্সটা আর পাইনি। পেছন থেকে চারটা বাইক কোনো কারণ ছাড়াই লেগে পরলো। তোমাদের ওই বাঁশঝাড়ের শর্টকাট রাস্তাটা চিনো না? ওখানে সন্ধ্যা নামলে অটোমেটিক নির্জন হয়ে যায়। মানুষ থাকে না। ওখানে গাড়ি আসতেই পেছনের গ্লাসটা হকিস্টিক দিয়ে গুড়িয়ে দিলো। একমূহুর্ত ভেবেছিলাম ডাইরেক্ট শ্যূটে নামবো, পরে গ্রাম্য এলাকা ভেবে থেমে গেলাম। সালেহ থামেনি, একহাতে স্টিয়ারিং ধরে ওমনেই রিভলবার বের করলো। আমি ওকে গুলি চালাতে নিষেধ করলাম। ততক্ষণে আমার ডানে-বামে হকিস্টিক মেরে কাঁচ গুড়িয়ে শেষ। বাইকাররা থামছিলো না, শেষে সালেহের জানালার কাছে ইচ্ছে করে বারিটা মারলো। সালেহ কন্ট্রোল হারিয়ে গাড়িটা রাস্তা ছেড়ে জমিতে থামালো, সাথে-সাথে ওখানে ঘিরে ধরলো ওরা। সংখ্যায় আটজন ছিলো, ওই আটটাকেই পিটিয়ে জখম করেছিলাম। সালেহ টোটালি সেন্সলেসের পর্যায়ে, ডান কান থেকে মারাত্মক ব্লিডিং হচ্ছিলো। ইমার্জেন্সিতে হসপিটালে পাঠানোর ব্যবস্থা করবো, তার আগেই পেছন থেকে কে যেনো ধারালো কিছু ঢুকিয়ে দিলো। ওই শালার টার্গেটই ছিলো ক্ষুর দিয়ে বুকের বাঁ পাশটা এফোড়-ওফোড় করবে। শালা পারেনি। ক্ষুর দিয়ে মোচড় মারার আগেই ওকে সাইড করলাম। ঘুষিটা দিতেই দেখি বারো জনের মতো ছুটে আসছে, সবগুলোর হাতে অস্ত্র। সালেহকে ততক্ষণে সেইফ জোনে সরিয়ে ধাক্কা মারলাম। ও সরে গেলো। একজনের হাতে পেট্রোলের অস্তিত্ব দেখে ওদের বাকিটা প্ল্যান আন্দাজ করা গেছিলো। আমারও ব্লিডিং হচ্ছিলো, ক্ষুরটা বের করার পর তেমন সেল্ফ ডিফেন্সের এনার্জী ছিলো না। পিস্তল ছিলো গাড়িতে, যার জন্য এনকাউন্টার করতে পারিনি। অবশ্য ওদের চোখে আমি ম-রে গেছি। ওরা আমাকে ক্ষুর দিয়ে জখম করে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে, জাস্ট এটাই জানে।

একদমে কথাগুলো বললো মাহতিম। ভয়-ডর ছাড়াই দ্বিতীয় লোকমার জন্য ভাতের দিকে ইশারা করলো। মেহনূর নিজের চকিত ভাব কাটাতে পারলো না, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেই ভীতু চাহনিতে প্রশ্ন করলো,

– আর কোথাও ব্যথা পাননি?

মাহতিম সহজ ভঙ্গিতে উত্তর দিলো,

– না, পাইনি। প্লিজ বসে থেকো না। খাইয়ে দাও।

হতভম্ব ভাব কাটিয়ে ফের ভাত মাখালো মেহনূর। লোকমা পাকাতেই প্রশ্ন করলো,

– রাতে কোথায় ছিলেন? আর ওই সালেহের কি হলো?

প্রশ্নটা করেই মুখে লোকমা তুলে দিলো মেহনূর। পেটের খিদেয় জোরে-জোরে খাবার চিবাতে লাগলো মাহতিম, প্রশ্ন শুনে ধাতস্থ হয়ে একচুমুক পানি খেয়ে বললো,

– আগে সালেহের ব্লিডিং অফ করলাম। আধ ঘন্টার ভেতর সেন্স ফিরে এলো, কিন্তু বেচারা উইক ছিলো। ওকে পাঠিয়ে দিয়ে সেই তরুণ মার্কা রেসোর্টটায় চলে গেলাম।

প্রচণ্ড ক্ষেপলো মেহনূর, আগুন চোখে বললো,

– তরুণ মার্কা মানে?

মাহতিম খোঁচা মেরে হাসতে-হাসতে বললো,

– তোমার তরুণ ভাইয়ের জন্য মালিক স্টিল আমাকে ভয় পায়। আমি ওখানে যেতেই, পারে না মাথা তুলে নাচে। হায়রে ব্যাটার কি ভয়!

মাহতিমের ঈষৎ খোঁচায় রুষ্ট হলো মেহনূর। ক্রুদ্ধ গলায় উত্তর দিলো,

– আপনি একটা নষ্টার কথা আমাদের মাঝখানে তুললেন। আপনি জানেন ওই ঘটনাগুলো আমার জন্য ভালো ছিলো না। কোনো মেয়ের জন্যই ওই স্মৃতিগুলো ভয়ংকর ছাড়া কিছু নয়। আপনি কাজটা ইচ্ছে করে করলেন না?

বাকি কথা বলতে গিয়েও মাহতিম চুপ রইলো। খাবারটা শান্ত ভাবে খেয়ে নিয়ে কলপাড় থেকে হাতমুখ ধুয়ে এলো। ঔষুধ গিলে একটু নিস্তার অনুভব করলো মাহতিম। আনন্দের ব্যাপার হলো হান্নান শেখ আজ বাড়িতে নেই, ওই সাধু বুড়ো আজও ফিরছেনা। তাহলে দ্বিতীয় টোপটা কি ফেলবে? ফেলা যায়। বেশ মোক্ষম সুযোগ। কাজটা করার আগে মেহনূরের রুমে আসলো মাহতিম। দরজায় ডানবাহু ঠেকিয়ে প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজলো। ভেতরে তাকিয়ে শান্ত গলায় ডাকলো,

– মেহনূর?

মোটা উপন্যাসের ভেতর অভিমানী মুখটা লুকিয়ে রেখেছে। তার ডাকে একবারও চোখ তুললো না সে। উলটো না শোনার ভান করে চুপ করে রইলো। খুবই অদ্ভুত হাসি দিয়ে ভণিতা ছাড়াই বললো মাহতিম, গলা খাকাড়ি দিয়ে বললো,

– ষোল নাম্বার শাড়ি, নো সাজগোজ। পাক্কা বিশ মিনিট দিলাম।

গম্ভীরতা বজায় রেখে পা ঘুরালো মাহতিম। শানাজ, সাবার রুমটা অতিক্রম করতে-করতে সিড়ি দিয়ে নামলো। এবার সে দ্বিতীয় কাজটায় হাত দিবে। পকেটে হাত গুঁজে আনমনা ভঙ্গিতে হাঁটতে-হাঁটতে সবুজ পর্দার সামনে আসলো। দরজাটা খোলা বলে লম্বা-লম্বা পর্দাগুলো মেঝে ছুঁয়ে ঝুলছে। মাহতিম পকেট থেকে হাত বের করে সৌজন্যে গলায় বললো,

– বড় মামী, আপনি কি জেগে আছেন?

হঠাৎ ভেতর থেকে পায়ের আওয়াজ শোনা গেলো। চোখের পলকেই ঝুলন্ত পর্দাটা দুপাশে সরে গিয়ে মাঝখানে ফাঁক হলো। মাহতিমের মুখোমুখি হলো সুজলা। অনিচ্ছুক হাসিটা টেনেটুনে ঠোঁটের কাছে ঝুলিয়ে দিলেন তিনি, সুলভ আচরণে ঠান্ডা মেজাজে বললেন,

– বাবা ঘুমাওনি? আসো, আসো। আমার তো রাতে ঘুম আসে না বাবা। এজন্য বসে-বসে তসবী জিকির করি। আসো,

মাহতিম সপ্রতিভ হাসি দিয়ে সুজলা পিছু-পিছু সুজলার বিছানায় বসলো। সুজলার ডানহাতে তসবীর মালা, চোখে-মুখে অদ্ভুত শঙ্কা। মাহতিম যেনো অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে সুজলার অবস্থাটা পড়তে পারছে। কোনো ভূমিকা না করেই মোদ্দাকথায় ফিরলো মাহতিম, নিজের সহজাত গাম্ভীর্য আচরণ ধরে বললো,

– এই বাড়ির হর্তাকর্তা হান্নান নানা হলেও আপনার সাথে জরুরী কিছু কথা ছিলো। কথাগুলো আপনাকেই বলবো বলে ঠিক করেছি। আমার বন্ধু সৌভিক আপনার বড় মেয়ে শানাজকে পছন্দ করে। তাদের মধ্যে মনের দিক দিয়ে সুসম্পর্ক থাকলেও সেটা পারিবারিক রেশ ধরে এগোয়নি। আমি আমার বন্ধু শাফায়াত ইসলাম সৌভিকের জন্য আপনার বড় মেয়ে শানাজ মুবাশশিরাকে স্ত্রী হিসেবে চাইছি। আমার মা খুবই অসুস্থ, আর সৌভিকের মা নেই। ওর পারিবারিক গার্ডিয়ান হিসেবে ওর বাবা থাকলেও বর্তমানে তিনি ব্যবসায়িক কাজে বিদেশে আছেন। সৌভিক আমাকে ওর বন্ধু ভাবেনা। এমনকি ওকেও আমি বন্ধুর নজরে দেখিনি। অবুঝ বয়স থেকে সৌভিকের সাথে বড় হয়েছি মামী। ওর পরিবারে কেউ ওর যথার্থ মূল্যায়নের জন্য ছিলো না। আমাদের বাড়িতেই বলতে গেলে মানুষ হয়েছে। ওর পৃথিবীতে আত্মীয় বলতে ও সবসময় আমাকেই পরিচয় দেয়। আজ সেই পরিচয়কে সঙ্গে করে আপনার কাছে হাজির হয়েছি। আমার ভাইটাকে আপনি সুখী করে দিন মামী। ওর জীবনে একটা মানুষ দরকার, যে ওকে দেখভাল করবে। আমি শানাজের চেয়ে ওমন যোগ্য মেয়ে কোথাও পাবো না। এই বাড়ির মেয়ে হিসেবে যখন মেহনূরকে আমি বিয়ে করেছি, সেদিনই বুঝে গিয়েছি ওদের সম্পর্কটা পারিবারিক করা উচিত। সৌভিকের মধ্যে কোনো খুঁত নেই মামী। একটু জেদ আছে। এছাড়া আর কোনো দোষ খুঁজে পাবেন না।

সুজলার তসবী জপার হাতটা থেমে আছে। তিনি চোখ নিচু করে গভীর মনে কিছু চিন্তা করছেন। মাহতিম যেনো সেটাও ধরতে পারলো। সুজলা এখন ভাবছে, হান্নান শেখ এই বিয়ে হতে দিবে না। মাহতিমের আসল পেশা সম্পর্কে যখন জেনেই গেছে, তাহলে শানাজের কপালে দূর্গতি জুটতে পারে। আবার শানাজকে যদি অন্য কারো কাছে বিয়ে দেন, সেক্ষেত্রে পাত্র হয়তো মনের মতো জুটবে না। সৌভিক এককথায় সবদিক দিয়ে নিখুঁত। সৌভিকের মতো ছেলেকে পেলে যেকোন অভিভাবক চোখ বন্ধ করে পাত্রী তুলে দিবেন। তার চেয়ে বড় ব্যাপার, পুরো বিষয়টার দেখাশোনা মাহতিম করবে। তিনি মাহতিমের উপর প্রচণ্ড ভরসা করেন। মাহতিমের মধ্যে উগ্রবাদী স্বভাব নেই, সুসংযত ব্যক্তিত্ব সবসময় ওর আচরণে প্রকাশ পায়। সুশীল ব্যক্তিত্ব যে কারো মন ও মস্তিষ্ক আকৃষ্ট করতে বাধ্য। সুজলা খুব আস্তে-আস্দে নত চোখদুটো তুললেন। তসবীর মালাটা হাত থেকে সরিয়ে বালিশের কাছটায় রেখে দিলেন। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে আজ বুক কাঁপছে, এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার দুঃসাহস তার কখনোই ছিলো না। যদি শ্বশুর এই ব্যাপারে জানতে পারে, তখন কি হবে? কি বিপত্তিটা ঘটতে পারে? ভয় কাটছে না। কোনোমতেই কাটছেনা।

.

পিঠের ব্যথাটা কমেছে। ঔষুধের পাওয়াটা হাই ছিলো বলে ভালোই কাজ করেছে। এখন বাঁহাত নির্বিঘ্নে নাড়াতে পারছে। পিঠের চোটটা সারতে কতদিন লাগবে কে জানে? এসব চোটকে অবশ্য পরোয়া করে না মাহতিম। ক্ষুর-চাকু-বুলেট তিনটাই ইতিমধ্যে নানা অপারেশন করতে গিয়ে খেয়েছে। তবে, ক্ষুরের অভিজ্ঞতা আজ নতুন করে একটু-আধটু ভুগিয়ে ছেড়েছে। গায়ের নেভি শার্টটা কিভাবে মেহনূরের কাছে এলো উত্তর পায়নি। সম্ভবত মেহনূর এটাকে চুরি করেছিলো। নক্ষত্রবাড়ি রেসোর্টের রাতে মেহনূর তখন এই শার্টটাই পড়তে চেয়েছিলো। সেদিনের ঘটনাটা মনে পড়তেই হেসে ফেললো মাহতিম। আজ সে ইচ্ছে করেই মেহনূরের রুমে যায়নি। তার সেই রুমটায় এসে শুয়েছে, যেখানে সে প্রথমবার এসে থেকেছিলো। রুমটার জানালা বেশ বড়। খোলা জানালা দিয়ে মিষ্টি গন্ধের সাথে ঠান্ডা বাতাস আসছে। যেনো মন-প্রাণ জুড়ানো ঠান্ডা বাতাস। বাতাসটা আরেকটু গায়ের মাখার জন্য শার্টের টপ বোতামদুটো খুলে ফেললো। লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণ দেওয়ার জন্য এমন ঠান্ডা বাতাসই যথেষ্ট। কারেন্ট না থাকার জন্য রুমে এখন হারিকেন জ্বলছে। পলতেটা বেশ বাড়িয়ে দিয়েছে সাবা। রুমটা হলদেটে আভায় ছেয়ে আছে। কারেন্টের আশা আপাতত সকাল ছাড়া হবে না। এ নিয়ে অবশ্য আফসোস হচ্ছে না। হঠাৎ মৃদ্যু-মৃদ্যু শব্দ এসে দরজার কাছে থামলো। মাহতিম মিচকি হাসি দিয়ে দরজার দিকে চোখ ফেললো। সে দরজাটা ইচ্ছে করে আঁটকে শোয়নি। কাঠের দরজাটা ‘ খড়খড় ‘ শব্দ তুলে খুলে যেতে লাগলো, মাহতিমের চোখ উন্মুখ হয়ে দেখার জন্য উতলা। ভীতু মেহনূরের মুখটা অবশ্য দেখার মতোই হবে। ব্যাপারটায় বেশ মজা পেতেই হঠাৎ মুখের হাসি খসে পরলো। মাহতিম অবাক! পুরো দরজা খুলে যেতেই একজোড়া পা প্রবেশ করলো। হারিকেনের হলদে আলোয় রহস্যময় লাগছে, অদ্ভূত শোভায় সজ্জিত হয়ে আগমন করেছে। গাঢ় নীলাভ শাড়ির আঁচল পাকা মেঝেটা ছুঁয়ে আসছে। শোয়া থেকে উঠে বসলো মাহতিম, অবাক নয়নে ড্যাবড্যাব করে আপাদমস্তক চোখ বুলালো। মাথার মাঝখানে সিঁথির ফাঁক, চোখে কালো মায়ার কাজল, চিকন নাকটার নিচে আদুরে ঠোঁটদুটো লজ্জায় কাঁপছে, নীল শাড়ি পড়ুয়া মেহনূর দুরুদুরু বুকে হাজির হয়েছে। মখমলের নীল ব্লাউজটা কোমরের দিকে একটু টানলো সে, কোমরের অনিচ্ছুক ফাঁকাটা জর্জেট শাড়িতে দেখা যাচ্ছে। হাঁটুর কাছে লম্বা চুলগুলো খোলা জানালার বাতাস পেয়ে উড়ছে। বিছানা থেকে নেমে একপা-দুইপা করে এগিয়ে গেলো মাহতিম। বাতাসে তার জেলহীন চুলও অবাধে উড়ু-উড়ু। মেহনূর নিজেই সম্পূর্ণ দূরত্বটুকু ঘুচিয়ে দিয়ে মাহতিমের কাছে আসলো। পেটের কাছে মুচড়াতে থাকা হাতজোড়া হুট করে খুলে ফেললো। আঙ্গুল সোজা করতেই সামনে থাকা মানুষটার দিকে হাসি দিয়ে তাকালো। নেভি শার্টের দিকে চোখ নামালো মেহনূর, আঁটসাঁট শার্টটার নিচে থাকা বুকটার দিকে কথা কল্পনা করলো। বুকের দুপাশটায় দুটো হাত রাখলো মেহনূর, আস্তে-আস্তে মাথাটা বুকটার মধ্যখানে রেখে দিলো। চোখ বন্ধ করতে-করতে আঙ্গুলগুলো খামচে ধরলো শার্টটা। গর্বিত ভঙ্গিতে নরম গলায় বলে উঠলো মেহনূর,

– আপনাকে পাওয়া আমার জীবনের স্বার্থকতা। আমার সৌভাগ্য আমি এমন মানুষকে পেয়েছি যাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারি। যার কোনো কথাই আমি ফেলতে পারিনা, অমান্য করতে পারিনা, কোনোদিন তার প্রতি ন্যাকা অভিমান রাখতে পারিনি। আপনি আমার শানাজ বুবুর দুঃখটাও দূর করে দিলেন। বুবু আমার কাছে খুশীতে কথা বলতে-বলতে কেঁদে ফেলেছে। আজ কতগুলো দিন পর বুবুর চোখে খুশী-হাসি-কান্না দেখলাম। আপনিই বলুন, আপনাকে কে না ভালোবাসবে? কার সেই সাহস আছে আপনাকে না বাসার? আপনি নিজেকে এমনভাবে প্রকাশ করেছেন, মানুষকে আপনি নিজের প্রতি ভয়ংকর ভাবে টেনে নিয়েছেন। আমার চারপাশ জুড়ে এমন দেয়াল বেঁধে দিয়েছেন, যেখানে শুধু আপনার নাম, আপনার শক্ত পরিচয় আঁটকে গেছে। সেখানে মাহতিম আনসারীর নামই সীমাবদ্ধ। ওই নামের পাশে আমার পরিচয় যুক্ত হওয়াটা আমার —।

ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলালো মেহনূর। কন্ঠ দিয়ে আওয়াজ বের করা যাচ্ছে না। ভেতর থেকে কান্নার দলটা উত্থাল-পাত্থাল করছে।

চলমান .

#FABIYAH_MOMO

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here