#স্নিগ্ধ_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১৮
আকাশটা আজ স্বচ্ছ।পূর্ণ রূপে চাঁদ উঠেছে আকাশে,সাথে রয়েছে অসংখ্য তারার মেলা।মৃদ্যুমন্দ শীতল হাওয়া বইছে।মনোমুগ্ধকর পরিবেশটা উপভোগ করছে আরাবী বারান্দায় দাঁড়িয়ে।হাতে তার এককাপ ধোঁয়া উঠা কফি।আজ সারাদিনের ঘটে যাওয়া টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো মনস্পটে ভেসে বেড়াচ্ছে।জায়ানের করা পাগলামিগুলো মনে করলেই লজ্জায় আরাবীর শ্যামরঙা মুখশ্রী যেন আরও মায়াময় হয়ে উঠে।এলোমেলো চুলগুলো কানের পিঠে গুজে আরাবী মুচঁকি হাসল।লোকটা এতো ঠোঁটকাটা।কিসব বলে ফেলে অকপটে।একটু বুঝেও না তার বলা লাগামছাড়া কথাগুলো ঠিক কতোটা লজ্জা দেয় ওকে।আরাবী ওর হাতের দিকে তাকালো।এখনও ওর হাতে জায়ানের পরিয়ে দেওয়া সেই কাঠগোলাপ ফুলের মালা।আলতো হাতে স্পর্শ করে ফুলগুলোকে আরাবী।
কাঠগোলাপ অনন্য সুন্দর একটি ফুল। এই ফুলের রূপ এতটাই মোহনীয়, যে কেউ যদি কাঠগোলাপ দেখে, না ছুঁয়ে পারবে না। ধবধবে সাদা রঙের পাপড়িগুলোর মাঝে গাঢ় হলুদ রঙের ছোঁয়া লাগা এই ফুলকে সবাই পছন্দ করে। আরাবীর কাছে মনে হয় কাঠগোলাপের মতো এত সুন্দর ফুল আর পৃথিবীতে হয় না। যখন আরাবী প্রথমবার এও ফুল দেখেছিলো।এক পলক দেখাতেই এই ফুলের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো ও।কাঠগোলাপের পাপড়িগুলো কতই না মনোরম। বৃষ্টিভেজা কাঠগোলাপ দেখতে সে কী অনিন্দ্য সুন্দর।এতো স্নিগ্ধ,মনকাড়া ফুলের নামে নাকি তাকে ডাকে জায়ান।আচ্ছা সে কি আসলেই এই ফুলটার মতো এতো সুন্দর?ফুলগুলো কি সুন্দর শুভ্র রঙের।কিন্তু ওর গায়ের রঙ তো শ্যাম বর্ণের।তবে কেন তাকে কাঠগোলাপ ডাকে লোকটা। আনমনা আরাবীর ধ্যান ভাঙলো ফোনের আওয়াজে।মেসেজ এসেছে।আরাবী ফোনটা অন করল।দেখল সেই আননোন নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে।
অনেকদিন অজ্ঞাত ব্যক্তিটি মেসেজ দেয়নি ওকে।আজ হঠাৎ করে আবার এইভাবে মেসেজ পেয়ে বড্ড অবাক হলো আরাবী।মেসেজ ওপেন করে দেখল সেখানে লিখা,
‘ আজকে ম্যাডামের মুড কি অনেক ভালো?’
আরাবী মেসেজটা পড়েই ওর বারান্দা দিয়ে রাস্তায় তাকায়।দেখে সেই কালো রঙের গাড়িতে আজও ওর বারান্দা বরাবর দাঁড় করানো।প্রতিদিন এই গাড়িটা এখানে দাঁড়িয়ে থাকে।আরাবী আর মেসেজের উত্তর দিলো না।অনেক হয়েছে এই লুকোচুরি।আজকে হাতেনাতে অজ্ঞাত ব্যক্তিটিকে ধরবে।যেই ভাবা সেই কাজ।আরাবী ঘরে ফিরে আসল।গায়ে ভালোভাবে ওড়না জড়িয়ে নিয়ে মাথায় ঘোমটা দিলো।তারপর বেড়িয়ে আসল রুম থেকে।বসার ঘরে কেউ নেই।ওর বাবা মা এতোক্ষণে ঘুমিয়ে গিয়েছে।ফাহিম এখন নিজের রুমে।আরাবী গেটের চাবি নিয়ে চুপিচুপি বেড়িয়ে এলো ঘর থেকে। তবে মেইন গেটের কাছে দারোয়ানকে দেখে ভড়কালো একটু।এদিকে আরাবীকে এতো রাতে এখানে দেখে দারোয়ান বলে উঠে,
‘ কি হইছে আরাবী মা?এতো রাইতে তুমি এইহানে?’
দারোয়ানের সাথে আবার আরাবীর অনেক ভালো সক্ষতা।তিনি আরাবীকে বেশ স্নেহ করেন।আরাবী আমতা আমতা করে বলে,
‘ আসলে আংকেল আমার একটা একজন কলিগ এসেছে।আমার তো ভীষণ শরীর খারাপ ছিলো আমি অফিসে যেতে পারিনি।তাই কিছু জরুরি কাজে সে আমার সাথে দেখা করতে এসেছে।ওইতো ওইযে কালো রঙের গাড়িটা দেখছেন নাহ?ওই গাড়িতেই বসে আছে।’
দারোয়ান সাহেব খানিকটা চিন্তিত হলেন।এতো রাতে একটা মেয়েকে এইভাবে যেতে দেওয়া তার ঠিক মনে হচ্ছে না।আবার আরাবী এমনভাবে বলছে মানা করতেও পারছে না।তাই শেষমেষ আরাবীকে বের হতে অনুমতি দিলো।আরাবী দারোয়ানকে ধন্যবাদ দিয়ে এইবার গাড়িটির দিকে এগিয়ে গেলো।বেশ অনেকটা দূরেই দাঁড়ানো গাড়িটি।তবে আরাবীর বারান্দা থেকে স্পষ্ট দেখা যায়।আরাবী গাড়িটির সামনে এসে দাঁড়ালো।তারপর কোনো কিছু না ভেবেই গাড়ির জানালার কাচে চাপড় মেরে বলতে লাগল,
‘ কে আপনি?বেড়িয়ে আসুন।বেড়িয়ে আসুন বলছি।ভালো হবে না কিন্তু আপনার জন্যে।আমাকে এইভাবে মেসেজ করে বিরক্ত করার কারন কি?সাহস থাকলে আমার সামনে আসুন।যা কথা হবে সামনা সামনি হবে।’
কিন্তু না কোনো সারাশব্দ এলো না ভেতর থেকে।আরাবী আরও দু চারবার ডাকল। এইবার হতাশ হলো বেশ।গাড়িটিতে বোধহয় কেউ নেই।শুধু শুধু একটু বেশিই ভাবছিলো আরবী।নিজেকে বকাঝকা করতে করতে আরাবী বাড়ি যাওয়ার জন্যে যেই না পা বাড়াতে যাবে।ওমনি গাড়ির দরজাটা হুট করে খুলে গেলো।তারপর একটা শক্ত পুরুষালি হাত এসে আরাবীর কব্জিটা শক্ত করে চেপে ধরল।আরাবীকে কিছু ভাববার সময়টুক না দিয়ে।হাতের মালিক আরাবীকে টেনে গাড়ির ভেতরে নিয়ে আসল। তারপর ঠাস করে দরজাটা লাগিয়ে দিলো।এদিকে আরাবী ভয়ে চোখ মুখ খিচে রয়েছে।কি হলো এটা ওর সাথে?ওকে কি কিডন্যাপ করে নিলো?এইবার কি ওকে মেরে ফেলবে?
‘ চোখ খুলো স্টুপিট একটা।’
আচমকা ধমকে কেঁপে উঠল আরাবী।পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়।তাকাতেই যেন চারশ চল্লিশ বোল্টের ঝটকা খেলো আরাবী।ওর সামনে আর কেউ না স্বয়ং সাফওয়ান জায়ান সাখাওয়াত বসা।যে আপাততো খেয়ে ফেলব দৃষ্টিতে আরাবীর দিকে তাকিয়ে আছে।আরাবী শুকনো ঢোক গিলল।কাঁপা গলায় বলে উঠল,
‘ আ..আপনি?’
‘ তো?আর কাকে এক্সপেক্ট করছিলে তুমি?’
আরাবী পিটপিট করে তাকিয়ে বলে,
‘ রেগে যাচ্ছেন কেন?’
জায়ান ভ্রু-কুচকে বলল,
‘ তো?এখন কি তোমাকে চুমু খাবো?’
আরাবী থমকে গেলো।জায়ান আবারও বলে উঠে,
‘ চুমু যে একটু খাবো তাও তো পারব না।আমি একটুখানি ছুঁয়ে দিলেই তো নেতিয়ে পরে।আমি শুধু ভেবে কুল পাইনা।বিয়ের পর তো আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারবো না।একদম পারবো না।তখন আমার কন্ট্রোলল্যাস চুমুর থেরাপিতে তোমার কি হাল হবে। আমি কোনো রাত,দিন, সময়,অসময় দেখব না।আমার যখন মন চাইবে আমি চুমু…..’
জায়ানকে আর বলতে দিলো না আরাবী।দুহাতে জায়ানের মুখ চেপে ধরে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।হালকা আওয়াজে চেঁচালো,
‘ ছি! আপনার এই অসভ্য কথাবার্তা বন্ধ করুন।’
জায়ান আরাবীর হাতের তালুতে চুমু খেলো।যাকে বলে সুযোগের সৎ ব্যবহার।আরাবী কেঁপে উঠল।দ্রুত হাত সরিয়ে নিতে নিলেই জায়ান আরাবীর হাতটা আঁকড়ে ধরল।জায়ান বাঁকা হেসে বলে,
‘ আমি তো এখনও কিছুই বললাম না।তুমি তো মেইন পার্টটা মিস করে গেলে।’
আরাবী করুণ চোখে তাকালো জায়ানের দিকে।বলল,
‘ চুপ করুন না। দোহাই আপনার।আমার লজ্জা লাগে। ‘
জায়ান ওর মুখটা ঝুকিয়ে আনলো আরাবীর কানের কাছে।আরাবী শক্ত হয়ে বসে রইলো।জায়ান ফিসফিস করে বলল,
‘ আমি তো চাই-ই তুমি লজ্জা পাও। কাঠগোলাপ লজ্জা পেলে যে তার স্নিগ্ধতা আরও দ্বিগুন বেড়ে যায়।তখন তাকে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে।খুব গভীর ছোঁয়া যাকে বলে।প্রেম প্রেম ছোঁয়া।’
আরাবী মাথা নিচু করে নিলো।জায়ানের বলা একেকটা শব্দ ওর হৃদয়টা গভীরভাবে ছুঁয়ে দেয়।সুখ সুখ অনুভব হয় আরাবীর।কিন্তু এইবার লোকটাকে থামাতে হবে।যেই হারে লাগামছাড়া কথা বলা শুরু করে দিয়েছে মানুষটা।আরাবী কথা ঘুরাবার জন্যে বলে উঠল,
‘ আ…আপনি এতো রাতে এখানে কি করছেন?’
‘ তুমি এতো রাতে এখানে কেন এসেছ?’ পালটা প্রশ্ম করল জায়ান।
আরাবী চোখ ছোটো ছোটো করে তাকালো জায়ানের দিকে।বলল,
‘ একদম কথা ঘুরাবেন না।আপনার সাথে যবে থেকে আমার দেখা হয়েছে।ঠিক সেদিনের পর থেকেই আমি আপনার এই গাড়িটা আমার বারান্দা দিয়ে রোজ দেখি।আর এখন তো আমি একশ পার্সেন্ট সিওর যে আমাকে আননোন নাম্বার থেকে ওই মেসেজগুলোও আপনিই-ই করতেন।’
জায়ান বাঁকা হাসল আরাবীর কথায়।আরাবী কপালে পরে থাকা চুলগুলো কানের পেছনে গুজে দিতে দিতে বলল,
‘ ভেরি ইন্টিলিজেন্ট গার্ল ইয়্যু আর আরাবী।’
আরাবী হা হয়ে গেলো।তার মানে ওর আন্দাজ টা-ই ঠিক।জায়ানই তবে সেই অজ্ঞাত ব্যক্তি।আরাবীর অভিমান হলো কিঞ্চিত। জায়ান তা দেখে বলে,
‘ মুখ ফুলিয়ে লাভ নেই।হ্যা মানলাম মেসেজগুলো আমিই করতাম।তবে আমার জায়গায় যদি অন্য কেউ হতো?তবে কি হতো বলো তো?এইভাবে ইডিয়টদের মতো কে এতো রাতে বাহিরে চলে আসে?মাথায় বুদ্ধিসুদ্ধি নেই?’
আরাবী মুখ ফুলিয়ে বলে,
‘ আপনি না মাত্র বললেন আমি ইন্টিলিজেন্ট গার্ল।’
‘ বলেছিমাম?আচ্ছা ভুলে যাও সে কথা।তুমি হলো বোকা।আমার অতি প্রিয় একটা বোকা ফুল।যার নাম দিয়েছি আমি কাঠগোলাপ।’
আরাবীর ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। কেন যেন জায়ানের মুখে যতোবার ওকে কাঠগোলাপ বলতে শোনে আরাবী।মনটা খুশিতে চনমনিয়ে উঠে।আরাবী ধীর আওয়াজে বলে,
‘ আচ্ছা আমি একটা প্রশ্ন করি?’
জায়ান আরাবীর বাম হাতটা ধরে আছে। সেখানে অনামিকা আঙুলে ওর পরিয়ে দেওয়া আংটিটা আলতো স্পর্শে দেখছে।আরাবীর প্রশ্নে ছোট্টো কণ্ঠে বলল,
‘ হু, একটা কেন?তুমি হাজারটা প্রশ্ন করো।ইয়্যু ডোন্ট নিড পার্মিশন।’
আরাবী থেমে থেমে বলল,
‘ আপনি আমাকে কাঠগোলাপ কেন ডাকেন?এটা জানতে পারি?’
জায়ান আরাবীর দিকে গভীর চোখে তাকালো।আরাবী চমকে উঠল,ভড়কে গেলো। এলোমেলো হলো দৃষ্টি।লোকটা দৃষ্টির প্রখরতা সহ্য করা যায় না।দেহ মন কেমন শিরশির করে উঠে।হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় হু হু করে।
জায়ান মুচঁকি হাসল আরাবীর অবস্থা দেখে।বলল,
‘ আমাদের প্রথম দেখা কোথায় হয়েছিলো মনে আছে?’
আরাবী জায়ানের কথায় ওদের প্রথম দেখা হওয়ার দিনটা স্মরণ করল।সেই বৃষ্টিমুখর দিন,আরাবীর জ্যামের কারনে ইন্টারভিউ দিতে লেট হয়ে যাওয়া।তারপর হঠাৎ করেই জায়ানের আগমন।ওকে আঘাত পাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজেই আঘাত পেয়ে যায় লোকটা।তারপর পার্কে কাটানো সেই মুহুর্তটা।কাঠগোলাপ গাছের নিচে প্রথমবার জায়ানের চোখে চোখ পড়া।লোকটা চলে যাওয়ার পর মনের মাঝে থেকে যাওয়া কিছু অজানা অনুভূতি।সবটা ভাবতেই আরাবীর ঠোঁটের কোণে মৃদ্যু হাসির রেখা দেখা দিলো।যা দেখে জায়ানও হাসল।হালকা আওয়াজে বলল,
‘ সেই পার্কে কাঠগোলাপ গাছের নিচে কাটানো মুহূর্তটুকু আমি কোনোদিন ভুলব না আরাবী।দমকা হাওয়ার তালে তালে যখন গাছের মাঝে থোকায় থোকায় থাকা কাঠগোলাপগুলো ঝরে পরছিলো তোমার উপর।তখন প্রথমবার আমার হৃদপিণ্ড অন্যরকম কিছু অনুভব করেছিলো।তোমাকে দেখে মনে হয়েছিলো ওই কাঠগোলাপ ফুলগুলোর মতোই তুমি আরেকটা ফুল।স্নিগ্ধ,কোমল,সুন্দর একটা ফুল।তাই তো তো তোমার নাম আমি ভালোবেসে দিয়েছি কাঠগোলাপ।’
আরাবীর চোখ ভড়ে উঠল।অথচ ওর ঠোঁটে হাসির ছাপ।একটা মানুষ কিভাবে এতোটা ভালোবাসতে পারে?জায়ান আরাবীর গালে দুহাত রাখল।তারপর আরাবীর কপালের সাথে নিজের কপাল ঠেকালো।আরাবী আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো।অনুভব করতে লাগল জায়ানকে।যে আস্তে আস্তে নিজের অধিপত্য বিস্তর করছে ওর মনের মাঝে।জায়ান নিজের পুরুষালি নেশাক্ত কন্ঠে বলে উঠল,
‘ কাঠগোলাপের হলুদ ছোঁয়ায়
আমি খুঁজে পাই তোমায়,
কাঠগোলাপের সাদার মায়ায় লেপ্টে রয়েছো তুমি,
কাঠগোলাপের প্রত্যেকটা পাপড়ি মনে হয় যেনো,
প্রত্যেকটা তোমার নামের অক্ষর।
কাঠগোলাপের মুক্ত সুবাসে,
আমি অনুভব করি তোমাকে।
কাঠগোলাপের স্নিগ্ধ চেহারায়,
তোমার মুখ ভেসে ওঠে।
তুমি যখন কানের পাশে কাঠগোলাপ ফুল জড়িয়ে রাখো
এইতো তখন মনে হয় মৃত্যু আমার খুব সন্নিকটে।
তাই তো এতো ভালোবাসি আমি তোমাকে।’
( ছন্দটা একান্ত আমার লিখা না।কিছুটা সংগ্রহ আর কিছুটা আমি যোগ করেছি।)
#চলবে__________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। কেমন হয়েছে জানাবেন।