স্নিগ্ধ_কাঠগোলাপ #সাদিয়া_জাহান_উম্মি #পর্বঃ৩৫

0
719

#স্নিগ্ধ_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৩৫
আনমনা হয়ে বসে আছে নূর।ভাবনা চিন্তার যেন শেষ নেই।কোনো সমাপ্তি খুজে পাচ্ছে না। ঠিক কি করবে?একদিকে ওর ভালোবাসার মানুষ ফাহিম অন্যদিকে আহাদ।যে সে কোনোভাবেই কষ্ট দিতে চায় না।আহাদকে সে ভালোবাসে না।কিন্তু আহাদের জন্যে ওর মায়া লাগে।হৃদয়ে কোথাও একটা সফট কর্ণার আছে।ছেলেটার নিস্পাপ চোখ দুটোর দিকে তাকালে।তাকে যেন ওর মনের কথাগুলো বলতে যেয়েও পিছিয়ে আসে নূর।
নূর চুল খামছে ধরল।উদাস কণ্ঠে বলল,’ আমি কি করব?তুমিই কোনো উপায় বলে দেও আল্লাহ্! আমার যে আর এই কষ্ট সহ্য হয় না।কেন ফাহিমের জন্যে আমার মনে ভালোবাসা তৈরি করলে?কেন আমি তাকে ভালোবাসলাম।আমার এই এক তরফা ভালোবাসা আমাকে যেন তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে।আমার আর বাচঁতে ইচ্ছে হয় না।’

নূরের গাল গড়িয়ে দুঃখের অশ্রু ঝড়ে।ও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো আহাদকে বলে দিবে ও ফাহিমকে ভালোবাসে।তাই ওকে বিয়ে করতে পারবে না।এতে আহাদ যদি কষ্ট পেয়ে সরেও যায়।তবুও তো সে ফাহিমকে পাবে না।কারন ফাহিম তো ওকে ভালোবাসা তো দূরে থাক।সেই নজরে তাকাওনি।তাহলে ঠিক কি উদ্দেশ্যে সে বিয়েটা ভাঙবে।তার এই এক তরফা ভালোবাসার জন্যে সে আহাদকে কষ্ট দিবে তার পরিবারের প্রতিটি মানুষকে কষ্ট দিবে।এটা কি হয়?নিজের ভালোর জন্যে এতোগুলো মানুষকে তো সে কষ্ট দিতে পারে না।তবে কি আহাদকেই মেনে নিতে হবে?ওর ভাগ্যে কি ফাহিমের সাথে ওর মিল সৃষ্টিকর্তা লিখি নি?
ভাবনার ছেদ ঘটে কারো কণ্ঠস্বরে।নূর দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো।চোখ মুছে ঘুরে তাকিয়ে দেখে ফাহিম।ফাহিম এগিয়ে এসে বলে,’ খাবার বাড়া হয়েছে।খেতে আসো।’
‘ আপনি যান আমি আসছি।’
‘ এখনই এসো।’

নূর করুণ চোখে তাকালো।ওর কান্না পাচ্ছে। ফাহিমকে দেখে যেন নিজেকে সামলাতে পারছে না।নূর নিজের কান্না আঁটকে রইলো।এর ফলে ওর চোখজোড়া লাল হয়ে গেলো।নূরের চেহারার এই বিধ্বস্ত রূপ দেখে ফাহিমের বুকে কেমন যেন করে উঠল।হাস্যজ্জ্বল মায়াবী মুখটার এই মলিনতা যেন সহ্য হলো না ফাহিমের।আচ্ছা,? মেয়েটা কি অসুস্থ?নাহলে এমন দেখাচ্ছে কেন তাকে?ফাহিম প্রশ্ন করল,’ নূর তুমি ঠিক আছ?’

নূর চমকে উঠল ফাহিমের প্রশ্নে।এই প্রশ্নটা কেন করল ফাহিম?নূর আমতা আমতা করে বলে,’ আমি ঠিক আছি।’
‘ তাহলে তোমার মুখটা এমন দেখাচ্ছে কেন?’
‘ ও এমনিতেই।রাতে ঘুমোতে পারিনি ঠিকঠাক।কাজিনরা একসাথে ঘুমিয়েছি তো তাই।’

স্বস্তি পেলো যেন ফাহিম।প্রশান্তির শ্বাস ফেলে বলে,
‘ আচ্ছা খেতে এসো।’

নূর মাথা দুলিয়ে চলল ফাহিমের পিছু পিছু।আজ ওরা আরাবীদের ওর বাবার বাড়ি থেকে নিতে এসেছে।আজ আরাবীকে নিয়ে ওরা ফিরে যাবে সাখাওয়াত ভিলায়।
এদিকে খাবার টেবিলে এসে দেখে সকলেই বসে পরেছে।নূরও চুপচাপ বসে পরল।জায়ানের পাশে।একপাশে আরাবী আর জায়ানের আরেকপাশে নূর।নূর জায়ানের পাশে এসে বসতেই জায়ান খুব গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,’ তোর ফোন কোথায় নূর?’

নূর তাকায় জায়ানের দিকে।উলটো প্রশ্ন করল,
‘ কেন ভাইয়া?’
‘ আহাদ আমাকে ফোন করেছিলো।জানালো তোর ফোনে নাকি কল যাচ্ছে না।আজকে এখানে তো আসতে পারল না ছেলেটা।তাই তোকে নিয়ে সন্ধ্যার পর ঘুরতে বেড়োবে।তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি সন্ধ্যার পরেই এখান থেকে যাবো।আহাদ এখানে এসেই তোকে নিয়ে যাবে।’

এটা শুনে আরাবী বলল,’ তিনি আমাদের বাড়িতে আসবেন নাহ?’
‘ নাহ, আমি বলেছিলাম এখানে ঘন্টা দেড়েক বসার জন্যে।তার নাকি হাতে সময় নেই।এমনিতেই কাজের অনেক প্রেশার।তাই নূরকে নিয়ে ডিরেক্ট ঘুরতে চলে যাবে।’
‘ আচ্ছা,তবে সময় পেলে আসতে বলবেন।’

এদিকে ফাহিম চুপচাপ সব শুনল।সে আসলে বুঝতে পারল না এই আহাদটা আবার কে?কাকে নিয়ে এতো কথা হচ্ছে।কৌতুহল দমাতে না পেরে ফাহিম জিজ্ঞেস করল,
‘ আহাদ কে জায়ান?’

ফাহিমের প্রশ্নে জায়ান বলল,’ ওহ তোমাকে তো পরিচয় করাতে পারিনি।ছেলেটা রিসিপশনের দিন এসে কোনোরকম খেয়েই চলে গিয়েছিলো।বেচারা একা হাতে অফিস সামলায়।তাই ওতো সময় পায় না হাতে।আহাদ হলো নূরের ফিয়ন্সে।নূরের অনার্স শেষ হলেই ওদের বিয়ে হবে।’

জায়ানের মুখে এই কথা শুনে ফাহিম চমকে উঠল।অবিশ্বাস্য নজরে তাকালো নূরের দিকে।এদিকে নূর চুপচাপ বসে খাবার খাচ্ছে।ফাহিমের জায়ানের কথাটা যেন হজম হলো না।নূর তো এখনও কতো ছোটো।ওকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবল কিভাবে?আর নূর তো কোনোদিন ওকে জানালও না যে ওর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।
পরক্ষণে নিজের এমন চিন্তাভাবনায় নিজেই অবাক হলো ফাহিম।আশ্চর্য! সে এসব কথা ভাবছে কেন?নূরের সাথে তো ওর তেমন কোনো সম্পর্ক নেই যে নূর ওর পার্সোনাল লাইফের বিষয়ে ওকে জানাবে।আগে তো কোচিং-এ শিক্ষক ছাত্রী হিসেবে কথা হতো।এখন আরাবী আর জায়ানের বিয়ে হওয়ায় আত্মীয়ের সূত্রে টুকিটাকি কথা বলেছে।কিন্তু নূরের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।এই কথাটা শুনে ওর এতো খারাপ লাগছে কেন?কেন জায়ানের মুখের এই কথাগুলো এতো জঘ’ন্য লাগল শুনতে।কেন এই কথাগুলো কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না।
কই আগে তো কখনও এমন হয়নি?তবে এখন কেন এরকম অনুভূতি হচ্ছে? আরাবীর বিদায়ের সময় নূরের সেই কথাগুলো বলার পর থেকেই নূরকে নিয়ে ওর মন মস্তিষ্ক ভেবেই চলেছে।মাথা থেকে যেন নূরকে সরাতেই পারছে না।সেদিনের নূরের কথাগুলো বেশ প্রভাবিত করেছিলো ওকে।
কিন্তু ওই ক্ষানিকের দেখা সাক্ষাৎকারে এইরকম ভাবনা চিন্তা আসা এটা কেন হচ্ছে?এই কেনোর উত্তর ফাহিম মেলাতে পারছে না কিছুতেই।খাবার টেবিলে চুপচাপ বসে কোনোরকম খাবারটুকু শেষ করল ফাহিম।আর একটা কথাও বলল না। শুধু আঁড়চোখে নূরের দিকে তাকিয়েছে কয়েকবার।কিন্তু নূর একবারও তাকায়নি ওর দিকে।দাঁতে দাঁত চিপে সেখান থেকে উঠে চলে গেলো ফাহিম।এই অসহ্যকর অনুভূতি ওকে পাগল করে দিচ্ছে।
_______
মধ্যহ্ন ভোজন শেষ করার পর মায়ের সাথে টুকিটাকি কাজ শেষ করে রুমে আসল আরাবী।আজ তারা চলে যাবে ভেবেই মনটা খারাপ লাগছে।দুদিন বাবার বাসায় থেকেছে।কিন্তু মন তো যেতে চাইছে না এখান থেকে।মন খারাপ করেই ভেতরে প্রবেশ করল।এসেই ট্রলি ব্যাগটা টেনে বিছানায় উঠিয়ে রাখল।এরপর আলমারি থেকে ওর প্রয়োজনীয় আর যা যা ছিলো তা প্যাকিং করতে লাগল।এদিকে বারান্দায় ছিলো জায়ান।ফোনে ইফতির সাথে কথা বলছিলো।বেচারা অফিসের কাজের কারনে আসতে পারেনি।ও আসেনি এই কারনে আলিফাও আসতে পারেনি।আরাবী বলেছিলো আসতে।কিন্তু আলিফা বলেছে ইফতি নাকি আসবে না।তাই ওকেও মানা করেছে।অফিসে যেতে বলেছে আজ।তাই আরাবী বেশি একটা জোড় করেনি।
কক্ষে এসেই স্ত্রীর মুখে মন খারাপের আঁধার দেখে জায়ান বিচলিত হলো।আরাবীর কাছে এগিলো এলো জায়ান।কিছু না ভেবেই আরাবীকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল।জায়ানের হাতজোড়া ঠাণ্ডা হয়ে আছে।শাড়ির ফাঁকে হাতজোড়া উদর স্পর্শ করতেই আরাবী কেঁপে উঠল।আরাবীর হাতে ওর কিছু প্লাজো আর টি-শার্ট ছিলো।সেগুলোও পরে গেলো।আরাবী জায়ানের হাতের উপর হাত রাখল।মৃদু আওয়াজে বলে,’ কি করছেন?আপনার হাতগুলো এতো ঠাণ্ডা কেন?’

জায়ান আরাবীকে ঘুরিয়ে ফেলল।নিজের মুখোমুখি করল।আরাবীর কোমড় দুহাতে জড়িয়ে নিয়ে বলে,’ বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে দেখছ না?একটু বৃষ্টির পানি স্পর্শ করেছিলাম।’

আরাবীর বিচলিত হলো।বলল,
‘ তাহলে ধরলেন কেন?ইশ,শরীরটাও যে ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে একদম।’

জায়ানের গালে,কপালে হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল আরাবী।জায়ান আরাবীকে টেনে আনল নিজের আরেকটু কাছে।খুব শক্ত করেই ধরল।ব্যথা পেলো আরাবী।ঠোঁট ফুলিয়ে বলে ‘ উফ,এতো জোড়ে কেউ ধরে?দম আটকে মরে যাবো তো।’

জায়ান ভ্রু উঁচু করে বলে,’ তুমি না বললে আমার শরীর অনেক ঠাণ্ডা হয়ে আছে?’

আরাবী ভ্রু-কুচকে বলে,’ হ্যা বলেছি তো?এটা বলায় এভাবে ধরবেন?’

জায়ান মাথা দুলালো।আরাবী উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে।তা দেখে জায়ান বাঁকা হাসল।আরাবীর কানের কাছে মুখ এগিয়ে আনলো।জায়ানের গরম নিঃশ্বাস নিজের কাধে অনুভব করতেই আরাবী ঘাড় কাত করে ফেলল।ওর কেমন যেন সুরসুরি লাগছে।জায়ান আরাবীর কানের লতিতে চুমু খেলো।চোখ বন্ধ করে ফেলল আরাবী।জায়ান ফিসফিস করে বলে,’ আমার এই শীতল দেহ আর মনটা তোমার ভালোবাসার উষ্ণতায় উষ্ণ করতে এসেছি। বুঝেছ বোকা মেয়ে।’

আরাবী মাথা নিচু করে নিলো।জায়ান সোজা হলো।আরাবীকে লজ্জা পেতে দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসল।বলল,’ বিয়ের পর থেকে প্রতিরাতেই এতো এতো আদর সোহাগ দিচ্ছি।তাও ম্যাডামের লজ্জা একবিন্দু পরিমানও কমেনি।আদরের ডোজটা কি আরও বাড়াতে হবে ম্যাম?’

আরাবী যেন লজ্জায় মরে যায়।মানুষটা এতো নির্ল’জ্জ কেন?ইশ,কি সব কথা বলে।আরাবী লজ্জায় জায়ানের বুকে মুখ লুকালো।এটা ছাড়া যে উপায় নেই।এখানেই নিজের লজ্জামিশ্রিত মুখটা সে লুকোতে পারে।ওর সবচেয়ে নিরাপদ স্থান যে ওর স্বামীর বুকে লুকিয়ে পরা।
জায়ান আরাবীকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল।আরাবীর কাণ্ড দেখে হেসে বলল,’ লজ্জা লুকানোর জন্যে লজ্জা দেওয়া ব্যক্তির কাছে এসেই লুকালে?এভাবে কি লুকাতে পারবে?সেই তো আমার কাছ থেকে বাচাঁর জন্যে আমার কাছে এসেই নিজেকে সমর্পণ করলে।তুমি আসলেই আমার বোকা কাঠগোলাপ।’

#চলবে_________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।কেমন হয়েছে জানাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here