#স্নিগ্ধ_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৪০
আজ ফাহিম ইচ্ছে করেই নূরদের ক্লাস নিতে এসেছে কোচিং-এ।এটা ও কেন করল ও জানে না।শুধু এটুকু জানে ওর নূরকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছিলো।তাই তো কলেজে না গিয়ে এখানে এসেছে।কিন্তু যার জন্যে এখানে আসা সেই নিষ্ঠুর রমণী একবারের জন্যেও ওর দিকে তাকাচ্ছে না।নূর একধ্যানে বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। না দৃষ্টি এদিক যাচ্ছে আর না ওদিক।অন্যদিন হলে নূরের বইয়ের প্রতি এতো মনোযোগ দেখলে ফাহিম খুশি হতো।কিন্তু আজ যেন ওর বইয়ের প্রতি এতো মনোযোগ সহ্য হচ্ছে না ফাহিমের।অসহ্য লাগছে সবকিছু।মন চাচ্ছে নূরের হাতের ওই বইটা পুড়িয়ে ফেলতে।কিন্তু কেন এমনটা মন চাইছে ওর?এই মনটা কেন এতো দিশেহারা হয়ে আছে ইদানিং।যেন ওর মন, মস্তিষ্ক ওর হাতে নেই।ফাহিমের নিজের প্রতি রাগ লাগল।এসব কি করছে ও?নূর অন্য একজনের বাগদত্তা। নূরের দিকে তাকানোও তো ওর পাপ?সেখানে আজ কয়েকটা দিন যাবত চব্বিশ ঘন্টা নূরের কথাই ভাবতে থাকে ফাহিম।ফাহিম নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করছে।না,এখানে আর বেশিক্ষণ থাকা যাবে না।
ফাহিম গম্ভীর স্বরে বলল,’ আজ এখানেই ক্লাস শেষ।আজ যা যা পড়ালাম এগুলো অনেক ইম্পোর্ট্যান্ট।সবাই পড়াগুলো আয়ত্ত্বে করে নিও।’
সবাই ফাহিমের কথায় সম্মতি প্রদান করল।ফাহিম বেড়িয়ে আসল ক্লাসরুম থেকে।টিচার্সরুমে গিয়ে বিদায় নিয়ে আসল।তার এখন কলেজে যেতে হবে।ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের একটা ক্লাস মিস দিয়েছে।বাকি ক্লাসগুলো মিস দিতে চায় না।তাই দ্রুত কদমে পা চালালো।বিল্ডিং থেকে বেড়িয়ে রাস্তায় আসতেই অনাকাঙ্ক্ষিত এক দৃশ্য দেখে ফাহিমের চলন্ত পা-জোড়া থেমে গেলো।গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে নূর আর সাথে ওর বাগদত্তা আহাদ।
আহাদ নূরের কাধের ব্যাগটা নিজের হাতে নিয়ে নিলো।তারপর নূরের একটা হাত নিজের হাতের মুঠোতে নিয়ে নিলো।এই দৃশ্যটুকু দেখে যেন ফাহিমের বুকের বা-পাশটায় আগুন ধরে গেলো।ভীষণ জ্বলন অনুভব হতে লাগল।সহ্য হচ্ছে না আহাদের হাতটা যে নূরের হাত ধরেছে।ইচ্ছে করছে আহাদকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে নূরের কাছ থেকে।কিন্তু না এমনটা যে করার অধিকার ওর নেই।আর কি কারনেই বা ও এমনটা করবে?কেন ওর মনে এসব ভাবনা আসছে।
ফাহিম ফের তাকালো।দেখল আহাদ একটা রিক্সা দাঁড় করাচ্ছে।অতঃপর তারা সেই রিকশাটায় উঠে চলে গেলো।নিষ্ঠুর রমণীটি একটাবারের জন্যেও পিছু ফিরে চাইলো না।
—-
চুপচাপ রিক্সায় বসে আছে নূর।ওর পাশেই হাসিমুখে বসে আছে আহাদ।আজ অফিসে তেমন একটা চাপ নেই।তাই ভাবল লাঞ্চ আওয়ারের আগ পর্যন্ত নূরকে সময় দেওয়া যাক।আহাদ তো ভেবেই নিয়েছে একটুখানি সময় পেলে সেটাও নূরের সাথে কাটাবে আহাদ।তবে পাশে বসা নূরের এতো নিরবতা সহ্য হলো আহাদের।ওর হাতের মুঠোতে থাকা নূরের হাতটা আরেকটু শক্ত করে ধরল।হাসিমুখে বলল,’ আজ রিকশায় করে আমরা ঘুড়ব নূর।ইফতি ভাইয়ের থেকে জেনেছি।তোমার নাকি রিক্সায় চড়ে ঘুড়ে বেড়ানো অনেক পছন্দ।’
নূর আহাদের কথায় তার দিকে তাকালো।তার জোড়পূর্বক একটা হাসি উপহার দিলো আহাদকে।আহাদের নূরের হাসিটা দেখে সন্দেহ হলো।মনে হলো না নূর মন থেকে খুশি হয়েছে।এই হাসিটা মিথ্যে হাসি।আহাদ শীতল কণ্ঠে বলে,’ তোমার হাসিটা মিথ্যে নূর।’
চমকে উঠল নূর।তাকালো আহাদের দিকে।অবাক কণ্ঠে বলে,’ মানে?মানুষ মিথ্যে হাসি কিভাবে হাসে?’
কেমন যেন ব্যথিত হৃদয়ের ব্যক্তিদের মতো বেদনাদায়ক হাসল আহাদ।ধীর আওয়াজে বলে, তুমি কি জানো মেয়ে?
হাসি জিনিসটা সত্যি খুব অদ্ভুত! হাজারো দুঃখ লুকানোর জন্য একটা মিষ্টি হাসিই যথেষ্ট!’
একটু থেমে আবারও বলল,’ কিন্তু তোমার এতো কিসের দুঃখ নূর?কেন তুমি সবসময় নিজেকে আমার থেকে আড়াল করে রাখো।নিজেকে গুটিয়ে রাখো আমাকে দেখলেই।তোমার কি আমাকে ভালোলাগে না নূর?আজ আমাকে তোমার মনের কথাগুলো খুলে বলবে?আমার আর এসব সহ্য হচ্ছে না। আমি একটা স্বাভাবিক দাম্পত্যজীবন চাই।সেই জন্য আমি চেষ্টা করছি।কিন্তু আমি একপা এগিয়ে আসলে আমার মনে হয় তুমি দশপা পিছিয়ে যাও।কেন এমন করো নূর?আমার এইসব প্রশ্নের উত্তর কি আজ তুমি দিবে?এভাবে আর আমাক্র ধোয়াশায় রেখো না।আমি উত্তর চাই নূর।’
আহাদের এক একটা কথা যেন নূরের বুকে তীব্র অনুশোচনার জাগ্রত হলো।হৃদয়টা যেন হাহাকার করে বলছে সে ভুল করেছে অনেক বড়ো ভুল।একজনের সাথে কমিটেড থেকেও আরেকজনকে ভালোবেসে ফেলা তো অন্যায়।তাও আবার এতোদিন যাবত আহাদকে মিথ্যে আশা দিয়ে রেখেছে।ছেলেটা ওকে পাগলের মতো ভালোবাসে।ওর কারনে বিয়ের ডেইট আগাচ্ছে না।ও যা চাইছে যেমনটা চাইছে তেমনটাই করছে।কিন্তু বিনিময়ে নূর আহাদের সাথে বেঈমানী করছে।ওকে যে ভালোবাসে তাকে ওর হৃদয়টা না দিয়ে।যে ওকে ভালোবাসা তো দূরে থাক ওর দিকে ঠিকভাবে তাকায়ও না। তাকে হৃদয় দিয়ে বসে আছে।এখন এইসব কথা কোন মুখে আহাদকে বলবে নূর।নূরের হৃদয়ের অনুশোচনাগুলো অশ্রু আকারে ঝরে পরতে লাগল।আর এদিকে নূরের চোখে পানি দেখে আঁতকে উঠল আহাদ।ওর কথায় কি নূর অনেক কষ্ট পেয়েছে?হ্যা পেয়েছে তো। তাই তো মেয়েটা কাঁদছে।
আহাদ অস্থির হলো।বিচলিত হলো খুব।করুণ কণ্ঠে বলল,’ আ`ম সরি নূর।কান্না করো না আর।আ`ম সরি।আমার কোনো কথাতে তুমি কষ্ট পেয়ে থাকলে।আমি অনেক সরি।’
নূর ঠোঁট কামড়ে ধরল কান্না আটকানোর জন্যে।অনেক হয়েছে আর নাহ।আজ সব কথা আহাদকে জানিয়ে দিবে।যা হবার হবে।মনের মাঝে এসব আর চেপে রাখতে পারবে না নূর।এভাবে ধুকে ধুকে মরতে পারবে না।এমন একটা রাত নেই যে ও শান্তিতে ঘুমিয়েছে।নানান এলোমেলো চিন্তাভাবনাগুলো পোকার মতো কিলবিল করে ওর মন মস্তিষ্কে।নূর ভেজা কণ্ঠে বলে উঠল,
‘ আমাকে একটু শান্তিময় কোথাও নিয়ে যাবেন?এই কোলহল এসব সহ্য হচ্ছে না আমার।’
‘ হ্যা অবশ্যই।এখান থেকে তো বেশি দূরে না জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান।সেখানে যাবে?’
‘ আপনি যেখানে খুশি নিয়ে চলুন।আমার শুধু একটা শান্ত পরিবেশ চাই।’
‘ আচ্ছা, আচ্ছা।আমি নিবো।তুমি শুধু কান্নাটা থামাও নূর।তোমার কান্না আমার সহ্য হয়না।প্লিজ কেঁদো না।’
নূর চুপচাপ বসে রইলো।তবে আজ আর কান্না থামানোর চেষ্টা করল না।ঝড়ে পড়ুক না কিছু অশ্রু ফোটা।যদি সেই অশ্রুজলের মাধ্যমে ওর হৃদয়ের কষ্টগুলো একটু হলেও কমে।আসলে কি জানেন?মানুষ তাদের অনুভূতিগুলোকে লুকিয়ে রাখতে চায় তবে এটা ভুলে যায় যে চোখও কথা বলতে পারে।
এদিকে বোটানিক্যাল গার্ডেনের সামনে রিকশা এসে থামতেই আহাদ নেমে দাঁড়ালো। তারপর হাত বাড়িয়ে দিলো নূরের দিকে।নূর দুহাতে চোখ মুছে নিলো।তারপর আহাদের হাত ধরে নেমে দাঁড়ালো রিকশা থেকে।আহাদ রিকশা ভাড়া মিটিয়ে নিলো।তারপর বোটানিক্যাল গার্ডেনে ওদের দুজনের জন্যে দুটো টিকিট কিনে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল।আহাদ এখনও নূরের হাত ধরে আছে।নূর মাথা নিচু করে হাটছে আহাদের সাথে।মনের মাঝে ওর জমানো কথাগুলো কিভাবে বলবে আহাদকে সেটা ক্রমানুসারে সাজিয়ে নিচ্ছে।এভাবে হাটতে হাটতে বেশ অনেকটা দূরে চলে আসল ওরা।আহাদের বেশ ভালো লাগছে নূরের সাথে এভাবে হাটতে।মনে হচ্ছে সময়টা এখানেই থেমে যাক।এভাবেই ওরা সারাজীবন একে-অপরের হাত আঁকড়ে ধরে দূর থেকে দূরান্তে পারি জমাক।
আহাদ আশেপাশে তাকালো।একটুখানি দূরে একটা বড়ো গাছ দেখতে পেলো।সেখানে বসার জায়গা আছে।আর জায়গাটাও নিরিবিলি। আহাদ সেদিকে আঙুল উঁচিয়ে নূরকে দেখাল।বলল,’ ওইযে ওইখানটায় চল।’
নূর মাথা দুলালো।আহাদ নূরকে নিয়ে সেখানে আসল।এরপর ওরা বসে পরল।দুজনের মাঝে নিরবতা।মূলত আহাদ নূরকে সময় দিচ্ছে ওর কথাগুলো গুছিয়ে নেওয়ার জন্যে।এভাবে অনেকটা সময় কেটে গেলো।নূর কিছুই বলছে না।আহাদ নূরের কাধে হাত রাখল।নূর টলমলে চোখে চাইলো আহাদের দিকে।আহাদ চোখের ইশারায় ভড়সা দিয়ে বলল,
‘ জানো নূর নিজেকে সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করতে গেলে প্রাথমিক ভাবে ভীতি আসে। তবে সেই ভয় কাটিয়ে নিজেকে বিশ্বাস করতে পারা জীবনের জন্য খুবই জরুরি।’
নূর চুপ করে রইলো।আহাদ নূরের হাতটা নিয়ে ওর দুহাতের মাঝে আবদ্ধ করল।অত্যন্ত কোমল গলায় বলল,
‘ নিজের হৃদয়ের কথা শোনো নূর ,কারণ হৃদয় কখনও বিশ্বাসঘাতকতা করে না।’
নূর আহাদের কথাগুলো শুনে মনে মনে অনেকটা ভড়সা পেলো।বার দুয়েক জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস ফেলল।অতঃপর নিজের মনের কথাটাই বলল,
‘ আহাদ,আমি আসলে…আসলে আমি অন্য কাউকে ভা..ভালোবাসি।’
#চলবে___________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। কেমন হয়েছে জানাবেন।