#মায়ারণ্যে
#লেখিকা- মেহরুমা নূর
#পর্ব-৩
★ সকালের ঝলমলে রোদ চোখে পড়তেই অরণ্যের ঘুম ভেঙে গেল। অরণ্য কপাল কুঁচকে চোখ মেলে তাকালো। মাথাটা হালকা এদিক ওদিক ঘুড়িয়ে দেখলো ও ব্যালকনিতেই ঘুমিয়ে আছে। অরণ্য আস্তে করে উঠে রুমে এলো। রুমে এসে দেখলো রিয়া বিছানার উপর হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। মেয়েটাকে যতবারই দেখছে কেমন যেন অস্বস্তিবোধ হচ্ছে ওর। নিজের বউয়ের সামনে এমন কেন লাগছে সেটারই কারণ খুঁজে পাচ্ছে না অরণ্য। সবকিছু ঠিক হয়েও কেন এতো বেঠিক লাগছে? নিজের ওপর নিজেই বিরক্ত হচ্ছে ও। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাবার্ড থেকে কাপড়চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো ফ্রেশ হতে।
অরণ্যেদের পরিবার এমনিতেই অনেক বড়ো। তারওপর বিয়ের জন্য আরও মেহমানে ভরে গেছে। সারাবড়ি শুধু মানুষের শোরগোল ।
অরণ্যের পরিবারের পরিচয়টা দেওয়া যাক। তো সবার বড়ো হলো অরণ্যের বাবা রায়হান হোসেন। তারা তিন ভাই বোন। সবার বড়ো রায়হান হোসনে, তার ছোট ভাই সাজ্জাদ হোসেন, আর তার ছোট বোন রাবেয়া। রায়হান হোসেনের স্ত্রী তনিমা বেগম, তাদের দুই ছেলেমেয়ে, ইরিন আর অরণ্য। সাজ্জাদ হোসেনের স্ত্রী এলিসা, তাদের একটাই মেয়ে সারা। রাবেয়ার স্বামী ইমাদ রহমান, তাদের দুই ছেলেমেয়ে সাহিল আর রাইসা। এরা সবাই একসাথেই এবাড়িতে থাকে।
অরণ্যের বড়ো বোন ইরিন ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে ফুলদানিতে ফুল সাজাচ্ছে। তখনই অরণ্যের বেস্ট ফ্রেন্ড ইহান ধপ করে ইরিনের গা ঘেঁষে হেলান দিয়ে বসে পড়ে বললো।
–গুড মর্নিং ইরাবতী।
ইহান ছোটবেলা থেকেই ইরিন কে ইরাবতী বলেই ডাকে। ইরিন অরণ্যের দুবছরের বড়ো হলেও ইহান ইরিনকে সবসময় তুমি বলেই সম্বোধন করে। ইরিনেরও অভ্যাস হয়ে গেছে তাই সেও কিছু মনে করে না। তাই ইরিনও মুচকি হেসে বললো।
–গুড মর্নিং। ঘুম ভাঙলো তোমাদের।
ইহান দুষ্টুমি করে বললো।
–হাহ্ আর ঘুম। আমার বন্ধু বিয়া কইরা বাসর কইরা ফালাইলো। আর আমরা এখনো সিঙ্গেল থাইকা গেলাম। এই দুঃখে কি আর ঘুম আসে? এই অধমের কপালে কবে বউ জুটবে?
ইহানের কথায় ইরিন মুচকি হেসে বললো।
–চিন্তা করোনা তুমিও একদিন তোমার মনমতো বউ পেয়ে যাবে।
ইহান এবার ইরিনের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললো।
–সত্যিতো? আমার মনমতো বউ পাবো?
ইরিন ইহানের দিকে না তাকিয়ে ওর কাজ করতে করতেই বললো।
–হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই পাবে।
ইরিন ইহানের দিকে তাকালে হয়তো দেখতে পেত ইহানের চোখের ভাষা। যে ভাষায় হাজারো না বলা অনুভূতিরা খেলা করছে।
ইহান ফুলদানি থেকে একটা হলুদ জারবেরা ফুল নিয়ে ইরিনের কানে গুঁজে দিয়ে বললো।
–ওয়াও হেব্বি লাগছে তোমাকে ইরাবতী। একদম নায়িকা সাবানা।
কথাটা বলে ইহান ফোন বের করে ফট করে ইরিনের একটা ছবি তুলে নিল।
সবসময়ের মতো ইরিন ইহানের কথা মজা ভেবে হেঁসে উড়িয়ে দিল। ইহানের চাহনি যে অন্য কথা বলছে সেটা আজও বুঝতে পারলো না ইরিন। কখনো বুঝাতে পারবে কিনা সেটাও জানে না ইহান।
একটু পরে অরণ্যের চাচী এলিসা নিচে এসে ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে কাজের মেয়ে মিনাকে ডাক দিয়ে বললো।
–এই মিনা শোন, আমার বরটা(ঘরটা) না অনেক ময়লা হয়ে গেছে বরটাকে একটু মেরে(ঝেড়ে) দে।
এলিসার কথায় বেচারি মিনা তব্দা খেয়ে গেল। অটো হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এলিসার পাশেই তার স্বামী সাজ্জাদ হোসেন বসে চা খাচ্ছিল। এলিসার কথায় বেচারার চা নাকে মুখে উঠে কাশতে শুরু করে দিল। বাকি সবাই শুধু মুকটিপে হাসছে। এলিসা আরও বলে উঠলো।
–আচ্ছা শোন প্রথমে বরটার চুলগুলো (ঝুলগুলো) ঝেড়ে দিবি। তারপর বরটাকে মেরে নিচে মুছে দিবি ঠিক আছে?
মিনা বেচারি এতো শক খেয়ে ওর হাতে থাকা চায়ের ট্রেটা ঠাস করে নিচে পরে গেল। ইরিন তখন বলে উঠলো।
–এই মিনা তুই এতোদিন হলো আমাদের বাড়িতে আছিস,এখনো চাচীর কথায় এতো চমকে যাস কেন?
তখনই সাহিল এসে সোফায় বসে হাসিমুখে বলে উঠলো।
–হ্যারে মিনা, তুই কি জানিস না এলিসা মামী হলো আমাদের ফিরাঙ্গি মামী? তাইতো মাঝে মধ্যে উল্টো পাল্টা বাংলা বলে ফেলে।
সাহিলের কথায় সবাই হেঁসে দিল। এলিসা বেচারি বুঝতে পারলো সে আবারও কোন ভুল বাংলা বলে ফেলেছে। তাই সে একটু লজ্জায় পড়ে গেল। সাহিল দুষ্টুমি করে বলে উঠলো।
–সাজ্জাদ মামা তুমি কিন্তু একটা গ্রেট কাজ করছো। ব্রিটিশদের কাছ থেকে একটু হলেও প্রতিশোধ নিয়েছ। বিদেশে গিয়ে তাদেরই দেশের মেয়েকে পটিয়ে নিয়ে এসেছ। এটা কি কম কথা নাকি। আমিতো তোমার পাঙ্খা হয়ে গেছি। আজ থেকেই তুমি আমার আইকন।
সাহিলের প্রসংশায় সাজ্জাদ হোসেন যেন ফুলে বেলুন হয়ে গেল। গর্বে তার বুকটা ফুলে যেন ফুটবল হয়ে গেল। আর বাকি সবাই মুখ টিপে হাসছে।
একটু পরে সারা এসে চেয়ার টান দিয়ে বসে ওর মায়ের উদ্দেশ্যে বললো।
–মাম্মা ক্ষুদা লেগেছে। তাড়াতাড়ি খেতে দাওনা। ক্ষুদায় পেটে ইঁদুর বিড়াল দৌড়াদৌড়ি করছে।
তখনই সাহিল বিশেষ টিপুনি করে বলে উঠলো।
–এই চশমিশ আর কতো খাবি? একটু কম খা। এইটুকুন পিচ্চি মেয়ে এত খাবার রাখিস কই? দিনদিন খেয়ে খেয়ে তো বেলুন হয়ে যাচ্ছিস। কবে আবার দেখা যাবে ফটাস করে ফেটে যাবি।
সাহিলের কথায় সারার ভীষণ রাগ হলো। সাথে খারাপও লাগলো প্রচুর। খুব কান্না পাচ্ছে ওর। খাওয়ার কথার চেয়ে বেশি খারাপ লাগলো ওকে চশমিশ বলায়। কেও ওকে চশমিশ বললে ওর ভীষণ রাগ লাগে। আর এই লোকটা শুধু বারবার ওকে এটাই বলে। যেদিন বিদেশ থেকে ফিরেছে সেদিনও ওকে দেখে চশমিশ বলেছিল। সেদিন থেকেই সাহিলকে অসহ্য লাগে ওর। যতটা পারে সাহিলের থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে। আর আজকে তো ওর খাবার নিয়েও কথা বলছে। রাগে গা রি রি করছে। মন চাচ্ছে মাথায় একটা বারি মেরে মাথা ফাটিয়ে দিতে। অসহ্য লোক একটা। সারা রাগে নিজের নাক টেনে চশমাটা ঠিক করে উঠে চলে যেতে নিলেই অরণ্যের মা তনিমা বেগম এসে বললো।
–কি হয়েছে সারা মা চলে যাচ্ছিস কেন? নাস্তা করবি না?
সারা অভিমানী সুরে বললো।
–না বড় মা। আমি খাবো না। আমার খাওয়া কারোর চোখের বিষ হয়ে গেছে। তোমরা বরং তাকেই বেশি করে খাওয়াও।
তনিমা বেগম আদুরে গলায় বললো।
–আমার সারা মামনিকে কে কি বললো হ্যাঁ? খবরদার আমার সারা মামনীকে কেউ কিছু বললে তার খাওয়া বন্ধ করে দিবো আমি।
ইহান বাঁকা হেসে সাহিলের উদ্দেশ্যে বললো।
–লে ভাই তোর আজকে উপস থাকতে হবে মনে হচ্ছে।
সাহিল শুধু একটা রহস্যময়ী হাসি দিল। তনিমা বেগম সারাকে অনেক বুজিয়ে সুঝিয়ে আবার খেতে বসালো। নিজের হাতে সারাকে খাইয়ে দিতে লাগলো। বাড়ির সবগুলো ছেলেমেয়ের চেয়ে সারা তার ফেবারিট। মেয়েটাকে তার খুব ভালো লাগে। কি সুন্দর সাদা দুধ মালাইয়ের মতো দেখতে। টোকা দিলেই যেন রক্ত বের হবে। একদম ফরেনার দের মতো। ফরেনার মা বলে হয়তো এমন হয়েছে।
একটু পরে অরণ্যও নিচে নেমে এলো। সোফায় বসতেই সাহিল আর ইহান ওর দিকে কেমন দুষ্টু চোখে তাকিয়ে স্ক্যানিং করতে লাগলো। অরণ্য সেটা দেখে ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কিরে তোরা এভাবে তাকিয়ে আসিছ কেন?
ইহান দুষ্টু সুরে বললো।
–কিরে ভাই কেমন পারফরম্যান্স দিলি? শরীরে তো কোন স্ক্রাচ দেখিনা। এতো স্মুধলি কেমনে করলি? আমাদেরও একটু টিপস দে।
অরণ্য দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
–আমার শরীরে না থাকুক তোদের শরীরে নির্ঘাত স্ক্রাচ পরে যাবে।তাও পারমানেন্টলি। তাই নিজেদের বাঁচাতে চাইলে ফালতু পেঁচাল বন্ধ কর।
অরণ্যের হুমকিতে ওরা দুজন একটু দমে গেল। তনিমা বেগম বলে উঠলেন।
–কিরে অরণ্য বৌমা কোথায়? ও নাস্তা করবে না?
অরণ্য বললো।
–ওতো এখনো ঘুম থেকে উঠেনি।
ইরিন বলে উঠলো।
–আচ্ছা আমি ডেকে নিয়ে আসছি ওকে।
ইরিন যেতেই সাহিল এবার দুষ্টু হেসে বললো।
–কি ব্যাপার ভাই, কেমন পারফরম্যান্স দিলা যে ভাবি বিছানা থেকেই উঠতে পারছে না?
কথাটা বলে সাহিল ইহানের হাতের ওপর তালি বাজিয়ে হাসতে লাগলো।
অন্য সময় হলে হয়তো অরণ্যও এদের সাথে হাসাহাসি করতো।তবে আজ এদের কথায় চরম বিরক্ত হচ্ছে ও। এখন এদের কিভাবে বুঝাবে যে ওরা যা ভাবছে তার কিছুই হয়নি।
ইরিন অরণ্যের দরজার সামনে এসে দুই তিনবার নক করলো। ভেতর থেকে কোন আওয়াজ না পেয়ে ইরিন দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে দেখলো রিয়া এখনো হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। ইরিন আরেকটা জিনিস খেয়াল করে দেখলো,অরণ্যের পাশের বিছানা একদম গোছানো আছে। বালিশটা দেখেও মনে হচ্ছে রাতে এর ওপর কেউ শোয়নি। আর রিয়াকে দেখেও মনে হচ্ছে না ওদের ভেতর কোনরকম শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে। বিষয় টা দেখে ইরিনের একটু সন্দেহ হলো। তবে আপাতত সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে রিয়াকে ডাকায় ব্যস্ত হলো। রিয়াকে কয়েকবার ডাক দেওয়ার পর রিয়া একটু নড়েচড়ে উঠে ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বললো।
–উফফ মা এতো ডাকছ কেন? ঘুমুতে দাওনা।
ইরিন মুচকি হেসে বললো।
–আমি তোমার মা না। তোমার ননদ। এবার উঠে নাস্তা করে নাও। নিচে সবাই ডাকছে তোমাকে।
রিয়া এবার এক ঝটকায় উঠে বসলো। ওতো ভুলেই গিয়েছিল যে ও এখন শশুরবাড়িতে আছে। রিয়া ইরিনের দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হেসে বললো।
–সরি আসলে বুঝতে পারিনি।
ইরিন মুচকি হেসে বললো।
–ইটস ওকে। এতো টেনশনের কিছু নেই। তুমি ফ্রেশ হয়ে নিচে এসো। সবাই নাস্তার টেবিলে তোমার অপেক্ষা করছে। আসলে আমাদের পরিবারের সবাই একসাথেই খাবার খাই। এটাই এবাড়ির নিয়ম। আমি যাই তুমি ফ্রেশ হয়ে নিচে এসো কেমন?
রিয়া মাথা ঝাকিয়ে সায় জানালো। ইরিন চলে যেতেই রিয়া বিরক্ত কন্ঠে বিড়বিড় করে বললো। –সকাল সকাল আমার ঘুমটা ভেঙে দিল।আমিতো দশটার আগে ঘুম থেকেই উঠি না৷ ঘুম থেকে উঠিয়ে আদিখ্যেতা দেখানো হচ্ছে,যত্তসব।
একটু পরে সবাই ব্রেকফাস্ট টেবিলে আসলো নাস্তা করতে। রিয়াও তখন নিচে নেমে এলো। রিয়া একটা গোল জামার সাথে লেগিস পড়েছে।ব্যাপার টা অরণ্যের মা তনিমার তেমন পছন্দ হলোনা। বিয়ের প্রথম দিন বাড়ির বউয়েরা শাড়ী পরবে তবেই না নতুন বউ মনে হবে। তবুও তনিমা বেগম কিছু বললেন না। এবাড়িতে নতুন এসেছে তাই মেয়েটা হয়তো বুঝতে পারেনি। এখুনি এতো স্ট্রিক্ট হওয়া ঠিক হবে না। কথাটা ভেবে তনিমা বেগম আর কিছু বললেন না। তবে অরণ্যের ফুপি রাবেয়া চুপ করে রইলেন না। তিনি স্বভাবতই একটু মুখফোড় টাইপের। তাই মুখের ওপরই বলে উঠলেন।
–বাড়ির নতুন বউ হয়ে এভাবে বাচ্চাদের মতো জামাকাপড় পড়ে ঘুরছ কেন? শাড়ীর কি অভাব পড়েছে নাকি? নাকি শাড়ী পরতেই জানোনা?
রাবেয়ার কথায় রিয়ার ভেতরে ভেতরে রাগ লাগলেও সেটা বুঝতে না দিয়ে বলে উঠলো।
–আসলে আমি বুঝতে পারিনি। বাসায় এসব পরেই অভ্যাস তো তাই।
–ঠিক আছে। কিন্তু পরবর্তীতে কিন্তু খেয়াল রাখবে। আপাতত নতুন নতুন কিছুদিন তো শাড়ী পরো। তারপর নাহয় তোমার ইচ্ছে অনুযায়ী পড়বে। আমরা এতটাও স্ট্রিক্ট না।
রাবেয়ার কথায় রিয়ার ভেতরে ভেতরে খুব রাগ লাগলো। আর এই বাড়িতে এতো মানুষ কেন? এতো বড়ো পরিবার এদের তাতো জানাই ছিলনা। এতলোক একসাথে থাকে কিভাবে এরা? আমার তো এখন থেকেই বিরক্ত লাগছে। একবার শুধু অরণ্যকে কোনরকমে কাবু করতে পারলেই হয়। তারপর ওকে বলবো এবাড়ি থেকে আলাদা থাকতে।
____
বিকাল ৪ টা
অরণ্য ছাঁদে দুই হাতে মাথা চেপে ধরে বসে আছে। রুমের ভেতর কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিল ওর। রিয়া তখন ওর কাছে ঘেঁষে কথা বলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু অরণ্যের প্রচুর অস্বস্তি লাগছিল। ও চেয়েও কেন যেন মেয়েটার সাথে কম্ফোর্টেবল হতে পারছে না। ও কতকিছু ভেবে রেখেছিল ওর সন্ধ্যামালতীর জন্য। অথচ এখন সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগছে ওর। কিন্তু এর কোন কারণই খুঁজে পাচ্ছে না ও।
হঠাৎ কাঁধে কারোর স্পর্শ পেয়ে মাথা তুলে তাকালো অরণ্য। তাকিয়ে দেখলো ইরিন এসে বসেছে ওর পাশে। ইরিন অরণ্যের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো।
–কি হয়েছে অরু? এখানে এভাবে একা একা বসে আছিস কেন? সব ঠিক আছে তো?
অরণ্য জোরপূর্বক মুচকি হেসে বললো।
–কি আবার হবে আপু। আমি একদম ঠিক আছি।
–তাহলে নতুন বউকে রেখে এখানে একা একা কি করছিস হ্যাঁ?
অরণ্য ইরিনের পায়ের ওপর মাথা রেখে কাত হয়ে শুয়ে বললো।
— আরে এমনি। নিচে অনেক শোরগোল হচ্ছিল। তাই একটু ফ্রেশ হাওয়া নিতে উপরে আসলাম। আর তোমাদের নতুন বউ তো রিসিপশনের জন্য রেডি হচ্ছে। সেখানে আমি কি করবো? তাই একাই বসে আছি।
ইরিন অরণ্যের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলো।
–সব ঠিক হলেই ভালো অরু। তুইতো আমাদের গর্ব। সবচেয়ে বেশি বাবার গর্ব। তুইতো জানিসই আমার কারণে বাবার মানসম্মানের অনেক ক্ষতি হয়েছে। আমিতো আর হয়তো কোনদিনও বাবার নজরে উঠতে পারবোনা। কিন্তু তুই কখনো এমন কিছু করিস না যাতে বাবা নিরাশ হয়।
অরণ্য বুঝতে পারছে ইরিন এসব কেন বলছে। অরণ্য তখন নিউইয়র্কে ছিল। ইরিন একটা ছেলের সাথে সম্পর্ক করেছিল। তবে বাবা ছেলেটাকে পছন্দ করেনি। বাবার মতে ছেলেটা ভালো ছিলোনা। তবে ইরিন তখন প্রেমে এতোটাই মাতোয়ারা হয়েছিল, যে ওর বাকি দুনিয়ার কোন হুশই ছিলনা। তাইতো সবার বিপক্ষে গিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে ওই ছেলেটার সাথে বিয়ে করে। বিয়ের পরেই ওই ছেলের আসল রুপ দেখতে পায় ইরিন। ছেলেটা মদ খাজা খেয়ে দিনরাত ইরিনের ওপর অত্যাচার করে।ইরিন তখন ওর ভুল বুঝতে পারে। তবে অপরাধ বোধের কারণে বাড়িতে আসার সাহস পায়না। অতঃপর পাঁচ মাস পরে একদিন ইরিন বিধ্বস্ত অবস্থায় অরণ্য দের বাড়ির দরজায় এসে পৌঁছায়। সেদিন ইরিনের অমন অবস্থা দেখে সবার রুহ কেঁপে উঠেছিল। যেমনই হোক নিজের মেয়ের এমন অবস্থা দেখে তারেক রহমানও আর মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেননি। সেদিনই ওই বদমাইশ কে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয় ওরা। তারপর ওর সাথে ডিভোর্স পেপারেও সাইন করিয়ে নেয়। সেই থেকে ইরিন তার কাজের জন্য এখনও অপরাধ বোধে ভোগে। ওর বাবার সাথে এখনও চোখ মেলাতে পারে না ইরিন।
অরণ্য ইরিনের মাইন্ড ডিসট্রাক করার জন্য বললো।
–ওহহো আপু তুমি কি একটা কথাই সবসময় টেনে নিয়ে বসে থাকো। বাদ দাও তো ওসব কথা। যা হবার তা হয়ে গেছে। মানুষ মাত্রই তো ভুল হয়। এখন অতীত কে বারবার মনে করে কি লাভ? ওসব ভুলে হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করো। ইহানের ভাষায়, চিল মারো।
ইরিন মুচকি হেসে বললো।
–আচ্ছা ঠিক আছে। এখন চল রেডি হয়ে নে একটু পরেই রিসিপশনের জন্য বের হতে হবে।
–ঠিক আছে চল।
_____
রাত ৮ টা
রিসিপশন পার্টি জমে উঠেছে। সব মেহমানরা চলে এসেছে ।অরণ্য আর রিয়া স্টেজে বসে আছে পাশাপাশি। কাল থেকে এই পর্যন্ত অরণ্য বোধহয় গোনা তিনটা কি চারটা কথা বলেছে রিয়ার সাথে। অরণ্যের এমন বিহেভিয়ারে রিয়া অনেক টা অবাক হচ্ছে। তবে সে বিষয়ে খুব একটা মাথা ঘামাচ্ছে না রিয়া। আপাতত সে তার নতুন হাইক্লাস লাইফ এনজয় করছে। এতো বড়ো পার্টি, এতো জাঁকজমক এর আগে কখনোই দেখেনি রিয়া। আজ ওর শাশুড়ী কতো দামী দামী গহনা দিয়েছে রিয়াকে।সেই খুশিতেই আপাতত নিজেকে ভাসাতে ব্যাস্ত সে। এসবই তো তার স্বপ্ন ছিল। বড়ো ঘরের বউ হবে,দামী দামী গাড়ীতে ঘুরবে এসবই তো সে চেয়েছিল। তাইতো বাকি জিনিস দেখার সময় নেই ওর।
রিয়ার বাবা মাও এসেছে পার্টিতে। নিজের মেয়েকে এমন রাজরানীর মতো দেখে রিয়ার মা মনে মনে এক বিশ্ব জয়ের হাসি দিচ্ছে। আজ তার বলা একটা মিথ্যে কথার কারণেই রিয়া আজ এতো সুখে রাজ করছে। হ্যাঁ মিথ্যে কথা। সেদিন যখন অরণ্যের বোন ইরিন রিয়ার মাকে ফোনের ছবিটা দেখিয়েছিল, তখন রিয়ার মা ছবি দেখেই বুঝে গিয়েছিল যে ওটা মায়ার ছবি।তবে সে সেদিন মিথ্যে বলেছিল যে ওটা রিয়ার ছবি। যাতে মায়ার বদলে রিয়ার বিয়ে হয়ে যায়। যদিও শেষমেশ মায়ার সাথেই বিয়েটা হয়েছে। তবুও রাজ তো আমার মেয়েই করছে। আর সবসময় ওই করবে। ওদের বিয়ের সত্যি টা আমি কখনোই সামনে আসতে দিবোনা।
অনুষ্ঠান শেষে নিয়ম অনুযায়ী অরণ্যকে আজ রিয়াদের বাড়িতে যেতে হবে। যদিও অরণ্যের যাওয়ার খুব একটা ইচ্ছে হচ্ছে না। তবুও সবার মান রাখতে যেতেই হবে।তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও রিয়ার সাথে ওদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য রওয়ানা দিল। তবে সারা আর রাইসা বায়না ধরেছে তারাও অরণ্যের সাথে যাবে। রিয়া মনে মনে বিরক্ত হলেও ওপরে ওপরে মেকি হেসে ওদের যেতে বললো সাথে। তারপর সবাই একসাথে রওয়ানা হলো।
_____
মায়া রান্নাঘরে কাজে ব্যাস্ত। ওর মামী যাওয়ার আগে বলে গেছে সব রান্নাবান্না যেন করে রাখে। তাই মায়া সেই বিকাল থেকেই রান্নাঘরে ব্যাস্ত। তাকে দেখে কেউ বলতেই পারবেনা যে,তার জীবনে এতবড় একটা ঝড় বয়ে গেছে। মায়া যে এমনই। নিজের সব কষ্ট নিজের মাঝেই আবদ্ধ রাখে সে। কি দরকার মানুষকে নিজের দুর্বলতা দেখানোর? কেউ কি ওর গ্লানি দূর করতে পারবে? বরং কাটা ঘায়ে শুধু নুনের ছিটা দিয়ে যাবে সবাই। তারচেয়ে ভালো নিজের কষ্ট নিজের মাঝেই রাখা। আর এমনিতেও মায়া কালকের ওই দিনটাকে আর মনে করতে চায়না। যত তাড়াতাড়ি সব ভুলতে পারে ততই ভালো ওর জন্য। নিজেকে মিথ্যে কোন আশা দিতে চায়না ও। আশা যে অনেক ভয়ংকর জিনিস। আশা ভেঙে গেলে যে অনেক কষ্ট হয়। তাই কোন আশা না করাই ভালো। মনকে এসব হাজারো বাহানা দিলেও তার মন কতটা আস্বস্ত হচ্ছে তা জানা নেই মায়ার।
মায়ার ভাবনার মাঝেই হঠাৎ কেউ ওর মুখে হালকা পানির ছিটা মারলো। মায়া একটু হকচকিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখলো এটা ওর মামাতো ভাই রাদিব। মায়া মিছে রাগ দেখিয়ে বললো।
–কিরে রাদিব এসব কি হচ্ছে হ্যাঁ? তুই না অসুস্থ? তারজন্য তুই বৌভাতেও গেলিনা। তাহলে এখন এখানে কি করছিস তুই?
–আরে আপু রুমে শুয়ে শুয়ে বোর হয়ে যাচ্ছিলাম। তুমিতো জানোই আমার মতো ট্যালেন্টেড লোক এভাবে শুয়ে থাকলে কি দুনিয়া চলবে?দুনিয়াতো থেমে থাকবে তাইনা?
মায়া এক ভ্রু উঁচিয়ে বললো।
–আচ্ছা তাই? তা এখানে কি আবিষ্কার করতে এসেছেন শুনি?
রাদিব ভাব নিয়ে বললো।
–তেমন কিছু না। দেখতে এসেছিলাম তুমি রান্না করার সময় ট্যাপের পানি ব্যাবহার করো নাকি চোখের পানি দিয়েই রান্না সেরে ফেল। হা হা
–তবেড়ে দুষ্টু, বড়ো বোনের সাথে ইয়ার্কি মারা হচ্ছে? দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা।
কথাটা বলে মায়া রাদিবের দিকে তেড়ে আসতে লাগলো। রাদিবকে আর পায় কে। সেও দৌড় দিল বাইরের দিকে। ড্রয়িং রুমের চারপাশে দুজন হাসছে আর দৌড়াচ্ছে। রাদিব আগে আগে আর মায়া ওর পিছে পিছে দৌড়াচ্ছে। মায়াকে হাসতে দেখে রাদিবের ভালো লাগছে। ওকে হাসানোর জন্যই তো এসব করেছে ও। যদিও মায়ার মন খারাপের কারণ জানে না। তবুও কাল থেকে কেমন বিষন্ন লাগছিল মায়াকে। তাইতো ওকে একটু হাসানোর জন্য এসব করেছে ও।
এমন সময় রিয়া আর অরণ্য রাও চলে আসে। রিয়ার মা ওদের সাথে থাকায় সে নিজেই দরজার লক খুলে ওদের ভেতরে ঢুকতে বলে। অরণ্য এক হাতে ফোন টিপতে টিপতে ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকেই ভেতরে ঢুকে। ওদিকে মায়া আর রাদিব এখনো ওদের খেয়াল করেনি। ওরা ওদের মতোই মাস্তি করে যাচ্ছে।
একসময় হঠাৎ মায়া কার্পেটের সাথে পা বেজে পড়ে যেতে নেয়।ভয়ে চোখ বন্ধ করে নেয় সে। তবে মায়া নিচে পরে না। সে পড়ে যাওয়ার আগেই কেউ তাকে ধরে ফেলে। আর মায়াও পড়া থেকে বাঁচতে সামনের ব্যাক্তির কাঁধ আঁকড়ে ধরে। আর যেমনটা আমরা সবাই জানি। সেই ব্যাক্তি আর কেউ নয় বরং আমাদের অরণ্য বাবু।
মায়া যখন পা বেজে পড়ে যেতে নেয় তখন সামনে অরণ্য ছিল। আর মায়া অরণ্যের ওপর গিয়েই পরে। আর আকস্মিক ঘটনায় অরণ্যও কোনকিছু বুঝে ওঠার আগেই মায়াকে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে ওর পেটের নিচে হাত রেখে ওকে ধরে। মায়ার মুখটা অরণ্যের কাঁধের নিচে ঝুঁকে পড়ে। আর ওর খোলা চুলগুলো সব মুখের ওপর এসে পড়ে। মায়া যখন বুঝতে পারলো ও পরেনি, তখন ও চোখ খুলে তাকালো। মাথাটা একটু উঁচু করে অরণ্যের দিকে তাকালো।
আর এতেই অরণ্যের সর্বনাশের সূচনা হয়ে গেল। মায়ার এলোমেলো চুলের ফাঁকে ওর মায়াবী চোখ দুটোর দিকে তাকাতেই ওর বুকের ভেতর তুমুল বেগে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। বেড়ে গেল হৃদয়ের স্পন্দন। আর মায়া কতক্ষণ তাকিয়ে আগে মনে করার চেষ্টা করলো লোকটা কে। আর যখনই ওর মন ওকে জানান দিল যে এটা ওর সেই নামমাত্র স্বামী। তখনই মায়ার পুরো শরীর যেন বরফের মতো ফ্রীজড হয়ে গেল। অদ্ভুত কম্পন শুরু হয়ে গেল হৃদপিণ্ডে। দুজন দুজনের চোখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ।
চলবে…….
গল্প নিয়ে যেকোনো আলোচনা আড্ডা দিতে আজই গ্রুপে জয়েন হতো। নিচে গ্রুপ লিংক দেওয়া হলো। জয়েন হওয়ার সময় অবশ্যই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিবেন।
গ্রুপ
https://facebook.com/groups/170529085281953/