মায়ারণ্য #লেখিকা-মেহরুমা নূর #পর্ব-৪

0
601

#মায়ারণ্য
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
#পর্ব-৪

★রিয়ার মা ভেতরে ঢুকে অরণ্য আর মায়াকে এই অবস্থায় দেখে রাগে চোয়াল শক্ত করে ফেললো। দাঁতে দাঁত চেপে মায়ার নাম ধরে ডাক দিয়ে বললো।
–মায়া, কি হচ্ছে কি এখানে?

শিউলি বেগমের কথায় দুজনের ঘোর কাটলো। মায়া এক ঝটকায় অরণ্যকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। মাথা নিচু করে কাঁপা কন্ঠে বললো।
–স সসরি।
কথাটা কোনরকমে বলেই মায়া ওখান থেকে দৌড়ে চলে গেল। অরণ্য মায়ার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো।

রিয়া অরণ্যের কাছে এগিয়ে এসে বললো।
–চলুন রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন।

অরণ্য হালকা মাথা ঝাকিয়ে রিয়ার পিছে পিছে গেল। রিয়ার মা সারা আর রাইসাকেও একটা রুমে নিয়ে গেল ফ্রেশ হওয়ার জন্য।

মায়া নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দরজার সাথে হেলান দিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো। আর কিছুক্ষণ ওখানে থাকলে বোধহয় নিঃশ্বাসই বন্ধ হয়ে যেত ওর। কিন্তু ওই লোকটা কাছে আসতেই এমন লাগলো কেন আমার? বুকের ভেতর এমন তুফান কেন শুরু হয়েছিল আমার?উনাকে তো আমি আগে কখনো দেখিই নি। তাহলে উনাকে আপন লাগলো কেন আমার? লোকে বলে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক নাকি এক অলৌকিক পবিত্র বন্ধন হয়। তাহলে কি সেই জন্য আমার এমন অনুভূতি হচ্ছে? না না এসব কি ভাবছি আমি। এসব ভাবা ঠিক না। ওসব শুধুই ভুল ছিল। সে এখন শুধু রিয়ার স্বামী। কিছুদিনের ভেতর হয়তো সত্যিকারের স্বামীও হয়ে যাবে। তাই ওসব মিথ্যে মোহে নিজেকে ডোবানো যাবেনা। আমাদের রাস্তা আলাদা আলাদা।

হঠাৎ দরজায় টোকা পড়তেই ভাবনায় ছেদ পড়লো মায়ার। মায়া দরজা খুলে দেখলো ওর মামী অগ্নিমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মায়া দরজা খুলতেই সে হনহন করে ভেতরে ঢুকে মায়ার হাত চেপে ধরে দাঁত কিড়মিড় করে বললো।
–কি করতে চাইছিলি তুই তখন হ্যাঁ? ছেলে দেখেই লাল টপকানো শুরু করে দিয়েছিস? নাকি ওই বিয়েটাকে সত্যি মেনে বসে আছিস তুই? তাই অরণ্যের বউ হওয়ার শখ জেগেছে তোর? নিজের অস্তিত্ব ভুলে গেছিস তুই?

মায়া দাঁতে দাঁত চেপে নিজের ব্যাথাটাকে হজম করে নিয়ে বললো।
–আমি কিছুই ভুলিনি মামী। তোমরা চিন্তা করোনা আমি কিছুই করবোনা। আমার জায়গা আমি ভালো করেই জানি। আর তখনও ওটা ভুলে হয়ে গিয়েছিল। আমি ইচ্ছে করে করিনি।

শিউলি বেগম এবার মায়ার হাত ছেড়ে দিয়ে বললেন।
–ঠিক আছে এবারের মতো ছেড়ে দিলাম তোকে। এরপর থেকে যেন এমন ভুল আর না হয়। আর একটা শোন। রিয়ার দুজন ননদ এসেছে। বাসায় আর রুম খালি নেই তাই আজ রাতে ওরা এই রুমেই থাকবে। ওদের খাটে দিয়ে তুই নিচে বিছানা পেরে ঘুমাস।

মায়া মাথা ঝাকিয়ে সায় জানালো। তারপর শিউলি বেগম চলে গেলেন

অরণ্য বেডের ওপর দুই হাতে মাথার চুল টেনে ধরে বসে আছে। হঠাৎ কেমন যেন অস্থির লাগছে ওর। ও বুঝতে পারছে না, তখন ওই মেয়েটাকে দেখে ওর এমন লাগলো কেন? কেন মনে হলো মেয়েটা খুব কাছের কেউ? বিষেশ করে ওর চোখ দুটো। ওই চোখে কিছু একটা আছে। যা আমাকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। কিন্তু কেন হচ্ছে এমন? মেয়েটাকে তো আমি চিনিও না।

রিয়া ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে নিজের গহনা খুলছিল। অরণ্য সেদিকে আরচোখে তাকিয়ে ইতস্ততভাবে বললো।
–আচ্ছা ওই মেয়েটা কে?

রিয়া ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কোন মেয়েটা?

–আরে বাইরে যে মাত্রই দেখলাম ওই মেয়েটা। না মানে আমিতো জানি তোমার আর কোন বোন নেই। তাহলে উনি কে?

–আরে ও আমার বোন হতে যাবে কেন? ওতো এবাড়ির আশ্রিতা।

–মানে?

–মানে ও আমার ফুপির মেয়ে। ওর মা বাবা ছোটবেলায় মারা গেছে। তখন থেকেই আমাদের বাড়িতেই পড়ে আছে আশ্রিতা হয়ে।

রিয়ার কথাবার্তা মোটেও পছন্দ হলোনা অরণ্যের। নিজের ফুফাতো বোনকে এভাবে আশ্রিতা বলতে পারে কেউ। রিয়ার মনমানসিকতা এতো নিচু কিভাবে হতে পারে। যে মেয়ে রাস্তার অসহায় মানুষের প্রতি এতো সহানুভূতি দেখায় সেই মেয়ে নিজের ফুফাতো বোনকে নিয়ে এমন মন্তব্য কিভাবে করে? রিয়াকে যত দেখছে ততই যেন অরণ্যের মনের ভেতর সন্দেহের সৃষ্টি হচ্ছে। তাহলে কি আমি কোন ভুল করলাম? অরণ্যের অস্থিরতা আরও বেড়ে যাচ্ছে। কিছুই ভালো লাগছে না ওর।

সারা আর রাইসা মায়ার রুমের বেডে বসে আছে। মায়া ওদের জন্য সুন্দর করে বিছানা করে দিয়েছে। এতক্ষণে মায়ার সাথে পরিচয় হয়ে গেছে ওদের। রাইসা সেই কখন থেকে ওর বয়ফ্রেন্ডের সাথে ফোনে লেগে আছে। সারার কান পেকে যাচ্ছে ওদের কথা শুনে। এতো কথা কেও কিভাবে বলতে পারে? কান পঁচে যায় না এদের? বেচারা জিজু মনে হয় বিয়ের আগেই বয়রা হয়ে যাবে। সারা সামনে তাকিয়ে দেখলো মায়া আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে। সারা মায়ার কাছে গিয়ে ওর কিছু চুল হাতে নিয়ে বললো।
–ওয়াও মায়া আপু তোমার চুল কত্তো লম্বা। আর অনেক সুন্দরও। এতো সুন্দর চুল কিভাবে বানিয়েছ তুমি?

মায়া মুচকি হেসে বললো।
–আরে আমি কিছুই করিনি। এটাতো এমনি এমনি এতো বড়ো হয়ে গেছে। আর তুমি সুন্দর বলছ এটা তো আমার কাছে একটা ভেজাল। এগুলো সামলাতে অনেক বিরক্ত হয়ে যায় আমি। মাঝে মাঝে মনে হয় কেটে ফেলি।

–হায়য় আপু কি বলছ এসব? এতো সুন্দর চুল তুমি কেটে ফেলবে? তাহলে আমাকে দিয়ে দিও কেমন? এতো সুন্দর চুল আমার হলে কতো সুন্দর লাগবে আমাকে।

মায়া হালকা হেঁসে বললো।
–আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু তুমিতো এমনিতেই অনেক সুন্দর। একদম পরীদের মতো।

–ধ্যাৎ কিযে বলোনা। আমি আর সুন্দর? ওতো আমার ফরেনার মায়ের জন্য একটু ফর্সা রঙ পেয়েছি। তাছাড়া আর কিছুই না। দেখনা কত্তো মোটা মোটা চশমা পড়তে হয়। একদম মুরুব্বি মুরুব্বি লাগে। স্কুলের সবাই শুধু খেপায় আমাকে।

মায়া সারার গালে হাত রেখে আদুরে গলায় বললো।
–কে বললো তোমাকে? আরে তুমিতো এত্তো কিউট। কেও তোমার মায়ায় পড়লে আর নিজেকে ছাড়াতে পারবে না।

–অওওওও আপু তুমিও অনেক কিউট। একদম কিউটের ডিব্বা।
কথাটা বলে সারা মায়ার গাল টেনে দিল।

সারার কথায় মায়া হেঁসে দিয়ে বললো।
–আচ্ছা তুমি কোন ক্লাসে পড়ো।

–আমি ক্লাস টেনে।

–আচ্ছা এসো আমি তোমার চুলে বিনুনি করে দেই। তাহলে ঘুমুতে সুবিধা হবে।

সারা খুশি হয়ে বললো।
–হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই করে দাও। তাহলে আমার চুলও তোমার মতো লম্বা হয়ে যাবে।

মায়া সারার চুলে বিনুনি করে দিতে লাগলো। অল্প সময়েই দুজনের খুব ভাব হয়ে গেল। মেয়েটাকে অনেক ভালো লেগেছে মায়ার। কতো মিশুক মেয়েটা৷ এতো ধনী হয়েও কোন অহংকার নেই ওদের ভেতর। এখানে নিজের মামাতো বোনই কখনো ওর সাথে এভাবে কথা বলেনি। অথচ এরা কতো সুন্দর মিশে গেছে ওর সাথে। মায়া মুচকি হেসে সারাকে বললো।
–আচ্ছা সারা,রাইসার আপুর কি বাচ্চা আছে? না মানে কখন থেকে বেবি বেবি করছে। মনে হচ্ছে ওনার বাচ্চার সাথে কথা বলছে।

মায়ার কথা শুনে সারা হঠাৎ উচ্চস্বরে হেঁসে উঠলো। সারাকে হাসতে দেখে মায়া একটু থতমত খেয়ে গেল। সারার হাসির শব্দ শুনে রাইসা ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো।
–এই গাধী, এভাবে ছাগলের মতো হাসছিস কেন? আমরা যে আত্মীয়র বাড়িতে আছি সে খেয়াল আছে তোর?

সারা কোনরকমে হাসি থামিয়ে বললো।
–আরে আপু তুমি আগে মায়া আপুর কথা শোন।তারপরে দেখ তুমিও হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাবে।

–আচ্ছা কি এমন কথা শুনি?

সারা রাইসাকে মায়ার বলা কথাটা বললো। রাইসাও শুনে হাসতে শুরু করে দিল। মায়া এদের এতো হাসার কারণ কিছুই বুঝতে পারছে না। সারা তখন মায়াকে সবটা খুলে বললো। তখন মায়াও ওদের সাথে হেঁসে দিল। অল্প সময়ের মাঝেই ওদের মাঝে খুব ভাব হয়ে গেল। মায়াকে ওদের দুজনেরই খুব পছন্দ হয়েছে। মেয়েটা ওর নামের মতোই অনেক মায়াবী। মায়া যখন নিচে শুতে চাইলো তখন সারা আর রাইসা ওকে কিছুতেই নিচে শুতে দিলনা। দুজন টেনে ওকে নিজেদের কাছে বিছানার উপর নিয়ে এলো। তারপর তিনজন মিলে নানান গল্প করতে লাগলো।

রাত ১২টা
অরণ্য বেডের এক কোণা ঘেঁষে বসে আছে। পাশেই রিয়া বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। অরণ্যের প্রচুর অস্বস্তি লাগছে। মেয়েটার সাথে এক ঘরে থাকতে কেমন যেন দমবন্ধ লাগছে ওর। কিন্তু এমনটা হওয়ার কারণ কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না ও। রিয়া তো ওর বউ। ওতো নিজেই ওকে পছন্দ করে বিয়ে করলো।তাহলে এমন লাগছে কেন ওর? নাহ আর ভাবতে পারছে না ও
।মাথাটা কেমন হ্যাং হয়ে আসছে ওর। একটু ফ্রেশ হাওয়া নিতে পারলে ভালো হতো। সাথে কফি হলেও ভালো হতো। কিন্তু এখানে কোথায় পাবে কফি। আর এতরাতে কাকেই বা বলবে।

তবুও অরণ্য একটু ফ্রেশ হাওয়া নিতে রুমের বাইরে বেরিয়ে এলো। রুমে ওর দমবন্ধ হয়ে আসছিল। অরণ্য ফ্রেশ হাওয়া নিতে ছাঁদের দিকে পা বাড়ালো। ছাঁদের সিঁড়ির কাছে আসতেই হঠাৎ একটা মিষ্টি সুর কানে ভেষে আসলো অরণ্যের। এতরাতে কারও গানের সুর শুনে অরণ্য একটু অবাক হলো। তবে গানের সুরটা খুবই মধুর। অরণ্য সুরের উৎস খুঁজতে ধীরে ধীরে ছাঁদের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো। ছাঁদের দরজায় আসতেই সুরটা আরও স্পষ্ট হয়ে এলো।

আদিত্য সামনে তাকিয়ে দেখলো একটা এলোকেশী কন্যা ছাদের ব্রেঞ্চের ওপর হাঁটু মুড়ে বসে নিজের মনে গান গাইছে।

♬ না জানি কোন অপরাধে দিলা এমন জীবন
♬আমারে পুড়াইতে তোমার এতো আয়োজন
♬ আমারে ডুবাইতে তোমার এতো আয়োজন

♬ সুখে থাকার স্বপ্ন দিলা,সুখতো দিলা না
♬ কতো সুখে আছি বেঁচে খবর নিলা না আআ
♬ বিধি খবর নিলা না আ আ…
♬আমি ছাড়া কেউ নাই আমার দুখের পরিজন
♬ আমারে পুড়াইতে তোমার এতো আয়োজন
♬ আমারে ডুবাইতে তোমার এতো আয়োজন

অরণ্য যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে এই সুরে। মেয়েটার দীঘল কালো চুল বাতাসে ঢেউ খেলছে। মনে হচ্ছে এই কালো চুল গুলোই যেন রাতের আকাশকে আরও ক্ষয়িষ্ণু করে তুলেছে।জোছনা ভরা চাঁদের আলোয় মেয়েটাকে যেন অলৌকিক কিছু মনে হচ্ছে। অরণ্যের কেমন যেন ঘোর লেগে আসছে। অরণ্য আনমনেই মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেল।

নিজের পেছনে কারোর পায়ের শব্দ শুনে চমকে গেল মায়া। সাথে সাথে গান বন্ধ করে পেছনে ফিরে তাকালো মায়া। অরণ্যকে এখানে দেখে আবারও বুকের ভেতর কেঁপে উঠল মায়ার। অরণ্যও তাকিয়ে আছে মায়ার দিকে। এবার ওর চেহারাটা পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে। এটা যে তখনকার সেই মেয়েটা তা চিনতে দেরি হলোনা অরণ্যের। মায়া উঠে দাঁড়িয়ে তড়িঘড়ি করে ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে নিল। মাথা নিচু করে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো।
–আ আপনি এখানে?

মায়ার কথায় অরণ্যের ঘোর কাটলো। অরণ্য একটু নড়েচড়ে উঠে বললো।
–এই এমনি। একটু ফ্রেশ হাওয়া নিতে এসেছিলাম।

মায়া আর কিছু না বলে মাথা নিচু করা অবস্থায়ই ওখান থেকে চলে যাওয়ার উদ্যোত হতেই অরণ্য বলে উঠলো।
–কি ব্যাপার আপনি সবসময় এভাবে পালিয়ে যান কেন? আমি কি দেখতেই এতটাই ভয়ানক নাকি যে আমাকে দেখেই ভয়ে পালান? নিজেকে তো আমার বাঘ ভাল্লুক টাইপ মনে হচ্ছে।

অরণ্যের কথায় মায়া হালকা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো।
–বাঘ ভাল্লুক তো শুধু শুধু বদনাম হয়েছে। আসল ভয়ংকর প্রাণী তো মানুষই হয়। মানুষের চেয়ে ভয়ংকর পৃথিবীতে কিছুই নেই।

অরণ্য মুচকি হেসে বললো।
–হুমম পয়েন্ট আছে।তাহলে আমাকে দেখে এভাবে পালিয়ে যাচ্ছেন কেন?

–পালানোর কি আছে? আমিতো শুধু আপনাকে স্পেস দিয়ে যাচ্ছিলাম। আপনি এখানে এসেছেন ফ্রেশ হাওয়া নিতে। আর আমি থাকলে আপনি ডিস্টার্ব হতে পারেন। তাই চলে যাচ্ছিলাম।

–আরে তেমন কিছুই না। আমার তো বরং আপনার গান শুনতে অনেক ভালোই লাগছিল। সরি বিনা অনুমতিতে আপনার গান শুনে ফেলেছি। আসলে আমি এদিকেই আসছিলাম হঠাৎ আপনার গান শুনতে পেলাম। তাই চলে আসলাম। সরি আপনাকে হয়তো আমি ডিস্টার্ব করে ফেললাম।

–আরে না না সরি বলার কি আছে? এটা আপনার শশুর বাড়ি। আপনি যেখানে খুশী সেখানে যেতেই পারেন। তা এতো রাতে আপনি বের হয়েছেন কেন? মানে কোন কিছুর দরকার ছিল আপনার?

অরণ্য ইতস্ততভাবে বললো।
–হ্যাঁ একটু তো দরকার ছিল। আসলে একটু কফির দরকার ছিল। তবে এতরাতে আর কাকে বলবো? তাই এমনিই হাঁটছিলাম।

–ঠিক আছে আমি আপনার জন্য কফি করে আনছি।
কথাটা বলে মায়া চলে গেল কফি বানাতে। আর অরণ্য ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটার সাথে কথা বলে কেমন যেন অনেক ভালো লাগছে ওর। এতক্ষণের দমবন্ধ ভাবটা কেটে গেছে একদম। মেয়েটার সাথে আরও কথা বলার ইচ্ছে জাগছে ওর। কেন হচ্ছে এমন তা বুঝতে পারছে না ও।

একটু পরেই মায়া ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ নিয়ে হাতে নিয়ে ছাঁদে এলো। অরণ্য এতক্ষণে ব্রেঞ্চের ওপর বসে পড়েছে। মায়া অরণ্যের সামনে এসে কফির মগটা অরণ্যের দিকে এগিয়ে দিল। অরণ্য মুচকি হেসে মগটা হাতে নিয়ে বললো।
–থ্যাংক ইউ সো মাচ।

মায়া সৌজন্যমূলক স্মিথ হেঁসে আবারও চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই অরণ্য বলে উঠলো।
–আরে কি হলো আবারও চলে যাচ্ছেন কেন? একটু বসুন না। অন্তত আমার কফিটা শেষ হওয়া পর্যন্ত থাকুন। একটু কথা বলি আমরা।

অরণ্য ব্রেঞ্চের একপাশে সরে বসে মায়াকে বসতে ইশারা করলো। মায়ার কেমন বুকের ভেতর কাঁপছে। দ্বিধায় পড়ে গেল মায়া। ও এই লোকটার কাছ থেকে যতটা পারে দূরে থাকতে চাচ্ছে। কারণ সে কোন মিথ্যে মায়ায় নিজেকে জড়াতে চায়না। তাহলে আবারও মনে নতুন আশার জন্ম হবে। যা হয়তো কখনোই পূরণ হবে না।তার ওপর মামী জানতে পারলে এই নিয়ে আরও অশান্তি করবে। কিন্তু এনাকে তো আর সেটা বলা যাচ্ছে না। তাই অগত্যা অরণ্যের কথায় ব্রেঞ্চের একপাশে গিয়ে বসলো।

অরণ্য বলে উঠলো।
–আচ্ছা আমি কি তুমি করে বলতে পারি আপনাকে? না মানে আপনিতো আমাদের বয়সে ছোটই হবেন। আর আমাদের সম্পর্কে টাও তো সেরকমই তাইনা?

সম্পর্কের কথা শুনে চমকে উঠলো মায়া। অরন্যের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো।
–স সম্পর্ক মানে?

–হ্যাঁ সম্পর্ক। কেন তুমি জানো না আমাদের কি সম্পর্ক?

মায়া ভয়ে শুকনো ঢোক গিলছে। তাহলে কি উনি সব জেনে গেছে? অরণ্য তখন বলে উঠলো।
–আরে আমি শালিকা আর দুলাভাইয়ের কথা বলছি। আমাদের তো সেই সম্পর্কই তাইনা?

মায়া মাথাটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে চোখ বন্ধ করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।তবে অরণ্যের বলা শালি দুলাভাইয়ের কথাটা কেমন কাঁটার মতো লাগলো ওর কাছে। জীবনে এমন একটা সিচুয়েশন আসবে তা কখনো ভাবেনি মায়া। জীবন কেমন খেলা খেলছে ওর সাথে। মায়ার ভাবনার মাঝেই অরণ্য বললো।
–তাই তোমার সমস্যা না হলে,,,

অরণ্যের কথা শেষ হওয়ার আগেই মায়া বলে উঠলো।
–হ্যাঁ বলতে পারেন। কোন সমস্যা নেই।

অরণ্য মুচকি হেসে বললো।
— ধন্যবাদ। তো এতরাতে ছাঁদে একা একা বসে আছ ভয় লাগেনা তোমার? নাকি একা থাকতে পছন্দ করো?

মায়া সামনের দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে আনমনেই বলে উঠলো।
–একা থাকাটা সবসময় নিজের পছন্দ না বরং প্রয়োজন হয়ে যায়। কারোর কারোর হয়তো একাকিত্বই একমাত্র সাথী। আর নিজের একমাত্র সাথীকে তো আর কেউ একা ছাড়তে পারেনা তাইনা? আর ভয়ের কথা বলছেন? রাতকে আবার ভয়ের কি আছে? আমার কাছে তো রাতটাই একমাত্র আপন মনে হয়। রাতের অন্ধকারের বুকে মাথা রেখে মানুষ নিজের সব সুখ দুঃখ, হাসি কান্না, মনের সব না বলা অনূভুতিগুলো ব্যাক্ত করতে পারে। আর এই বিশাল রাত তার গহিনে আমাদের সবকিছুই সযত্নে রেখে দেয়। কখনো কাওকে কিছু বলে না।

অরণ্য মুগ্ধ হয়ে মায়ার কথাগুলো শুনছে। সত্যিই কত গভীর ভাবে কথাগুলো বললো মেয়েটা। এমনভাবে হয়তো আমরা কখনো ভেবেই দেখেনি। তবে ওর কথায় অরণ্য বুঝতে পারলো যে মেয়েটার মাঝে অনেক কষ্ট জমে আছে। রিয়া বলেছিল মায়ার মা বাবা মারা গেছে। তাই হয়তো মেয়েটার এতো কষ্ট। পৃথিবীতে মা বাবার না থাকার মতো কষ্ট আর কিসে থাকতে পারে। কথাটা ভেবে অরণ্য বলে উঠলো।
–আমি তোমার মা বাবার কথা শুনলাম।অ্যাম সরি ফর ইউর লস।

মায়া একইভাবে থেকেই বলে উঠলো।
–আপনি কেন সরি বলছেন? আপনার জন্য কি আর তারা মরেছে। এই ইংরেজ রাও ভালো একটা শব্দ তৈরি করেছে। “সরি”। বাচ যাইহোক সরি বলে দিলেই শেষ। তাইতো লোক কথায় কথায় সরি বলে দেয়।

মায়ার কথায় অরণ্য হেঁসে দিল। মায়া এবার সরাসরি অরণ্যের দিকে তাকালো। অরণ্যের হাস্যোজ্জ্বল মুখটায় চোখ আটকে গেল ওর। কত সুন্দর উনার হাসি। লোকটাও খুব সুন্দর। রিয়া ঠিকই বলে উনার মতো এতো সুন্দর লোক আমার মতো কুৎসিত মেয়েকে কখনোই স্ত্রী হিসেবে মেনে নিবে না। কথাটা ভেবে মায়া সাথে সাথে মাথাটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল। এসব ভাবাও অনর্থক।

অরণ্য তখন বলে উঠলো।
–তুমি সত্যিই অনেক সুন্দর করে কথা বলো।

অরণ্যের কথায় মায়ার খেয়াল হলো। ও নিজেও অনেক টা অবাক হলো। ও কখনো কোন ছেলের সাথে এতো কথা বলেনি। তাহলে আজ ওনাকে এতো কথা কিভাবে বলে দিলাম? কেমন নির্দ্বিধায় এতো কথা বলে দিল। যেন অতি আপন কারোর সাথে কথা বলছে। মায়ার ভাবনার মাঝেই অরণ্য আবার বলে উঠলো।
–বায়দা ওয়ে কফিটা কিন্তু অনেক ভালো ছিল। থ্যাংক ইউ।

মায়া সৌজন্যমূলক হাসি দিল। এভাবে আরও নানান কথা বলতে লাগলো ওরা। অরণ্য যেন সময়ের সাথে আরও মুগ্ধতায় জড়িয়ে পড়ছে। বুকের ভেতর এক অদ্ভুত প্রশান্তির বাতাস বইছে। চোরা চোখে শুধু মায়াকেই দেখে যাচ্ছে। মেয়েটার চেহারায় কেমন অদ্ভুত এক মায়া আছে। তারওপর চাঁদের আলোয় মেয়েটাকে আরও বেশি মায়াবী লাগছে। মাথায় ওড়না দিয়ে ঢেকে রাখলেও সামনের কিছু চুল বাইরে এসে বাতাসে কপালের ওপর উড়ছ। অরণ্যের খুব বলতে ইচ্ছে করছে ওড়নাটা সরিয়ে চুলগুলোকে মুক্ত করে দিতে। মায়াকে দেখতে দেখতে অরণ্যের হঠাৎই মনে হলো মায়ার চেহারা টা ওর সেই কল্পকন্যার সাথে কেমন মিলে যাচ্ছে।

কথাটা মনে আসতেই চমকে গেল অরণ্য। কি ভাবছে ও এসব? এমন একটা উদ্ভট কথা মাথায় কিভাবে এলো ওর? আমিতো আমার পছন্দের মেয়েকেই বিয়ে করেছি। তাহলে এসব কি হচ্ছে আমার সাথে? না না এটা ঠিক না। এসব অনুচিত চিন্তা ভাবনা মাথায় আনা একদম ঠিক না। অরণ্যের ভাবনার মাঝেই মায়া বলে উঠলো।
–অনেক রাত হয়েছে। আমার এখন যাওয়া উচিত। সকালে আবার ভার্সিটিতে যেতে হবে।

অরণ্য মাথা হালকা ঝাঁকিয়ে সায় জানালো। মায়া উঠে চলে যেতে লাগলো। কিছুদূর যেতেই অরণ্য আবার পেছন থেকে ডাক দিল। মায়া পিছনে তাকাতেই অরণ্য বলে উঠলো।
–গুড নাইট।

মায়াও সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বললো।
–গুড নাইট।

মায়া চলে গেল। তবে পেছনে রেখে গেল অরণ্যের মাঝে অশান্তির ঢেউ। এতক্ষণ শান্তি পেলেও মায়া চলে যেতেই আবারও মনটা অশান্ত হয়ে উঠলো। মায়ার সাথে সময় কাটিয়ে ওর মনের এলোমেলো ভাবনা গুলো আরও যেন গুলিয়ে গেল। কি হচ্ছে ওর সাথে কিছুই বুঝতে পারছে না অরণ্য। সবকিছু কেমন অদ্ভুত লাগছে। মনের মাঝে এতো প্রশ্নের উৎপত্তি হচ্ছে কেন? আমি কি কোথাও কিছু ভুল করলাম?

চলবে…..

গল্প বা লেখিকার লেটেস্ট আপডেট পেতে এবং গল্প নিয়ে যেকোনো আলোচনা আড্ডা দিতে অবশ্যই গ্রুপে জয়েন হোন।
গ্রুপ
https://facebook.com/groups/170529085281953/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here