#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৩৩
হসপিটালের সবাই হা হয়ে তাকিয়ে আছে আদ্রিতার দিকে। এই প্রথম তারা আদ্রিতাকে সাজ সমৃদ্ধ রূপে শাড়ি পরিধিত দেখছে। তাকে দেখেই ডক্টর কবির এগিয়ে এলেন। তিনি আদ্রিতাদের একজন সিনিয়র ডক্টর। আদ্রিতা এগিয়ে গিয়ে তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে বললো,
“কি হয়েছে স্যার?”
“রুম নাম্বার চারশো ছয়ে যাও।”
আদ্রিতা দেরি করলো না। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল রুম নাম্বার চারশো ছয়ের দিকে। রুমে একজন মহিলা আছে। বুড়ো মহিলা তার মাথায় সার্জারী হয়েছে একসপ্তাহ হয়েছে। তার একটা সমস্যা হলো তিনি আদ্রিতাকে অনেক পছন্দ করে। তাকে ছাড়া আর কারো কাছেই কোনো চিকিৎসাই নিবেন না। একটা ঔষধী ইনফেকশন পুস করা হবে তার হাতে। কিন্তু তিনি কিছুতেই সেটা কোনো নার্সের কাছ থেকে নিবেন না। নিবেন আদ্রিতা থেকে। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়েই আদ্রিতাকে ডাকা হয়েছে। আদ্রিতা রুম খুলে ভিতরে ঢুকতেই মহিলাটি হাসলেন। বললেন,“তুমি আইছো পাখি।”
আদ্রিতা মৃদু হাসলো। সামনে এগিয়ে গিয়ে বললো,“হুম এসেছি। কিন্তু কি শুনছি আমি? তুমি নাকি ইনজেকশন দিতে দিচ্ছেলে না।”
মহিলাটি মিনমিনে কণ্ঠে বললো,“ওনারা ব্যাথা দেয়। তুমি দেও। তুমি দিলে আমি ব্যাথা পাই না।”
আদ্রিতা আর কিছু বললো না। নার্সের হাত থেকে ইনজেকশনটা নিলো। এগিয়ে গেল মহিলাটার দিকে।
—-
চাঁদনীর চেম্বারে স্যুটব্যুট পড়ে বসে আছে আদিব। হাতে একগুচ্ছ গোলাপ যা তাকে ফারিশ কিনে দিয়েছে। ফারিশ নিচে আছে গাড়ি নিয়ে। বলেছে, ‘তুমি গিয়ে শুরু করো না পারলে আমি আসছি।’
আদিব কিছু বলে নি। শুধু নির্বিকার ভঙ্গিতে চেয়েছিল ফারিশের দিকে। চাঁদনীর ডাকে ধ্যান ফিরলো আদিবের। সে বললো,“এই যে মিস্টার, আজ কি সমস্যা নিয়ে আসলেন?”
আদিব কেঁপে উঠলো খানিকটা। হাতের ফুলগুলো চাঁদনীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,“এগুলো আপনার জন্য।”
চাঁদনী বেশি ভাবলো না। হাত বাড়িয়ে নিলো। প্রশ্ন করলো,“হঠাৎ ফুল কেন?”
আদিব ঘামছে কিছু বলছে না। তার কানে ব্লুটুথ। ফারিশ বললো,“তুমি কি বলবে আদিব নাকি আমি আসবো।”
আদিব আচমকাই চেঁচিয়ে উঠলো। বললো,“না।”
আদিবের আচমকা চেঁচানি শুনে চাঁদনী ঘাবড়ে গেল। থমথমে কণ্ঠে বললো,“কি হয়েছে?”
আদিব চাইলো চাঁদনীর দিকে। বললো,“কিছু হয় নি। আমার আপনাকে কিছু বলার আছে।”
চাঁদনী শান্ত হলো। বললো,“ঠিক আছে বলুন।”
আদিব কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে ববলে উঠলো,“আসলে আমি..
চাঁদনীও পরপর উত্তর দিলো,“আসলে আপনি..
আদিবের আবার ঘাম বের হচ্ছে সে বললো,
“আসলে আমি..
“আসলে আপনি,
“আসলে..
এবার চাঁদনীর বিরক্ত লাগলো। সে কর্কশ কণ্ঠে বললো,“কি কখন থেকে আসলে আসলে করে যাচ্ছেন পরেটা তো বলুন।”
অন্যদিকে ফারিশও বিরক্ত। সে বুঝলো এ ছেলে আজও বলতে পারবে না। ফারিশ বললো,“তোমায় বলতে হবে না আদিব আমিই আসছি।”
কথাটা বলে গাড়ির দরজা খুলতে নিলো ফারিশ সঙ্গে সঙ্গে আদিব চোখ বন্ধ করে বলে উঠলো,“আসলে আমি আপনাকে ভাললবাসি। বিয়ে করতে চাই।”
ফারিশ হেঁসে উঠলো। গাড়ির দরজা আস্তে করে বন্ধ করে দিল। ফারিশ এমনিতেও যেত না। আদিবকে ঘাবড়ানোর জন্যই দরজা খুলেছিল শব্দ করে।’
আদিব চোখ বন্ধ করে বসে। তার হাত পা কাঁপছে। চাঁদনী কি রিয়েকশন দিলো। দেখতেও তার ভয় হচ্ছে। হঠাৎই হাতে কারো স্পর্শ পেল আদিব। আদিব চাইলো। চাঁদনী তার খুব কাছে দাঁড়িয়ে। চাঁদনী লাজুক হাসলো। শান্ত স্বরে শুধালো,“এতটুকু কথা বলতে কেউ এত সময় লাগায় খবিশ।”
আদিব বার কয়েক চোখের পলক ফেলে তাকিয়ে রইলো চাঁদনীর দিকে। চাঁদনী মৃদু হেঁসে আদিবকে জড়িয়ে ধরলো। শীতল স্বরে আওড়ালো,“আমিও আপনায় ভালোবাসি মিস্টার খবিশ।”
আদিব তিন সেকেন্ড স্তব্ধ থেকে হেঁসে উঠলো আপনাআপনি। কানের পাশে ফারিশ বললো,“অল দা বেস্ট আদিব। সুখি হও। ফারিশের কথা শুনে আদিবের হাসি আরো চওড়া হলো মৃদু শব্দ করে বললো,“শুকরিয়া ভাই।”
—
কান থেকে ব্লুটুথ সরিয়ে কল কাটলো ফারিশ। যাক অবশেষে আদিব তার মনের মানুষটাকে পেয়ে গেল। এবার সুন্দর একটা দিন দেখে আদিব আর চাঁদনীর বিয়েটা দিয়ে দিতে হবে। ফারিশ হাত ঘড়িটা দেখলো। বেলা প্রায় চারটার কাটায় ছুঁই ছুঁই। ফারিশ আদ্রিতাকে মেসেজ লিখলো,“আর কতক্ষণ অপেক্ষায় থাকবো ডাক্তার ম্যাডাম, এবার তো নিশ্বাস ফেলাও দায় হয়ে পড়ছে।”
আদ্রিতা তখন নিজের ক্যাভিন থেকে বের হবে। সে মেসেজ লিখলো,“আমার হসপিটালের সামনে এসে মেসেজ লিখুন আমি আসছি।”
পরপরই মেসেজ আসলো,“আমি হসপিটালের কাছেই আছি চলে আসুন।”
আদ্রিতা একটু অবাক হলেও বেশি ভাবলো না। মুচকি হেসে লিখলো,
“একটু অপেক্ষা করুন আসছি।”
“ঠিক আছে।”
ফারিশের ‘ঠিক আছে’ মেসেজটা পেতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো আদ্রিতা। মোবাইলে একটু দেখে নিলো নিজেকে। সব ঠিক আছে। ভেবেই কাঁধে ব্যাগটা নিলো। বাহিরে যাবে এরই মাঝে তার ক্যাভিন খুলে ভিতরে আসলো কেউ। বললো,“কেমন আছেন ডাক্তার সাহেবা?”
আদ্রিতা বেশ অবাক চোখে তার পানে তাকালো। বললো,“আপনি এখানে?”
—
পনের মিনিট যাবৎ ফারিশ বসে আছে গাড়িতে অথচ আদ্রিতার খবর নেই। এই মুহূর্তে ফারিশের মনে হচ্ছে ডাক্তারদের সাথে পিরিত করতে নেই। এদের যখন তখন ইমারজেন্সি হয়ে যেতে পারে। ফারিশ হতাশার সুর টানলো। হঠাৎ ফারিশের মনে হলো আদ্রিতা আসছে। ফারিশ গাড়ির দরজা খুললো। আদ্রিতা হাসিমুখে তার দিকে এগিয়ে আসছে ফারিশ মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো আদ্রিতার দিকে। এই প্রথম আদ্রিতা তার সামনে শাড়ি পড়ে এসেছে। গোলাপী শাড়ি আর খোলাচুলে মেয়েটাকে এত বেশি সুন্দর লাগছে কেন! আজ যেন নতুন করে আদ্রিতার প্রেমে পড়লো ফারিশ। ফারিশ হাসলো। মিষ্টি সেই হাসি। যে হাসিতে কোনো মিথ্যে নেই। আদ্রিতা ততক্ষণে ফারিশের কাছাকাছি এসে পড়েছে। সে মিষ্টি স্বরে বললো,“আপনি বিকেল চেয়েছিলেন আমি কিন্তু বিকেল নিয়ে এসেছি ফারিশ।”
ফারিশ আদ্রিতার হাত ধরলো। আনমনা ঠোঁটে হাতে চুমু কাটলো,“একটু ছুইলাম কথা দিচ্ছি বিয়ের আগে এভাবে আর ছুবো না।”
আদ্রিতা বরফের ন্যায় কেঁপে উঠলো। ফারিশ মুগ্ধ নয়নে তার পানে তাকিয়ে। নীরব। চুপচাপ। শান্ত চাহনি। আদ্রিতা বললো,“বিকেলটা কি এখানে দাড়িয়েই কাটাবেন?”
ফারিশ আশপাশ দেখলো। আদ্রিতার কানের কাছে মুখটা নিয়ে বললো,“এমন বিকেল আমার রোজ চাই ডাক্তার ম্যাডাম।”
আদ্রিতা হাসে। বলে,“আগে আজকের বিকাল তো শেষ করি।”
ফারিশ পুরো পাগলাটে হয়ে গেছে। নিজেকে সামলানো কঠিন হচ্ছে। আদ্রিতা গাড়িতে গিয়ে বসলো। ফারিশ নিজের ভাবনায় নিজেই মাথায় একটা চাটি মারলো। নিজেই নিজেকে বললো,“তুই এমন পাগলাটে কবে থেকে হলি ফারিশ।”
উত্তর এলো না। নিজের প্রশ্নের উত্তর কি নিজে নিজে দেয়া যায়। ফারিশের কল আসলো আদিব করেছে। নিশ্চয়ই খুশির চোটে ফোন করেছে। ফারিশ ফোনটা তুলে আদিবকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বললো,“কি আদিব খুশি তো। তোমার ডাক্তার ম্যাডামকে নিয়ে বের হচ্ছি। এসে কথা বলবো। কেমন!”
ফোন কেটে দিল ফারিশ। এরপর দ্রুত গিয়ে বসলো ড্রাইভিং সিটে। গাড়ি চালাতে চালাতে বললো,“আমি হঠাৎ বেসামাল হয়ে উঠলে এর দায় কিন্তু আপনার। এত সেজেছেন কেন?”
আদ্রিতা অবাক হয়ে বললো,“আপনিই তো বললেন একটু ভিন্নভাবে আসতে।”
ফারিশ কিছু বলবে এরই মাঝে আদিব আবার ফোন করলো কিন্তু ফারিশ তুললো না। এই ছেলের এখনই ধন্যবাদ না দিলে কি চলবে না। ফারিশ ফোনটা সাইলেন্ট করে সামনে রাখলো। অতঃপর পারি দিলো দূর সীমানায়।’
ফারিশদের গাড়ি এসে থামলো এক নির্জন ব্রিজের সামনে। ফারিশ নামলো। আদ্রিতাকেও বললো,“নামুন।”
আদ্রিতা নেমে পড়লো। শাড়ির কুঁচি ধরে নামলো। এগিয়ে গেল। দুজন দাঁড়ালো ব্রিজের একদম মাঝ বরাবর। বিকেলের সুন্দর শীতলমাখা বাতাস এসে নাড়িয়ে দিল তাদের। আদ্রিতা আসার সময় হাতে করে গায়ের চাদর এনেছে যেটা বর্তমানে গাড়ির ভিতর বিরাজ করছে। ফারিশ পাশে এসে দাঁড়ালো। শান্ত স্বরে বললো,“আমি আজ আপনায় অনেককিছু বলবো আদ্রিতা। হয়তো কথাগুলো শুনে আপনি আমায় অনেককিছু ভাববেন। ভাবতেই পারেন। তবে আমি মনে করি আমাদের নতুন জীবন শুরু করার আগে আপনার আমার ব্যাপারে সবটা জানা উচিত।”
আদ্রিতা শীতল দৃষ্টি নিয়ে ফারিশের দিকে চাইলো। ফারিশ কিছু বলবে তার আগেই ফারিশের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বললো,“হুস এখন নয় পরে শুনবো।”
ফারিশ থেমে গেল। চুপ করে রইলো। আর কিচ্ছুটি বললো না। ব্রিজের নিচ বেয়ে নৌকা, স্টিমার যাচ্ছিল। বিশাল বিশাল ঢেউ দিচ্ছিল নদীতে। প্রকৃতিটা আজ যেন একটু বেশিই সুন্দর।’
অন্যদিকে গাড়িতে আদ্রিতার ফোনটাও ফারিশের ফোনের কাছে শুয়ে। আসার সময় ভুলে রেখে গেছে। ফারিশের ফোন বাজছে। আদিব লাগাতার কল করছে। এত তাড়া যে তার কিসের!’
সময় গড়ালো। বিকেল তখন সন্ধ্যার মুখে। আদ্রিতা ফারিশ এসে বসলো গাড়িতে। ফারিশ এবার অস্থির প্রায় আদ্রিতাকে সবটা জানানোর জন্য। ফারিশ গাড়িতে বসেই বলে উঠল,“এবার তো শুনুন আমার কথা।”
আদ্রিতা তার ফোন হাতে নিলো। কেউ কল করেছে কিনা চেক করলো। এরপর বললো,“জি বলুুন।”
ফারিশ জোরে এক নিশ্বাস ফেলে বলতে লাগলো,“আমি সত্যিই ভালো মানুষ নই আদ্রিতা। আমি একজন খারাপ মানুষ।”
আদ্রিতা সরাসরি চাইলো ফারিশের দিকে। বললো,“আবারও মজা করছেন ফারিশ?”
ফারিশ হতাশ হয়ে আদ্রিতার হাত ধরলো। তাকে ঠিক লাগছে না। আদ্রিতা এবার কিছুটা সিরিয়াস হলো। চোখে মুখে চিন্তার ছাপ এনে বললো,“কি হয়েছে?”
ফারিশ বেশি সময় নিলো না। প্রশ্ন করলো,“আপনি পপি গাছের নাম শুনেছেন। যার ইংরেজি নাম হলো
Papaver somniferum যা দিয়ে আফিম তৈরি হয় এছাড়াও এ থেকে মরফিন পাওয়া যায়।”
আদ্রিতা কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বললো,“শুনেছি। কিন্তু এখানে আপনার খারাপ হওয়ার কি আছে?”
ফারিশ বলে উঠল,“আছে অনেক কিছু আছে। আসলে দুনিয়ার মানুষ আমায় যে নামে চেনে বা যে সম্পর্ক নিয়ে জানে তা পুরোপুরি..
আর বলার আগেই বিকট শব্দে ফোন বেজে কেটে গেল ফারিশের। ফারিশ থেমে গেল। নজর গেল ফোনের দিকে। আদিব পঞ্চাশ বার তাকে কল করেছে। এবার যেন বেশ অবাকই হলো ফারিশ। আদিব এতবার কল করছে কেন! আদ্রিতা এবার তাড়া দিলো। বললো,“কি হলো থেমে গেলেন যে।”
ফারিশ বললো না। আদিবকে কল ব্যাক করবে এরই মাঝে আদিব আবার কল করলো। ফারিশ আদ্রিতাকে চুপ হতে বলে। আদিবকে উদ্দেশ্য করে বললো,“কি হয়েছে আদিব এতবার কল করছো কেন?”
তখনই আদিব কিছু বললো। অনেককিছু বললো। ফারিশ নির্বিকার ভঙ্গিতে আদ্রিতার পানে তাকিয়ে। কতক্ষণ পর ফারিশ কান থেকে ফোন সরালো। চুপ থাকলো অনেকক্ষণ। ফারিশের নীরবতায় আদ্রিতা থমকালো। প্রশ্ন করলো,“কিছু কি হয়েছে?”
ফারিশ মলিন হাসলো। চোখ জ্বলছে তার। নিশ্বাস আটকে আসছে। চাকুর আঘাতের চেয়েও ভিতরটা বেশি ছারখার হচ্ছে। ফারিশ নিজেকে সামলালো। করুণ কণ্ঠে আদ্রিতার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,“আমাকে জানার জন্য এত নিখুঁত অভিনয়ের খুব কি দরকার ছিল ডাক্তার ম্যাডাম?”
#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ]
#TanjiL_Mim♥️.