#শিশির_ভেজা_শিউলি
#পর্ব_১২
#ইবনাত_ইমরোজ_নোহা
(🚫দয়া করে কেউ কপি করবেন না।কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫)
আকাশে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছে তুলো রাশির দল। তাদের মাঝেই উঁকি দিচ্ছে দিবাকর।আজ তার মন বুঝি খারাপ। এইসময় ধরনীকে তার তেজে ঝলসে দেওয়ার কথা কিন্তু আজ সে বড্ড শান্ত। কিন্তু ভ্যাপসা গরম বেশ। রাস্তা পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছে সূরা। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সে।সূরার মনে হচ্ছে সে মরে যাচ্ছে। আচ্ছা সে কি সত্যি মরে যাচ্ছে? আবার আগের মত কষ্ট হচ্ছে তার।আগের বারও তো তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছিল, সেই অসহনীয় যন্ত্রণা আজ আবারো হচ্ছে। চোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা হয়ে আসছে তার।সবাই কেন তাকে ভুল বুঝে? কেন?এসব ভাবতে ভাবতে রাস্তার মাঝখানে চলে এসেছে সূরা সেই দিকে তার কোনো খেয়াল নেই। হঠাৎ একটা গাড়ি এসে দ্রুত গতিতে ধাক্কা দিল সূরাকে। ছিটকে রাস্তার পাশে পরলো সূরা। ঝাপসা চোখে শৈশবের মধুর স্মৃতি ভেসে ওঠে সূরার। কতো সুমধুর ছিল দিনগুলো। বড় হওয়া বুঝি পাপ। ঘোর পাপ। কিছু আপনজন মানুষের মুখোস্রি ভেসে ওঠে।অস্ফুটস্বরে বলে
“আব্বাজান, আম্মা, ভাইজান তোমাদের সুর কি মরে যাচ্ছে? কষ্ট হচ্ছে আম্মাজান।খুব কষ্ট হচ্ছে।ভাবিজান কে বলো তার সুরপাখি খুনি নাহ্।তার সুরপাখি ভালো নেই।ও আব্বাজান! আমি কি মরে যাচ্ছি? ডাক্তার কে যে অনেক কথা বলার ছিল।ও ডাক্তার!মাফ করবেন তোহ্ আপনার সুরজানকে?”
★★★★★★
ভ্যাপসা গরমে সব প্রাণীকুলের জীবন অতিষ্ঠ করে দিচ্ছে। ঘেমেনেয়ে একাকার অবস্থা সবার। ধরনীর বুকে এক পলসা বৃষ্টি হলে মন্দ হতোনা।পুরো কলেজ ক্যাম্পাস তন্যতন্য করে খুঁজেও সূরাকে পায়নি কেউ।মিসবাহর নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। পার্কিং এরিয়ার দিকে ছুটে যাচ্ছে সবাই। উদ্দেশ্যে সূরাকে খোঁজা। গাড়িতে উঠে বসল মিসবাহ। ফ্রন্ট সিটে জিহাদ বসল। পেছনের সিটে দিয়া ,রাফি আর সিহাব।মুঠোফোনটা অনেকক্ষণ যাবৎ কর্কশ শব্দে বেজে যাচ্ছে। সেদিকে খেয়াল নেই মিসবাহর। জিহাদ মিসবাহর দিকে তাকালো।শুভ্র মুখোস্রী রক্তিম আজ। চোখে মুখে চিন্তার ছাপ। পরনের শার্ট টা কুঁচকে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। এলোমেলো চুল। জিহাদ ভেবে পায়না একটা মানুষ এতো অবহেলা পাওয়ার পরেও কি করে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসতে পারে।সূরা কেনো বুঝেনা? আবার মুঠোফোনের কর্কশ শব্দে হকচকিয়ে যায় জিহাদ। গলা ঝেরে বলল
“স্যার হয়তো জরুরি কল। অনেকক্ষণ ধরে বেজে যাচ্ছে।”
মিসবাহ তাকালো জিহাদের দিকে। রক্তিম চোখ দেখে ভরকে গেল জিহাদ। গাড়ি থামিয়ে কল রিসিভ করল মিসবাহ।অপর পাশে থেকে কিছু বার্তায় থমকে গেল সে। মুঠোফোন টা ধরে রাখার শক্তি টুকুও বুঝি নেই তার।হাত থেকে অবহেলায় পড়ে গেল যন্ত্রটা। শুধু অস্ফুটস্বরে বলল
“আমার সুরজান!”
★★★★★★
কোলাহলপূর্ণ হাসপাতাল।পাশের কেবিন থেকে স্বজন হারানোর আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। অনিল বুঝি ভারি হয়ে আছে। ফিনাইলের গন্ধে গা গুলিয়ে উঠবে যে কারোর কিন্তু কিছু মানুষের মধ্যে জাগতিক কোনো ভাবাবেগ নেই এখন। মিসবাহ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অপারেশন থিয়েটারের বন্ধ দরজার দিকে।সূরাকে রাস্তা থেকে মিসবাহর মা-বাবা নিজেদের হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। মাহমুদ সিকদার আর মুনতাহা সিকদার এক আত্মীয়ের বাসায় যাচ্ছিলেন। রাস্তায় এক্সিডেন্টের কথা শুনে গাড়ি থেকে নামেন।মুনতাহা সিকদার সূরা কে দেখেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।সূরার অবস্থা ভালো না দেখে দ্রুত হসপিটালে নিয়ে আসেন তারা।
দিয়া কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান প্রায়। প্রানপ্রিয় বান্ধবীর এই করুন অবস্থা মেনে নিতে পারছে না পঞ্চপাণ্ডবের চারজন। জিহাদ, রাফি, সিহাব মাথা নিচু করে বসে আছে। ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই।তাই বুঝি ওরা শত কষ্টেও কাঁদতে ব্যর্থ আজ। তবুও নিঃশব্দে নোনা জল কপোল ছুঁয়ে যাচ্ছে টের পাচ্ছে কি তারা। দিয়াকে মুনতাহা সিকদার সামলাচ্ছেন। মাহমুদ সিকদার ছেলের কাছে এগিয়ে গেলেন। পাশে বসে কাঁধে হাত রাখলেন। মিসবাহ এখনো পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে বন্ধ দরজার দিকে। মনে হচ্ছে পলক ফেললেই বুঝি সূরাকে হারিয়ে ফেলবে। মাহমুদ সিকদার কাতর স্বরে বলল
“আব্বা নিজেকে শক্ত করো। কিছু হবেনা সূরার।ভরসা রাখো।”
মিসবাহর কি হলো কে জানে হঠাৎ মাহমুদ সিকদারকে জড়িয়ে ধরে বলল
“বাবা তোমার মনে আছে? ছোট বেলায় তুমি বলতে আমি যা মন থেকে চাইব সেটা যদি অন্যায় কিছু না হয়ে পবিত্র হয় তাহলে আল্লাহ আমাকে তা দিবে। আমার সুর তো পবিত্র ফুল বাবা। আল্লাহ কি তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিবে না?”
মাহমুদ সিকদার কি বলে শান্তনা দিবেন ভেবে পাচ্ছেন না। নিজের কাঁধে ভেজা কিছু টের পেতেই বুঝলেন তার গম্ভীর, শক্ত ব্যক্তিত্বের অধিকারী, কঠোর লৌহ মানব ছেলেটি কাঁদছে। সকল পরিস্থিতি সবসময় শান্ত, স্থির হয়ে সামলানো ছেলেটা আজও বাইরে থেকে শান্ত কিন্তু ভেতরে ভেতরে কি সে স্থির আছে? নাকি সবকিছু সূরা নামক তান্ডবে শেষ হয়ে গেছে।ছেলের মুখ দেখতে চাইলে মিসবাহ আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। হয়তো নিজের দুর্বলতা দেখাতে নারাজ এই কঠোর মানবটি। কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলল
“ও বাবা!সুরের কি বেশি লেগেছিল?আমি ডাক্তার হয়েও যে ভেতরে যাওয়ার সাহস পাচ্ছি না।ওই মেয়েটাকে আমি কোনোদিন ক্ষমা করব না।আমায় একটু ভালোবাসলো না কেন বাবা? আমাকে কি একটু ভালোবাসা যেতো না?সব থেকেও আজ নিজেকে কেন নিঃস্ব মনে হচ্ছে?আমি কি মরে যাচ্ছি বাবা?”
“আব্বাজান এসব কেন বলছো?সূরা মামনি একদম ঠিক হয়ে যাবে। শান্ত হও।”
মিসবাহ আর কিছু বলল না। লেপ্টে রইলো বাবার সাথে। দেখে মনে হচ্ছে ছোট বাচ্চা তার বাবার কাছে আবদারের ঝুড়ি নিয়ে বসেছে।একটাই আবদার তার এই নিষ্ঠুর যন্ত্রণা থেকে আমাকে লুকিয়ে নাও বাবা।অপারেশন থিয়েটার থেকে ডক্টর বেরিয়ে আসতেই সবাই একপ্রকার দৌড়ে গেল তার কাছে।সবার একটাই কথা সূরা কেমন আছে। মিসবাহ ব্যস্ত স্বরে বলল
“ডা.সাদাদ সুর কেমন আছে?”
ডা.সাদাদ এই প্রথম সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানবটিকে এতোটা বিচলিত হতে দেখলেন। শান্ত থাকলেও ভেতরে ভেতরে ভয় পাচ্ছেন মানবটি।এই কঠোর মানবটার ব্যক্তিত্বের সব চেয়ে বড় ভক্ত সে। কিন্তু আপনজন হারানোর ভয়ে ভীত আজ এই কঠিন চোখ জোড়া। ডা.সাদাদ বলল
“স্যার অপারেশন সাকসেসফুল। মাথায় আঘাত পেয়েছিল ঠিকি কিন্তু ক্ষতটা বেশি না।ডান পা টা ফ্যাকচার হয়েছে। কিন্তু স্যার..
কিন্তু কথাটা শুনা মাত্র মিসবাহর বুক ধক করে উঠল। গম্ভীর স্বরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল
“কিন্তু কি ডা.সাদাদ?আপনি কি এখানে সিনেমার ডক্টরের রোল প্লে করছেন যে কিন্তু বলে থেমে গেলেন। কিন্তু কি?”
মুনতাহা সিকদার শান্ত স্বরে বলল “মিসবাহ আব্বা শান্ত হ।আগে দেখ কি বলে। ওকে বলতে দে।”
দিয়া ডুকরে কেঁদে উঠলো। সিহাব ওকে শক্ত করে ধরে আছে।সবার বিচলিত নজর ডা.সাদাদ এর ওপরে।ডা.সাদাদ শুকনো ঢক গিললো। নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল
“সরি স্যার।পেসেন্টের অবস্থা এখন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেও কতোক্ষন সেটা সম্ভব হবে আমরা বলতে পারছিনা।”
রাফি বলে উঠলো “কি বলতে চাইছেন আপনি?”
ডা.সাদাদ বলল “সূরার এক্সিডেন্ট হওয়ার আগে প্যানিক এ্যাটাক হয়েছিল। আমি ধারনা করছি আজ প্রথম ওর প্যানিক এ্যাটাক হয়নি এর আগেও বহুবার হয়েছে।আর স্যার উনি ডিপ্রেশড।হাসি খুশি রাখা উচিৎ ওনাকে।আমরা কেবিনে দিয়েছি। কিছুক্ষণ পরে দেখা করতে পারবেন।”
মিসবাহ আর কিছু না শুনে কেবিনের দিকে গেল।সূরাকে দেখা প্রয়োজন তার।সূরা কোনো কিছু নিয়ে ডিপ্রেশনে আছে মিসবাহ আগেই বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু প্যানিক এ্যাটাক হয় এটা কখনো মাথায় আসেনি তার।দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে মিসবাহ।শুভ্র কেবিনের মাঝে শুভ্র বিছানায় শুয়ে আছে তার প্রানভোমরা।মাথায়, পায়ে ব্যান্ডেজ। কিছুক্ষণ আগেও মনে হয়েছিল এই বুঝি জীবনের সব সুর হারিয়ে গেল মিসবাহর। একটু আগেও বুকে যে চিনচিনে ব্যথা ছিল এখন এই একটি মেয়েকে দেখেই সব শান্ত।বেড সাইড টুলে বসল মিসবাহ।কি মায়াবী মুখোস্রি।নিষ্পাপ, পবিত্র ফুল তার। ইচ্ছে করছে একটু মুখটা ছুঁয়ে দিতে। ব্যান্ডেজে অনাবৃত ললাটে তার ওষ্ঠধর ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু এই মেয়ে যে ওকে সেই অধিকার দেয়নি।কি হবে একটু যদি অনাধিকার চর্চা করে। একটু ছুঁয়ে দেওয়ার অপরাধে এই নিষ্ঠুর রমনী কি ওকে অসভ্য অপবাদ দিবে? দিলে দিবে। ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে মিসবাহ তার পুরুষালী শক্ত হাত ছুঁয়ে দিল সূরার কপোল। একটু থমকালো বুঝি এই কঠিন মানব।মুখ বাড়িয়ে সূরার ব্যান্ডেজে আবৃত ললাটে ওষ্ঠ জোড়া ছুঁয়ে দিল।কতোক্ষন ছুঁয়ে রাখলো জানা নেই তার।সূরা একটু নড়ে উঠতেই সরে আসল।সূরা ধিরে ধিরে পিটপিট করে তাকালো।মাথা ভার ভার লাগছে তার।বাম হাত একটু উঠাতেই ব্যথায় কুঁকড়ে অস্ফুটস্বরে ” আহ” বলে উঠল। মিসবাহ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল
“কি হয়েছে সুরজান?আমায় বলো। কোথায় কষ্ট হচ্ছে তোমার? খারাপ লাগছে?”
সূরা তাকালো মিসবাহর দিকে।কেমন এলোমেলো হয়ে আছে লোকটা। ফিনাইলের তীব্র গন্ধে বুঝলো হসপিটালে সে। হাতটা মিসবাহর গালে রাখলো। থমকে গেল মিসবাহ। হার্ট বিট বেড়ে গেল বুঝি। শান্ত চোখে তাকালো সূরার দিকে।সূরা অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো
“আমি কি মরে যাচ্ছি ডাক্তার?আমার বুকে এতো কষ্ট কেন হচ্ছে? ওরা আবার আমাকে কাঁদায় ছুড়ে ফেলে দিল। আমার সারা গায়ে নোংরা লেগে আছে ডাক্তার। দুর্গন্ধে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে দেখুন। অপবিত্র আমি।”
ডুকরে কেঁদে উঠলো সূরা। মিসবাহ দুই হাতের আজলায় সূরার মুখোস্রি আগলে নিল। ললাটে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল।সূরা আবেশে চোখ বন্ধ করে নিয়ে ডুকরে উঠে। মিসবাহ সরে এসে আদুরে কন্ঠে বলল
“আমি বলেছি না আমার সুরজান আমার পবিত্র শিউলি ফুল।সদ্য ফোটা শিউলি ফুল সে।ভালোবাসি তো সোনা। খুব ভালোবাসি।”
সূরা পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো মিসবাহর দিকে।আজ প্রথম মিসবাহ ভালোবাসি বলল।আগে অনেক ভাবে বুঝিয়েছে নিজের ভালোবাসা কিন্তু মুখ ফুটে আজ প্রথম প্রনয়ের কথা বলল।সূরা নিজেকে সামলে নিল।এই ভালো মানুষটাকে সে চাইনা নিজের অন্ধকার জীবনে।অতি কষ্টে বলল
“আমি আব্বাজান, ভাইজানের কাছে যাবো স্যার।দয়া করে তাদের আসতে বলুন।”
মিসবাহ সূরার কপোল থেকে নিজের হাত গুটিয়ে নেয়।মেয়েটা বড্ড বোকা।সে হয়তো জানেনা তার হৃদয়ের অব্যক্ত কথা মিসবাহ খুব ভালো ভাবে বুঝে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মিসবাহ।এই দহনের শেষ কোথায়?আর কতো দগ্ধ হবে সে।প্রনয়ের দহনে পুড়তে পুড়তে নিঃশেষ না হয়ে যায়।
#চলবে ……