#শিশির_ভেজা_শিউলি
#পর্ব_৩৬
#ইবনাত_ইমরোজ_নোহা
(🚫দয়া করে কেউ কপি করবেন না।কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫)
(প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য এই পর্ব)
গ্ৰামের সকাল শুরু হয় এক অন্য রকম প্রশান্তি নিয়ে। পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভাঙ্গে প্রত্যেকের। আজ আর দূর আকাশে কোনো কালো মেঘের প্রলেপ নেই। জানালা গলিয়ে বাইরে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে এক কিশোরী। তার বেসামাল অনুভূতির হিসেব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে সে। ঘরে দ্বিতীয় কারো উপস্থিতি টের পেতেই নড়েচড়ে দাঁড়ালো মেহের। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালে এক কঠোর মানবের মুখোস্রি দেখে। রায়হান শান্ত স্বরে বলে
“তোর সাথে আমার কথা আছে মেহু।”
মেহেরের নির্বিকার প্রতিত্তর “বলুন শুনছি।”
মেহেরের নির্বিকার প্রতিত্তর রায়হানের পছন্দ হয়না। চঞ্চল মেয়েটা কেমন যেনো গুটিয়ে গেছে। এই মেয়েকে যে এমন মনমরা ভালো লাগে না সে কি জানে? রায়হান বলে
“আমি তোকে ভালবাসি মেহু।”
মেহের চকিতে তাকায়। সে কি ঠিক শুনলো? হ্যাঁ ঠিকই তো শুনেছে সে। বিষ্ময়কর কন্ঠে বলে “কি বললেন রায়হান ভাই? আপনি আমাকে ভালোবাসেন?”
রায়হানের সরল স্বীকারোক্তি “হুঁ! ভালোবাসি। আমি কিছু বলতে চাই। মন দিয়ে শুনবি। কথার মাঝে কথা বলবি না। বুঝলি?”
মেহেরের অতি আনন্দে চোখ ছলছল করছে। এতো বছরের অপেক্ষার প্রহর শেষ। তার শখের পুরুষ তাকে ভালোবাসে। মেহের উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে বোঝায় সে শুনবে। রায়হান মেহেরের হাত ধরে বিছানায় বসালো। নিজেও দুরত্ব বজায় রেখে বসে। বলে
“সূরার জীবন আজ আমাদের কাছে খোলা বইয়ের মতো। তুই সবটাই জানিস তাই আশা করি আমাকে সবটা বলা লাগবেনা। তোর এখনো বয়স হয়নি মেহু। এখনো অনেক ছোট তুই। আমি চাইনা এই বয়সের কোনো ভুল সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয় তোকে। আমি তোকে ভালোবাসি তুই আমাকে ভালোবাসার অনেক আগে থেকেই। এক সদ্য কিশোরী বয়সে পা দেওয়া মেয়ের প্রেমে পড়েছিলাম আমি। কিন্তু কখনো চাইনি তুই আমার প্রেমে পড়িস। আমি তোর জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করতে রাজি মেহু কিন্তু আমি চাইনা তুই আবেগের বশে ভুল কাজ করিস।”
মেহের কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই রায়হান বলে “জানি। তুই হয়তো বলবি এই গুলো তোর আবেগ না। বিশ্বাস কর যদি তাই হয় তাহলে আমার চেয়ে খুশি আর কেউ হবেনা। তবুও আমি চাই একটা প্রাপ্ত বয়স্ক রমনী আমাকে বলুক আমি আপনাকে ভালোবাসি রায়হান ভাই। তখন আমি পুরো পৃথিবীকে একপাশে রেখে তোকে আগে গ্ৰহন করবো। কোনো বাঁধা মানবো না। বুঝতে পারছিস তো কি বলছি?”
মেহের উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে বোঝায় সে বুঝেছে। ক্ষীন স্বরে বলে “আমি পড়াশোনা করে অনেক বড় হবো রায়হান ভাই। যখন প্রাপ্ত বয়স্ক রমনীতে পদার্পন করবো তখন আপনাকে বলবো আমাকে বিয়ে করতে। তখন কিন্তু আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারবেন না।”
রায়হান মেহেরের গালে হাত রেখে বলে “আমার হৃদয়ে তোর বসবাস ছিল, আছে, থাকবে আমৃত্যু।”
মেহের খুশিতে গদগদ হয়ে বলে “তাহলে আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরি রায়হান ভাই।”
রায়হান শব্দ করে হেসে উঠে। রায়হানকে হাসতে দেখে মেহের ফিক করে হেসে দেয়। এই মেয়ে কখনো ঠিক হবেনা। এই মেয়ের চঞ্চলতার প্রেমেই তো সে পড়ে বারবার বারংবার।
★★★★★★
জমিদার বাড়ির পুকুরের পাড়ে উদাসীন হয়ে বসে আছে প্রিয়া। জিহাদ তার পাশে বসেই যে তাকেই দেখছে সেই দিকে কোনো খেয়াল নেই রমনীর। সকাল সকাল তার মেও মেও কে না দেখে জিহাদ এই দিকে আসে। তার মেও মেও যে এতো উদাস বুঝতে পারেনি জিহাদ। পাশে এসে বসলেও কোনো সারা শব্দ নেই তার। জিহাদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়ে পৃথিবীতে আছে নাকি মঙ্গলগ্রহে পাড়ি জমিয়েছে বোধগম্য হলো না জিহাদের। জিহাদ শান্ত স্বরে বলে “মেও মেও!”
প্রিয়া শুনতে পেল বলে মনে হলো না। জিহাদ আবার ডাকলেও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই দেখে একটু জোরে বলে “মেও মেও?”
প্রিয়া হয়তো প্রস্তুত ছিল না অনাকাঙ্ক্ষিত পুরুষালী কথার। হকচকিয়ে গেল প্রিয়া। ভয় পেয়ে গেল। দ্রুত উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পুকুরের পানিতে পা পিছলে গিয়ে পড়লো। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে জিহাদ। সে হয়তো কল্পনাও করেনি মেয়েটা ভয় পেয়ে পড়ে যাবে। প্রিয়ার পুকুরে পড়ে নাকে মুখে পানি উঠে গেছে। কাশতে কাশতে বেহাল দশা। একটু স্বাভাবিক হয়ে জিহাদের দিকে কটমট করে তাকালো সে। জিহাদ এখনো ঘোরের মধ্যে আছে যেন। প্রিয়া দাঁতে দাঁত চেপে বলল
“এই আপনার সমস্যা কি? সবসময় আমার পেছনে লেগে থাকেন কেন? আপনার কি খেয়ে দেয়ে কাজ নেই?”
“সরি মেও মেও। আমি বুঝতে পারিনি তুমি চিতল মাছের মতো চিটপাটাং হয়ে পানিতে পড়ে যাবে।”
“খবরদার আমাকে মেও মেও বলবেন না।”
“তাহলে কি বলবো?”
প্রিয়া শক্ত কন্ঠে বলে “আমার নাম প্রিয়া।”
জিহাদ বাঁকা হেসে বলে “কিন্তু সূরার পুষির নাম তো আমি প্রিয়া রেখেছি। তোমাকে কিভাবে একটা বিড়াল ছানার নামে ডাকি বলো তো? যতোই হোক তোমার তো একটা প্রেস্টিজ আছে নাকি।”
প্রিয়া বিরক্ত হলো। পানিতে পড়েও শরীর রাগে ক্ষোভে দুঃখে জ্বলে উঠলো তার। বলল
“তোর প্রেস্টিজের গুষ্টি কিলাই সা**লা খচ্চর ব্যাটা। এই তোর মতলব কি রে? আমার পিছনে পড়ে আছিস কেন?”
জিহাদ অসহায় মুখ করে বলে “নাউজবিল্লাহ! এসব কেমন ভাষা মেও মেও। নাহ্ আমার ভবিষ্যৎ যে বউয়ের মুখ ঝামটা খেতে খেতে অন্ধকারে তলিয়ে যাবে ঢের বুঝেছি আমি।”
প্রিয়া কটমট করে তাকালো। জিহাদ মুখ টিপে হাসে। হাত বাড়িয়ে দেয় প্রিয়ার দিকে। প্রিয়া বাঁকা হেসে জিহাদের হাত তো ধরে কিন্তু কিছু বুঝে উঠার আগেই হাত ধরে টান মারে। জিহাদ পানিতে পড়ে যায়। প্রিয়া খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। জিহাদ ওই দিকে কাশছে। জিহাদ প্রিয়ার দিকে তেড়ে আসলে প্রিয়া উপরে উঠার চেষ্টা করে কিন্তু পারেনা। তার আগেই জিহাদ ধরে নিয়েছে প্রিয়াকে। নিজের সাথে মিশিয়ে শক্ত করে ধরে প্রিয়াকে। প্রিয়া এভাবে ধরায় লজ্জা পায়। কেউ দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হবে। জিহাদ ভ্রু নাচিয়ে বলে
“এবার কোথায় পালাবে মেয়ে। ভুলে যেও না যতোই গাইগুই করো না কেন তোমার শেষ ঠিকানা আমি।”
প্রিয়া তাকালো জিহাদের দিকে। এই লোকটা যে তাকে পছন্দ করে জানে সে। কিন্তু ভয় হয়। যদি সূরার মতো তাকেও কষ্ট পেতে হয়। প্রিয়া ক্ষীন স্বরে বলল
“কি করছেন কি? ছাড়ুন প্লীজ। কেউ দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হবে।”
“জমিদার বাড়ির পুকুরে গ্ৰামের কেউ দেখবে বলছো? চিন্তা নেই মেয়ে তুমি আর আমি ছাড়া কেউ নেই এখানে।”
“তাই বলে কি আপনি এভাবে জড়িয়ে ধরে থাকবেন আমাকে। আমি কিন্তু মেনে নিবো না এই ধরনের অসভ্যতামো।”
“কই সরিয়েও তো দিচ্ছো না।”
“সরিয়ে দিবো বলছেন। খুশি হবেন তাহলে?”
“উঁহু! আপন করে নিলে খুশি হবো।”
প্রিয়া কিছু বলে না। মুচকি হেসে জিহাদের বুকে আলতো করে ধাক্কা দেয়। জিহাদ ছেড়ে দিলে উঠে যায় সে। জিহাদ মুচকি হাসে। বরফ গললো বলে।
★★★★★★★
জমিদার বাড়ির রান্নাঘরে আজ বাড়ির নতুন বউ রান্না করছে। সকালে সবাই যখন রান্না ঘরে রান্না করছিল তখন সূরা এসে বলে সে রান্না করবে। মুনতাহা সিকদারের শত বারন করার পরেও জেদি একরোখা মেয়ে রান্নাঘর থেকে সবাইকে বের করে দিয়ে নিজে একাই রান্না করছে।ঘেমেনেয়ে একাকার অবস্থা। খাশির মাংস রান্না করতে ব্যস্ত রমনী। ছেলেরা গেছে এতিমখানায়। তাদের বিয়ে উপলক্ষে কিছু বাচ্চাকে এখানে নিয়ে এসে খাওয়ানো হবে। সারাদিন তারা জমিদার বাড়িতেই থাকবে। তাই এতো এতো রান্নার আয়োজন। সব রান্না অন্যরা করলেও খাশির মাংস রান্না সূরা করছে। মিসবাহর খুব পছন্দ খাশির মাংস। বাইরে কিছু নিয়ে হৈচৈ হচ্ছে। রান্না শেষ দেখে চুলা বন্ধ করে বসার ঘরের দিকে যায় সূরা। নিহারিকা সিকদারের একটা কথায় থেমে যায় তার পা। নিহারিকা সিকদার মীরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন
“সুখি হ মা। এতো বড়ো খুশির খবর। আমি বুঝতে পারছিনা তোকে কি বলে দোয়া করবো? আমি দাদি হবো।”
মুনতাহা সিকদার বলেন “আমিও তো দাদী হবো ছোট।”
“হ্যাঁ আপা। আমার ছেলেটা আবার সুখের মুখ দেখবে বলো। কম কষ্ট তো পেয়েছিল না সেই বার।”
সূরা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। মীরা সূরাকে দেখে হাসি মুখে এগিয়ে যায় সূরার কাছে। বলে
“সুরপাখি তোর কুচুপু আসছে। তুই খুশি হসনি?”
সূরার হঠাৎ কি হলো অস্ফুটস্বরে বলল “দূরে যাও।”
সূরা আর দাঁড়ালো না। চঞ্চল পায়ে ছুটে চলে যায় নিজের ঘরে। মীরা ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে। নিহারিকা সিকদার ফুঁপিয়ে উঠলো। মুনতাহা সিকদার সোফায় বসালেন তাকে। বাইরে গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে। ছেলেরা এতিমখানা থেকে চলে এসেছে ভেবেই মীরা দৌড়ে যায় সদর দরজার দিকে। ছোট ছোট বাচ্চা গুলোকে গাড়ি থেকে নামতে সাহায্য করছে রাফি, সিহাব আর জিহাদ। মিসবাহ আর নুহাশ সদর দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই মীরা ফুঁপিয়ে উঠলো। নুহাশ মীরার কাছে গিয়ে ব্যস্ত কন্ঠে বলে
“কি হয়েছে মীরাবতী? কাঁদছো কেন? কেউ কিছু বলেছে?”
মীরা জবাব দেয় না। মিসবাহর দিকে ছলছল চোখে তাকালো। মুনতাহা সিকদার একটু আগের কথা খুলে বললে মিসবাহ সিঁড়ি বেয়ে উপরে নিজের রুমের দিকে যায়। রুমের দরজার সামনে এসে মিসবাহর বুক ধক করে উঠল। ভেজানো দরজা দিয়ে ভেসে আসছে তার সুরজানের কান্না। মিসবাহ দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে। সূরা ছলছল চোখে তাকালো মিসবাহর দিকে। বিছানা ছেড়ে দৌড়ে এসে মিসবাহর গলা জড়িয়ে ধরে। শূন্যে তার পা। পুরো ভর মিসবাহর উপর দিয়ে মুখ গুজে দেয় মিসবাহর গলায়। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। মিসবাহ অপ্রস্তুত থাকায় দুই কদম পিছিয়ে যায়। মিসবাহ দুই হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার সুরজান কে। গুটিগুটি পায়ে সূরাকে নিয়ে বসে পড়ে বিছানায়। সূরা মিসবাহর কোলে বসে এখনো মুখ গুঁজে আছে মিসবাহর গলায়। অনেকক্ষণ কান্নার ফলে শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে তার। মিসবাহর আদুরে স্বরে বলে
“সুরজান! এই সোনা।”
সূরা কিছু বলেনা। একটু নড়েচড়ে আবার ওই ভাবেই লেপ্ট থাকে মিসবাহর সাথে। মিসবাহ মুচকি হাসে। তার আদুরে বিড়াল ছানা। আদুরে গলায় বলল
“আমার সুরজান এতো স্বার্থপর কিভাবে হলো? তার কুচুপু আসছে জেনেও ঘরে বসে দুঃখ বিলাস করছে? কুচুপু তো ভেবেছিল সে আসার খবরে তার ফুপি পুরো বাড়ি মাথায় তুলে নাচবে। আনন্দে কাঁদবে। সে তো ভাবেনি সে আসার খবরে তার ফুপি কষ্ট পাবে। তাহলে কি সে আসতো?”
সূরা গলা থেকে মুখ তুলে ছলছল চোখে তাকালো মিসবাহর দিকে। কান্নার ফলে ঠোঁট নাক লাল টুকটুকে হয়ে গেছে। এই মেয়ের এমন রুপ দেখে এখন যদি মিসবাহ কিছু করে ফেলে তখন তো এই মেয়ে অসভ্য উপাধি দিবে। মিসবাহর হয়েছে যতো জ্বালা। মিসবাহ গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সূরা নাক টেনে বলে
“আমি অনেক খুশি হয়েছি ডাক্তার। আমার কুচুপু আসছে কিন্তু আমার ভয় করছে ডাক্তার। আমার সান্নিধ্যে আবার যদি ও চলে যায়। যদি আবার ওর ক্ষতি হয়। তাহলে এবার আমি মরেই যাবো। এই কষ্ট সহ্য করার আগেই গলায় ফাঁস দিবো।”
“সূরা। আর একবার এমন কথা বললে চড়িয়ে গাল লাল করে দিবো মেয়ে। এই ওঠো। ওঠো বলছি। সাহস কি করো হলো আমার সামনে গলায় ফাঁস দেওয়ার কথা বলতে।”
সূরা মিসবাহর রাগে রক্তিম হওয়া মুখোস্রি দেখে শুকনো ঢক গিলে। ঠোঁট উল্টে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দেয়। মিসবাহ অসহায় চোখে তাকালো। তার হয়েছে যতো জ্বালা। এই মেয়ের উপরে রাগ করা মানে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারা। এই মেয়ে আপনজনদের সান্নিধ্যে আদুরে বিড়াল ছানা হয়ে যায়। আল্লাদ করলে তো কথায় নেই। মিসবাহ নিজেকেই শাসালো। আরও মাথায় তুলে আল্লাদ কর। পরক্ষনে বললো তার সুরজান কে সে আল্লাদ করবে না তো কে করবে। মিসবাহ ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে। সূরা এখনো ফুঁপিয়ে যাচ্ছে। আপাতত তার প্রধান কাজ কান্না করা। সূরা ফোঁপাতে ফোঁপাতে নাক টেনে আদুরে স্বরে বলে
“আপনি আমাকে সূরা বলে কেন ডাকলেন ডাক্তার? এই নামটা এতো জঘন্য শুনতে লাগলো কেন আজ? কই আগে তো এমন মনে হয়নি। সুরজান সম্বোধন এতো মধুর কেন ডাক্তার? আমি আর কখনো এমন কথা বলবো না তবুও আপনি সূরা বলে ডাকবেন না আমাকে।”
মিসবাহর অসহায় চোখে তাকালো। এই মেয়ে নাটকবাজ বটে। ঠিকই আল্লাদির ভোল ধরে তার রাগে পানি ঢেলে দিল। সূরা কাঁদছে কম নাক টানছে বেশি। সূরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মিসবাহ। বুকের ভেতর ঢুকিয়ে নিলে কি শান্তি পেত সে। হয়তো পেত। মিসবাহ কন্ঠে খাদ নামিয়ে বলে
“সুরজান! সোনা তুমি কি জানো তোমাকে হারানোর ভয়ে ভীত আমি? এই কঠিন মানবটারও তার সুরজানকে হারানোর ভয়ে বুক কেঁপে উঠে। জানলে কি সে একবারও গলায় ফাঁস দেওয়ার কথা বলতে পারতো? আমি কি ধরে নিব নিষ্ঠুর রমনীর বুক কাঁপে না আমাকে আঘাত করতে?”
সূরা শব্দ করে মিসবাহর বুকে চুমু খেল। বুকের বা পাশে পরপর কয়েকটা চুমু খেয়ে বলে
“যেখানে আমার বসবাস সেখানে কষ্ট দিই কিভাবে ডাক্তার? আমার ছোঁয়ায় এই বুকে প্রশান্তি দিতে চায় আমি।”
মিসবাহ আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। সূরার মনে হলো হাড়গোড় বুঝি আস্ত থাকবেনা আজ। তবুও শান্তিতে লেপ্টে থাকে অর্ধাঙ্গের বুকে। মিসবাহ শান্ত স্বরে বলে
“পৃথিবীটা সবার জন্য ফুলের বাগান না সুরজান। নিজের দুঃখ, নিজের কষ্ট আমাদেরকেই সহ্য করতে হবে। আবার আমাদেরকেই সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জীবনে চলার পথে হোঁচট খেতে হবেই। তাই বলে কি আমরা সামনে এগোবো না? থেমে যাবো মাঝ পথে? উঁহু! এটা বোকামি। সবার জীবনেই কোনো না কোনো কালো তিক্ততায় ভরা অতীত থাকেই। যাদের নেই তারা এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। আর যাদের জীবন কালো অতীতে ঘেরা তাঁদের উচিৎ সেখান থেকে বেরিয়ে আসা। আমরা পরিবারের সবাই হয়তো তোমাকে সহানুভূতি লেখাতে পারবো, তোমার কষ্টে ব্যথিত হতে পারবো কিন্তু সেখান থেকে তোমাকেই বেরিয়ে আসতে হবে। যে হাত আমি ধরেছি সেই হাত আলগা হতে দেওয়া কি ঠিক হবে? আমাদের সামনে সুন্দর ভবিষ্যৎ সুর। তুমি আমি আমাদের পরিবার। ভরা সংসার তোমার। তোমার কান্না মিশ্রিত ওই মুখোস্রী দেখলে আমার নিজেকে অসহায় লাগে। আমি আমার সেই সুরজান কে চাই যে আমাতে বিভোর থাকবে। কোনো কালো অতীত তার মনে দাগ কাটতে পারবেনা।”
সূরা মুগ্ধ চোখে দেখে তার শখের পুরুষকে। ঠিকই তো আর কতো দিন কালো ছায়া নিয়ে বাঁচবে সে। এখন তার একান্ত ব্যক্তিগত পুরুষ আছে তার পাশে। শক্ত করে ধরে রেখেছে তার হাত। আর কি চাই তার? সূরা মিসবাহর গলায় মুখ গুজে আল্লাদি সুরে বলল
“ও ডাক্তার! আমার একটা ছোট ডাক্তার চাই।”
সূরার কথায় মিসবাহ শুকনো কেশে উঠলো। সূরা মিসবাহর দিকে তাকিয়ে আছে। মিসবাহর কাশি থামার নাম গন্ধ নেই দেখে সূরা মিসবাহর কোল থেকে নেমে গ্লাসে পানি ঢেলে মিসবাহকে দেয়। মিসবাহ সূরার হাত থেকে পানির গ্লাস নিয়ে এক নিঃশ্বাসে পুরোটা শেষ করে। জোরে তপ্ত শ্বাস ফেলে সূরার দিকে তাকায়। সূরা তার দিকেই বোকা বোকা চাহনি তে তাকিয়ে আছে। মিসবাহ ভ্রু কুঁচকে বলে
“কি বললে?”
সূরা কন্ঠে বিরক্তি নিয়ে বলল “ছোট ডাক্তার চাইলাম অথচ শুনতে পাননি আপনি? এই শোনেন আপনার কিন্তু বয়স হচ্ছে। কাল হসপিটালে নিয়ে যাবো আপনাকে।”
“এই মেয়ে বিয়ের দুইদিনও হয়নি অথচ বাচ্চা চাইছো তুমি? লজ্জা শরম কি কাল রাতেই চলে গেছে?”
সূরা মিসবাহর সামনে দাঁড়িয়ে মিসবাহর চুলে হাত বুলিয়ে বলে “বিয়ের দুইদিন হয়নি তো কি হয়েছে? চাইলে এখনি বাচ্চা নেওয়া যায়। আর আপনি জানেন না সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। আপনার মতো নির্লজ্জের সংস্পর্শে থাকলে যে কেউ নির্লজ্জ হতে বাধ্য। আমি তো সামান্য রমনী মাত্র।”
মিসবাহ চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। বলে না সব দোষ নন্দ ঘোষ তার হয়েছে এই অবস্থা। সব দোষ মাকহুল ঘোষ। মিসবাহ মুখ কুঁচকায়। না ঘোষ টা মানাচ্ছে না। পরক্ষনে কি ভেবে মিসবাহ বাঁকা হেসে সূরার কোমড় জড়িয়ে ধরে। পেটে মুখ গুজে বলে
“এই ছোট পেটে এখনো বাচ্চা আসতে অনেক দেরি। অপেক্ষা করো মেয়ে।”
মিসবাহ আরো গভীর হয়। মিসবাহর ফন্দি বুঝতে পেরে সূরা একটু দূরে সরে দাঁড়ালো। মিসবাহ বিরক্ত হয় বটে। ভ্রু কুঁচকে বলে
“কি সমস্যা?”
সূরা চোখ ছোট ছোট করে বলে “মতলব কি ডাক্তার? কি চাই?”
মিসবাহ বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে সূরার দিকে এক হাত বাড়িয়ে দেয়। মিসবাহর সরল স্বীকারোক্তি “বউজান কে চাই।”
সূরা মুচকি হেসে বলল “কাজ আছে আমার। বাড়িতে ছোট বাচ্চারা আছে সে খেয়াল কি আছে?”
“আমি কি বাচ্চাদের সামনে বউকে আদর করবো নাকি। আমি তো দরজা বন্ধ করে বউকে আদর করবো।”
সূরা কিছু বলবে তার আগেই মিসবাহ সূরার হাত ধরে হেঁচকা টানে নিজের বুকের উপর ফেলে তাকে। সূরার কোমড় জড়িয়ে ধরে বলল
“ছোট ডাক্তার চাচ্ছো মেয়ে অথচ স্বামীকে অনাহারে রাখছো। স্বামী অভুক্ত থাকলে ছোট ডাক্তার কোথায় পাবে। তাই নিয়ম করে তিন বেলা স্বামীকে চুমু খাবে।”
“আপনি কি ভালো হবেন না ডাক্তার।আপনি জানেন আপনি একটা নির্লজ্জ বেহায়া অসভ্য পুরুষ।”
মিসবাহ শব্দ করে হাসে। বাঁকা হেসে বলে “অসভ্য উপাধি পাওয়া নির্লজ্জ পুরুষ একটু অসভ্যতামি করুক। কি বলো সুরজান।”
সূরা কথার মর্মার্থ বুঝতে পেরে লজ্জা পায়। রক্তিম হয়ে উঠলো কপোলদ্বয়। মিসবাহ সূরাকে লজ্জা পেতে দেখে মিটিমিটি হাসে। সূরা মুখ লুকায় স্বামীর বুকে। নিরব থেকে সম্মতি জানালো কি? মিসবাহ শক্ত করে বুকে জড়িয়ে রাখে তার সুরজান কে। কিছু মধুর স্মৃতি মনের মধ্যে ফ্রেম বন্দি করে রাখে দুই কপোত কপোতী।
★★★★★★
নুহাশের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সূরা আর মিসবাহ্। ভেতর থেকে মীরার কান্নার আওয়াজ আসছে। বাইরে দাঁড়িয়েই সূরা মীরার কান্নার আওয়াজে ঠোঁট উল্টিয়ে কান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মিসবাহ তাকালো সূরার দিকে। এই মেয়ে কান্নার আগে বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টাবেই। মিসবাহ সূরার থেকে চোখ সরিয়ে দরজা নক করে। কয়েক সেকেন্ড পরে নুহাশ দরজা খুলে দেয়। সূরা আর মিসবাহ্ কে একসাথে এখানে দেখে বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মিসবাহ বিরক্ত হলো নুহাশের বোকা বোকা চাহনি দেখে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে
“খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে ঢুকতে দিবি নাকি চলে যেতে বলছিস।”
নুহাশ অপ্রস্তুত হয়ে কাচুমাচু করে বলে “নাহ্! না ভাইয়া। এসো না ভেতরে।”
সূরা আর মিসবাহ্ ঘরের ভেতরে ঢুকে। নুহাশ একপাশে দাঁড়ায়। মীরা মাথা নিচু করে বিছানায় বসে আছে। সূরা মীরার কাছে গিয়ে পাশে বসে। এক কানের লতি আলতো করে ধরে অপরাধীর সুরে বলে
“সরি ভাবিজান। এবারের মতো মাফ করে দাও। আমি তখন ভয় পেয়ে গেছিলাম। ওর নিষ্পাপ মুখটা মনে পড়ছিল তাই আমি,,,
আর বলতে পারেনা সূরা। মীরা জড়িয়ে ধরে মেয়েটাকে। এই মেয়েটা সত্যিই নিষ্ঠুর। নিষ্ঠুর রমনী একবারও ভাবেনা পরিবারের সবাই তাকে কতোটা ভালোবাসে। সূরা ফুঁপিয়ে উঠে। নুহাশ আর মিসবাহ বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। দুই বোনকে একটু আলাদা ছেড়ে দেওয়ায় ভালো। মীরা বলে
“আমি কিছু মনে করিনি সোনা। তোকে যে আমরা সবাই খুব ভালোবাসি। সব ভুলে যা। ভাইয়াকে নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু কর। তুই শুধু আবার আগের মতো হয়ে যা সুরপাখি।”
“আমি সব ভুলে যাবো ভাবিজান। আমি আমার ডাক্তার কে নিয়ে সুখে থাকবো দেখো।”
“থাকবি তো সোনা। খুব সুখে থাকবি তুই। তুই খুশি তো তোর কুচুপু আসার খবরে?”
সূরা মীরাকে ছেড়ে তাকালো মীরার দিকে। চোখে হাসে সূরা। মীরার পেটে কান পেতে বলে
“কুচুপু সোনা। ফুপির কথা শুনতে পাচ্ছিস? আমি খুব খুশি সোনা। তুই একবার ফুপির কাছে চলে আয় দেখবি ফুপি তোকে অনেক আদর দিবে সোনা। আর হারিয়ে যেতে দিবে না তোকে।”
মীরা ছলছল চোখে হাসলো। সূরা বকবক করছে তার কুচুপুর সাথে। মীরার একটাই চাওয়া প্রানোচ্ছ্বল হাস্যোজ্জ্বল সূরা আবার ফিরে আসুক।
★★★★★★
সিকদার বাড়ীর প্রত্যেকের আজ খুশির অন্ত নেই। সবচেয়ে বেশি খুশি মোজাম্মেল সিকদার। নাতির ঘরে নতুন অতিথি আসার খবরে তিনি ভুলেই গেছেন তার বয়স হয়েছে। এতিমখানার বাচ্চাগুলোর সাথে বাইরে হৈ হুল্লোড় করছে পঞ্চপাণ্ডব আর প্রিয়া আর মেহের। বাইরে বাচ্চাদের হাসির শব্দে মুখোরিত জমিদার বাড়ির চারপাশ। বাচ্চাদের সাথে দৌড়াদৌড়ি করে হাঁপিয়ে গেছে জিহাদ। সবাইকে খাওয়ার জন্য ডাকতে এসেছিল সে। কিন্তু এসে যে বিপদে পড়বে সে কি জানতো? যখন এসে খেতে যাওয়ার কথা বললো তখনি শুরু হয়েছে তাদের দৌড়াদৌড়ি। তাদের একটাই কথা তারা খাবেনা। জিহাদ ধরতে গেলে উল্টো জিহাদকে নাকানিচোবানি খাওয়ায় তারা। বিচ্ছু গুলো তার হাতের নাগালে আসছে না। জিহাদ হাঁটুতে হাত দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো
“বিচ্ছু সবগুলা। এই তোদের বেতনভুক্ত ভৃত্য পেয়েছিস আমাকে। সা*লা খেলে খা নয়লে না খা। আমার কি বা***।”
প্রিয়া মুখ কুঁচকে বলে “এই লোক মুখের ভাষা ঠিক করেন। বাচ্চাদের সাথে কি ভাষায় কথা বলছেন আপনি? ছিঃ ভাষার কি ছিরি।”
জিহাদ প্রিয়ার কথা সম্পূর্ণ অগ্ৰাহ্য করে বলে “দেখো মেও মেও তোমাকে আগে থেকেই বলে রাখছি এই রকম বিচ্ছু পোলাপান ডাউনলোড দিবা না। ভবিষ্যত কিন্তু অন্ধকার হয়ে যাবে বলে রাখলাম। আমার কিন্তু আমার মতোই শান্ত বাচ্চা চাই।”
প্রিয়া অতি শোকে পাথর হয়ে গেছে। মুখে কোনো কথা নেই। এই কথার প্রেক্ষিতে কেমন রিয়েকশন দেওয়া উচিৎ ভেবে পাচ্ছে না সে। সবাই শব্দ করে হাসে। রাফি বলে
“তুই শান্ত? কস কি মামা। তুই শান্ত হলে আমরা সবাই এলিয়েন।”
আবার হেসে উঠলো সবাই। জিহাদ রাফির দিকে কটমট করে তাকালো। প্রিয়া জিহাদের দিকে তাকিয়ে মুখ কুঁচকে বলে
“বজ্জাত লোক। এই তোর বাচ্চা লাগবে তুই ডাউনলোড দে। আমাকে বলিস কেন?”
“আহা মেও মেও রেগে যেওনা। আমার মধ্যে ডাউনলোড দেওয়ার ফাংশন থাকলে কি আর আমি তোমাকে বলতাম?”
সূরা, মেহের আর দিয়ার হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা। বাচ্চা গুলোও মুখে দুই হাত চেপে ফিক ফিক করে হাসছে। তারা কি আদৌ বুঝেছে বড়দের হাসির কারণ? দেখে তো মনে হয়না। প্রিয়া আর কিছু বলে না। হনহনিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে জিহাদ এবার শব্দ করে হেসে উঠে। প্রিয়া জিহাদের হাসির শব্দ শুনে বিরবিরালো
“বজ্জাত লোক। তোর ফাংশনের গুষ্টি কিলাই।”
#চলবে…….