শিশির_ভেজা_শিউলি #অন্তিম_পর্ব #ইবনাত_ইমরোজ_নোহা

0
887

#শিশির_ভেজা_শিউলি
#অন্তিম_পর্ব
#ইবনাত_ইমরোজ_নোহা

(🚫দয়া করে কেউ কপি করবেন না।কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫)

দেখতে দেখতে চোখের পলকে দিন যায়, মাস যায়, বছরও পেরিয়ে যায়। জীবন নামক সংগ্ৰামে প্রতিনিয়ত সংগ্ৰাম করতে হয়। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে কেউ হেরে যায় তো কেউ টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে। জীবন সুন্দর যদি আমরা তাকে সহজভাবে উপভোগ করার চেষ্টা করি। আমরা যতো জটিল করবো জীবন ততো জটিল হবে। আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ধৈর্য্য কে ধরা উচিৎ। উচিৎ নয় কি? ধৈর্য্য ধারণ করে সামনে এগিয়ে গেলেই আমরা পাবো সফলতা। যা কষ্ট, অপেক্ষা না করেই সহজেই পাওয়া যায় তার কি আমরা মূল্য দিই? দিই না। শত অপেক্ষা, কষ্টের পরে যা নিজের করে পাওয়া যায় তাই তো মূল্যবান সম্পদ। সফলতাও ঠিক তেমন। শত অপেক্ষা করে সে বিজয়ী বেশে আমাদের জীবনে আসবেই। তাই কখনো নিরাশ হওয়া যাবেনা। হতাশাগ্রস্ত হওয়া যাবেনা। কখনো যদি মনে হয় আমি একা, এই পৃথিবী আমার জন্য না, আমি ব্যর্থ তাহলে বলবো আমরা ভুল। এই পৃথিবী কারো জন্যেই ফুলশয্যা না। লড়াই করতে হবে। নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই। বেরিয়ে আসতে হবে ডিপ্রেশন থেকে। মনে রাখতে হবে আমার আমি ছাড়া যেমন কেউ নেই তেমনি আমাকেই এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে মুক্তির পথ খুঁজে নিতে হবে। নিজের জন্য না হলেও পরিবারের জন্য পারতে হবে। তাহলে আর কোনো মায়ের বুক খালি হবেনা। আর কোনো বাবার কাঁধে তার সন্তানের লাশ উঠবেনা। বাঁচতে হবে। একটা মাত্র জীবন নিজের মতো করে সৎপথে উপভোগ করতে হবে। কলঙ্ক, কটুক্তি, সমালোচনা আসবেই তাই বলে পিছিয়ে গেলে হবেনা। সামনে এগিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে আমিও পারি। ভালোবাসা! সুন্দর একটা শব্দ। কিন্তু মনে রাখতে হবে ভালোবাসা তখনই সুন্দর যখন অপর পাশের ব্যক্তির মন সুন্দর হয়। আর সেই ভালোবাসায় বিষাক্ত যখন অপর পাশের ব্যক্তিটির মন বিষাক্ত হয়। সূরা কাছে ভালোবাসা সুন্দর। এখন আর বিষাক্ত না। তার যে ডাক্তার আছে। এখন সূরার নয় মাস চলছে। মেয়েটা আগের চেয়ে অনেক গুলুমলু হয়েছে। হাঁটাচলা করতে অসুবিধা হয় বৈকি। সবকিছুতে বন্ধু, পরিবারের সবার সাপোর্টে সূরার নিজেকে এখন ভাগ্যবতী মনে হয়। কাল মোজাম্মেল সিকদার হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় মাহমুদ সিকদার-মুনতাহা সিকদার-দিয়া আর মেহের গ্ৰামে গেছে তার কাছে। মুনতাহা সিকদার সূরার কাছে থাকতে চাইলেও চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন দেখে সূরা তাকে জোর করে যেতে বলে। মিসবাহ সূরাকে একা রেখে যেতে পারেনি প্রিয় দাদুর কাছে। প্রেগনেন্সির এই মুহুর্তে মিসবাহ যেনো আরো চোখে হারায় তার সুরজান কে। ডেলিভারির ডেট যতো এগিয়ে আসে ততো তার উৎকণ্ঠা বাড়ে। রাত জেগে সেবা করে। কখনো কোমরে তেল মালিশ করে দেয় তো কখনো হাত ধরে হাঁটাহাঁটি করায়। সূরার ডেলিভারির এখনো দুই সপ্তাহ বাকি আছে। এই সময়টা হয়তো মেয়েরা মনে মনে জীবনের আশঙ্কায় ভীত থাকে। সূরাও এর ব্যতিক্রম না। আজ সকাল থেকে সূরার তলপেটে ব্যথা অনুভব হচ্ছে। ডেট এখনো দেরিতে থাকায় ফলস পেইন ভেবে ব্যথা অগ্ৰাহ্য করে সে। কিন্তু এখন যতো সময় যাচ্ছে ব্যথা যেনো বাড়ছে। সূরা পেটে হাত রাখে। চিনচিনে অসহনীয় ব্যথায় বিষিয়ে উঠছে শরীর। মিসবাহর ইম্পরটেন্ট সার্জারি থাকায় প্রায় ঘন্টা খানেক আগে গেছে হসপিটালে। বাড়িতে এখন সিহাব ছাড়া কেউ নেই। সে হসপিটালের কাজের জন্য যেতে পারেনি গ্ৰামে। পঞ্চপান্ডবের সকলে মাহমুদ সিকদারের হসপিটাল জয়েন করেছে। অবশ্য নিজের যোগ্যতায়। সূরা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। পা টনটন করছে তার। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায় সিহাবের রুমের দিকে। দরজা ভেজানো দেখে বাইরে থেকে ক্ষীন স্বরে সুধায়

“সিহাব?”

সিহাব দিয়ার সাথে ফোনে কথা বলছিল। সূরার কন্ঠ শুনে দরজা খুলে সূরাকে এই অবস্থায় দেখে আঁতকে উঠে। সূরার মুখে অসহনীয় যন্ত্রনার ছাপ স্পষ্ট। ব্যস্ত কন্ঠে বলে

“কি হয়েছে? কষ্ট হচ্ছে তোর? ভাই কই?”

সূরা সিহাবের হাত শক্ত করে ধরে। বলে “আমার কষ্ট হচ্ছে সিহাব। তোর ভাইকে ফোন দে।”

সিহাব সূরাকে ধরে নিজের রুমে বিছানায় শুয়ে দেয়। দিয়া ফোনের ওইপাশ থেকে উত্তেজিত কন্ঠে জানতে চাইছে কি হয়েছে। সিহাব ছোট করে দিয়াকে জানায় সূরার পেইন হচ্ছে। দিয়ার ফোন কেটে মিসবাহকে ফোন দিতে যাবে তখনই সিঁড়ি বেয়ে ওপরে মিসবাহকে উঠতে দেখে সিহাব। ছুটে যায় মিসবাহর কাছে। অনবরত ঘামছে সে। প্রিয় বান্ধবীর ব্যথাতুর মুখোস্রি কষ্ট দিচ্ছে তাকে। সিহাব মিসবাহর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ব্যস্ত কন্ঠে বলে

“ভাই তুই এসেছিস?”

“কেন না আসার কথা ছিল নাকি? আর এমন করছিস কেন?”

“ভাই সূরা। আমার রুমে চল প্লীজ।”

মিসবাহ বুক ধক করে উঠলো। ব্যস্ত পায়ে ছুটে যায় সিহাবের রুমে। রুমে ঢুকতেই থমকে যায় পা জোড়া। সূরা বিছানায় কাতরাচ্ছে। একটু আগেই তো ভালো দেখে গিয়েছিল মেয়েটাকে। মিসবাহ আর সিহাব ছুটে যায় সূরার কাছে। মিসবাহ সূরার মাথা কোলে তুলে নিয়ে বলে

“কষ্ট হচ্ছে সুরজান? কখন থেকে এমন হচ্ছে?”

সূরা ঠোঁট উল্টে কেঁদে দেয়। এতোক্ষণ হয়তো এই মানুষটাকেই খুঁজছিল সে। উঠে বসতে চাইলে মিসবাহ বসিয়ে দিল তাকে। বুকে আগলে নিয়ে বলে

“আমরা এখনই হসপিটাল যাবো তো সোনা। কাঁদছো কেন?”

“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ডাক্তার। আমি কি মরে যাবো? যদি মরে যায় তবুও আপনি কখনো বিয়ে করবেন না। আপনার পাশে আমি কিন্তু কাউকে সহ্য করবোনা। দরকার হলে দেবদাস হয়ে ঘুরে বেড়াবেন। হ্যাঁ! তাই বলে কিন্তু চন্দ্রমুখীর পাল্লায় পড়বেন না যেন।”

সূরার কথা শুনে মিসবাহ অসহায় চোখে তাকালো সূরার দিকে। সিহাব ফিক করে হেসে দেয়। এমন সিরিয়াস মুহূর্তেও এমন কথা এই মেয়েই বলতে পারে। মিসবাহ কটমট করে তাকালো সিহাবের দিকে। সিহাব আমতা আমতা করে বলল

“আমি বরং গাড়ি বের করি । তুই ওকে নিয়ে আয় ভাই।”

সিহাব দ্রুত গতিতে রুম ত্যাগ করে। মিসবাহ শান্ত চোখে তাকালো সূরার দিকে। অনর্গল চোখ দিয়ে পানি পড়ছে তার। মায়া হলো মিসবাহর। বুকে চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। অজানা ভয়ে বুক কেঁপে উঠলো। বললো

“কিছু হবেনা সোনা। তুমি না নিজে একজন মেডিকেল পার্সোন। আমরা এখনই হসপিটাল যাবো। আমাদের রাজকন্যা আসবে তো। আমার সুরজানের কোল আলো করে আমাদের রাজকন্যা আসবে।”

“আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি ডাক্তার।”

মিসবাহর বুকে যেনো হাতুড়ি পেটা হচ্ছে। সূরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল “আমিও তো ভালোবাসি সোনা। আমার সুরজান কে আমি খুব ভালোবাসি।”

মিসবাহ কোলে তুলে নিল সূরাকে। মেয়েটা ব্যথায় ককিয়ে উঠছে। এই প্রথম মিসবাহর নিজেকে অসহায় লাগছে। বাবা নামক ব্যক্তিকে মিস করছে। একটা শক্ত হাত প্রয়োজন তার‌। যে তাকে ভরসা জোগাবে।

★★★★★★★

হসপিটালে লেবার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মিসবাহ। ভেতর থেকে সূরার আর্তনাদে কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে যেন। বুকে অনবরত হাতুড়ি পেটা হচ্ছে। পঞ্চপাণ্ডবের তিনজন চেয়ারে মাথা নিচু করে বসে আছে। বান্ধবীর চিৎকারে তাদেরও যে কষ্ট হচ্ছে। ক্ষমতা থাকলে হয়তো বন্ধুর এই অসহনীয় যন্ত্রণা কমিয়ে দিতো তারা। কিন্তু এই কষ্ট কমানোর ক্ষমতা তো একমাত্র আল্লাহ তায়ালার কাছে। এখন দোয়া ছাড়া আর কোনো উপায় আছে কি? প্রিয়া লেবার রুমের ভেতরে আছে সূরার কাছে। গ্ৰামের সকলকে সূরার কথা জানানো হলে তারা তৎক্ষণাৎ রওনা দেয়। অজানা ভয়ে এইপ্রথম চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে মিসবাহর। কিন্তু বরাবরের মতো সে এবারেও ব্যর্থ। ভেতরের উচাটন মন বাইরে প্রকাশ করতে অক্ষম সে। মিসবাহর মনে হচ্ছে সে ভেতরে গিয়ে আগলে নিক তার সুরজানকে। তার সুরজানের কষ্ট মিশ্রিত আর্তনাদ তাকে মৃত্যু সমতুল্য যন্ত্রনা দিচ্ছে। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে লেবার রুমের দিকে। ভেতরে যেতেই পারে কিন্তু ভেতরে গিয়ে কি ঠিক থাকতে পারবে সে? অনবরত শুকনো ঢক গিলে মিসবাহ। মরুভূমির মতো খাঁ খাঁ করছে বুক। একপলসা বৃষ্টি দরকার। সুরজান নামক বৃষ্টি। পিয়াস তাকিয়ে আছে মিসবাহর দিকে। কতো শান্ত এই পুরুষ। অথচ তার ভেতরের উচাটন মন বুঝতে সক্ষম পিয়াস। পিয়াস কে মিসবাহ জানায় সূরার কথা। এতো কিছুর মধ্যেও পিয়াসের কথা ভুলেনি সে। অপ্রাপ্তির খাতা পূর্ণ করতেই হয়তো পিয়াসকে আসতে বলে। পিয়াস কৃতজ্ঞ এই মানবের প্রতি। কি অসাধারণ, অমায়িক ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই সুদর্শন পুরুষ। পিয়াস এগিয়ে গেল মিসবাহর কাছে। মিসবাহর কাঁধে হাত রাখতেই মিসবাহ শান্ত চোখে ঘুরে তাকালো পিয়াসের দিকে। আঁতকে উঠে পিয়াস। শান্ত চোখজোড়া আজ রক্তিম। মিসবাহ জড়িয়ে ধরে পিয়াসকে। নিজের ভেতরের হাহাকার চাপা আর্তনাদ বোঝাতে আজও অক্ষম সে। নিষ্প্রভ কন্ঠে বলল

“আমি এই অসহনীয় যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না পিয়াস। আমার সুরজান এ কোন মরন যন্ত্রনায় ছটফট করছে? বাবা মা হতে এতো যন্ত্রনা পেরোতে হয় কেন? আমার ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে আমার সুরজানকে আগলে নিই।”

পিয়াসের চোখ ছলছল করে ওঠে। তারও তো কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এতো বেশি কি‌? জানা নেই পিয়াসের। কিন্তু পিয়াস সবসময় এটা বিশ্বাস করে তার সুরের জন্য এই অমায়িক ব্যক্তিত্বের অধিকারী পুরুষই উত্তম‌। সে হয়তো এই মানুষটার মতো করে কখনো ভালোবাসতে পারতো না। লেবার রুমের দরজা খুলার আওয়াজে মিসবাহ পিয়াস কে ছেড়ে এগিয়ে যায় সে দিকে। জিহাদ-রাফি-সিহাব উঠে আসে। পিয়াস এগিয়ে যায়। প্রিয়ার কোলে সাদা তোয়ালায় মুড়ানো এক জান্নাতের ফুল। মিসবাহ একবার বাচ্চার দিকে তাকিয়ে প্রিয়াকে বলে

“সুর কেমন আছে প্রিয়া?”

প্রিয়া মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো “সে ভালো আছে ভাইয়া। মেয়েকে দেখে কেঁদে দিয়েছিল। তাই ওকে বাইরে নিয়ে আসতে দেরি হলো। আপনার মেয়ে হয়েছে ভাইয়া। কোলে নিবেন না?”

মিসবাহ তাকালো মেয়ের দিকে। বুকে একরাশ প্রশান্তি অনুভব করলো। বাবা হওয়ার প্রশান্তিতে ভরে গেল মন। প্রিয়ার থেকে কাঁপা কাঁপা হাতে কোলে নিলো মেয়েকে। মেয়ের কপালে স্নেহের পরশ এঁকে দিল। বিরবিরালো

“আমার প্রনয়ের পূর্নতা আমার মেয়ে। আমার শত প্রহর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আমার পূর্নতা এসেছে। আমার আম্মা! আমার রাজকন্যা! আমার পূর্নতা মাকহুল!”

মেয়ের কানের কাছে মৃদু স্বরে আজান দিলো মিসবাহ। সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তোয়ালেই মুড়ানো থাকায় ভালোভাবে দেখতে পারছে না কেউ। জিহাদ গদগদ হয়ে বলে

“স্যার ওকে একটু আমাদেরও দেখতে দিন।”

মিসবাহ মুচকি হাসে। পিয়াস কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিসবাহ পিয়াসের দিকে তাকিয়ে মেয়েকে তার দিকে বাড়িয়ে দেয়। পিয়াস চকিতে তাকায় মিসবাহর দিকে। মিসবাহ চোখে হাসে‌। পিয়াস ছলছল চোখে হাসলো। কোলে তুলে নিল তার সুরের ছোট সুরকে। কি নিষ্পাপ মুখোস্রি! বড় বড় চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। পিয়াসের মনে হলো তার শূন্য জীবন পূর্নতা পেয়েছে। মনে মনে আওরালো “পূর্নতা”

★★★★★★★

হসপিটালের শুভ্র বিছানায় শুয়ে আছে মিসবাহর প্রানভোমরা। এতোক্ষণে হয়তো ঠিকঠাক ভাবে নিঃশ্বাস নিচ্ছে মিসবাহ। এই মেয়ের সামান্য থেকে সামান্য কষ্টও যে তার বুকে চিনচিনে ব্যথার উৎপত্তি ঘটায়। বাবা ভাইয়ের রাজকন্যা একটু বেশিই নরম। সকলের চোখের মনি সূরা। সূরাকে কেবিনে দিতেই মেয়েকে পরিবারের কাছে রেখে মিসবাহ ছুটে এসেছে কেবিনে। পিয়াস হসপিটাল থেকে বাইরে চলে গেছে মিজানুর সিকদাররা আসার আগেই। হসপিটালে ঝামেলা না বাড়ানোই ভালো। সে তো পেয়ে গেছে বেঁচে থাকার সম্বল। মিসবাহ বলে দিয়েছে যখন ইচ্ছা সে মেয়েকে দেখতে পারবে। কেউ বাঁধা দিবেনা তাকে। শূন্য বুকটা ওই একটুখানি জান্নাতের ফুল সুবাস ছড়িয়েছে। মিসবাহ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে। সূরার বেড সাইড টুলে বসে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সূরার দিকে। তৃষ্ণার্ত চোখজোড়া এতোক্ষণ কাতর ছিল এই মুখোস্রি দেখার জন্য। সূরার চোখ বন্ধ। মিসবাহ সূরার ললাটে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল। নাহ্ মন ভরলো না তার। সূরার সারা মুখে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল মিসবাহ। ললাটে ললাট ঠেকিয়ে কম্পমান স্বরে সুধালো

“আমার সুরজান! আমার সোনা কেমন আছে? ঘুমের ভান করে কি আমার আদর নিচ্ছিল সে?”

সূরা চোখ বন্ধ করেই ঠোঁট উল্টালো। এই লোকের কাছে কখনো সে অভিনয় করে পারেনি। ধূর্ত মানবের চোখ ফাঁকি দেওয়া সম্ভব না। সূরা চোখ পিটপিট করে তাকালো। মিসবাহ অতি নিকটে। মিসবাহ সূরার ললাটে ঠোঁট ছুঁয়ে সরে আসতে চাইলে সূরা দুই হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে তার। বলে

“আমি মোটেও ঘুমের ভান করে ছিলাম না। আপনি আমার ঘুম ভেঙে দিয়েছেন।”

“ও আচ্ছা! আমিই তাহলে ভুল ভাবলাম।”

“আলবাত ভুল। ভুল ত্রুটি মানুষ মাত্রই হয় তাই ক্ষমা করে দিলাম।”

মিসবাহর শব্দ করে হেসে উঠে। সূরাও হাসে। মিসবাহ সূরার হাত ছাড়িয়ে বেডে বসে। স্বযত্নে সূরাকে বসিয়ে বুকে আগলে নিল। এখন হয়তো শান্তি লাগছে তার। মিসবাহ কন্ঠে খাদ নামিয়ে বলে

“আমার সুরজান! আমার সোনা এখন কেমন আছে?”

“ভালো আছি আমি‌। আমাদের মেয়ে কোথায়?”

“বাইরে। সবার কাছে।”

“সবাই এসেছে?”

“আসবেনা বলছো?”

“তখন না মনে হচ্ছিল আর কাউকে দেখ,,,

মিসবাহ ভরাট কন্ঠে বলে উঠলো “খবরদার মেয়ে এর আগেও এমন কথা বলেছো। তখন কিছু বলিনি বলে ভেবোনা এখনো কিছু বলবো না।”

সূরা কাচুমাচু করে। আমতা আমতা করে কিছু বলতে চাইলে মিসবাহ শান্ত স্বরে বলে “পিয়াস এসেছিল। আমাদের মেয়েকে আমার পরে তার কোলেই দিয়েছি আমি।”

সূরা মাথা তুলে তাকালো মিসবাহর দিকে। মিসবাহ তার দিকেই তাকিয়ে আছে হাস্যোজ্জ্বল মুখে। তার না বলা প্রত্যেকটা কথা এই মানুষটা অতি সহজেই বুঝে যায়। সূরা আবার মাথা রাখে মিসবাহর বুকে। বলে

“আপনার খারাপ লাগেনা ডাক্তার?”

মিসবাহ ভ্রু কুঁচকে বলে “খারাপ লাগবে কেন?”

“এই যে পিয়াস ভাই এখনো আমাকে ভালোবাসে। আমি তো আপনার নাম পর্যন্ত অন্য কোনো রমনীর মুখে শুনতেও নারাজ।”

মিসবাহ ওষ্ঠধর ফাক করে তপ্ত শ্বাস ফেলে। বলে “খারাপ লাগতো যদি সে আমার বউজানের আশেপাশে আসার চেষ্টা করতো। অতৃপ্ত সে। একটু খানি প্রাপ্তি তার নামে তোলা থাক। একসময় যে যন্ত্রনায় আমি ছটফট করেছি এখন পিয়াস করে। হয়তো তার চেয়েও বেশি যন্ত্রনায় ছটফট করে সে।”

সূরা ভেজা কন্ঠে বলে “সব দোষ কি আমার ডাক্তার? কিন্তু আমি যে আপনাকে ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারিনা। নিয়তি কি কেড়ে নিবে আপনাকে আমার থেকে?”

“ভুল বললে মেয়ে। তোমার দোষ থাকলেও তুমি আমার ভাগ্য। যা আমার তা আমারই। কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।”

সূরা আর কিছু বলেনা। থাক না কিছু তার মাকাল ফলের নামে। তবুও সে ভালো থাক। সূরা মিসবাহর থেকে সরে এসে বসে। ভালো‌ লাগছে না তার। কষ্ট হচ্ছে। কিছু নাম না জানা কষ্ট। মিসবাহ সূরার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো

“অসহনীয় বিষ ব্যথায় নীল হয়ে ওঠে আমার শরীরের শিরা উপশিরা। অসহনীয় যন্ত্রনায় ছটফট করি আমি। চক্ষুশীতল কারিনী মায়া করো একটু। তোমার উষ্ণতায় বুকটা শীতল করো আমার। মরুভূমির বুকে এক পলশা বৃষ্টি হয়ে আছড়ে পড়ো। সিক্ত করো আমার হৃদয়।”

সূরা সময়ব্যয় না করেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরল মিসবাহকে। শান্তি লাগছে। মিসবাহর মনে হলো সময় থমকে যাক। তার সুরজান তার বুকে থাক। দরজা ঠেলে ভেতরে আসে পরিবারের সকলে। সূরা তাদের দেখে নড়েচড়ে উঠে বসলো। মিসবাহ বসে আছে সূরার পাশে। মিজানুর সিকদার মেয়ের কোলে নাতনি কে দিয়ে বলেন

“একদম আমার আম্মাজানের মতো হয়েছে! দেখেন আম্মাজান।”

মিসবাহ ভ্রু কুঁচকে বলে “ভুল বললে চাচ্চু। আমার মেয়ে কিন্তু আমার মতোই হয়েছে। গায়ের রং টাও পুরো আমার মতো।”

সূরা মেয়েকে কোলে নিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলল “অসভ্য লোক এখন গায়ের রং নিয়ে খোটা দিবেন আমায়?”

“আরে আমি কখন তোমায় খোটা দিলাম। আমি তো বললাম আমার মেয়ে আমার মতো হয়েছে। তুমি চেতে যাচ্ছো কেন? দিন দিন তোমার বদঅভ্যাস হচ্ছে অকারনেই চেতে যাওয়া।”

ছোটরা শব্দ করে হেসে উঠে। বড়রা মুখ টিপে হাসছে। সূরা কটমট করে তাকালো মিসবাহর দিকে। সে আপাতত মেয়ের আঙ্গুল নিয়ে খেলছে। সূরা ঠোঁট উল্টে মিজানুর সিকদারের উদ্দেশ্যে বলল

“আব্বাজান!”

মিজানুর সিকদার এবার শব্দ করে হেসে উঠলো। সূরা বলে “আপনিও হাসছেন? এর সাথে থাকবো না আমি। অসভ্য লোক একটা।”

মিসবাহ কন্ঠে খাদ নামিয়ে বলে “তুমি চাও বা না চাও আমৃত্যু আমার সাথেই থাকা লাগবে তোমাকে। এমনকি জান্নাতেও।”

সূরা চোখে হাসে। মেয়ের কপালে স্নেহের পরশ এঁকে দেয়। মিসবাহ আর সূরা মেয়েকে নিয়ে আল্লাদ করছে। সকলের চোখে মুখে মুগ্ধতা। একরাশ প্রশান্তি। এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কি হতে পারে! সদ্য জন্ম নেওয়া জান্নাতের ফুল সুবাস ছড়াচ্ছে যেনো। দূরে দাঁড়িয়ে জানালা গলিয়ে একজোড়া কাতর চোখ চেয়ে আছে সদ্য বাবা মা হওয়া এক প্রেমিকযুগলের পানে। এই সুন্দর মনোমুগ্ধকর সময়টা তো তারও হতে পারতো। নাহ্! তার হলে হয়তো এতো সুন্দর হতোনা। প্রেয়সীর মুখে এতো নুর থাকতো না। এই দৃশ্যে তার চোখ জ্বালা করছেনা। বুকে প্রশান্তি অনুভব হচ্ছে। আর কি চাই তার? শখের নারী ভালো থাকুক। আজ কতো বছর পরে প্রেয়সীর ওই স্নিগ্ধ মুখোস্রি দেখছে সে। তৃষ্ণার্ত কাতর চোখজোড়ার একটুখানি তৃষ্ণা তো মিটলো। চলে যায় সে। পথ হারা পথিক আজ পথ খুঁজে পেয়েছে। প্রকৃতি তাকে ছেড়ে না দিলেও বেঁচে থাকার সম্বল দিয়েছে। পূর্নতা। সকলে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে। মিসবাহ মেয়ের কপালে স্নেহের পরশ এঁকে দেয়। সূরার দিকে তাকিয়ে অমায়িক হাসি ফুটিয়ে তোলে মুখে। সূরার কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে বলে

“আমার একান্ত ব্যক্তিগত আকাশের চন্দ্রকান্তাকে ধন্যবাদ আমার রাজ্যকে পূর্নতা দেওয়ার জন্য।”

সূরা মিসবাহর বুকে মাথা রাখে। একফোঁটা সুখের অশ্রু সিক্ত করে তার কপোলদ্বয়। মিসবাহ একহাতে সূরাকে জড়িয়ে ধরে অন্য হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে মেয়ের গালে ছোঁয়ায়। কন্ঠে খাদ নামিয়ে বললো

“তার প্রেমে পরেছি আমি শতবার শতকোটি বার। তার ওই চোখের মায়ায় বাঁধা পরেছি শহস্রবার। দেখেছি নিজের সর্বনাশ। তার ওই হাসিতে হেরে গেছি বারবার বারংবার। শিশির ভেজা শিউলি ফুলের রাজ্যে তার আগমনে থমকে গেছিল এক কঠোর মানব। মানবের ওষ্ঠজোড়া ছুঁয়েছিল রমনীর শিশির ভেজা পদযুগল। আমার দেখা শ্রেষ্ঠ সুন্দরী রমনী আমার একান্ত ব্যক্তিগত চন্দ্রকান্তা। আমার সুরজান!”

…………..সমাপ্ত……………..

(দীর্ঘ একটা জার্নি। জানিনা নতুন লেখিকা হিসেবে আমার গল্পের মাধ্যমে পাঠক পাঠিকাদের মন ছুঁতে পেরেছি কিনা। আজ সবার রেসপন্স আশা করছি। যাদের ভালো লাগেনি তারাও রেসপন্স করবেন প্লীজ। আজ সবাই রেসপন্স করবেন প্লীজ। সবার এই গল্প ভালো লাগলে আবার নতুন গল্প লিখবো ইনশাআল্লাহ। ভালোবাসা রইলো ❤️)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here