অদৃষ্টে_তুমি_আমি #লেখিকা_সিনথীয়া #পর্ব_৫

0
547

#অদৃষ্টে_তুমি_আমি
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্ব_৫

ক‍্যাবিন থেকে দৌড়ে বের হয়ে পৃথা রেস্টরুমে গেল। বেসিনের সামনে যেয়ে জিদে দু তিন বার হাত মুঠ করে মার্বেলে মারলো ও।
– উফফ্ পৃথা!কি করলি তুই এটা? এতো না বোঝানো হলো যে নিজের গার্ড ডাউন করবি না। এতো তাড়াতাড়ি নিজেকে সারেনডার করে দিলি তুই?
পৃথার নিজের চুল নিজেরই ছিড়তে ইচ্ছা করছিল তখন। বেশ সময় লগলো ওর রাগ ঠান্ডা হতে। শেষ পর্যন্ত নিজেকে বোঝাতে সক্ষম হলো ও,
– শান্ত হ। এখনো তেমন কিছুই হয়নি। ও তোকে কিস করেছে, তুই তো সাড়া দেসনি। তাহলে কোনো সমস‍্যা নেই। সামনে থেকে আরও সতর্ক থাকবি। তাহলেই হবে।
এরপর নিজের চুল ঠিক ঠাক করে রেস্টরুম থেকে বের হয়ে পৃথা নিজের ডিপার্টমেন্টে চলে গেল।
……………………………….
পৃথার ফুফু, মিসেসে রিতা আহমেদ, ছাদ থেকে মাত্র নেমে এসেছেন হাতে সব্জি নিয়ে। ছাদে বাগান আছে তার অনেক বড়। বাসায় সব্জির তাই কোনো অভাব থাকে না কখনো। ড্রয়িং রুম পার করতে গিয়ে দেখলেন তার ছেলে জর্জ ঘুমন্ত চোখে রুম থেকে বের হয়েছে। অবাক হলেন রিতা,
-কি রে আব্বা, তুই এতো বেলায় বাসায় কেন? আমি তো ভেবেছি সাত সকালেই তুই বের হয়ে গিয়েছিস অফিসের জন‍্য।
হাই তুলতে তুলতে জর্জ নিজের মাকে বললো,
– আরে ধুর্ আম্মু। এই ইন্টার্নশিপ করে কোনো মজাই নাই। কবে পার্মানেন্ট হব কে জানে? তাই হুদাই এতো খাটনি করে লাভ নাই।
– কিন্তু বাবা, তোর আব্বা অনেক কষ্টে এই কম্পানিতে তোর চাকরি দিয়েছে। দুই মাস তো পার হলোই, আর একমাস কাজ কর্ ঠিক ভাবে, দেখবি চাকরিটা হয়ে গেছে। অফিসে সিনিয়রদের সাথে লিয়াজু মেন্টেন করবি, ভালো একটা সম্পর্ক তৈরী হবে। তখন চাকরি পেতে সুবিধা হবে।
জর্জ সিগারেটে কালো হয়ে যাওয়া দাঁত গুলো দিয়ে খিক খিক করে বিচ্ছিরি একটা হাসি দিয়ে ওর মা কে বললো,
– তোমার ছেলেকে কি অথর্ব মনে করেছ মা? লিয়াজু মেন্টেন কিভাবে করতে হয় তা খুব ভালোভাবেই আমার জানা। অফিসের সুপারভাইসারের সাথে ভালো খাতির জমাইসি আমি। দেরী করে অফিসে গেলে কিছু বলে না সে। আজকে ফোন দিয়ে বলে দিসি আসবো না অফিসে, সে শুনে শুধু “আচ্ছা” বলেছে।

এই সময় অন‍্যরুম থেকে বের হলেন মেজবা আহমেদ সাহেব। ছেলের শেষের কথাগুলো শুনেছেন তিনি। শুনে তেলেবেগুন জ্বলে গেলেন। তেড়ে আসলেন ছেলের দিকে,
– একটা অকর্মার ঢেকি জন্ম নিয়েছে আমার বাসায়। বুদ্ধি প্রতিবন্ধি একটা। আরে নালায়েক, কিসের লিয়াজু মেন্টেন করছিস তুই?

জর্জ বাবার কথায় বিরক্ত আর ভয় নিয়ে মায়ের পেছনে মাথা ঢাকলো। রিতা রেগে গেলেন স্বামীর ওপর।
– কি ধরনের বাবা তুমি, বলো তো? এতো বড় ছেলের সাথে কেউ এভাবে করে কথা বলে?
– সেটাই তো আমার কথা রিতা। এতো বড় ছেলে হয়েও একটা ঢংয়ের চাকরি জোগাড় করতে পারে নাই এতো দিনে। তোমার আষ্কারা পেয়ে পেয়ে সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। যাও কষ্টমষ্ট করে এই চাকরিটা জোগাড় করে দিয়েছিলাম, গাধাটা সেটাও খোয়াতে চলেছে।
-কি বলছো এগুলো? চাকরি খোয়াবে কেন আমার ছেলে? এখনি তো বললো ও যে সুপারভাইসারের সাথে ওর ভালো খাতির হয়ে গেছে। সেই তো ওপরে রেকমেন্ড করবে তাই না?
– খাতির হয়েছে না ছাই হয়েছে। তোমার ছেলে খাতির বোঝে? সুপারভাইসারকে বলেছে যে আসবে না অফিসে আর তিনি রাজি হয়েছেন, তার মানে কি এটাই যে সে ওকে ভালো চেনেন? আরে সুপারভাইসারের কাজই হলো ইন্টার্নদের পরীক্ষা করা। ওরা কতোটা কাজের প্রতি এবং কম্পানির প্রতি ডেডিকেটেড সেটা যাচাই করা। এই সময়টায় কোনো ইন্টার্ন ঝামেলা করলে তারা কখনই আপত্তি জানাবে না। বরঞ্চ খুশি হবে কারণ ওদের পরে যেয়ে ইমপ্লয়ি ছাটতে সুবিধা হবে। তোমার ছেলে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারছে।

রিতা নিজের স্বামীর কথায় কোনো ভ্রুক্ষেপ করলেন না। বরং ছেলের দিকে ঘুরে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
– তুমি বেশী বেশী উল্টাপাল্টা কথা বলো। আমার ছোলে কোটিতে একটা। ওকে এবার চাকরিতে নিয়েই নিবে, দেইখে নিও তুমি।

আবার জর্জের সেই বিচ্ছিড়ি হাসিটা দেখা গেল। আহমেদ সাহেব রাগের চোটে হাল ছেড়ে দিলেন।
-এই মায়ের জন‍্যই ছেলেটার আজ এই দশা। উফ!
…………………………….
নিজের কিউবিকালে বসে অনেক চেষ্টার পর যখন কাজে মন বসালো পৃথা ঠিক তখনি ওদের রুমে ঢুকলো স্বাধীন। ওকে দেখে সবাই দাড়িয়ে গেল। স্বাধীন সবার উদ্দেশ‍্যে বললো,
– আপনারা বসুন। আমি মিস পৃথার খোজে এসেছি।
এই বলে স্বাধীন সোজাসোজি পৃথার দিকে তাকালো। ভেতর থেকে পৃথার মনে হলো যেন সব পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। চুপ করে দাড়িয়ে রইলো ও, কিছু বললো না। স্বাধীনই বললো ওকে,
– মিস পৃথা, আমাদের কাজটা কিন্তু শেষ হয়নি।
পৃথা ঝট করে বড় বড় চোখ নিয়ে তাকালো স্বাধীনের দিকে। মনে মনে নিজেকে বললো,
– কোন কাজের কথা বলছে ও?
নিজের ঠোটের ওপর অজান্তেই হাত চলে গেল পৃথার। আতকে উঠলো ও,
– ইয়া আল্লাহ্! এটার কথা বলছে না তো?…. ছিঃ ছিঃ কি আবোল তাবল ভাবছিস পৃথা?
স্বাধীনও আশপাশের পরিবেশ দেখে নিজের কথাকে শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করলো,
– আই মিন, ফাইলগুলোর কনটেন্ট এখনো সব বোঝা হয়নি আমার।

পৃথা দেখলো স্বাধীন এখনো দাড়ানো। ওর অপেক্ষাতেই আছে। এটা বুঝে তাড়াতাড়ি স্বাধীনের দিকে হাটা দিল পৃথা তবে ওর চোখে খেলে যাওয়া দুষ্টুমির হাসিটা পৃথার চোখে পরলো না। রুম থেকে বের হয়ে গেল দুজন।

ক‍্যাবিনের সামনে এসে আবারও স্বাধীন পৃথার জন‍্য দরজা খুলে একপাশে দাড়ালো। এটা দেখে ঝামটা মেরে উঠলো পৃথা,
– আমার নিজের দুইটা হাত আছে। একাই দরজা খুলতে পারি আমি।

স্বাধীন পৃথার কথা বুঝে চোখের সেই দুষ্টুমির মতনই একটা হাসি দিয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো। এই হাসিটা পৃথাকে খুব বিরক্ত করছে। গট্ গট্ করে ভেতরে চলে গেল পৃথা।
কাজে আবার বসলো দুজন তবে এবার স্বাধীন ফাইলের দিকে মোটেও তাকালো না। পৃথা বিষয় টা আঁচ করতে পেরে ওপরে তাকাতেই দেখলো স্বাধীন ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। মুখে সেই হাসিটাতো রয়েছেই। সাথে সাথে চোখ নামিয়ে ফেললো পৃথা। ফাইলে ডোবালো মাথা। তবে কৌতুহল যে কখনো কখনো বেশ খারাপ জিনিস তা তো সবাই জানে। নিজেকে না দমাতে পেরে আড়চোখে আবার তাকালো। দেখলো স্বাধীনের চোখ একটুও সরেনি। ধরা খেয়ে যাওয়ার ভয়ে ঝট্ করে পৃথা চোখ নামিয়ে ফেললো। মনের ভেতর বিড় বিড় করে রাগ ঝাড়লো,
– কি নির্লজ্জ রে বাবা! কিভাবে একনাগারে তাকিয়ে আছে।

এরকম দৃষ্টির লুকোচুরি কয়েকবারই হলো ওদের মাঝে। ঠিক করে বললে আসলে স্বাধীন তো চোখ সরায়েইনি। অধিকারের সাথে পৃথার দিকে চেয়েই ছিল। পৃথাই একমাত্র নিজের দৃষ্টি ওঠা নামা করাচ্ছিলো। এক সময় পৃথার বেশ অস্বস্তি বোধ হতে শুরু করলো। ফাইলটা নিচে নামিয়ে রেখে ইতস্তত কন্ঠে স্বাধীনকে বললো ও,
– আর… কিছু যদি বোঝার.. বাকি না থাকে…তাহলে আমি আসি।

এই বলে পৃথা উঠে গেল চেয়ার থেকে। সাথে সাথে স্বাধীনও উঠে দাড়ালো। পৃথা কিছু পা আগাতেই পেছন থেকে আল্তো ভাবে ধরে ফেললো ওকে।
– বোঝার বাকি আছে আমার অনেক কিছু।

স্বাধীন কি ব‍্যাপারে কথা বলছে পৃথার বুঝতে অসুবিধা হলো না। রাগান্বিত চোখে ফিরে তাকালো ও।
– আমার আর কিছু বলার নেই। যা বলার বলে দিয়েছি আমি আগেই।
– কি বলেছ?

স্বাধীন এটা জিজ্ঞেস করে পৃথার কাছে এক পা এগিয়ে আসলো। পৃথা পেছানোর চেষ্টা করেও পারলো না। স্বাধীন শক্ত করে ওর হাত ধরে রেখেছে।
– আমার হাত ছাড়ো।
– ছাড়বো। তার আগে বলো কি বলেছ তুমি আমাকে?
– এটাই যে….আমার…

স্বাধীন আরও এক পা বাড়ালো। পৃথার বুকের ভেতর ডামাডোল বাজা তো শুরু হয়েছে আগেই। স্বাধীনের কাছে আসা ওর আশপাশের পরিবেশটা কেমন যেন করে দিচ্ছিলো। মুখ দিয়ে কোনো‍ প্রতিবাদ করতে পারছিল না পৃথা। স্বাধীনের আওয়াজ কানে আসলো ওর,
– পৃথা… এখনো কি তুমি এটাই বলবা যে আমার প্রতি তোমার আর কোনো ফিলিংস বাকি নেই?
কাঁপা গলায় অস্বস্তি নিয়ে উত্তর আসলো,
– হ‍্যাঁ।

স্বাধীন ততোক্ষণে পৃথার একদম কাছে চলে এসেছে। নিজেদের মাঝের ফাঁকটা পুরোপুরি ঘুচিয়ে দিয়েছে। পৃথার কানের কাছে নিজের মুখ নামালো স্বাধীন।
-তাহলে আমার ঠোটের স্পর্শে তোমার চোখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কেন তখন?

স্বাধীনের ভরা গলার আওয়াজ পৃথার কান দিয়ে একদম ভেতরে যেয়ে লাগলো। সারা শরীরে শিহরণ বয়ে গেল যেন। স্বাধীন থামলো না,
– তুমি আমার ভালোবাসাকে ভুলে যাওনি পৃথা। আমি জানি সেটা। তুমি তোমার স্বাধীনকে ভুলে যাওনি।

কম্পিত স্বরে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলো পৃথা,
– কে বলেছে? আমি… চিনি না… তোমাকে।
– এভাবে বলো না পৃথা, প্লিস।
-এভাবেই বলবো। আমার চেনা সেই স্বাধীন তুমি নও। সে কোথাও হারিয়ে গেছে।

স্বাধীন সাথেসাথেই ভালো করে তাকালো পৃথার দিকে। পৃথার চোখের পানি ওকে সম্পূর্ণ কাপিয়ে তুললো। পৃথা সেই অভিমান নিয়েই আদেশের সুরে বললো স্বাধীনকে,
– সরে যাও।
তবে এবার স্বাধীনও নিজ জায়গা ধরে রইলো,
-না আমি সরবো না। এখন সরে গেলে সব ধোয়াসাই রয়ে যাবে।
– থাক ধোয়াসা। কিচ্ছু ঠিক করার দরকার নেই।
– পৃথা প্লিজ তুমি এভাবে কেঁদো না।

স্বাধীন জোর করে পৃথার মুখ তুলে ওর চোখের পানি মুছে দিল। পৃথা এবার খেয়াল করলো স্বাধীনের চোখও কেমন নরম হয়ে এসেছে। আচ্ছা ওর চোখে কি একটু পানি জমেছে? আসলেই কি সেটা দেখতে পাচ্ছে পৃথা?

একে অপরকে কতোক্ষণ এভাবে দুজন পর্যবেক্ষণ করলো তা ওরা জানে না তবে হঠাৎ কিছুক্ষণের আগের আবেগ ভর করে গেল ওদের মাঝে। এ যেন এমন এক আকর্ষণ যা থেকে রেহাই পাওয়ার সাধ‍্য দুজনের একজনেরও হচ্ছিলো না। নিজের ঠোট নামিয়ে স্বাধীন আবার আদর করলো পৃথাকে এবং এবারও পৃথা বাধা দিল না। বরঞ্চ একটু কি সাড়াই দিয়ে ফেললো ও?

কিছুক্ষণ পর মাথা ওঠালো স্বাধীন। পৃথার কাঁপা চোখটাকে নিজের দিকে করলো,
– জানি অনেক অভিমান মনে নিয়ে আছ তুমি। অনেক ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে । তবে আমাকে একটু সময় দাও। একে একে সব কিছু ঠিক করে দিব আমি।

সেই রাতে নিজের বিছানায় শুয়ে পৃথা গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়লো। স্বাধীনকে নিয়ে হাজারো ধরনের অনুভূতি খেলে যাচ্ছিলো ওর ভেতরে। আজ স্বাধীনের স্পর্ষ পেয়েছে ও এতো বছর পর। দুপুরের সেই দৃশ‍্যটা চোখের সামনে ভাসতেই আবার কেঁপে উঠলো পৃথা। সেই সময়টাতেও দশ বছর পিছিয়ে গিয়েছিল ও ঠিক এখনের মতন।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here