মালা_করনু_তারে_দান,পর্ব-১৬,১৭

0
480

#মালা_করনু_তারে_দান,পর্ব-১৬,১৭
অরিত্রিকা আহানা
পর্ব-১৬

মাইকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। চারদিক অন্ধকার! হাঁসফাঁস করছে বিনি!
রাহেলা মির্জা স্ট্রোক করেছেন। গতকাল রাতে শরীর খারাপ থাকায় বিনি পাশে শুয়েছিলো। ভোর রাতের দিকে স্ট্রোক করে বসেন।

এদিকে ইফরানকেও ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। বন্ধুর বিয়ে খেতে গেছে। তবুও বিনি লাগাতর ট্রাই করে যাচ্ছে।

বাইরে তুমুল বর্ষণ। রাস্তাঘাটে পানি জমে গেছে। এর মাঝে হস্পিটালের উদ্দেশ্যে ছুটে চলেছে তাঁদের অ্যাম্বুলেন্স। অচেতন অবস্থায় স্ট্রেচারে পড়ে আছেন রাহেল মির্জা। ভয়ে বিনির হাত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। মেরুদণ্ড অসাড় হয়ে আসছে। ঠান্ডা আবহাওয়াতেও দরদর করে ঘামছে সে।

অবশেষে পৌনে পাঁচটার দিকে হস্পিটালে গিয়ে পৌঁছালো তাঁরা। সঙ্গে সঙ্গেই কর্তব্যরত ডিউটি ডাক্তার ইমার্জেন্সিতে শিফট করলেন রাহেলা মির্জাকে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো হলো!


বিনি একেরপর এক কল দিয়ে যাচ্ছে ইফরানের ফোনে। সুইচড অফ! একে তো আবহাওয়া খারাপ তারপর ফোনের চার্জও নেই। কোনভাবেই কানেক্ট করতে পারলো না।

শেষমেশ তাঁর আশা ছেড়ে দিলো বিনি। হালিম মিয়াকে সঙ্গে নিজেই একা হাতে সবটা সামাল দিলো।

সকাল নয়টার দিকে জ্ঞান ফিরলো রাহেলা মির্জার। এই যাত্রায় বেঁচে গেছেন। বিনিকে দেখে মলিন হাসলেন। বিনি তাঁর মুখের কাছে ঝুঁকে কোমল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—‘এখন কেমন লাগছে মা?’

জবাবে রাহেলা মির্জা মাথা নাড়ালেন। এর মানে ভালো লাগছে। রুগ্ন, পীড়িত চোখজোড়া কেবিনের ভেতর বাহির পর্যবেক্ষণ করে ক্ষীণস্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
—‘ইফরান আসে নি?’

বিনির মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। ধীরে ধীরে দুদিকে মাথা নাড়ালো। মৌনমুখে বললো,
—‘ফোন বন্ধ!’
রাহেলা মির্জার চেহারায় অসহায়ত্ব, বিষাদ, ফুটে উঠলো। পাশ ফিরে চোখের পানি গোপন করলেন।

বিনি এইপ্রথম এই মহিলাটির জন্য ভীষণ দুঃখ বোধ করলো। ইনি তাঁর চেয়েও বেশি অভাগী। অল্পবয়সে স্বামী হারিয়েছেন। ছেলের কথা ভেবে আর বিয়ে করেন নি। অথচ সেই ছেলে কখনো মায়ের দুঃখ বুঝলোই না। মায়ের বিপদের সময়টাতে পর্যন্ত তাঁকে কাছে পাওয়া গেলো না। আফসোস!

রাহেলা মির্জার একসপ্তাহের মতন হস্পিটালে রইলেন। এর ভেতরে ইফরানের কোন খোঁজ পাওয়া গেলো না। সে দেশে থাকলে তবেই না খোঁজ পাওয়া যাবে? সে তো দেশেই নেই।

বন্ধুর বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে সবাই মিলে প্ল্যানিং করে নেপাল ভ্রমণে বেরিয়েছে। সেখানে গিয়ে ফোন হারিয়ে ফেলায় দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।
ইফরান অবশ্য কোনকালেই নিজে থেকে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে নি। প্রতিবার রাহেলা মির্জা নিজে থেকেই হালিম মিয়াকে পাঠিয়ে তাঁর খবর জোগাড় করেছেন। কিন্তু এবার তিনি অসুস্থ থাকায় হালিম সেদিকে মনোযোগ দিতে পারে নি। বাড়িতে হস্পিটালে দৌড়াদৌড়ি করেই অস্থির হয়ে গেছে।

এখন আগের চাইতে একটু ভালো আছেন রাহেলা মির্জা। খাটের ওপর আধশোয়া হয়ে বসে আছেন। তার পাশে বসে আছে বিনি।

উকিল সাহেব নোটিশ পড়ে শোনাচ্ছে। অফিসের জায়গা টুকু বাদে রাহেলা মির্জা নিজে স্থাবর অস্থাবর সকল সম্পত্তি বিনির নামে হস্তান্তর করে দিয়েছেন। বিনি চাইলে সংযোজন, বিয়োজন করতে পারবে। প্রয়োজনে মালিকানাও হস্তান্তর করতে পারবে। শুধু অফিসের বেলাতেই অন্য নিয়ম। পাওয়ার অফ এটোর্নি পাবে বিনি। বিক্রয় করা যাবে না।

বিনি হতভম্ব, বিস্ফোরিত নেত্রে রাহেলা মির্জার দিকে চেয়ে রইলো। অবিশ্বাস্য কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
—‘এসব কেন করেছেন মা?’

রাহেলা মির্জাকে ডাক্তার সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। তাই এখন আর চাইলেও আগের মতন অফিসে যেতে পারবে না। ইফরান তো দায়িত্ব নেবেই না। ব্যবসা বাণিজ্য সব ছারখার হয়ে যাবে।
তাই সবদিক ভেবেচিন্তে তিনি এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছেন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
—‘আমার বয়স হয়েছে। শরীরের অবস্থা বেশি ভালো নয়। ইফরানের হাতে এসব তুলে দিতে ভরসা পাই না। ও কিচ্ছু রাখবে না। সব তছনছ করে ফেলবে। তাই তোর হাতে সব তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চাই।
—‘কিন্তু তাই বলে আপনি আমার নামে সম্পত্তি লিখে দেওয়ার কি প্রয়োজন ছিলো? আমি আপনাদের সম্পত্তি দিয়ে কি করবো?’

রাহেলা মির্জা বিনির মনের অবস্থা বুঝলেন। বিনি হয়ত ভাবছে সম্পত্তির লোভ দেখিয়ে তিনি বিনিকে এই বাড়িতে আটকে রাখতে চাইছেন। তাঁর ভুল ধারণা ভেঙ্গে দিয়ে বললেন,
—‘ইফরানের বাবার হাতে গড়া এই সম্পত্তি। এতদিন সমস্ত ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে আমি আগলে রেখেছি। এখন আমার বয়স হয়েছে। শরীর ধকল নিতে পারে না। তাই তোর ওপর দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছি। তুই আমাকে না ফিরিয়ে দিস না। তাছাড়া আমি জানি ইফরান যদি কখনো দায়িত্ব নিতে চায় তুই ওকে ঠকাবি না।’

বিনি নির্বাক, অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। রাহেলা মির্জার অসহায় মুখটা দেখে ভীষণ মায়া হচ্ছে। অসুস্থ মানুষটার একমাত্র ভরসা এখন সে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
—‘আপনার ওষুধের সময় হয়ে গেছে মা। আমি নার্সকে ডেকে আনি।’


বিনি ঘরে বাইরে একা হাতে সামলাচ্ছে। ব্যস্ত, বিভীষিকাময় দিন যাচ্ছে। নিজেকে সময় দেওয়ার মত ন্যুনতম বিরতি নেই। প্রতিরাতে ক্লান্ত অবসন্ন দেহ নিয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়ে সে। আর ভাবে কত বাস্তবতা কত নিষ্ঠুর। কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে তাঁকে।

সকাল নয়টা! ইফরান গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকছে। দেশে ফিরেই মায়ের অসুস্থতার কথা জানতে পেরেছে। তাই আর দেরী করে নি। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা বাড়িতে চলে এসেছে।
গেটে পা রাখতে না রাখতেই ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। চতুর মাঝবয়সী ভদ্রলোক। ইফরানকে দেখে একগাল হেসে বললেন,
—‘আরে ইফরান যে, ফিরেছো। আজই ফিরলে ?’
—‘হ্যাঁ। মায়ের কি অবস্থা।’
—‘তিনি ভালো আছেন। তোমার বাবা রাজকপাল। সর্বগুনসম্পন্না অর্ধাঙ্গিনী পেয়েছো। বউয়ের ওপর সব ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়েতে পারো।’

ম্যানেজারের কন্ঠে সুক্ষ্ম কূটিলতার ইঙ্গিত। ইফরান ধরতে পারলো না। ইশারায় জিজ্ঞেস করলো,
—‘কিসের কথা বলছেন? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’

—‘সে কি। তুমি তো দেখছি কিছুই জানো না। ব্যবসার দায়িত্ব তো এখন বউমা সামলাচ্ছে। তোমার মা মানে আমাদের বেগম সাহেবা সব তাঁর নামে লিখে দিয়েছেন। যদিও লিখে দেওয়ার সময় আমরা কেউ ছিলাম না, শুনেছি কাগজপত্র হস্পিটালে হয়েছে। তিনি হুঁশে ছিলেন কিনা কে জানে। যাইহোক, তোমার বউ কিন্তু ভীষণ খুশি। নিয়ম মেনে অফিসে আসা যাওয়া করছে।’

বিনির প্রসঙ্গে ম্যানেজার ইচ্ছাকৃত ইফরানকে উস্কে দিতে চাইছে। ইশারা ইঙ্গিতে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছে যে রাহেলা মির্জার অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে সম্পত্তি লিখে নিয়েছে বিনি।
তার এমন উস্কানিমূলক কথাবার্তার কারণ বিনির সঙ্গে ইফরানের বিয়ে।
ইতোপূর্বে তাঁর বহুত আশা ছিলো একমাত্র ভাগ্নির সঙ্গে ইফরানের বিয়ে দিয়ে ভাগ্নিকে রাজরানী করবেন। সমস্ত কিছুর মালকিন হবে তাঁর আদরের ভাগ্নি। কিন্তু রাহেলা মির্জার চতুরতায় সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তার দুরভিসন্ধি বুঝতে পেরে একপ্রকার তাড়াহুড়ো করেই বিনির সঙ্গে ইফরানের বিয়ে দেন।
তাতে করে ম্যানেজারের সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো বিনির ওপর। যদিও এতদিন প্রকাশের সুযোগ পায় নি। তবে রাহেলা মির্জার অসুস্থতাতে কেন্দ্র করে একটা সুযোগ তৈরী করে ফেলেছেন। এর অবশ্য একটা কারণ আছে। বিনি অফিসে যোগদান করার পরপরই তিনি বুঝে গেছেন এই অল্পবয়স্কা, চুপচাপ প্রকৃতির মেয়েটি রাহেলা মির্জার চাইতেও বেশি চালাক এবং পরিশ্রমী। একে হটাতে না পারলে বিপদে পড়ে যাবেন। অফিসে এসেই পুরোনো হিসেবপত্র থেকে শুরু আয়,মুনাফা পইপই করে হিসেব নিতে শুরু করে দিয়েছে।

তাই এইমুহূর্তে একটাই উপায়। কোনভাবে ইফরানকে ভড়কে দেওয়া। বিনির সঙ্গে তাঁর বিশেষ ভাব ভালোবাসা নেই। ভাগ্নির কাছ থেকেই শুনেছেন। সেই সুযোগটাই লুফে নিলেন ম্যানেজার সাহেব। বিনিকে কালপ্রিট বানিয়ে আগুনে ঘি ঢেলে দিলেন।

ইফরান চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাঁর সব কথা শুনলো। তিনি শেষ করতেই কোন রকম বাক্যবিনিময় ছাড়াই গম্ভীর মুখে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলো। বিনি এমন কিছু করতে পারে সে বিশ্বাস করতে পারছে না!

তবে কি তাঁর বন্ধুরা ঠিক বলেছিলো। সম্পত্তির লোভেই ইফরানকে বিয়ে করেছে বিনি!এত লোভ!
নাকি সব মিথ্যা?
এদিকে ইফরানের উত্তপ্ত মেজাজ আর একরোখা স্বভাবের কথা ভেবে মনে মনে হাসলেন ম্যানেজার। ইফরানের মনে সন্দেহ ঢুকে গেছে। এবার বিনির জব্দ হওয়ায় পালা। অত্যাধিক প্রসন্ন মনে ‘গীতাঞ্জলী’ ত্যাগ করলেন তিনি।
#মালা_করনু_তারে_দান
অরিত্রিকা আহানা
পর্ব-১৭

ইফরান ভেতরে প্রবেশ করতেই দোতলার সিঁড়ি দিয়ে বিনিকে নামতে দেখা গেলো। অফিসের ফাইলপত্র হাতে নিয়ে পরিপাটি হয়ে নামছে। ইফরানকে দেখে ক্ষণকালের জন্য থমকে গেলো।

ইফরান আগে থেকেই শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পিঠের ব্যাগটা নামিয়ে হাত দিয়ে ঘাড় মালিশ করলো। উচ্চস্বরে মিনুকে ডাক দিয়ে বললো,
—‘এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে আয় তো মিনু।’

মিনু পানি দিয়ে গেলে ঢকঢক করে পুরোটা পানি খেলো। বিনি দুই সিঁড়ি নিচে নেমে এলো। মুখ কালো করে চাপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—‘ফোন বন্ধ ছিলো কেন তোমার?’

ইফরান তাঁর প্রশ্নের জবাব না দিলো। তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে বিনির মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালো। ভরাট কন্ঠে পাল্টা প্রশ্ন করলো,
—‘ম্যানেজার সাহেব কি বলছে এসব? মা নাকি তোমার নামে সবকিছু লিখে দিয়েছে?’

হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনে কিছুটা অবাক হলো বিনি। পরোক্ষণেই নিজেকে শান্ত করে রয়েসয়ে জবাব দিলো,
—‘হ্যাঁ..’

তাঁর কথা পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই ইফরানের বিক্ষুব্ধ কন্ঠস্বর শোনা গেলো। বিনির মুখ থেকে হ্যাঁ-সূচক অভিব্যক্তি সে আশা করে নি। মুহূর্তেই মেজাজ খিঁচড়ে গেলো। তিরস্কারপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
—‘তারমানে কি আমি ধরে নেবো তুমি টাকার জন্যই আমাকে বিয়ে করেছিলে?’

বিনি বরাবরই ধীরচিত্ত! পাহাড়সম অটল তাঁর ধৈর্য। নতুবা এত আত্মত্যাগের পরেও এমন অপবাদ যে কাউকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু বিনি শান্ত। হাতের ফাইলগুলো গুছিয়ে নিয়ে শীতল কন্ঠে বললো,
—‘যা বলেছে একদম সত্যি বলেছে। টাকার জন্যই আমি তোমাকে বিয়ে করেছি। নইলে তোমার মত অপদার্থ, লাইফলেসকে আমি কেন বিয়ে করতে যাবো? কি আছে তোমার?’

বিনির কন্ঠস্বর অত্যাধিক শীতল, ধীরস্থির! ইফরানের কাছে জবাব দেওয়ার কোন প্রয়োজন বোধ করলো না সে। যেই ছেলেকে মায়ের বিপদের সময় খুঁজে পাওয়া যায় না, স্ত্রীর প্রয়োজনে পাশে থাকতে পারে না, সংসারের দায়িত্ব নিতে জানে না তাঁর কাছে কিসের কৈফিয়ত? নির্বিকার ভঙ্গিতে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।

ইফরান ক্রোধে রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। বিনির অকপট স্বীকারোক্তি তাঁর চিন্তাশক্তিকে বিকল করে দিয়েছে। মস্তিষ্কে হুল ফোটাচ্ছে। কেন বিনি আত্মপক্ষ সমর্থণের কোন চেষ্টা করছে না? এতদিন তাহলে সব অভিনয় ছিলো? একমুহূর্তের জন্যেও ভালোবাসে নি ইফরানকে? এত লোভ তাঁর!
ক্ষিপ্ত, ক্রুদ্ধ কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠে বললো,
—‘লজ্জা করছে না তোমার? লজ্জা করছে না এই কথাগুলো বলতে? আমার মা তোমাকে বিশ্বাস করে এই বাড়ির বউ করেছে। আর তার সুযোগ নিয়ে তুমি এতবড় জঘন্য কাজ করলে?’
—‘স্বার্থে আঘাত পড়ায় এখন মুখ দিয়ে মায়ের নাম বেরোচ্ছে। সবই তাহলে টাকাপয়সার গুন।’

বিনির কন্ঠে পরিহাস। ইফরানের রাগত দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে হালিম মিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—‘হালিম চাচা। আমি বেরোবো। গাড়ি বের করতে বলুন। আর কারো যদি টাকা পয়সার প্রয়োজন হয় তাহলে সে যেন মায়ের নাম করে হাত পাতে। আমি দিয়ে দেবো।’

ঠাস করে একটা চড় পড়লো বিনির গালে। পাঁচ আঙুলের দাগ স্পষ্ট হয়ে বসে গেলো। ইফরানের চোখ দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে।
বাড়ির ভৃত্যরা সকলে হতবম্ভ। মায়ের মত স্নেহময়ী, পরোপকারী গৃহকর্ত্রীর শেষে কিনা এমন অপমান! নিষ্ঠুর বর্বরটার বিন্দুমাত্র লজ্জা যদি থাকতো। এতদিন ধরে সমস্ত সংসার বিনি একা টানছে। ঘরে বাইরে সবখানে একা হাতে সামলাচ্ছে। আর এই অকৃতজ্ঞ বেইমান কিনা এভাবে তাঁর প্রতিদান দিলো! চাকরবাকরের সামনে তাঁর সম্মানের কথা পর্যন্ত ভাবলো না!

বিনির লজ্জা ঠেকাতেই যেন মাথা নিচু করে আড়ালে সরে গেলো সবাই। হালিম মিয়া কাঁদোকাঁদো মুখ করে বললো,
—‘আপনি মাকে ভুল বুঝছেন ছোটবাবাজি। মায়ের কোন দোষ নেই!’

কিন্তু যাকে ঘিরে এত উত্তাপ সেই বিনিই নিরুত্তাপ! গালে হাত দিয়ে ইফরানের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যভরে হাসলো সে। অথচ এই চড় যে তাঁর কতখানি আত্মসম্মানে লেগেছে তা কেবল সে জানে আর জানে তাঁর সৃষ্টিকর্তা! গলা অব্দি আটকে থাকা ক্রন্দন কত কষ্ট করে ঠেকিয়ে রেখেছে তার কথা নাহয় নাই বললাম।

ইফরান প্রকৃতিস্থ অবস্থায় থাকলে বুঝতে পারতো বিনির হাসিতে কতখানি ঘৃণা,কতখানি উপহাস লুকিয়ে আছে।
বিনি বরফ শীতল কণ্ঠে বললো,’গায়ে জোর আছে। তবে চড়টা বউয়ের গালে না মেরে নিজের গালে মারলে সত্যিকারের পুরুষ ভাবতাম।’

কথা শেষ করে আর একমুহূর্তও দাড়ালো না বিনি। তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো। হতভম্ব, বাকরুদ্ধ ইফরান মুর্তির মত ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। এই বিনিকে সে চিনতেই পারছে না। মাত্র পনেরো দিনে এতটা বদলে গেলো? সত্যিই টাকা পয়সার লোভ মানুষকে এত নিচে নামাতে পারে?

বাস্তবিকই নারীহৃদয় বোঝার ক্ষমতা ইফরানের নেই। নইলে সে বুঝতো, সে যেটাকে ‘পরিবর্তন’ বলে ধারণা করে বসে আছে সেটা আসলে তাঁর প্রতি বিনির জমে থাকা ক্ষোভ, তীরস্কারের বহিঃপ্রকাশ!


স্কুল কলেজ, রাস্তাঘাট সব পেছনে ফেলে তীব্র গতিতে অফিসের উদ্দেশ্যে ছুটে চলেছে গাড়ি। গাড়ির পেছনের সীটে মাথা এলিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে বাইরে তাকিয়ে আছে বিনি। চোখের কোনে পানি চিকচিক করছে। গালের চারপাশটা ভয়ানক লাল হয়ে আছে, জ্বালাপোড়া করছে। তার চেয়েও বেশি জ্বালাপোড়া করছে বিনি অন্তর।

সবাই বিনির বাইরে শক্ত খোলসটাই দেখে। অনুভূতিহীন, কঠিন চেহারাটাই সবার সামনে প্রকাশিত। অথচ খোলসের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভাঙ্গাচোরা হৃদয়টা কেউ দেখে না। কেউ জানে না কত কষ্ট, কত বেদনা লুকিয়ে আছে এই শক্ত খোলসের আড়ালে। ঝাঁপিয়ে আসা অবরুদ্ধ ক্রন্দন ঠেকাতে না পেরে মাঝরাস্তায় গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়লো।

হ্যাঁ! ধারালো, প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মেয়েটা ফুটপাতে বসেই কেঁদে ফেললো। যেই বিনির ধৈর্য পাহাড়ের মত অটল, ব্যক্তিত্ব আপসহীন, অবিচল সেই বিনিই আজ সমস্ত ধরণী কাঁপিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। এক এক ফোঁটা অশ্রু বিন্দু যেন রক্ত হয়ে ঝরলো চোখ বেয়ে। এত অপমান। এত আঘাত! কাউকে বোঝাতে পারবে না বিনি! চাপা কষ্টে বুকের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে, লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে। কেউ যেন তীক্ষ্ণ ছুরির ফলা দিয়ে হৃদয়টাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here