অদৃষ্টে_তুমি_আমি #লেখিকা_সিনথীয়া #পর্ব_১৬

0
430

#অদৃষ্টে_তুমি_আমি
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্ব_১৬

রিতার মাথায় পরিকল্পনার প্রতিযোগিতা চলছে। নানান ভাবে চিন্তা ভাবনা করে সে একটা সমাধানে পৌছতে চাচ্ছেন। এমন একটা সমাধান যেটা শুধুই তাকে লাভবান করবে।
এই সময়ে ঘরের দরজায় কড়া নাড়লো জর্জ।
– আম্মা, অন্ধকারে বসে কি করো? লাইট জ্বালাবো?
– না না লাইট দিশ না। ডাইনিং থেকে আলো তো আসছেই। সেটাই ভাল লাগছে।
– তো এখানে একা বসে কেন তুমি? আব্বা ড্রয়িংরুমে টিভি দেখছে, তুমিও চলো।
– না, আমার টিভি দেখতে ভালো লাগছে না।
জর্জ মায়ের গলায় বিরক্তির আঁচ পেল। খাটের ওপর মায়ের পাশে যেয়ে বসলো ও,
– আম্মা, কি হয়েছে বলো তো?
রিতা এক মুহূর্ত ছেলের দিকে তাকালেন।
-একটা ঘটনা ঘটেছে জর্জ।
– কি?
– স্বাধীন দেশে ফিরেছে।
– স্বাধীন….কে?….. কি বললা?
জর্জ কে দেখে মনে হলো যেন ভূত দেখেছে ও। রিতার চেহারাতেও আতঙ্ক স্পষ্ট।
– আম্মা, ওই ছেলে আসার মানে তো পৃথা….
– হমম। ওটা নিয়েই তো মূল চিন্তা আমার।
-পৃথা জানে এই ব‍্যাপারে কিছু?
-ওই বোকা মেয়ে কোথা থেকে জানবে? আমি তো শুনে এসেছি আমাদের পূরাতন ফ্ল‍্যাটের ওখান থেকে। পৃথা তো আর ওদিকে কখনো যায় না। আর ওদের নতুন ঠিকানা আমি কাউকেই ডিসক্লোজ করিনি। তাই স্বাধীনেরও পৃথাকে খুজে পাওয়া অসম্ভব।
-হমমম।
-কিন্তু, জর্জ। আমার মনে কেমন কু ডাকছে বুঝছিস? মনে হচ্ছে সামনে কোনো অঘটন ঘটতে পারে। ছেলেটা যেহেতু ফিরেছেই…
– তোমার কথা বুঝতে পারসি আম্মা। ওই ছোকরা কিছু জানা,বোঝার আগেই আমাদের কিছু করতে হবে। আম্মা, পৃথা আমার চাইই চাই।
ছেলের মাথায় হাত বুলালেন রিতা,
– পৃথা তোরই হবে বাবা। আমি এটা করেই ছাড়বো।
– কিন্তু বাবা?
– ধুর! তোর বাবার কথা বাদ দে। অনেক শুনছি তার কথা কিন্তু আর না। এইবার তার একটা কথাও মানবো না আমি। পৃথা অফিসের কাজে শহরের বাইরে আছে। ও ফিরলেই তোর বিয়ের কথা ওঠাবো আমি। পারলে এক বসাতেই তোদের বিয়েটা পরিয়ে দিয়ে, পৃথাকে নিয়ে আসবো এই বাড়িতে।
মায়ের কথায় মনের সুখে হাসতে থাকলো জর্জ। শেষ পর্যন্ত পৃথাকে পাওয়ার আশা ওর পূরণ হতে যাচ্ছে। মেয়েটাকে দেখলেই ওর ভেতর কেমন কেমন করে। পৃথাকে ওর কেন যেন ভীষণ আবেদনময়ী মনে হয়। ইচ্ছা করে সাথেসাথেই ওর ওপর নিজের পৌরষত্ব খাটিয়ে মজা নিতে। অনেক কষ্টে এতোদিন সেই ইচ্ছা দমন করে বসেছিল ও। এখন মনে হচ্ছে ওর অপেক্ষার দিন প্রায় শেষ হয়ে আসছে। একবার বিয়ে করে আনলেই পৃথার সবটুকুই ওর হয়ে যাবে। তখন মজা নিবে অনেক জর্জ। অনেক মজা।
……………………………………………
হলুদ শেষ হতে মধ‍্যরাত পার হয়ে গেল। আজও রুমে ঢুকে পৃথা স্বাধীনকে বললো আগে ফ্রেশ হয়ে আসতে কারণ, ফুলের গয়না গুলো খুলতে সময় লাগবে ওর। স্বাধীন শুধু সম্মতি জানিয়ে চলে গেল। এতে মনে মনে অনেক অবাক হলো পৃথা। ও তো ইচ্ছা করেই স্বাধীনকে বলেছিল আগে ফ্রেশ হয়ে নিতে, যাতে স্বাধীন ওকে মানা করে এটাই বলে যে ও পৃথাকে ওর গয়না খুলতে সাহায‍্য করতে চায়। কিন্তু এ কি? ওরকম কিছুই না বলে, সোজা চলে গেল ছেলেটা? অবাক কান্ড না?
আর শুধুই এই এখনই না, আজ পুরো হলুদের অনুষ্ঠানেই স্বাধীনকে একটু অন‍্যরকম মনে হয়েছে পৃথার। বেশীই স্বাভাবিক আচরণ করেছে ছেলেটা আজকে।
আয়নার সামনে দাড়িয়ে একটা একটা করে গয়না খুলছিল আর ভাবছিল পৃথা। গত দেড় মাসে ওদের দুজনের মাঝের প্রায় প্রতিটা ক্ষণেই স্বাধীন ওকে নিজের ভালোবাসার কোনো না কোনো রুপ ব‍্যক্ত করেছে। এমন মুহূর্ত পৃথার মনে পরছে না যখন স্বাধীনের এইসব কাজে ও লজ্জা পেতে বাধ‍্য হয়নি। বরং কখনো কখনোতো নিজেকেই সামলাতে পৃথার ভীষণ কষ্ট হয়েছে যেমনটা গত রাতে হয়েছিল। আস্তে আস্তে স্বাধীনকে এভাবেই কাছে পেতে এক প্রকার অভ‍্যস্ত হয়ে গিয়েছে ও। মেনেই নিয়েছে যে স্বাধীন ওর সাথে এভাবেই মনমাতানো প্রেম চালিয়ে যেতে থাকবে।
তাই আজকে স্বাধীনের স্বাভাবিক আচরণ পৃথাকে অবাক করে দিয়েছে। আসলে শুধু অবাকই না, কষ্টও দিয়েছে খানিকটা। গতকাল মেহেদির প্রোগ্রামে ওকে দেখে স্বাধীনের যেই প্রতিক্রিয়া ছিল, আবার রাতেও খাটে পৃথাকে পাশে নিয়ে যেভাবে প্রশংসা করলো ওর সাজের, এই সব মিলিয়ে পৃথার মাঝে আজ লোভ জন্মেছিল স্বাধীনের থেকে আরও ভালোবাসা পাওয়ার। তাই তো খুব যত্ন নিয়ে আজ সেজেছিল ও। গত কাল সাজে যা অপূর্ণ মনে হয়েছিল তাও পূরণ করার চেষ্টা করেছে। শুধু স্বাধীনকে ইম্প্রেস করাই ছিল ওর মূল উদ্দেশ‍্য। কিন্তু হয়ে গেল সব ওলটপালট। স্বাধীন ওকে দেখেছে ঠিকই, কিন্তু আগের দিনের মতন কোন প্রতিক্রিয়া দেয় নি। শুধু একটু হেসেছে। পৃথা প্রথমেই ব‍্যাপারটা লক্ষ‍্য করলেও নিজের বরকে একটু সময় দিতে চাচ্ছিলো। তাই আকারে ইঙ্গিতে ও বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগলো ওর সাজ। কখনো চুলের খোপায় হাত তো কখনো হাতে ফুলের বালা নাড়ানো, সবই করলো পৃথা স্বাধীনের সামনে। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হলো না। স্বাধীন সেভাবে খেয়াল করেনি পৃথাকে। এটা দেখে তখন বেশ অভিমান হয়েছিল পৃথার মনে মনে তবে সেটা প্রকাশ করার মতন সুযোগ সবার সামনে ছিল না। তাই নিজের মাঝেই চুপ থেকেছিল ও।
পৃথা ভেবেছিল, সবার মাঝে কিছু না বললেও স্বাধীন হয়তো রুমে এসে একান্তে প্রশংসা করবে বউয়ের। গতরাতের মতন আবার আদর করে কাছে টেনে নিবে। পৃথা আবার সেই লজ্জার উপস্থিতি পাবে নিজের মাঝে। কিন্তু কই? কিছুই তো এমন হলো না। স্বাধীন কি সুন্দর এসে ওয়াশরুমে চলে গেল। পৃথা বললোও যে ও সব সাজ খুলে ফেলবে, তাও স্বাধীন কিছু করলো না। শুধু ‘আচ্ছা’ বলে চলে গেল ওর সামনে থেকে।
এখন পৃথা সম্পূর্ণ দমে গেছে। চেহারায় ছেয়ে এসেছে মলিনতা। স্বাধীনের রাগগুলো বেজান গয়নাগুলোর ওপর ঝাড়তে লাগলো ও।
-খামখাই এতো কষ্ট করে সাজলাম। যার জন‍্য করলাম তারই কোনো ইন্টারেস্ট নেই। ধুর!
এসময়ে স্বাধীনকে মুখ মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসতে দেখলো পৃথা। দুজনের দৃষ্টি মিললো কিছুক্ষণের জন‍্য, পৃথার মনে অজানা একটা আশা আবার জন্মাল। তবে সেই আশায় গ্লাস ভরে পানি ফেলে, স্বাধীন মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বারান্দার দিকে চলে গেল।
অবাক হওয়ার শেষ সীমায় পৌছালো পৃথা।
– এটা কি হলো? ছেলেটা আমার কাছে আসলোও না?
আবার রাগ উঠলো পৃথার। আবার ও রাগ ঝাড়া শুরু করলো গয়না আর ওর সাজের ওপর,
– গতকাল কি মিষ্টি সুরে আমাকে বলছিল কোনো সাহায‍্য লাগবে কি না। কাছে আসার কতো বাহানা করে যাচ্ছিলো। তাহলে আজকে কি হলো? গতকাল লাগেনি বলে কি আজ আমার সাহায‍্য লাগতে পারে না? আজ একবার জিজ্ঞেস করলেই হতো? দেখতো কি উত্তর দেই। তা না করে আমাকে সম্পূর্ণ এভোয়েড করে যাচ্ছে? উফফ!
খুব বিরক্তির সাথে কাপড় পাল্টে, ফ্রেশ হয়ে পৃথা ছাদ বারান্দাটায় এসে স্বাধীনের পাশে দাড়ালো। ওকে দেখে হাসলো স্বাধীন,
– ফ্রেশ হয়ে গেছ?
পৃথা কোনো উত্তর দিল না। শুধু মুখটা শক্ত রেখে মাথা নেড়ে দিল। স্বাধীন উত্তর পেয়ে নিজের মাঝে নিয়ে নিল পৃথার হাত।
– আজকে হলুদের অনুষ্ঠানটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। এরকম অনুষ্ঠানগুলো করলে অনেক এ‍্যাডভানটেজ আছে তাই না?
পৃথা অবাক চোখে প্রশ্ন নিয়ে স্বাধীনের দিকে তাকালো। স্বাধীন ভেঙে বললো তখন,
– দেখো, যদি এই প্রোগ্রামটা কোনো কমিউনিটি সেন্টার অথবা কনভেনশন হলে হতো তাহলে কতো ধরনের বাধা থাকতো। যেমন সময় থাকতো লিমিটেড, মজা হতো কম। তারপর প্রাইভেসি থাকতো না, পাশেই হয়তো অন‍্য কোনো অনুষ্ঠান হতে পারতো। আবার কতৃপক্ষের থাকতো নানান শর্ত। এগুলো সব মূল আনন্দটাই নষ্ট করে দিত হয়তো। কিন্তু নিজেদের বাড়ির আঙিনায় এসবের কোনো চিন্তাই নেই। যতক্ষণ ইচ্ছা সময় নিয়ে মজা করা যায়, স্পেসটা পুরাই নিজস্ব তাই অন‍্য কেউ এসে হস্তক্ষেপ করবে না, ইত‍্যাদি।
-হমম।
আচ্ছা পৃথা আজ তোমার কি কি ভালো লেগেছে অনুষ্ঠানে?
পৃথা এ কথার জবাবে একটা মলিন হাসি হাসলো। খুব বলতে ইচ্ছা করছিল যে স্বাধীনের জন‍্য ও কোনো মজাই করতে পারে নাই আজকে, কিন্তু সেটা আর বলতে পারলো না। অভিমানি মুখ নিয়ে পরে রইলো।
– কি হলো পৃথা? কি ভালো লেগেছে বললা না তো,
– আমার…. সব ভালো লেগেছে।
– ওওও।
কিছুক্ষণের জন‍্য নিরবতা বিরাজ করলো দুজনের মাঝে। তারপর হঠাৎ পৃথা জিজ্ঞেস করে বসলো স্বাধীনকে,
– আচ্ছা বলোতো, আজকে বউ ছাড়া, সব চাইতে বেশি কাকে সুন্দর লাগছিল অনুষ্ঠানে?
অবাক হয়ে ফিরে তাকালো স্বাধীন,
– এটা কেমন প্রশ্ন হলো, আমি কি সব মেয়েদের দিকে তাকিয়েছি নাকি? আমি কেমনে বলবো কাকে বেশি সুন্দর লাগছিল?
স্বাধীনের উত্তরে পৃথা বুঝলো যে ও আসলেই বোকার মতন প্রশ্ন করে ফেলেছে। তবে তার সাথে রাগও উঠলো কিছুটা। নিজে নিজেই বিড়বিড় করে সেই রাগ ঝাড়লো,
– অন‍্য কাউকে আর কি দেখবা, নিজের বউকেই তো দেখো নাই ভালো করে। হুহ!
– কিছু বললা পৃথা?
– হমম? না না, কিছু না। আচ্ছা আমি অনেক টায়ার্ড ফিল করছি। এখন ঘুমাতে যাব। কাল নাকি সকাল থেকেই কি কি কাজ আছে, সেগুলো তে থাকতে হবে, বলে দিয়েছেন চাচি।
– চাচি? চাচি কে?
– রোজি আন্টি। আমাকে তিনি বলেছেন ওনাকে ‘চাচি’ ডাকতে।
-ওহহো! এইটা তো ইনজাস্টিস। আমি সারা জীবন তাকে আন্টি ডাকলাম, তুমি কিভাবে তাকে চাচি ডাকার অনুমতি পেলা?
নিজের চুল পেছন ধাক্কা দিয়ে একটা ভারিক্কি ভাব আনলো চেহারায় পৃথা,
– This is my charm dear. huh!
অভিমানি হাসি দিল স্বাধীন এর উত্তরে। তারপর পৃথার পেছন পেছন রুমের ভেতরে গেল।
খাটে আজ পৃথা ইচ্ছা করেই দুজনের মাঝে কোল বালিশ দিয়েছে। গতরাতে ও স্বাধীনের মুখে ওর কান্ডকালাপ যা শুনেছে তারপর থেকে লজ্জার মাত্রা কয়েক গুণ বেড়ে গেছে ওর। তবে এই বালিশটা মাঝখানে দেওয়ার পেছনের মূল কারণটা অন‍্য। পৃথা এই মুহূর্তে স্বাধীনের ওপর ভীষণ অভিমান করে পরে আছে। তাই স্বাধীনের কাছে আসতে চায় না ও।
বালিশটা দেখে স্বাধীন একটু অবাক হলো,
– আজ মাঝে বালিশ কেন?
– এমনেই।
– এমনেই?
– হমম। আমার না ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। আমি শুয়ে পরলাম। গুড নাইট।
– গুড নাইট।
পৃথা আজও শুয়ে পরলো ওপাশ ঘুরে। স্বাধীন দেখে একটা স্মিত হাসি দিল। সেই হাসিতেই রহস‍্য লুকিয়ে ছিল। তবে সেটার খোলাসা এখন স্বাধীন করবে না। পৃথাকে করতে হবে সেটা। আর তার জন‍্য অপেক্ষায় থাকবে স্বাধীন।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here