#মালা_করনু_তারে_দান,পর্বঃ২০,২১
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২০
ঘরে বিনিকে খুঁজে না পেয়ে নিচতলায় নেমে এলো ইফরান। বসার ঘরে চোখ পড়তেই নজর আটকে গেলো। চেয়ারের হাতলে কনুই ঠেকিয়ে কাত হয়ে ঘুমাচ্ছে বিনি।
অফিসের জরুরি ফাইলপত্র দেখছিলো সে। শরীর ক্লান্ত থাকায় দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
বিনির ধারণা ইফরানের সম্পত্তি নিয়ে আগ্রহ কেবল মালিকানা আদায় পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে। এর পরেই খালাশ! অফিসের কোথায় কি হচ্ছে এই নিয়ে কোন মাথাব্যথা থাকবে না। তাই সে নিজে অফিস যাওয়া আসার মধ্যে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো। যাই হয়ে যাক না কেন, রাহেলা মির্জা ভরসা করে বিনির হাতে এই দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন। বিনি কোনভাবেই তাঁকে কোন দুশ্চিন্তায় ফেলতে চায় না।
নিচের ঘরে এসি নেই। বিনির কপালে, থুতনিতে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। খোপা ঢিলা হয়ে কিছু চুল সামনে ঝুলে আছে। পরনে হালকা ধূসর বর্ণের সুতি খাদি শাড়ি। চোখে পাওয়ারি চশমা।
ইফরান বেশ অবাক হলো। বিনি চশমা কবে নিয়েছে সে জানেই না। একটানা বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখ জ্বালাপোড়া করে। তাই কাজ করার সময় ডাক্তার বিনিকে চশমা ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন।
ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে চেয়ারের সামনে বসলো ইফরান। নিরব অনুরাগে বেশকিছুক্ষণ বিনির মুখের দিকে চেয়ে রইলো। যেই দায়িত্ব তাঁর নেওয়ার কথা ছিলো সেই দায়িত্ব বিনি মাথায় নিয়ে ঘুরছে। কাজের চাপে স্বাস্থ্য ভেঙ্গে একহারা হয়ে গেছে। অথচ মুখে কোন প্রতিবাদ নেই।
ইফরান সাবধানে ফাইলপত্র গুলো আলমারিতে ঢুকিয়ে রাখলো। সিলিং ফ্যানটা বন্ধ করে বিনিকে কোলে তুলে নিলো। নড়াচড়া হওয়ায় বিনি ঘুমের ঘোরে ‘চ’ দ্বিরুক্তি মূলক শব্দ করে উঠলো।
ইফরান তৎক্ষণাৎ পা চালানো থামিয়ে দিলো। ধৈর্য সহকারে বিনির ঘুম গাঢ় হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলো। তারপর ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে বিনিকে ঘরে শুইয়ে দিলো। খুব সাবধানে চোখ থেকে চশমাটা খুলে দিলো। এসি অন করে একটা পাতলা কাঁথা মেলে দিলো গায়ের ওপর।
দরজা বন্ধ করে বিনির পাশে এসে বসলো। বিনির অপূর্ব সুন্দর মুখশ্রীতে নজর পড়তেই দৃষ্টি মোলায়েম হয়ে এলো। সাদামাটা সুন্দরী!
কিন্তু এই মেয়েটাই তেজি,ধারালো এবং বুদ্ধিমত্তায় অতুলনীয়। দৃঢ়তায় তাঁর সঙ্গে পেরে উঠা কঠিন। ইফরান আগে কখনো এতটা গভীর ভাবে খেয়াল করে নি।
ধীরে ধীরে বিনির চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে আলতো করে চুমু খেলো কপালে। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
—‘আমি কেবল তোমাকেই নয়, নিজেকেও ভুল চিনেছি।’
★
রাত দুটোর দিকে ঠান্ডায় বিনির ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ঘুম ভাঙতেই আশেপাশে তাকিয়ে নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করলো সে। পাশে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় ফাইলপত্র দেখছে ইফরান। বিনির দৃষ্টি গাঢ় হয়ে গেলো। ইফরানকে এমন অবস্থায় দেখবে ভাবতে পারে নি। কোন শব্দ করলো না সে। নিরবে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ফের চোখ বন্ধ করে ফেললো। ক্লান্ত নিশ্বাস ফেলে মনে মনে প্রার্থনা করলো এবার যেন তাঁর মুক্তি মেলে।
ইফরানের ঘুম ভেঙ্গেছে সকাল সাড়ে আটটায়। অফিসের কাজ গুছিয়ে ভোর পাঁচটায় সময় শুয়েছে সে। এলার্ম বাজতেই ধড়মড় করে উঠে বসলো। হাই তুলে আশেপাশে চাইলো। বিনি মাত্র গোসল সেরে বেরিয়েছে। মাথায় ভেজা টাওয়েল প্যাঁচানো। সেটা বারান্দায় মেলে দিয়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে চুল আঁচড়াতে বসলো। ইফরান খাটে বসে একধ্যানে সেদিকে তাকিয়ে রইলো।
মনে মনে ভীষণ বিরক্ত হলো যে। কি হতো বিনির চুল থেকে সামান্য একটু পানি ঝরলে? সামান্য একটু পিঠ ভিজে গেলে?
ইফরান একটু যত্ন করে মুছে দিতে পারতো!
কেন বিনি সবসময় এমন পরিপাটি থাকে?
রান্না করতে গিয়ে কখনো পুড়িয়ে ফেলে না সে, মাছ কাটতে গিয়ে হাত কেটে ফেলে না, গোসল সেরে বেরোনোর পর ভেজা চুল থেকে পানি ঝরে না, তেলাপোকা দেখলে ভয়ে চিৎকার করে উঠে না। সব দিক থেকেই নিখুঁত। এমন হলে ইফরান বিনির কেয়ার করবে কি করে? ইফরান তো চায় বিনির কেয়ার করতে! এতদিন যত কষ্ট দিয়েছে সব ভুলিয়ে দিতে।
আয়নার ভেতর দিয়ে একমনে বিনির দিকে চেয়ে রইলো সে। বিনি সেটা লক্ষ্য করলেও তাঁর চেহারা প্রতিক্রিয়াবিহীন।
চুল আঁচড়ানো শেষে নাশতা রেডি করতে বেরিয়ে গেলো। ইফরান ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কেন যে আরো আগে মানুষ হলো না সে?
আড়মোড়া ভেঙ্গে দ্রুত ফ্রেশ হতে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখলো বিছানা চাদরপরিপাটি। বিনি গুছিয়ে দিয়ে গেছে। ইফরান রীতিমত অবাক না হয়ে পারলো না। বিনির এতকিছু কি করে মনে রাখে?
★
নাশতার টেবিলে বসে উশখুশ করলো ইফরান। রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো বিনি উল্টো দিকে মুখ করে পরোটা সেঁকছে। টেবিলে পরোটা, ডিমভাজি আর ফ্রুট সালাদ দেওয়া হয়েছে। ডিম, সালাদ, ফ্রুটস একটাও পছন্দ না তাঁর। ডিমে এলার্জি আর ফ্রুট সালাদ বরাবরই অপ্রিয়।
বিনি রাহেলা মির্জার জন্য নাশতা রেডি করতে এসেছিলো। টেবিলের কাছে এসে দেখলো ইফরান বসে বসে শুকনো পরোটা চিবুচ্ছে। মুখ কালো। সামনে হটপট। সেটা খুলে দেখার মতন ধৈর্য বা বুদ্ধি তাঁর নেই!
বিনি মনে মনে বিরক্ত হলেও গম্ভীরমুখে হটপটের ঢাকনা খুলে তাঁর সামনে ঠেলে দিলো। ভেতরে গরুর মাংস দেখে ইফরানের খাওয়া অটোমেটিক থেমে গেলো! সে খেয়ালই করে নি টেবিলে আরো একটা বাটি আছে! অপ্রস্তুত চেহারা নিয়ে বিনির দিকে চেয়ে রইলো। বিনি নির্বিকার। মিনুকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—‘মায়ের খাবারটা উপরে দিয়ে আসো।’
তারপর চুপচাপ রান্নাঘরে ফিরে গেলো। ইফরান লজ্জা পেলেও মনে মনে খুশি হলো। বিনির এখনো তাঁর খাবারের দিকে খেয়াল আছে! এই বা কম কিসে?
★
নিয়মিত অফিসে আসা যাওয়া করছে ইফরান। সুযোগ পেলে বিনিও যাচ্ছে। প্রয়োজনীয় কাজ সেরে আবার চলে আসে।
তোফায়েল সিনহা যাতে ফাঁক পেয়ে ইফরানের ভেতরে ঢুকতে না পারে সেদিকে বিশেষভাবে নজর রাখছে। রাহেলা মির্জা বারবার সতর্ক করে দিয়েছেন ইফরান এখনো অফিসে নতুন। ব্যবসার হালচাল রীতিনীতি বুঝে উঠার জন্য তাঁর কিছু সময়ের প্রয়োজন। এই সময়েটাতে যাতে তোফায়েল সিনহা কোনভাবেই ইফরানের আশেপাশে ঘেঁষতে না পারে। এই লোক ভয়ানক কুটিল। দেখা যাবে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে ইফরানের কাছ থেকে ডিলটা হাতিয়ে নিয়েছে।
তাই তোফায়েল সিনহার সঙ্গে কোন ধরণের মিটিং হলে ইফরানের সঙ্গে তৌহিদার পরিবর্তে বিনি উপস্থিত থাকে। ইফরান মনে মনে খুশি হয়। উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন বিনি তো কাছাকাছি থাকছে!
অফিসে, বাড়িতে কাজের ফাঁকে ফাঁকে তাঁর সঙ্গে টুকটাক কথা বলার চেষ্টা করে সে। কিন্তু বিনি কথা বলে না। খুব বেশি প্রয়োজন হলে ভাববাচ্যে প্রকাশ করে।
ইফরান ভেতরে ভেতরে অধৈর্য বোধ করে। বিনির উপেক্ষা সে নিতে পারে না। বুকের ভেতর জ্বালাপোড়া করে। আফসোস আর হাহাকারে চোখ ভিজে উঠে।
তথাপি মুখফুটে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হয় না। পাছে যদি এটুকুও না থাকে? শান্ত মানুষের শান্ত রাগটা বড় মারাত্মক! সহজে ভাঙ্গানো যায় না। কিছু জিজ্ঞেস করলে যদি বিনি বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা বলে ফেলে? তখন ইফরান কি করবে? কি করে তাঁকে আটকাবে? বিনি তো আর পাঁচজনের মতন নয়। সে স্থির, অবিচল। তাঁর কথায় ওজন আছে। একবার কোনকিছু ঠিক করে নিলে তাঁকে আর ফেরানো যাবে না। তাই ইফরান ভয়ে কিছু বলে না।
তবে এতসব দুশ্চিন্তা এবং হতাশার মাঝেও বিনির দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা জারি রেখেছে সে। উদ্দেশ্য পুরোনো বিনিকে ফিরে পাওয়া। কখনো অফিসে যাওয়ার সময় ঘড়ি খোঁজার বাহানায়, কখনো বিকেলবেলা কফি খাওয়ার বাহানায় কখনো বা ফাইলপত্র হারানোর বাহানায় বিনির সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা বলে। আলমারির জিনিসপত্র ইচ্ছে করেই অগোছালো করে রাখে। সে চায় বিনি কিছু বলুক। আগের মতন শাসন করুক।
কিন্তু বিনি নির্বিকার। সব বুঝেও যেন কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। মূলত ইফরান কতদিন এই ধৈর্যশক্তির খেলা চালিয়ে যেতে পারে বিনি দেখতে চায়। যেই মানুষ অনায়াসে আরেকজনকে নির্দয়ভাবে আঘাত করতে পারে তাঁর নিজের সহ্যক্ষমতা কতটুকু সে জানতে চায়।
#মালা_করনু_তারে_দান
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২১
স্বচ্ছ কাঁচের দেওয়াল পেরিয়ে বিনির মুখাবয়ব স্পষ্ট দেখতে পারছে ইফরান। তৌহিদার সঙ্গে কিছু একটা নিয়ে খুব জরুরি আলাপ করছে। মুখের ভাব গম্ভীর।
ইফরান একদৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে আছে। বিনির কথা বলার ভঙ্গি, ধীরস্থির মুখাবয়ব, গাঢ়, সংযত চাহনি সবকিছুতেই যেন অনির্বচনীয় বুদ্ধিমত্তার ছাপ। নিজেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপে ভাঙ্গে বিনি,আবার নিখুঁত ভাবে গড়ে। ইফরান যত দেখে তত অবাক হয়।
ইফরানের পাশে রাকা বসে আছে। অফিসে ঢোকার সময় বিনির মুখোমুখি পড়েছিলো সে। বিনি তাঁকে কফি খাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলো। সেটাকে উপেক্ষা করে পাশ কাটিয়ে চলে এসেছে সে। খুব একটা আন্তরিকতা দেখানোর প্রয়োজন বোধ করে নি।
রাকার সঙ্গে বিনির দেখা হয়েছিলো বড়জোর দুতিনবার। এই দুই তিনবারে খুব বেশি ফ্রি হতে পারে নি রাকা। যতবার কথা বিনির সঙ্গে কথা হয়েছে অদ্ভুত এক জড়তা, ভয় এসে উপস্থিত হয়েছে মনের মধ্যে। সবার মুখে বিনির ব্যক্তিত্বের এত প্রশংসা শুনেছিলো যে কোথাও না কোথাও সে নিজের মধ্যে ঘাটতি, হীনমন্যতা বোধ অনুভব করতে শুরু করলো। তবে সেটা কখনো মুখে প্রকাশ হতে দেয় নি।
দুর্বল মানুষ ব্যক্তিত্বকে বরাবরই ভয় পায়, ঈর্ষা করে।নিজের মধ্যে সেটা ধারণ করতে না পারলে অপরজনের টাও সহ্য করতে পারে না। রাকার মনের অবস্থাটাও ঠিক সেরকম। সে নিজে বিনির মত হতে পারবে না জেনে বিনিকে সাধারণের কাতারে দেখতে চাইছিলো। মনে মনে প্রত্যাশা করছিলো বিনিও তাঁর মত নিজের অবস্থান নিয়ে বিব্রত বোধ করুক, ইনফিরিওরিটি ফিল করুক,সবার কাছে অতি সাধারণ, সহজলভ্য হয়ে উঠুক। এভাবেই রাকার নিজের মধ্যে অনুভূত কমতিটুকু আস্তে আস্তে ঈর্ষায় রূপ নিলো।
বিনির চেহারায় আফসোস, বিব্রতভাব দেখার জন্যই যেন ইফরানের সঙ্গে আজকে একটু বেশি মাখামাখি দেখানোর চেষ্টা করলো।
বিনিকে বাইরে দাঁড়ানো দেখে ইফরানের পাশে ঘেঁষে বসলো। মুচকি হেসে ইফরানের সঙ্গে কফি খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলো। বিনিকে বিশেষ পাত্তা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না। যেই মেয়ের নিজের স্বামীর প্রতিই অধিকারবোধ নেই তাঁর সঙ্গে এত নমনম করার কি প্রয়োজন? অফিসে আর পাঁচজন সাধারণ কর্মচারীদের মত তাকেও ইফরানের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হয়। কাজ করার জন্য কর্মচারীদের সঙ্গে রুম শেয়ার করতে হয়। ইফরানের রুমে আসতে হলে পারমিশন নিতে হয়। এর চাইতে আফসোসের আর কি হতে পারে? মনে আত্মতৃপ্তি বোধ করলো রাকা।
অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে সে। কথাবার্তার অধিকাংশই ম্যানেজারের জন্য সুপারিশের নিমিত্তে। এককালীন কিছু টাকা আর তিনমাসের এক্সট্রা বেতন সমেত ম্যানজারকে চাকরি থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছে ইফরান।
এতদিনে সে ভালো করে বুঝে গেছে ম্যানেজারের লোকটি মোটেও সুবিধার নয়। তাঁর আসল উদ্দেশ্য টাকা পয়সা আত্মসাৎ। বিনির সঙ্গে ইফরানের ঝামেলা সৃষ্টি করার জন্যেও জোর প্রয়াস চালিয়েছে সে। কারণটা ঠিক ইফরান জানে না। জানতে চায় ও না। যত তাড়াতাড়ি আপদ বিদায় করা যায় ততই ভালো। তাই বয়সের অযুহাত দিয়ে কৌশলে অফিস থেকে সরিয়ে দিয়েছে।
রাকার সঙ্গে ইফরানের বন্ধুত্ব অনেক দিনের। ম্যানেজার অফিসের জয়েন করার একেবারে শুরু দিক থেকে। সেই সুবাদে মামার জন্য সুপারিশ করতে এসেছে রাকা। আসার পর থেকে লাগাতর সাফাই গেয়ে যাচ্ছে। ইফরান এসব শুনছে না। তাঁর দৃষ্টি বিনির দিকে। বিনি একবারও এদিকে তাকায় নি। রাকাকে ভেতরে ঢুকতে দেখার পরেও তাঁর মধ্যে কোনরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায় নি। যেটা ইফরানকে মনে মনে অস্থির করে তুলেছে।
সে মনে প্রাণে চাইছে বিনি একবার এদিকে তাকাক। ইফরানের ওপর রাগ দেখাক। অভিমান করুক।
রাকা ইফরানের হাতের ওপর হাত রেখেছে। বিনীত গলায় ম্যানেজারের হয়ে অনুরোধ করছে,
—‘মামার যদি কোন ভুল হয়ে থাকে তবে তাঁর হয়ে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। তুমি প্লিজ তাঁকে কাজে ফিরিয়ে নাও। তিনি ভীষণ ডিপ্রেশড হয়ে আছেন। কারো সঙ্গে ঠিকমত কথাবার্তা বলছেন না।’
জবাবে ইফরান কিছু বলার জন্য মুখ খুলছিলো তাঁর আগেই বিনির সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেলো। কথা বলতে বলতে এদিকে তাকিয়েছে বিনি! ইফরান থেমে গেলো! মনের মধ্যে আশার সঞ্চার হলো। রাকার হাত এখনো তাঁর হাতের ওপর! ভয়ে বুক দুরুদুরু করে উঠলো। এবার নিশ্চয়ই বিনির চোখে পুরোনো অধিকারবোধ দেখতে পাবে সে! বিনি নিশ্চয়ই তাঁর সঙ্গে রাকাকে দেখে গাঢ় অভিমানে ঠোঁট বাঁকাবে? নইলে রাগে চোখমুখ লাল করে ফেলবে?
কিন্তু বিনি এসবের কিছুই করলো না। কথা বলতে বলতেই আবার দৃষ্টি সরিয়ে নিলো সে। তৌহিদাকে কাগজপত্র বুঝিয়ে দিয়ে শান্তভাবে ভেতরে ঢুকে গেলো।
ইফরান হতাশ হলো। মনের মধ্যে ক্লেশ অনুভব করলো। আশাহত চেহারা নিয়ে নিজেই রাকার হাতের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিলো। সামান্য সরে বসলো। গম্ভীর গলায় রাকাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—‘আমার এখন কিছু ভালো লাগছে না। আমি ভেবেচিন্তে পরে তোমাকে জানাবো।’
ইফরান চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। বিনির উপেক্ষা সে আর নিতে পারছে না। প্রতিমুহূর্তে এই উপেক্ষা তাঁর সুখ, শান্তি, আশাভরসা সব কেড়ে নিচ্ছে। অসহায়, অর্থহীন লাগছে নিজেকে। রাকা গেলো না। ইফরানের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য জোর চেষ্টা চালিয়ে গেলো। ইফরান শুধু তাঁর কথায় হু হা করে গেলো।
★
রাকার কথা শেষ হয় নি। ইফরানের মত মনোযোগী শ্রোতা পেয়ে কথা বলার আগ্রহ বেড়ে গেছে।
ইফরানের ভালো লাগছিলো না। বিধ্বস্ত লাগছিলো নিজেকে। অশান্ত মনটা বিনিকে খুব করে চাইছিলো। আগের সেই পুরাতন বিনিকে! সেই স্নেহময়ী, নিখুঁতভাবে ভালোবাসতে পারা বিনিকে।
সেই বিনিকে আদৌ আর কোনদিন ফিরে পাবে কিনা ইফরান জানে না। তবে বারবার মনে হচ্ছিলো এই অশান্ত মনকে অন্যদিকে বিক্ষিপ্ত করা না গেলে বিনির চিন্তায় চিন্তায় পাগল হয়ে যাবে সে। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়েই রাকার কথায় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলো।
এদিকে রাকা তো আর তাঁর এই ভগ্ন হৃদয়ের খবর জানে না! সে মনে মনে ইফরানের মনোযোগ পেয়েছে ভেবে উচ্ছ্বাসিত বোধ করলো।
তাঁর ধারণা বিনির প্রতি এখনো কোন আগ্রহ তৈরী হয় নি ইফরানের! নইলে এতক্ষণ তাঁর সঙ্গে বসে গল্প করবে কেন ইফরান? এসব ভাবতেই ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। দ্বিগুণ উদ্যমে একের পর এক নতুন গল্প জুড়ে দিলো।
তাঁর গল্পের মাঝঝানেই তৌহিদা এসে দরজায় নক করলো। সামান্য হেসে ভেতরে ঢোকার অনুমতি চাইলো,
—‘আসবো স্যার?’
রাকা থেমে গেলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে চাইলো। ইফরান হাত ইশারায় তৌহিদাকে ভেতরে ঢুকার নির্দেশ দিয়ে বললো,
—‘আসুন।’
—‘আপনাকে ম্যাম ডাকছে স্যার। একবার তাঁর রুমে যেতে হবে।’
ইফরান প্রথমে ঠিক বিশ্বাস করতে পারলো না বিনি তাঁকে ডাকছে। চোখেমুখে অবিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন করলো সে,
—‘কে? কে ডাকছে?’
—‘জি, বিনি ম্যাম।’
তৌহিদার কথা শুনে ইফরান চুপ হয়ে গেলো। শান্ত হয়ে নিজেকে স্থির হওয়ার সময় দিলো কিছুক্ষণ। তারপর বহু কষ্টে ভেতরের উচ্ছ্বাস গোপন করে বললো,
—‘আসছি আমি। আপনি যান।’
রাকার সঙ্গে আলোচনার সমাপ্তি টেনে নিলো ইফরান। হাতের ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে রাকাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—‘তোমার সঙ্গে এই ব্যাপারে পরে আলাপ হবে। এখন আগে বিনির সঙ্গে দেখা করা প্রয়োজন।’
একপ্রকার তাড়াহুড়ো করেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো ইফরান। রাকা মৌনমুখে বসে রইলো। ইফরানের এই মুহূর্তের আগ্রহ, উচ্ছ্বাস দেখে পূর্বের ভুল ধারণা ভেঙ্গে গিয়েছে তাঁর। ইফরানকে সে ভুল চিনেছে। বাস্তবিকই ভুল চিনেছে। আর বিনিকে?
বিনি তো বরাবরই আলাদা! ইফরানের প্রতি রাকার মনোভাব সে ঠিকই বুঝতে পেরে গেছে। তাইতো মুখে কিছু না বললে কাজের মাধ্যমে রাকাকে ঠিক বুঝিয়ে দিয়েছে ইফরানের ওপর তাঁর কতখানি ক্ষমতা। চাইলেই সে কত অনায়াসেই নিজের ক্ষমতা জাহির করতে পারে!
বিনি চাইলে নিজেই ইফরানের রুমে যেতে পারতো। কিংবা তৌহিদার মারফতে আলাপ আলোচনা সেরে নিতে পারতো। কিন্তু তাতে করে রাকার ভুল ধারণাটা ভাঙতো না। রাকা ভেবেছিলো সম্পর্ক ধরে রাখার আগ্রহ কেবল বিনির মধ্যেই আছে। ইফরান নিঃস্পৃহ। বিনিকে সে চায় না। তাই তাঁকে সত্যিটা দেখিয়ে দিতে দেরী করলো না বিনি।
তাছাড়া বিনি বোকা নয়। ইফরানের ওপর তাঁর যতই রাগ থাকুক না কেন রাকাকে সে কোন সুযোগ নিতে দিলো না। কারণ সম্পর্কের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তিকে ঢুকতে দেওয়ার মত বড় বোকামি আর কিছু হতে পারে না।
★
ইফরান গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বিনির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ভালো লাগছে বিনিকে দেখতে। বিনি আজকে হলুদ সাদা সুতি শাড়ি পরে এসেছে। বেশ মানিয়েছে। একটুখানি ছুঁয়ে দিতে মন চাইছে। কিন্তু বিনির রিয়েকশন কি হতে পারে ভেবে ভয়ে সাহস করলো না।
বিনি ডিলের কাগজপত্র এক এক করে ফাইলে গুছিয়ে রাখছে আর ইফরানকে তার বিবরণ বুঝিয়ে দিচ্ছে। প্রয়োজনের সময় তাহলে আর খুঁজে পেতে অসুবিধে হবে না।
এদিকে বিনির উপস্থিতিতে এসব ফাইল পত্রের প্রতি আকর্ষণ বোধ করলো না ইফরান। ভাবলেশহীন ভাবে বললো,
—‘এসব তোমার কাছে রাখলেই তো পারো। আমি কখন হারিয়ে ফেলি তাঁর কোন ঠিক আছে?’
—‘ডিল অনুযায়ী অর্ডারের কাজ শুরু হয়ে গেছে। উপরস্তর থেকে সরকারী কর্মকর্তারা পরিদর্শনে বেরোলে সবার আগে কম্পানীর মালিকের খোঁজ করবে। তখন এই ফাইলগুলো লাগবে।’
—‘তো তোমার কাছে রাখলে ক্ষতি কি?’
—‘বললাম তো এগুলো মালিকের কাছে রাখার মতন ফাইলপত্র।’
—‘তুমি মালিক নও?’
ইফরান ভেবেছিলো বিনির কাছ থেকে খানিকটা অভিমানী জবাব শুনবে। কিন্তু বিনি তাঁকে অবাক করে দিয়ে একেবারে কাটাকাটা জবাব দিলো,
—‘না।’
—‘তবে কি?’
—‘আপাতত কর্মচারী। তোমাকে সব বুঝিয়ে দিতে পারলে আমার দায়িত্ব শেষ।’
—‘বাহ! আজকাল কর্মচারীরাও তাহলে বসদের রুমে ডাকায়? ভালো। নতুন কিছু শিখলাম।’
ইফরানের কন্ঠে কৌতুক। চোখেমুখে হাসি। বিনিকে বিব্রত করার প্রয়াস। বিনি জবাব দিতে পারলো না। অস্বস্তি ঠেকাতে তাড়াহুড়ো করে ফাইলপত্র গুছানোয় মনোযোগ দিলো। ইফরান চট করে তাঁর হাত থেকে ফাইলটা টেনে নিয়ে পেছনে লুকিয়ে ফেললো। বিনির বিস্মিত চাহনির বিপরীতে তাঁর একেবারে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
—‘অধিকার যখন দেখাবে তখন পুরোটাই দেখাও না। আমি তো অধীর হয়ে বসে আছি তোমাকে আমার হৃদয় সিংহাসনের রানী হিসেবে দেখবো বলে। তুমি চাইলে আমি সব ছেড়ে দেবো।’
ইফরানের কন্ঠে আবেগ, আকুতি। মায়াভরা চাহনি নিয়ে বিনির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। বিনির মন মস্তিষ্কের লড়াই শুরু হয়ে গেছে। তবে মনকে জয়ী হতে দিলো না সে। আত্মসংবরণ করে নিয়ে বললো,
—‘আমি কাগজপত্র নিয়ে মিটিং রুমে আসছি। সেখানেই বাকি আলাপ আলোচনা হবে।’
ইফরান হতাশ চোখে চেয়ে রইলো। বিনি কি কোনদিন তাঁকে মাফ করবে না! এত কঠিন সে কি করে হতে পারছে? অসহায়, ছোট শিশুদের মত করুণ মুখ করে বিনির দিকে চেয়ে রইলো। বিনি সেদিকে পাত্তা দিলো না। কাগজ পত্র নিয়ে মিটিং রুমের দিকে পা বাড়ালো।