কাব্যের_বিহঙ্গিনী #পর্ব_৭ #লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

0
778

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৭
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

“আমার কেউ নেই ‘ কতো ছোট্ট একটা বাক্য তাইনা। কিন্তু এই কথাটা বলতে কতটা শক্তি প্রয়োজন হয় সেটা কি আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে? সারা শরীরের সব শক্তি একত্রিত করে তারপর বলতে হয় ‘আমার কেউ নেই!”

ফেসবুকের সাদা স্কিনে লেখাটা জ্বলজ্বল করছে। পোস্ট টা পাচ মিনিট আগেই করা হয়েছে “কাব্যের বিহঙ্গিনী” পেজ থেকে। কতোশত স্যাড রিয়াক্ট আর কমেন্ট এর ছড়াছড়ি। বিহঙ্গিনী পেজের মেয়েটার কি হয়েছে সবাই জানতে চাইছে। কিন্তু এই কমেন্টের কোন রিপ্লাই আসবে না সেটাও সবাই জানে। মুখর পোস্ট টা দেখা মাত্রই কমেন্ট এ কিছু লিখতে নিল কিন্তু লিখে আবার মুছে ফেললো। চোখগুলো জ্বলতে লাগলো হয়তো পানিগুলো জমা হচ্ছে চোখে। তখনি আরবাজ এলো ওর রুমে। ফোন হাতে ওর চোখেও পানি ছলছল করছে। হয়তো কিছু হয়েছে কিনা এটা জানার জন্য নাকি তাঁদের কোন কাজে সে কষ্ট পেয়েছে এটা বলার জন্য।

_____________

সবেই চোখ বন্ধ করেছে মেহবিন এমন সময় একটা নোটিফিকেশন এলো। মোবাইল টা হাতে ধরতেই দেখলো ‘বিহঙ্গিনীর কাব্য’ আইডি থেকে নতুন পোস্ট হয়েছে।

“কতো সহজে ‘আমার কেউ নেই’ এই কঠিন কথাটা বলে দিল সে। কিন্তু সে কি জানে না অপ্রকাশিত সবার সামনে হলেও একজন তাকে অসম্ভব ভালোবাসে।”

মেহবিন মুচকি হেসে কমেন্ট লিখলো,,

‘অসম্ভব ভালোবাসে দেখেই তো বোধহয় সঙ্গটাও অসম্ভব হয়ে পরেছে।”

‘সে কি জানে? তার পরিপূর্ণ সঙ্গ পাওয়ার জন্য কেউ অতন্দ্র প্রহরীর মতো অপেক্ষা করে আছে।”

“বিহঙ্গিনীর সাথে সন্ধিও যেমন জরুরি ছিল সাথে বিচ্ছেদ ও বোধহয় জরুরি ছিল।”

“এই বিচ্ছেদ কি তার মনকে বিষাদে ভরে দু চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়ায়?”

“উঁহু,,
আমি বিষাদ নিয়েছি কিন্তু অশ্রু নয়!
আমি সম্পর্ক গড়েছি কিন্তু সঙ্গ নয়!
সবশেষে আমি বিচ্ছেদ নিয়েছি
তবে একেবারে সম্পর্ক ছিন্ন করে নয়।”

ওপাশ থেকে অনেকক্ষন কোন রিপ্লাই আসলো না। তা দেখে মেহবিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুমানোর চেষ্টা করলো কিন্তু ঘুম আসলো না । মনে পরলো ইয়ারফোন টা ব্যাগে রয়েছে একটু সূরা শোনা যাক। মেহবিন উঠে ব্যাগে হাত দিতেই দু’টো ফুল দেখতে পেল তার সাথে একটা চিরকুট। মেহবিন ফুল দু’টো বের করে চিরকুট টা খুলল তাতে লেখা,,

“ফুল কে ফুল না দিতে পারার কষ্ট হলেও পরে তা প্রশমিত হলো। কথা ছিল প্রতিটা সাক্ষাতেই ফুল দিতে হবে। কিন্তু আজ আর হাতে দেওয়া হলো না। তাই ব্যাগে রেখে দিলাম। তোমার জীবন ফুলের মতোই কোমল হোক।”

মেহবিন হাসলো মুহুর্তেই মনটা ভালো হয়ে গেল। তারপর ইয়ারফোনটা নিয়ে বিছানায় এলো সূরা রহমান ছেড়ে ইয়ারফোন কানে গুজলো। এক সময় ঘুমিয়েও পরলো।

__________________

প্রতিটা দিনের মতো আজ ও সকাল হলো। কিন্তু মেহবিনের কিছু ভালো লাগছে না।
আজ শনিবার আজ ও তার ডিউটি নেই। ফজরের নামাজ পড়ে আবার শুয়ে রইলো। ঘুম ও আসছে না কিছু ভালোও লাগছে না হুট করেই মনটা অশান্ত হয়ে আছে। খাওয়ার জন্য কিছু বানাবে তাও ভালো লাগছে না। সকাল আটটা বাজে এমন সময় কেউ ওকে ডাকছে। কি আর করার বাইরে বের হলো বারান্দার কেচিগেইট এর তালা খুলে দেখলো একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। তা দেখে মেহবিন বলল,,

“কিছু বলবেন?”

“হ ”

“জি বলুন?”

“তোমার তো ফ্রিরিজ আছে তাই না। আমার এই দুধটুকু রাখবা দুইদিন পর নিয়া যামুনে।”

“আচ্ছা রেখে যান। তবে হ্যা আমি কিন্তু সারাদিন বাড়ি থাকবো না। সকাল আটটার আগে না হয় সন্ধ্যায় নিতে হবে যেদিনই নেন।”

“আইচ্ছা।”

মেহবিন ওনার হাত থেকে দুই লিটারের বোতল টা রেখে দিল। ক্ষুদাও লেগেছে রাতে আর খায় নি সে। দুপুরের খাবার গুলো এখনও আছে ফ্রিজে । কিন্তু এখন খেতে ইচ্ছে করছে না। রান্নাঘরে গিয়ে কাপ নুডুলস বের করলো একটু গরম পানি করে নুডুলস বানিয়ে নিল। ঘরে গিয়ে বাবু হয়ে বসে খেতে লাগল। খাওয়া দাওয়া শেষ করে। একটা টুল নিয়ে রোদে বসে রইলো। বেশ শীত করছে তার। রোদে বসে বসে নানান জিনিস ভাবছে সে। তখন ওর ফোনটা বেজে উঠলো কালকের আন নোন নাম্বার থেকে মানে চেয়ারম্যান সাহেব। ও ফোন কানে ধরে সালাম দিল,,

“আসসালামু আলাইকুম!”

“ওয়ালাইকুমুস সালাম।”

“তো কি বলার জন্য ফোন দিয়েছেন?”

“আজকে যদি আপনাকে দাওয়াত দিই আপনি কি গ্ৰহন করবেন?”

“আপনার কি মনে হয় না আপনাদের সাথে আমার যোগাযোগ টা বেশী অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাচ্ছে। এতো তাড়াতাড়ি এতো ফ্রি হওয়া ঠিক নয়। মিশু না হয় অসুস্থ আপনি তো নন।”

“আমার মেয়েটা চাইছে বলেই তো!”

“সবসময় সব ইচ্ছে কে প্রশ্রয় দিতে নেই চেয়ারম্যান সাহেব।”

“যে কখনো ইচ্ছে করে না সেই যদি কিছু ইচ্ছে করে তবে তা করা উচিৎ নয় কি?”

“সেটা আপনাদের পারিবারিক বিষয় আমাকে জরাচ্ছেন কেন?’

“আপনি না চাইলেও তো জরিয়ে যাচ্ছেন। আপনি দাওয়াত টা রাখবেন কি না।”

“আপাতত আমি আজ কোথাও যেতে চাচ্ছি না। সবথেকে বড় কথা দাওয়াত টা কি উপলক্ষে?”

“তেমন কোন উপলক্ষ নেই আজ বাবা আই মিন মিশুর দাদু বাড়ি ফিরছেন।”

“ওহ আচ্ছা। দুঃখিত আপনার দাওয়াত গ্ৰহন করতে পারছি না। আর সবকিছুতে আমাকে জড়ানো বন্ধ করুন। কাল আপনারাই পারতেন মিশুকে শান্ত করতে হুদাই আমাকে নিলেন। আজকে আমাকে ফোন না করলেও পারতেন নিজেদের মতো দিনটা উদযাপন করতে পারতেন। আপনাদের পারিবারিক বিষয়ে আমাকে টানবেন না প্লিজ।”

“কালকে আরিফা ঐ কথাটা বলেছে বলে এমন করছেন ডাক্তার?”

“না আমি শুধু সত্যি কথা বলছি।”

“আপনি জানতে চাইছিলেন না অনু কে?”

“হুম চেয়েছিলাম কারন তার কথা জানতে পারলে হয়তো মিশুর ব্যাপারে আমি আরেকটু সাহায্য করতে পারতাম। তবে এখন মনে হচ্ছে আপনাদের পারিবারিক বিষয়ে না জড়ানোই উত্তম। এক সপ্তাহ হয় নি আমি এখানে এসেছি। চেয়ারম্যান বাড়ির সাথে এতো সখ্যতা নিশ্চয়ই ভালো চোখে দেখবে না মানুষ।”

“আপনি মানুষের কথা ভেবে চলেন ডাক্তার।”

“আমি আমার কথা বলছি না চেয়ারম্যান সাহেব। আমি আপনাদের কথা বলছি স্পেশালি আপনার কথা বলছি। আপনি চেয়ারম্যান মানুষ আপনার একটা সম্মান আছে।”

“এতো সম্মান দিয়ে কি হবে? যদি নিজের মানুষদেরই খুশি রাখতে না পারি। এতো সম্পদ এতো সম্মান আমার , কিন্তু মানুষের এতো সম্মানের পরেও আমার মেয়ের খেতাব চেয়ারম্যানের পাগল মাইয়া। আপনাকে জড়াই কারন আমার মেয়ের আপনি পছন্দ, তার বন্ধু আপনি। তাই আমি আমার মেয়েকে খুশি রাখতে আপনার সাথে সখ্যতা গড়ছি। লোকে কি বলল তাতে আমার কিছু যায় আসে না।”

“আপনি খুব স্বার্থপর একজন মানুষ। আপনি আপনার মেয়ের ভালোর জন্য আমাকে ব্যবহার করছেন চেয়ারম্যান সাহেব।”

“তেমন টা নয় আপনি ভুল বুঝছেন।”

“আপনাকে নতুন করে আমায় বুঝতে হবে না চেয়ারম্যান সাহেব।”

“মিশু ঘুম থেকে উঠেই আপনার কথা বলছিল তাই ফোন দিয়েছিলাম।”

“তাকে সামলান চেয়ারম্যান সাহেব যদি আমি একবার শক্ত করে ওর হাত ধরে তাকে সবসময় সামলানোর দায়িত্ব নিই। নাহলে কিন্তু আপনার পরিবারের জন্য খারাপ হয়ে যাবে। কারন আমি এর শেষ দেখে ছাড়বো।”

“আমি তো চাই আপনি ওর হাত ধরুন ডাক্তার।”

“কিন্তু আমি চাই না চেয়ারম্যান সাহেব। আমি আপনাদের ঐ চেয়ারম্যান বাড়ির ত্রী সীমানায় যেতে চাই না। কিন্তু ভাগ্য কি আমার প্রথম দিন থেকেই ও বাড়ির সাথে জুড়ে গেছে।”

‘ডাক্তার প্লিজ!”

“অনু কে চেয়ারম্যান সাহেব?”

ওপাশ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল। তারপর আবার শোনা গেল,,

“মিশুর হাজবেন্ড অনু মানে অনুভব খান। যে চার বছর আগে এক্সিডেন্ট এ মারা গেছে। এবং ঐ এক্সিডেন্টের পরেই মিশুর এই অবস্থা। মিশু এরকম ছিল না সে একজন শিক্ষিতা পড়াশোনা শেষ করা বুদ্ধিমতী মেয়ে ছিল। কিন্তু একটা এক্সিডেন্ট সব এলোমেলো করে দিল।”

“তার এক্সিডেন্ট কিভাবে হয়েছিল আর সেদিন কি মিশু সাথে ছিল?”

“জানিনা কিভাবে হয়েছিল কিন্তু মিশু অনুভবের সাথেই ছিল।”

“কাল কেন এসব বললেন না আমায়?”

“এতো বছর পর অনুভবের কথা শুনে একটু চমকে গিয়েছিলাম। আর মিশুও তিন বছর যাবত অনুভবের নাম নেয় নি কালকেই নিয়েছিল তাই একটু থমকে গিয়েছিলাম। তারপর যে বলবো আপনার আর আরিফার মাঝে একটা কথাকাটাকাটি হলো তারপর তো আপনি চলেই এলেন।”

“অনুভব কি মারা গেছে?”

“শুনেছি মারা গেছে কিন্তু দেখার সাহস হয় নি। ওর মুখটা রক্তে রাঙানো ছিলো। আমি ওকে খুব ভালবাসতাম ওকে ঐ অবস্থায় দেখার সাহস হয় নি।”

“ওহ আচ্ছা। রাখছি!

“আপনি কি মিশুর সাথে দেখা করতে আসবেন না।”

“আমায় হাসপাতালে যেতে হবে নওশি কে দেখতে।”

“সারাদিন কি ওখানেই পার করে দেবেন নাকি? বিকেলে আসিয়েন?”

“আমি যাবো না চেয়ারম্যান সাহেব। আপনার পরিবার থেকে যত দূরে থাকা যায় সেটাই ভালো।’

“আপনার কাছে কিছু চাই না শুধু একটা কথা চাই দেবেন?”

“কি?”

“আপনার বন্ধের দিনগুলো তে মিশুকে যাস্ট এক ঘন্টা করে সময় দেবেন। ও আপনার সাথে সময় কাটালে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে। আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি উনি বলেছে যার সাথে মিশু ফ্রি তার সাথে বেশি থাকতে। আপনার সাথে তো মিশু অনেকটাই ফ্রি আপনাকে বন্ধু ভাবে সে। শুধু এইটুকু করুন আমি আপনাকে আর কোনদিন ও কিছু বলবো না।”

“আমি পারবো না!”

“প্লিজ ডাক্তার!”

“আমি পারবো না চেয়ারম্যান সাহেব। দয়া করে যখন তখন আপনাদের প্রয়োজনে আমায় ফোন করবেন বা ডাকবেন না।”

বলেই মেহবিন ফোন রেখে দিল। এমনিতেই ওর ভালো লাগছে না তারওপর চেয়ারম্যান সাহেব এর কথাগুলো ওর মেজাজ হুট করেই গরম করে দিয়েছে। ও নিজেও জানে না ওর মেজাজ এতো গরম হচ্ছে কেন? ও রুমে এসে ফ্রিজ থেকে দশটার মতো বড় চকলেট নিল। তারপর আবার গিয়ে রোদে বসলো বড় বড় বাইট দিয়ে চকলেট খেতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর একটু ভালো লাগলো। তখন তাজেল এলো মেহবিনের কাছে ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলল,,

“নওশি আপারে দেখতে যাবা ডাক্তার?”

“তুমি যাবে নেত্রী?”

“তুমি গেলে তোমার সাথে যাইতাম।”

“নওশি তোমার কেমন বোন হয় নেত্রী?”

“আমার কাকাতো বোন।”

“নওশি তোমায় অনেক আদর করে তাই না।”

“মা যাওয়ার পর তো দাদি আর নওশি আপাই আমারে দেইখা রাখে আদর করে।”

“তোমার মা কোথায় গেছে?”

“এক জনের লগে ভাইগা গেছে যহন আমার চার বছর আমারে আর আমার বাপেরে থুইয়া।”

বলতে বলতেই তাজেলের চোখ ছলছল করে উঠলো। মেহবিন তাজেলকে ওর কাছে এনে ওকে কোলে বসালো। তখন তাজেল বলল,,

“জানো ডাক্তার আমার বাপ আমারে ভালোবাসেনা কিন্তু আগে ভালোবাসতো যহন মা গেল গা তহন আমারে জরাই ধইরা কতো কানতো। আমারে কতো আদর করতো। কিন্তু যহন হেয় আরাটা বিয়া করলো তহন থেইকা আমার বাপ বদলাইইতে লাগলো। প্রথম প্রথম আমার সৎমায় আমার লগে ভালো ব্যবহার করতো কিন্তু তার কয়েকদিন পর থিকাই বাপে কামে গেলে আমারে বকা দিতো আর আমারে মারতো। আমার মায়রে নিয়া বাজে কথা কইতো। বাপের কাছে আমার নামে মিছা কতা কইতো আমার বাপেও আমারে বকতো। তুমি জানো আমার সৎবইন আর ভাই ও আছে ওই বইনের বয়স পাঁচ বছর আমার সৎমায়ের মাইয়া আর ভাই আমার বাপের ঘরে অইছে। আমি তারে আদর করি কিন্তু আমার সৎমায়ে ওরে ধরতে দেয় না।”

বলতে বলতেই তাজেলের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরলো। মেহবিন তা মুছে দিল। মেহবিন তাজেলের মাঝে নিজেকে দেখতে পেল তাজেলের যেমন ওর পরিবার থেকেও কেউ নেই। তেমন ওর ও কেউ নেই। মেহবিন তাজেলকে চকলেট দিয়ে বলল,,

“নেত্রী একদম কান্না না এখন!

‘আমি তো কানতে চাইনা কিন্তু আইসা পরে।”

“আচ্ছা কিন্তু আর কাদবে না এখন নাও চকলেট খাও।

মেহবিনের কথায় তাজেল চোখ মুছে বলল,,

“তুমি নওশি আপারে দেখতে যাইবা না?”

“এমনিতেও কাজ নেই চলো তুমি যখন যেতে চাও তাহলে যাই। এমনিতেও আমি যেতাম। তো তুমি কি রেডি?

‘হ আমার এইডাই ভালো জামা। আমি জানতাম তুমি আমার কথা হুইনা আমার সাথে যাইবা তাই রেডি হইয়া আইছি।”

“কাউকে বলে এসেছো?”

“আমার খবর কেউ রাখে না। খালি আমার বাপে রাইতে একবার জিগাইবো আমি কোনে আর আমার দাদি একটু খবর নিব আমি কোনে আছি। তাও সন্ধ্যার আগে আমার দাদিও আমারে খুজবো না। আর নওশি আপা থাকলে হেয় একটু খবর নিতো।”

মেহবিন তাজেলের দিকে তাকালো ওর ঠোঁটে মুচকি হাঁসি। তা দেখে মেহবিন হেঁসে বলল,,

‘তুমি দাঁড়াও আমি তৈরি হয়ে আসি। ততক্ষণে তুমি চকলেট খাও।”

মেহবিন ভেতরে চলে গেল তারপর বোরকা হিজাব পরে বের হলো। তারপর তাজেল কে নিয়ে বের হলো। তাজেলের পা আগের থেকে অনেকটাই ঠিক। তাই তাজেল বলল হেঁটে হেঁটে যাবে। কিন্তু মেহবিন শুনলো না ও একটা রিক্সা নিল। হাসপাতালে গিয়ে সোজা নওশির ওখানে চলে গেল। মেহবিন তাজেলকে কোলে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। নওশি শুয়ে আছে ওর মা নেই আশেপাশে। হয়তো বাড়িতে খাবার আনতে গেছে বা কোন কাজে গেছে। মেহবিন কে দেখেই নওশি উঠতে চেষ্টা করলো মেহবিন ওকে শুয়ে থাকতে বলে তারপর বলল,,

‘নওশি এখন কেমন লাগছে?”

নওশি মুচকি হেসে বলল,,

“এখন তো ভালো লাগছে। কিন্তু কাল মরে গেলেই বোধহয় ভালো হতো। আব্বার আর কোন চিন্তা থাকতো না।”

“উঁহু এরকম কথা বলতে হয় না নওশি। রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন,
পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন, তোমরা কখনই নিজের মৃত্যু কামনা করো না।
(সহীহ_বুখারী, ৫৬৭১)

নওশি বলল,,

“আমি তো মরতে চাই না ডাক্তার আপা। পরিস্থিতি বাধ্য করে এমন কথা বলতে।”

মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

‘আল্লাহ কে বিশ্বাস করো? তার ওপর ভরসা করো তো?”

‘তার ওপর বিশ্বাস আর ভরসা করি বলেই তো এতদূর আসতে পেরেছি।”

“তাহলে এরকম কথা কিভাবে বলছো। আমরা বলি, “আমি ব্যর্থ।”
কোরআন বলে, “অবশ্যই বিশ্বাসীরা সফল হয়।”
(সুরা : মুমিনুল, আয়াত : ১)

আমরা বলি, “আমার জীবনে অনেক কষ্ট।”
কোরআন বলে, “নিশ্চয়ই কষ্টের সঙ্গে আছে স্বস্তি।”
(সুরা : ইনশিরাহ, আয়াত : ৬)

আমরা বলি, “আমাকে কেউ সাহায্য করে না।”
কোরআন বলে, “মুমিনদের সাহায্য করা আমার দায়িত্ব।” (সুরা : রুম, আয়াত : ৪৭)

আমরা বলি, “আমার সঙ্গে কেউ নেই।”
কোরআন বলে, “তোমরা ভয় করো না, আমি (আল্লাহ) তো তোমাদের সঙ্গে আছি। আমি শুনি এবং আমি দেখি।” (সুরা : ত্বহা, আয়াত : ৪৬)

আমরা বলি, “আমার পাপ অনেক বেশি।”
কোরআন বলে, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারীদের ভালোবাসেন।” (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২২২)

আমরা বলি, “কোনো কিছু আমার ভালো লাগে না।”
কোরআন বলে, “তোমার জন্য পরবর্তী সময় পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে শ্রেয়।” (সুরা : দুহা, আয়াত : ৫)

আমরা বলি, “বিজয় অনেক দূরে।”
কোরআন বলে, “জেনে রেখো, অবশ্যই আল্লাহর সাহায্য নিকটে।” (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২১৪)

আমরা বলি, “আমার জীবনে কোনো খুশি নেই।”
কোরআন বলে, “শিগগির তোমার রব তোমাকে (এতো) দেবেন যে তুমি খুশি হয়ে যাবে।”
(সুরা : দুহা, আয়াত : ৫)

আমরা বলি, “আমি সব সময় হতাশ।”
কোরআন বলে, “আর তোমরা হীনবল হয়ো না এবং দুঃখিতও হয়ো না। তোমরাই বিজয়ী, যদি তোমরা মুমিন হও।” (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৩৯)

আমরা বলি, “আমার কোনো পরিকল্পনা সফল হয় না।”
কোরআন বলে, “আল্লাহ সর্বোত্তম পরিকল্পনাকারী।”
(সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৫৪)

এখন বলো এতকিছুর পরেও তোমার মনে হয় তোমার মরে যাওয়া উচিত ছিল।”

নওশি মুচকি হেসে বলল,,

“তাজেল ঠিকই বলে তুমি জাদু জানো।”

মেহবিন এবার হাসলো আর বলল,,

‘নেত্রী তো নেত্রীই! এসব ছাড়ো এখন বলো তোমার বাবা তোমার সাথে এরকম করলো কেন?’

“আসলে আমি পরতে চাই। কিন্তু আমার বাপের সেটা পছন্দ নয়। সে আমার বিয়ে দিতে চায় আমার সমস্যা নেই বিয়ে করতে কিন্তু আমার একটাই কথা বিয়ের পর পরতে দিতে হবে। আমার অনেকদিনের স্বপ্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরবো। আর জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবো। কিন্তু সে একটা বুরো লোকের সাথে আমার বিয়ের কথা বলেছিল। লোকটা তার সাথেই মদ গাঁজা খায়। তাই কালকে উনারা আসতেই ওনাদের আমি মুখের ওপর না করেছি বলে আজ এই অবস্থা কারন ঐ বুরো লোকটা তারে দুই লক্ষ টাকা দিতো‌। মুদ্দা কথা আমার বাপে আমারে বিক্রি করছিল তার কাছে। আমার থেকে বাধা পেয়েছে তাই আমাকে মেরেছে।”

মেহবিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,

“ওনাকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম উনি ড্রাগ এডিক্টেড। তুমি চিন্তা করো না আমি তোমার স্বপ্নপূরন করতে সাহায্য করবো।”

‘দেখি আমার স্বপ্ন কোন দিকে যায়। পরিস্থিতির চাপে পরে কখনো কখনো স্বপ্ন দেখা বন্ধ করতে হয় ডাক্তার আপা।”

‘একটা কথা মনে রেখো নওশি প্রয়োজনে স্বপ্ন বদলে নিও কিন্তু স্বপ্ন দেখা বন্ধ করো না। নাহলে বেঁচে থাকার আশা থাকবে না। নিজের জন্য হলেও স্বপ্ন দেখতে হবে আর বাঁচতে হবে। সবশেষে তুমি তোমার স্বপ্ন নিয়ে প্রানখুলে বাঁচবে। কি আশা নিয়ে বাঁচবে তো?

মেহবিনের কথা শুনে নওশির চোখ চকচক করে উঠলো ও হাঁসি মুখে বলল,,

‘আমি বাঁচবো ডাক্তার আপা। আমি স্বপ্ন দেখবো অতঃপর আমি বাঁচবো আমি প্রানখুলে স্বপ্ন নিয়ে বাঁচবো।”

মেহবিন হাসলো। তারপর আরো কিছু কথা বলতে লাগলো। নওশি তাজেলের সাথেও কথা বলল । নওশির মা এলে মেহবিন আর তাজেল ওদের থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলো। এখন তাজেল জেদ ধরেছে হেঁটেই ফিরবে। মেহবিনের ওর কাছে হার মেনে তাজেলের হাত ধরে হাঁটতে লাগলো। হুট করে তাজেল বলল,,

“ডাক্তার তুমি কি নওশি আপার মতো আমার একটা ইচ্ছা পূরন করবা?”

“যদি পারি তাহলে অবশ্যই পূরণ করবো নেত্রী।”

“সত্যি তুমি পূরন করবা?”

“বললাম তো যদি পারি তাহলে অবশ্যই করবো। তো শুনি কি ইচ্ছে?

তাজেল দাঁড়ালো তা দেখে মেহবিন ও দাঁড়ালো। তাজেল বলল,,

“আমি পরবার চাই ডাক্তার। আমিও নওশি আপার মতো বড় কিছু হইতে চাই।”

‘মানে তুমি স্কুলে যাও না?”

“না ডাক্তার ও আমারে স্কুলে যাইতে দেয় না। আমি পরবার চাই ডাক্তার কিন্তু ঐ সৎমায় আমারে পরতে দেয় না । আমারে পরাইতে নাকি তার টাহা লাগবো এই কইয়া আমার পরা বন্ধ কইরা দিছে। এক বছর আগে। আমি বড় হইয়া তোমার মতো হইতে চাই সবার সাহায্য করবার চাই ডাক্তার। সেদিন তোমারে বললাম না বড় হইয়া নেতা হমু এই জন্যই যে সবাই জানি আমার কথা হুনে আমি যেন সবাইরে তোমার মতো সাহায্য করবার পারি। আমি সবসময় এইডা কইয়া নিজেরে শান্তনা দেই আমি বড় হইয়া নেতা হমু।

বলতে বলতেই তাজেল এবার শব্দ করেই কেঁদে উঠলো। মেহবিন বুঝতে পারলো ও তাজেলের ভরসায় জায়গা করে নিয়েছে তাই তো এতো সহজে সব বলে দিলো। মেহবিন তাজেলের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে জরিয়ে ধরলো। তাজেল শান্ত হতেই মেহবিন ওকে সামনে দাড় করিয়ে ওর চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে গালে হাত রেখে বলল,,

‘কেঁদো না নেত্রী তুমি পরতে পারবে। আমি তোমার পড়ার ব্যবস্থা করবো। তুমি বড় হয়ে যা ইচ্ছে তাই হতে পারবে।”

‘সত্যি কইতেছো?”

“একদম সত্যি। না পরলে তুমি যোগ্য নেত্রী কিভাবে হবে বলো তো। আমার নেত্রী সবথেকে এগিয়ে থাকবে। আর এই নেত্রীকে এগোতে সাহায্য করবে এই নেত্রীর ডাক্তার ঠিক আছে।”

মেহবিনের কথায় তাজেল হেঁসে বলল

“ঠিক আছে! তুমি অনেক ভালো ডাক্তার।”

‘তাই বুঝি?”

“হুম তাই।”

‘এতো ভালো দেখেই তো কেউ আমায় তার সাথে রাখে না।সবাই একা ছেড়ে দেয়।”

“কি বললা?”

তখনি মেহবিনের ফোন বেজে উঠল। মেহবিন দেখলো হাসপাতালের সবথেকে সিনিয়র ডক্টর ফোন দিয়েছে সালাম দিয়ে ফোন ধরতেই সে বলল মেহবিনকে হাসপাতালে যেতে। বাড়ি প্রায় এসেই গেছে তাই তাজেল কে বলে ও আবার হাসপাতালে গেল । হাসপাতালে গিয়ে দেখতে পেল সিনিয়র ডাক্তারের কেবিনে ডক্টর বাবুল সহ আরো একজন ডাক্তার আছেন। ও ভেতরে গিয়ে বসতেই সিনিয়র ডাক্তার বললেন,,

“ডক্টর মেহবিন মুসকান আমরা আপনাকে ডক্টর পদ থেকে বহিষ্কার করছি।”

~চলবে,,

বিঃদ্রঃ আসসালামু আলাইকুম। গল্পটা কেমন আগাচ্ছে যদি বলতেন তাহলে একটু মনোবল পেতাম আর কি? গল্পটা কেমন হচ্ছে জানাবেন প্লিজ। ভুল ত্রুটি ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন। আর আজ রাত নয়টার দিকে ছোট করে হলেও একটা বোনাস পার্ট দেব।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here