#টক_ঝাল_মিষ্টি
#তামান্না_আঁখি
#পর্ব-৪
কুহু আয়নার সামনে বসে সাজছে।তার সামনে বিভিন্ন মেকাপ আইটেম ছড়ানো ছিটানো। কুহুর পিছনে বিছানায় বসে তনয়া পায়েস খাচ্ছে আর আয়নায় কুহুর প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে আছে। আজ কুহুকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে তাই সকাল সকাল কুহু তাকে কল করে ডেকে এনেছে শাড়ি পড়বে বলে। সেই কখন থেকে সে এসে বসে আছে কিন্তু কুহুর সাজ আর শেষ হচ্ছে না। এতক্ষন কিসব মুখে লাগিয়ে বসেছিলো তারপর গোসল করে এসে এখন মেকাপ করতে বসেছে। তনয়া এক চামচ পায়েস মুখে দিয়ে বলল-
“রাজনীতিবিদ পছন্দ করিস না তাই বিয়ে করবি না বলে কত লাফঝাপ দিলি আর এখন নির্লজ্জের মতো ঢ্যাং ঢ্যাং করে বিয়েতে রাজি হয়ে গেলি।”
কুহু মেকাপ ব্রাশ টা নামিয়ে আয়না দিয়ে তনয়ার দিকে তাকিয়ে বলল-
“বিয়েতে রাজী হওয়া অপরাধ নাকি?”
“না তা না। আগে যে বিয়ে করবি না বলে লাফালি।”
কুহু মেকাপ ব্রাশ ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে তনয়ার দিকে ফিরলো। চোখেমুখে দুঃখি দুঃখি ভাব করে ভেজা কন্ঠে বললো-
“একটা মানুষকে ভালো লেগেছে,হোক না রাজনীতিবিদ ,তাতে কি ভালো লাগা কমে যাবে? আমি না হয় রাজনীতি একটু সহ্য করে নেব। তার উপর বাবা মায়ের খুব ইচ্ছা এখানে বিয়ে দিবে। এখন মেয়ে হয়ে তাদের ইচ্ছে পূরণ করা কি আমার অপরাধ?একটা মানুষকে পছন্দ করে বিয়ে করতে চাওয়া কি অপরাধ? অপরাধ হলে আমাকে শাস্তি দে!! আমাকে ফাঁসি দে!!পানিশ মি!”
বলেই কুহু পড়নের ওডনা নাকে-মুখে চেপে ধরলো। গুনগুন করে কান্নার সুর ভেসে আসলো।থেমে থেমে হেচকিও তুললো। তনয়া হতভম্ব হয়ে গেলো এমন কান্ডে।তীব্র অপরাধবোধ ছেয়ে গেলো তার মনে। আসলেই তো মেয়েটা ওই ছেলেটাকে রাজনীতি করা স্বত্তেও পছন্দ করে ফেলেছে। বাবা মায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী বিয়েও করতে রাজী হয়েছে। এটা তো তার অপরাধ না।তনয়া উঠে গিয়ে কুহুর সামনে ড্রেসিং টেবিলে বসলো। অপরাধী কন্ঠে বললো-
“এ..এই কুহু,কাঁদছিস কেন? স্যরি দোস্ত, আমি বুঝতে পারি নি ।এইবারের মতো ক্ষমা করে দে না।এই কুহু?”
তনয়া অনেক অনুনয় করলো।আজকের এই শুভ দিনে মেয়েটা তার কথায় চোখের পানি ফেলছে,নিজেকে অনেক দোষী মনে হলো তার। কুহু আচমকা নাক থেকে ওড়না সরিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো-
“আচ্ছা যা, ক্ষমা করে দিলাম।”
তনয়ার মুখটা হা হয়ে গেলো। কোথায় চোখের পানি? চোখ দুটো একদম মরুভুমির মতো শুকনো।তার মানে এতক্ষন এই মেয়ে অভিনয় করছিলো? এত নিঁখুত অভিনয়? রাগে তনয়ার ব্রহ্মতালু জ্বলে গেলো। কুহুর এসবে তেমন ভাবাবেগ হলো না।সে মেকাপ ব্রাশ টা নিয়ে গালে ব্লাশ দিতে ব্যস্ত। তনয়া গরম কন্ঠে বললো-
“অপরাধ তুইও করিস নি আমিও করি নি, অপরাধ করছে ওই ভদ্রলোক। তোকে বিয়ে করার অপরাধ। বিয়ের পর হাড়ে হাড়ে টের পাবে কি জিনিস ঘরে তুলেছে।”
————
শাহাদ নির্বাচন অফিসে এসেছে। একটা খুব দরকারি কাজ আছে। তার বাবার পরিবর্তে সে এসেছে। নির্বাচন অফিসের বারান্দার একটা চেয়ারে বসে আছে। তার পড়নে সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা,পাঞ্জাবির উপরে একটা কালো কটি।পাঞ্জাবির হাতা গুটানো। এখানকার কাজ শেষ করে কুহুদের বাড়িতে যাওয়ার কথা তার। ভিতর থেকে তার বাবার সেক্রেটারি রওনাক বেরিয়ে এলো। বয়সে শাহাদের সমবয়সীই। ২ বছর ধরে কাজ করছে সেক্রেটারি হিসেবে। রওনাক বের হয়ে শাহাদের কাছে এসে বললো-
“ভাই চলুন ভিতরে।”
শাহাদ উঠে দাঁড়ালো। প্রবেশ করলো অফিসের ভিতর। আধা ঘন্টা পর কাজ শেষ করে বেরিয়ে আসলো। বাইরে এসে ঘড়ি দেখলো। এতক্ষনে ওর পরিবারের সবার কুহুর বাসায় চলে যাওয়ার কথা। শাহাদ বের হয়ে আসলো অফিস থেকে। অফিস চত্বরের এক পাশে তার গাড়ি আর তার সাথে আসা ছোট একটা ছেলেদের দল। শাহাদ সেদিকে যাওয়ার সময় গেট দিয়ে কয়েকটা বাইক ঢুকলো।বাইক গুলোর পিছনে আসলো একটা দামী কালো গাড়ি। শাহাদ আর রওনাক দুজনে দাঁড়িয়ে পড়লো জায়গায়। বাইক সহ গাড়িগুলো একপাশে গিয়ে থামলো। গাড়ি থেকে বের হয়ে আসলো বিরোধী দলের নেতা হিশাম চৌধুরী। শাহাদের চেয়ে বয়সে ৫-৬ বছরের বড়। পড়নে পাঞ্জাবি পায়জামা। দেখতে বেশ সুপুরুষ।
গাড়ি থেকে বের হয়ে হিশামের চোখচোখি হলো শাহাদের সাথে। শাহাদকে সে গেট দিয়ে ঢুকার সময়ই দেখেছে।তাকে সামনাসামনি এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। পাশে দাঁড়ানো তার সেক্রেটারিকে বললো-
“এ এখানে কি করছে?”
“স্যার, আগামী নির্বাচনের জন্য কোনো কাজে এসেছিলো বোধহয়। ”
“নির্বাচন কমিশনার আছে তো অফিসে?”
“আছে স্যার,আমি খবর নিয়ে জেনেছি।”
হিশামের মুখের কাঠিন্যতা দূর হলো না। সেক্রেটারিকে নিয়ে এগিয়ে গেলো অফিসের দিকে। শাহাদের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় আরেকবার চোখাচোখি হলো দুজনের। শাহাদ শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে। হিশাম চোখ সরিয়ে নিলো। সে ছোট থেকে শাহাদকে চিনে। বেশ শান্তশিষ্ট, ভদ্র টাইপের ছেলে। কিন্তু তারপরেও শাহাদকে তার ভালো লাগে না। এই যে তাকিয়ে আছে ওর দিকে চোখের দৃষ্টিতে কোনো উত্তাপ নেই,শান্ত দিঘির পানির মতো চাউনি। কিন্তু তারপরও হিশামের মনে হচ্ছে এক্ষনি শাহাদ তাকে গুলি করে দিবে। যেমনটা সে করেছিলো গত নির্বাচনে।
শাহাদ নিশ্চল দাঁড়িয়ে থেকে হিশামের চলে যাওয়া দেখলো। রওনাক পাশ থেকে কানাকানি করার মতো করে গলা নামিয়ে বললো-
“এই সন্ত্রাস এখানে এসেছে নিশ্চয়ই কোনো মতলব আছে। আগামী নির্বাচন নিয়ে কোনো প্ল্যান করছে হয়ত।”
শাহাদ উত্তর দিলো না। সে মুখ ঘুরিয়ে গাড়ীর কাছে এগিয়ে গেলো। গাড়ির কাছে গিয়ে দেখলো তার দলের ছেলেগুলো অপর পাশে থাকা হিশাম চৌধুরির দলের ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বিভিন্ন আক্রমণাত্মক ইশারা ইংগিত করছে। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো ওই পাশ থেকেও ওরা কম যাচ্ছে না। কেউ কেউ আবার শার্ট উপরে তুলে কোমড়ে গুজে রাখা রিভ*লবার দেখাচ্ছে। শাহাদ গাড়িতে উঠে বসলো। রওনাকও সামনের প্যাসেঞ্জার সিটে উঠে বসলো। শাহাদের দিকে পিছন ফিরে তাকিয়ে বলল-
“একটু আগেই খবর পেলাম স্যার পৌছে গেছেন ওইখানে।”
শাহাদ ঘড়ি দেখলো। রুওনাকের দিকে তাকিয়ে বলল-
“তাহলে ওখানে যাওয়া যাক।”
“ভাই জর্জ কোর্টে যেতে হবে, কিছু মামলা মোকদ্দমা আছে।তারপর ওইখান থেকে পার্টি অফিস।সেখানে একটা মিটিং আছে।”
“ঠিক আছে। ”
শাহাদ ছোট একটা শ্বাস ফেললো।আজ আর বোধহয় কুহুর সাথে দেখা হবে না। মেয়েটা কি আশা নিয়ে বসে আছে?অপেক্ষা করবে তার জন্য?কিংবা না গেলে রাগ করবে? নাহ!!এরকম কিছু করবে না।এখনো তো তাদের ভালো করে কেমিস্ট্রিই জমলো না। শাহাদ অন্যদিকে চিন্তা সরাতে চাইলো। প্রথম দেখার পর থেকেই মেয়েটা তার মস্তিষ্কে জুড়ে বসেছে। মস্তিষ্ক থেকে তাকে সরানো বড্ড দায় হয়ে পড়েছে।
————
কুহু খুব সুন্দর একটা বেগুনি কালার শাড়ি পড়েছে। তনয়া খুব যত্ন করে পড়িয়ে দিয়েছে তাকে। চুলগুলো মাঝখানে সিঁথি করে ছেড়ে দিয়েছে, কানের নিচে দুটো টকটকে লাল গোলাপ গুজে দিয়েছে। কানে টানা দুল পড়েছে, গলায় খুব সিম্পল একটা লকেটওয়ালা হার। আর হাতে বেগুনি কালার কাচের চুড়ি, চোখে কাজল টেনে দেয়া আর ঠোটে লিপস্টিক। আয়নার সামনে দাঁড়ানো কুহুকে জড়িয়ে ধরে তনয়া মুগ্ধ কন্ঠে বললো-
“তোকে কি সুন্দর লাগছে রে কুহু!! মা শা আল্লাহ,কারো নজর না পড়ুক।আজ তোর রসগোল্লা তোকে দেখে রসমালাই হয়ে যাবে। ”
কুহু মাথা নীচ দিকে দিয়ে তনয়াকে হালকা ধাক্কা দিয়ে লাজুক হেসে বলল-
“যাহ!! কি যে বলিস না।”
“সত্যি বলছি। তোকে একদম নব্বই দশকের নায়িকাদের মতো লাগছে।”
কুহু আবারো লাজুক হাসলো৷ তনয়া মুগ্ধ দৃষ্টিতে কুহুকে দেখলো। এই মেয়ে নায়িকাদের মতো করে সাজার জন্য কি জেদটাই না করলো। শিরিনা বেগমও তার কাছে হার মেনে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। এখন সাজ কমপ্লিট হওয়ার পর কুহুকে দেখতে আসলেই নব্বই দশকের নায়িকাদের মতোই লাগছে। কুহু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বিভিন্নভাবে লজ্জা পাওয়ার ভংগি করতে লাগলো। তনয়া কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো-
“এমন করছিস কেন?”
“কিভাবে ওদের সামনে গেলে দেখতে ভালো লাগবে সেটাই দেখছি।”
তারপর তনয়ার দিকে ফিরে বললো-
“দেখ না কিভাবে যাব এভাবে নাকি এভাবে।”
কুহু বিভিন্ন রকম লজ্জামিশ্রিত হাসি দিয়ে এদিক ওদিক মুখ বাকিয়ে দেখালো। তনয়া নাক কুচকে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। কুহু তাড়া দিয়ে বলল-
“কি হলো বল?”
তনয়া কিছু বলার আগেই নিচ থেকে গাড়ির হর্নের শব্দ ভেসে এলো। কুহুর মুখে তৎক্ষনাৎ বিদ্যুৎ খেলে গেলো। তনয়ার দিকে তাকিয়ে বললো-
“ওরা চলে এসেছে। ”
বলেই বারান্দার দিকে দৌড় দিলো।তনয়া হায় হায় করে উঠলো-
“এই তুই কোথায় যাচ্ছিস?তুই তো পাত্রী।”
তারপর ছুটে গেলো কুহুর পিছনে।কুহু বারান্দায় পিলারের আড়ালে দাঁড়িয়ে রাস্তায় উঁকি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তনয়াও কুহুর ঘাড়ের উপর দিয়ে উঁকি দিলো রাস্তায়। তিনটে গাড়ি এসেছে। সামনে একটা মাইক্রো মাঝখানে একটা প্রাইভেট কার তার পিছনে আরেকটা মাইক্রো। সামনের মাইক্রোটা থেকে কয়েকজন লোক বের হয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে প্রাইভেট কারের দরজা টা খুলে দিলো। বের হয়ে আসলো সাদা পাঞ্জাবি পড়া একজন বৃদ্ধ লোক। তাঁর এক হাতে একটা লাঠি। গাড়ির অপর পাশ থেকে আরেকজন মধ্য বয়স্ক পাঞ্জাবি পায়জামা পড়া লোক নামলো। তনয়া ব্যস্ত হয়ে কুহুকে বললো-
“এই যে উনি হচ্ছেন এমপি আশফাক খান। আমি উনার ছবি পোস্টারে দেখেছি। অনলাইনেও উনার নির্বাচনী প্রচারনা দেখেছি অনেকবার।”
কুহু আশফাক খানকে চিনতে পেরেছে। তবে আশফাক খান যে তার বাবার বন্ধু তা সে জানতো না। গেটের সামনে কুহুর বাবা মোয়াজ্জেম সাহেবকে দেখা গেলো।পাশে দাঁড়িয়ে আছে যিয়াদ।মোয়াজ্জেম সাহেব
হাস্যোজ্জ্বল চেহারা নিয়ে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো আশফাক খানকে। আশফাক খানও হাসলেন। দুই বন্ধু কুশল বিনিময় করলো। আশফাক খানকে ছেড়ে তাঁর পাশে দাঁড়ানো বৃদ্ধকে সালাম জানালো মোয়াজ্জেম হাসান।পিছনের মাইক্রোটা থেকে আস্তে আস্তে মহিলারা নেমে এলো। এই পর্যায়ে তনয়া তড়িঘড়ি করে কুহুকে টেনে ঘরে নিয়ে আসলো। কুহু বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করলো-
“টানছিস কেন?”
“দেখছিস না সবাই নেমে গেছে।হঠাৎ করে কেউ উপরে তাকিয়ে তোকে দেখে ফেললে কেলেংকারী হয়ে যাবে।”
কুহু ব্যাপারটা বুঝলো কিন্তু তার মন টা উশখুশ করতে লাগলো শাহাদকে দেখার জন্য। শাহাদ এখনো নামলো না কেন গাড়ি থেকে? তনয়া কুহুকে তাড়া দিয়ে বলল-
“তাড়াতাড়ি চল নিচের ঘরে। উনারা চলে আসবে এক্ষুনি।”
কুহু নিজের কয়েকটা প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে নিচের ঘরের দিকে রওয়ানা করলো। তনয়ার সাহায্যে শাড়ি সামলে সিড়ি দিয়ে নিচে নামলো। তারপর নিচের গেস্ট রুমটায় ঢুকে গেলো।
খান পরিবারের সবাইকে আপ্যায়ন করে ড্রয়িং রুমে বসানো হলো। তনয়া দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো কে কে এসেছে। কিন্তু এখান থেকে ড্রয়িং রুমের সবটা দেখা যায় না বলে তার দেখতে অসুবিধা হলো। কুহু গেস্ট রুমের বিছানার উপরে বসে ছিলো। চাপা গলায় তনয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল-
“কে কে এসেছে?”
“সবাইকে দেখা যাচ্ছে না তো। শুধু দুজন মহিলাকে দেখা যাচ্ছে।”
শিরিনা বেগম সবার সাথে কুশল বিনিময় করে যথাসাধ্য আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।খানিক্ষন বাদে কুহুর কাছে আসলেন। কুহুর সাজগোজের পর উনি আর কুহুকে দেখেননি।মেয়েকে এরকম সাজে দেখে উনার চোখে পানি এসে গেলো।সেদিনের সেই ছোট্ট কুহু কিভাবে এত বড় হয়ে গেলো? তনয়া শিরিনা বেগমকে হাসিমুখে বললো-
“আন্টি, শাড়ি কিন্তু আমি পড়িয়ে দিয়েছি কুহুকে।কেমন হয়েছে?”
“খুব সুন্দর হয়েছে।”
তারপর এগিয়ে এসে বিছানায় বসে থাকা কুহুর কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন-
“মা শা আল্লাহ!!আমার মেয়ের গায়ে কারো নজর না লাগুক।”
কুহু ভয়ার্ত কন্ঠে বললো-
“আমার ভয় করছে মা। আই এম নার্ভাস।”
“কোনো ভয় নেই মা। তোর বাবা আছে আমি আছি, ভয় কিসের?”
তারপর তনয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন-
“ওকে নিয়ে বাইরে আসো।”
শিরিনা বেগম যেতে উদ্ধত হলে কুহু হাত আকড়ে ধরলো।অনুনয় করে বলল-
“তুমি আমার সাথে থাকো মা। আমি তোমার সাথে যাব।”
“বোকা মেয়ে,আমার কাজ আছে। সবাইকে আপ্যায়ন করতে হবে তো।”
শিরিনা বেগম মেয়ের হাত ছাড়িয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।কুহু সূরা পড়ে বুকে ফু দিলো। এক গ্লাস পানি ঢক ঢক করে পুরোটা খেয়ে ফেললো। তনয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে বললো-
“দেখ হাত কাঁপছে।মনে হয় সুগার ফল হচ্ছে।একটু মিষ্টি খেলে ভালো লাগতো।”
তনয়া দুষ্টু হেসে বলল-
“বসার ঘরে তোর রসগোল্লা আছে।গিয়ে দুটো কামড় দে। সুগার ফল বাপ বাপ করে পালাবে।”
এত নার্ভাসন্যাসের মাঝেও লজ্জায় কুহুর গাল দুটো রক্তিম বর্ন ধারন করলো। তনয়া কুহুকে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। আস্তে আস্তে ড্রয়িং রুমের দিকে এগিয়ে গেলো। ড্রয়িং রুমে ওরা ঢুকতেই সকলের মনোযোগ ওদের দিকে ঘুরে গেলো। তনয়া কুহুকে নিয়ে এক পাশের সোফায় বসিয়ে দিলো। কুহু লাজুক ভংগিতে জড়োসড়ো হয়ে বসলো।মৃদু কন্ঠে সবাইকে সালাম দিলো।মোয়াজ্জেম সাহেব মেয়ের আচরনে খুশি হলেন খুব।। একটা মহিলা উঠে এসে কুহুর পাশে বসে চিবুকে হাত দিয়ে মুখটা তুললো।হাসি দিয়ে বলল-
“বাহ!কি সুন্দর দেখতে হয়েছো!! সেই ছোট বেলায় তোমায় দেখেছিলাম।”
কুহু মহিলাটার দিকে তাকালো। গোলগাল মায়া মায়া মুখ। মহিলাটি হেসে বলল-
“আমি তোমার শ্বাশুড়ি হব। আমাকে মা বলে ডাকবে।ঠিক আছে?”
কুহু হালকা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল।অপাশ থেকে আশফাক খান গলা উচিয়ে বললেন-
“আর আমাকে ডাকবে বাবা।”
তারপর পাশে বসে থাকা মোয়াজ্জেম সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন-
“বুঝেছিস মোয়াজ মেয়েকে বিয়ে দিয়ে অন্যের বাড়ি পাঠিয়েছি এখন ছেলেকে বিয়ে করিয়ে আরেকটা মেয়ে পাব। শূন্য ঘরটা আবারো পূর্নতা পাবে।”
মোয়াজ্জেম সাহেব বন্ধুর কথায় হাসলেন। সাথে আসা বৃদ্ধ লোকটি কুহুকে প্রশ্ন করলো-
“আমার নাতিকে তোমার পছন্দ হয়েছে তো? আমার নাতি কিন্তু লাখে একটা।”
কুহু এক পলক শাহাদের দাদা আব্দুল গাফফার খানকে দেখলো। সাদা চুল সাদা দাড়ি,হাসি হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কুহু মাথা নাড়িয়ে বুঝালো তার পছন্দ হয়েছে। গাফফার খান উপদেশ দেয়ার মতো করে বললেন-
“আমার নাতি খান পরিবারের উত্তরাধিকারী। ভবিষ্যৎ এমপি। তোমাকে কিন্তু শক্ত হাতে তার হাত ধরতে হবে, সাপোর্ট দিতে হবে।অনেক ঝড়-ঝাপ্টা আসবে কিন্তু হাত ছাড়া যাবে না।”
আশফাক খান বাধা দিয়ে বলল-
“বাবা আপনি মেয়েটাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছেন এসব বলে। আস্তে আস্তে ও নিজেই সব বুঝে যাবে।”
আরো কিছু কথাবার্তা চললো।কুহু এক ফাকে সবাইকে একটু দেখে নিলো। আরো একটা মহিলা এসেছে। তার দুই পাশে দুটো মেয়ে,একটা মেয়ে যিয়াদের বয়সী ।কুহু তাকাতেই মেয়ে দুটো মিষ্টি করে হাসলো। কুহুও হাসলো। কিন্তু তার মন টা কিছুটা খারাপ হলো শাহাদকে না দেখতে পেয়ে। শাহাদের মা তাকে সুন্দর একটা হার উপহার দিলেন।অপর পাশে থাকা মহিলাটা উঠে এসে এক জোড়া বালা হাতে পড়িয়ে দিয়ে বলল-
“আমি শাহাদের চাচী হই। আমাকে কাকিমনি বলে ডাকবে।”
কুহু হেসে দিয়ে মাথা নাড়লো। আগের নার্ভাসন্যাস টা আর নেই এখন।সবার ব্যবহারে অনেকটাই সহজ হয়েছে সে। কিছুক্ষন পর কুহুকে গেস্ট রুমে পাঠিয়ে দেয়া হলো। সংগে এলো সাথে আসা দুটো মেয়ে।কুহুকে একা ঘরে পেয়ে একটা মেয়ে বললো-
“ভাইয়ার কাছে তোমার দেখেছিলাম। কিন্ত তুমি ছবির থেকেও সুন্দর।”
তনয়া জিজ্ঞেস করলো-
“তোমরা কি হও শাহাদ ভাইয়ার?”
বড় মেয়েটা বললো-
“আমরা কাজিন হই।আমার নাম রাফা ওর নাম রিদি।আমি ক্লাস টেনে পড়ি আর ও পড়ে ক্লাস সেভেনে।”
কুহু রিদির গাল টেনে দিলো।খানিক পরেই ঘরে আসলো শিরিনা বেগম সাথে আসলো শাহাদের মা আর চাচী। সব মহিলারা একসাথে হয় কিছুক্ষন গল্প করলেন।এক পর্যায়ে শিরিনা বেগম আক্ষেপ করে বললেন-
“মেয়েটা ঘরের কোনো কাজ ই করতে চায় না আপা। হাজার বকাবকি করেও তাকে দিয়ে কিছু করাতে পারি না। সারাদিন মুভি দেখে।সংসার যে কিভাবে করবে।”
শাহাদের মা রেজিয়া সুলতানা হেসে বললেন-
“সেসব আপনাকে ভাবতে হবে না আপা।আমার ছেলের বউকে আমি ঠিক সব শিখিয়ে পড়িয়ে নিব।”
শিরিনা বেগম রেজিয়া সুলতানার হাত ধরে কৃতজ্ঞ হয়ে বললেন-
“তাহলে তো আমার আর চিন্তাই রইলো না।”
আরো কিছুক্ষন আলোচনা চললো। আলোচনা করে ঠিক হলো আর এক সপ্তাহ পড়েই বিয়ে।প্রথমে মোয়াজ্জেম সাহেব একটু দ্বিমত পোষণ করলেও আশফাক খানের বিভিন্ন যুক্তির কাছে হেরে গেলেন।এক সপ্তাহ পরে বিয়ে হবে এতেই মত দিলেন তিনি। তারপর দুপুরের খাওয়া দাওয়া করে সবাই বিদায় নিলো।
সবাই বিদায় নিতেই কুহু নিজের ঘরে এসে শাড়ি খুলে টিশার্ট পড়ে চার হাত পা মেলে বিছানায় শুয়ে পড়লো। এতক্ষন সে নিচে ওদের সাথে ছিলো। খুব কষ্টে সে নিজেকে শান্ত শিষ্ট রেখেছে। ভুলভাল কাজ না করার চেষ্টা করেছে। অবশ্য শিরিনা বেগম তাকে কোনো কাজই করতে দেয় নি তাই ভুল হওয়ার প্রশ্নই আসে না।সে শুধু নিজ দায়িত্বে মুখটা বন্ধ রেখেছে।
তনয়া তার হ্যান্ডব্যাগটা কাধে নিয়ে বললো-
“এবার আমি গেলাম৷ ”
কুহু বিছানায় উঠে বসে বললো-
“না খেয়ে চলে যাচ্ছিস কেন?”
“মাত্রই না তোর সাথে খেয়ে উপরে আসলাম।ভুলে গেলি?”
কুহু নাক মুখ কুচকে হাত দিয়ে নিজের মাথায় বারি দিলো। তনয়ার দিকে তাকিয়ে বলল-
“ভুলে গিয়েছিলাম।”
তনয়া ঘড়ি দেখে বলল-
“বেশি দেরি হলে মা বকা দিবে।এবার যাই। রাতে ভিডিও কল দিব।এখন গেলাম।তোকে আর নিচে আসতে হবে না। ”
কুহু হাত নেড়ে তনয়াকে বাই জানালো।তারপর আবারো বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে পড়লো।ছাদের দিকে তাকিয়ে ভাবলো আজ একটু আগে তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। দুদিন পর তার বিয়ে হবে।বিয়ের পর সংসার,তারপর বাচ্চাকাচ্চা। কুহু জিভ কাটলো। দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো।কিসব ভাবছে সে।কি লজ্জার ব্যাপার!
_________
পার্টি অফিসের কাজ শেষ করতে শাহাদের অনেক্ষন লেগে গেলো। সে বারবার ঘড়ি দেখছে।এতটা সময় লাগবে জানলে সে আজকের মিটিং ক্যানসেল করে দিত। অবশেষে মিটিংটা যখন শেষ হলো তখন সে এক প্রকার দৌড়েই বের হলো অফিস থেকে। রওনাককে উদ্দেশ্য করে বলল-
“গাড়ি বের কর,কুইক। কুহুদের বাসায় যাব। ”
“কিন্তু ভাই স্যাররা তো সবাই চলে এসেছেন।”
“চলে এসেছেন?”
“হ্যা ভাই,একটু আগেই খবর পেলাম তারা সবাই খান বাড়িতে ফিরে এসেছেন।আপনার বিয়ের ডেটও ঠিক হয়ে গেছে।”
“কবে?”
“এক সপ্তাহ পর।”
চলবে