#টক_ঝাল_মিষ্টি
#তামান্না_আঁখি
#পর্ব-১০
আনিশার কান্না শুনে কুলসুমা বেগম আর জয়াও বের হয়ে আসলো। জয়া বেগম শ্বাশুড়ির পায়ে তেল মালিশ করছিলো, মালার চিৎকার শুনে তৎক্ষনাৎ শ্বাশুড়ির পায়ের তেল মুছে তাঁকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। ড্রয়িং রুমে পা দিয়ে আনিশা আর রেজিয়া সুলতানাকে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থেকে কাঁদতে দেখলেন। আদরের নাতনীকে এত দিন পর দেখে কুলসুমা বেগমও আবেগী হয়ে গেলেন।জয়ার হাত ধরে আনিশার কাছে এলেন। আনিশা তার দাদীকে দেখে তাকেও জড়িয়ে ধরলো। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রাহাত এতক্ষনে সুযোগ পেলো শ্বাশুড়ির সাথে কথা বলার। সে শ্বাশুড়ির কাছে এসে সালাম দিলো। রেজিয়া সুলতানা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে রাহাতের সালাম জবাব দিলো।জিজ্ঞেস করলো-
“তোমার মা-বাবা ভালো আছে তো বাবা?”
“জী মা,আলহামদুলিল্লাহ সবাই ভালো। বাবা কোথায়?শাহাদ,দাদাজান সবাই কোথায়?”
“ওরা তিনজন ই অফিসে গেছেন,আর তোমার চাচ্চু ব্যবসার কাজে দেশের বাইরে আছে।কাল পরশু চলে আসবে।”
রাহাত একে একে বাকি সবার সাথেই কুশল বিনিময় করলো। রেজিয়া সুলতানা দুজনকেই ঘরে পাঠালেন রেস্ট নেয়ার জন্য।তারপর জয়াকে সাথে করে নিজে গেলেন রান্না ঘরে। কাজের লোকদের সবাইকে কাজ বুঝিয়ে দিলেন। এতদিন পর মেয়ে আর মেয়ে জামাই এসেছে তাদের জন্য দুপুরে ভালো মন্দ রান্না করতে হবে। কুলসুমা বেগম রান্নাঘরে একটা চেয়ার নিয়ে আরাম করে বসলেন।মালা পাশে বসে তাকে পান বানিয়ে দিলো।পান মুখে দিয়ে তিনি রান্নার তদারকি করতে লাগলেন। দুই পুত্রবধূকে বিভিন্ন উপদেশ দিলেন।নাতনী আর নাতজামাই এর যত্নের কোনো কমতি রাখবেন না তিনি।
রাহাত ঘরে এসেই হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো। আনিশা ব্যাগ থেকে রাহাতের টি শার্ট ট্রাউজার বের করে দিয়ে বলল-
“ফ্রেশ হয়ে এগুলো পড়ো।”
রাহাত বিস্ময়ে প্রশ্ন করলো-
“এগুলো কই থেকে বের করলে? নতুন কিনে এনেছো?”
“না এসব আগেরই ছিলো। আলমারিতেই ছিলো এতদিন।গতকাল লুকিয়ে রেখেছিলাম বলে দেখতে পাও নি।”
রাহাতের বিস্ময়ের পরিমান বেড়ে গেলো। এইগুলো কবে কিনেছে তা মনে করতে পারলো না। আনিশা নিজের জন্য জামাকাপড় বের করতে করতে বললো –
“বাবা আসলে ভদ্র ছেলের মতো গিয়ে দেখা করে আসবে। কোনো ধানাই পানাই করবে না,বুঝেছো।”
আনিশা জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। রাহাতের ফ্যাকাশে মুখ করে শুয়ে রইলো। আনিশার বাবার জন্যই সে এই বাড়ি আসতে ভয় পায়। ভদ্রলোক তার সাথে আনিশার বিয়ে দিতে চান নি।একবার তো দেখা করতে এসে উনার ব*ন্দুকের নলের সামনে পড়েছিলো। বিয়ের দিন থেকে আজ পর্যন্ত আনিশার বাবার সাথে সহজ আর হতে পারে নি।সামনে গেলেই একটা ভয় ভয় ব্যাপার কাজ করে।
কুহু রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে ঘামছে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে শিরিনা বেগম। তিনি গরম চোখে তাকিয়ে আছেন।কুহু অপরাধী কন্ঠে বললো-
“আরেকবার ট্রাই করে দেখি তাহলে মা?”
“আমি তোকে তিন জাতের মসলার প্রতিটা থেকে এক চামচ করে মোট তিন চামচ মসলা তরকারিতে দিতে বলেছি।আর তুই বাকি মসলা বাদ দিয়ে তিন চামচ হলুদ দিয়ে বসে আছিস।”
“মনে ছিলো না মা।”
“মন কই থাকে তোর।আবার কর। এরপর চিকেন আর বিফ রাঁধবি।”
শিরিনা বেগম সরে গিয়ে ডায়নিং এ বসে তরকারি কুটতে লাগলেন। কুহু চুলা বন্ধ করে পাতিলটা নামালো।পাতিলের ঝোলে কিছু সবজি ভাসছে, ঝোলের রঙ হলুদ। কুহু পাতিল নামিয়ে আরেকটা পাতিল বসালো। তারপর চুলা অন করে দিলো।শিরিনা বেগম তাকে রান্না শেখানোর ব্রত নিয়েছেন। কুহু যে একবারে রান্না পারে না তা না।টুকটাক নুডুলস রান্না চা কফি করা সে পারে। কিন্তু তরকারি সে এর আগে রাঁধে নি। তাই শিরিনা বেগম অল্প কিছু সবজি দিয়ে তাকে রান্না শেখার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।কুহুকে নিজহাতে সব সবজিসহ পেয়াজ মরিচ কাটতে হয়েছে৷ সে পাতিলে তেল ঢাললো, তেল গরম হতেই পেঁয়াজ মরিচ ছেড়ে দিলো।মনে মনে রেসিপিটা আরেকটু সাজিয়ে নিলো।অন্যমনস্ক হলে চলবে না,এইবার সে আর কোনো ভুল করবে না।
শিরিনা বেগম তরকারি কুটতে কুটতে হতাশ চোখে কুহুকে দেখলেন। মাথা চুলকে চুলায় চাপানো পাতিলে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। আগে থেকেই কোনো কাজ না শিখানোর জন্য মনে মনে আফসোস করলেন। তিনি ভাবেন নি এত তাড়াতাড়ি মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে যাবে, জানলে এই ভুল করতেন না।
সন্ধ্যার পর কুহু ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে সোজা বিছানায় শুয়ে পড়লো। আজ দিনের বেশির ভাগ সময়ই সে রান্নাঘরে কাটিয়েছে, এখন সন্ধ্যার নাস্তার সময়ও শিরিনা বেগম তাকে দিয়ে কাজ করিয়েছে। কুহু মনে মনে চিন্তা করলো শিরিনা বেগমের কথা। তার মা বাড়ির সব কাজ করে,বাড়ির সবার দেখভাল করে, যে যখন যা খেতে চায় তাই-ই বানিয়ে দেয়, কখনো ক্লান্ত হওয়ার দোহাই দেয় না।অথচ সে একদিনেই কাহিল হয়ে গেছে। হঠাৎ দরজায় টোকা পড়লো।কুহু উঠে বসলো। গলা উঁচিয়ে বললো-
“দরজা খোলা।”
দরজা হালকা ফাঁক করে যিয়াদ উঁকি দিলো। কুহুর দিকে তাকিয়ে বলল-
“আপু তোমাকে বাবা ডাকছে।”
যিয়াদ চলে গেলো। কুহু কিছুক্ষন বসে থাকলো।নিজেকে একটু পরিপাটি করে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসলো। মোয়াজ্জেম হোসেনের দরজায় নক করলো।ভিতর থেকে ভেসে আসলো-” দরজা খোলা আছে।”
কুহু ভিতরে ঢুকলো।দেখতে পেলো তার বাবা মা দুজনেই সোফায় বসে সামনের টেবিলে ঝুঁকে কিছু একটা দেখছে। শিরিনা বেগম ডাকলেন-
“এদিকে এসে বস।”
কুহু মায়ের পাশে গিয়ে বসলো।দেখলো টেবিলের উপর অনেকগুলো বিয়ের কার্ড। মোয়াজ্জেম হোসেন বিয়ের কার্ডগুলো কুহুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন-
“দেখো তো তোমার কোনটা পছন্দ হয়।তোমার যেটা পছন্দ হয় সেটাই ফাইনাল।”
কুহু উল্টেপাল্টে কয়েকটা কার্ড দেখে একটা সিলেক্ট করলো।হাতে নিয়ে সম্মতির আশায় শিরিনা বেগমের দিকে তাকালো। শিরিনা বেগম হাতে নিয়ে দেখলেন।মুখে বললেন-
“বাহ! সুন্দর তো!এটাই ফাইনাল করে দাও।”
মোয়াজ্জেম হোসেন চায়ে চুমুক দিয়ে উপর নীচ মাথা নাড়লেন। অর্থাৎ এটাই ফাইনাল।
খান বাড়িতে ড্রয়িং রুমে বাড়ির সবাই এক হয়ে আড্ডা দিচ্ছে। আড্ডার মধ্যমনি রাহাত। তার দুই পাশে রাফা আর রিদি বসে আছে। সে বিভিন্ন কথা বার্তা বলে তাদের দুজনকে হাসাচ্ছে। বাড়ির মহিলারাও পাশে আরেকটা সোফায় বসে চা খাচ্ছে আর শুনছে সব। রাহাত বেগুনিতে কামড় দিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
“ওরা এখনো আসছে না কেন মা?”
জয়া বেগম চায়ের কাপ টেবিলে রেখে বললেন-
“ফোনে কথা হয়েছে শাহাদের সাথে। কাজে আটকে পড়েছে তারা।ব্যবসার কাজ শেষ করে সবাই পার্টি অফিসে গেছে।”
কুলসুমা বেগম রাহাতকে জিজ্ঞেস করলেন –
“তোমার বাবার খবর কি?সামনের নির্বাচনেও কি এমপি পদে দাঁড়াবে?”
রাহাত হেসে বিনয়ের সাথে বললো-
“জী ইন শা আল্লাহ।”
কুলসুমা বেগমের পাশে বসা মালা ফোঁড়ন কেটে বললো-
“আমরার এলাকায় সামনের নির্বাচনে ভাইজান দাঁড়াইব,তাই না চাচীআম্মা?”
রেজিয়া সুলতানা বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলেন-
“তোকে এই কথা কে বলেছে?”
মালা মুড়িমাখা চাবাতে চাবাতে বললো-
“চাচাজান রে চা দিতে যাইয়া শুনছি।মোবাইলে কার লগে জানি আলাপ করতাছিলো।”
বসার ঘরের সবাই থ হয়ে গেলো। তারা কেউই এই ব্যাপারে জানলো না অথচ মালা জেনে বসে আছে।রাহাত জিজ্ঞেস করলো-
“শাহাদ নির্বাচন করবে?”
রেজিয়া সুলতানা বললেন-
“না এমন কোনো কথা হয় নি তো।ও কি শুনতে কি শুনেছে।”
শাহাদরা সবাই বাড়ি ফিরায় কথা আর আগালো না। তাদের আগে আগে দুজন লোক এসে হাত ভর্তি কিছু শপিং ব্যাগ আর কাঁচাবাজারের ব্যাগ এক পাশে রেখে গেলো। আব্দুল গাফফার খান বাড়িতে ঢুকেই হাঁক ছেড়ে আনিশাকে ডাকলেন।আনিশা আব্দুল গাফফার খানের গলা শুনে “দাদাজান” বলে সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। আব্দুল গাফফার খান নাতনীর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন। আশফাক খান মেয়েকে এত দিন পর দেখে মেয়ের কপালে চুমু খেলেন। শাহাদ জিজ্ঞেস করলো-
“কেমন আছিস আপু?”
আনিশা শাহাদের চুল এলোমেলো করে বলল-
“তোদেরকে দেখে এখন অনেক ভালো আছি।”
আনিশার দেখাদেখি রাহাত উঠে এসে সালাম দিলো আব্দুল গাফফার খানকে।আশফাক খানকে ভয়ে ভয়ে সালাম দিলো রাহাত।তিনি সালামের জবাব দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন-
“অনেক দিন পর এসেছো। এইবার বেশ কয়েকটা দিন থেকে তারপর যাবে।কোনো ব্যস্ততার দোহাই দিবে না। আমার মেয়ে এত ঘন ঘন দূরের জার্নি করতে পারে না।”
রাহাত নীরবে মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিলো,না করার সাধ্য তার নেই।তাহলে আবার ব*ন্দুক নিয়ে তাড়া করবে।রাহাত সেই রিস্ক নিলো না সে আরো অনেকদিন থাকবে।একবার আড়চোখে তাকিয়ে শ্বশুড়ের চলে যাওয়া দেখলো। শাহাদ রাহাতের কাঁধে হাত রেখে বলল-
“কি খবর ভাই? অবস্থা কিছুটা টাইট মনে হচ্ছে।”
“বিয়ে তো করো নি অবস্থা টাইটের কি বুঝবে। বিয়েটা আগে করো পরে বুঝবে কত ধানে কত চাল।”
শাহাদ চোখ মেরে বললো-
“আমার বউ এর বাবা নিজে থেকে আমাকে পছন্দ করেছে, তাই অবস্থা টাইট হওয়ার ভয় নেই।ধান চালও গুণতে হবে না।।”
রাহাত আসল জায়গায় খোঁচা খেয়ে চোখ ছোট ছোট করে বলল-
“বিয়ের আগেই বউ?হা? মনে তো হচ্ছে তোমার অবস্থা টাইট করবে তোমার বউ।”
শাহাদ ঠোঁট কামড়ে হাসলো।গলার স্বর নিচু করে রাহাতকে বললো-
” শ্বশুরের বদলে বউ এর হাতে অবস্থা টাইট হলে মন্দ হয় না।আই হোপ ব্যাপারটা সুইট হবে।”
রাহাত নাক কুচকে শাহাদের দিকে তাকালো।শাহাদের হাসি দেখে তার গা জ্বলে যাচ্ছে।এই শালা জাতির “শালাগিরি” না করলে চলে না? ঠিক ই সুযোগ বুঝে একটা খোঁচা মে*রে দিলো। রাহাতের ইচ্ছে হচ্ছে শাহাদের হবু বউ এর কাছে গিয়ে শাহাদকে নাকানি চুবানি খাওয়ানোর বুদ্ধি দিয়ে আসতে।
চলবে
[আজকের পার্টটা অনেক ছোট হয়ে গেছে।ব্যস্ততার কারনে গল্পটা গুছিয়ে লিখতে পারছি না। একে তো ব্যস্ততা তার উপর হাড় কাঁপানো ঠান্ডা, সব কিছু মিলিয়ে নাজেহাল অবস্থা। অনেকে প্রতিদিন গল্প দিতে বলছেন।কাল থেকে ইন শা আল্লাহ চেষ্টা করব প্রতিদিন দেয়ার😊।]