#মায়াবন_বিহারিনী_হরিণী
#Writer_Neel_Noor
#পর্ব ৪
কারো ডাকে ঘুম ভাঙল। আড়মোড়ে জেগে উঠলাম। পাশে দেখি রেহানা ভাবী দাঁড়িয়ে আছে, আমি চোখ মেলে তাকাতেই বলল- উঠো, তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হয়ে নাও। এই হাওলাদার বাড়ির নিয়ম বেলা ৭ টার আগেই সকালের নাস্তা রেডি থাকতে হবে। এমনিতেই ৬ টা বেজে গেছে। আর বাড়ির বউদের সবার আগে উঠে নামাজ পড়ে রান্নাঘরে যেতে হয়। চল চল..নিচে চল…কাল একটু বেশি রাতে ঘুমিয়েছো বলে আমি তোমাকে ফজরের সময় জাগাই নাই….
তার কথায় তড়িঘড়ি করে উঠে বসলাম। সত্যি ই তো, আমি তো আর ঐ বাড়িতে নেই, নতুন একটা বাড়িতে এসেছি, এখানে অনেক নিয়ম আছে, আমাকে মেনে নিতে চলতে হবে তো….
রেহানা ভাবী চলে গেল , আমি উঠে মিনিট দশেকের মধ্যে ই নিচে নামলাম। নিচে নামতেই, প্রায় সাড়ে ছয় ছুঁই ছুঁই বেজে গেছে, একটা রুক্ষ কন্ঠের তীর আমার দিকে ছুড়ে এলো…
বলল- জমিদারের বেটি নাকি? তা জমিদারের বেটি কে তো টাকা দিয়েই কিন্না আনছি, জমিদারি করতে তো আনি নাই। এ কেমন বেক্কাল বউ, নতুন বউ রা কি বেলা বাজাইয়া উঠে, এই ছেমরি, আক্কল নাই তোর?….
কথাটায় কেঁপে উঠলাম। ভেতর থেকে চাপা অভিমান এ চোখে জল গড়িয়ে পড়লো!!এ পৃথিবীতে কি ই কান্না আর কথা শুনতেই এসেছিলাম নাকি। ছলছল চোখে তাকালাম…
এক বৃদ্ধ মহিলা পান চিবুতে চিবুতে এ কথার তীর আমার দিকে ছুড়েছে, এই আগুনের মধ্যে ই ঘি ঢাললো আমার চাচি শাশুড়ি, বলল- কিন্না আনছে, আমাগো বংশের পোলার সেবা করার জন্য, রক্ষিতাদের আবার বউ বলে ডাইকেন না মা!! পরে মাথায় উঠে যাইবে…(আমি আশেপাশে আড়চোখে তাকালাম, পরিবারের লোকজন না থাকলে ও, দুজন কাজের লোক ছিল, এই চোখ দুটো শুধু এই কথার তীর থেকে বাঁচাবে, এমন লোক খুঁজছিল…)
বুঝতে পারলাম ওনি আমার দাদি শাশুড়ি। কাঁপা কাঁপা গলায় সালাম দিলাম। কিন্তু ওনি মুখ ভেংচে দিল। রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই, দাদি শাশুড়ি চিল্লিয়ে উঠল – এই এই!! রক্ষিতা মাইয়া, একদম রান্নাঘরের দিকে যাইবা না, খাবার ছুইবা না, তুমি রানলে, ও রান্না গলা দিয়ে নামবো না, যাইবা না….
(আর কিছু বলার আগেই চাচি শাশুড়ি তাঁর কানের কাছে ফিসফিস করে কিছু বলল, দুজনেই চোখের ইশারায় একমত হলো, রাইটার- নীলনূর)
নিমিষেই দাদি শাশুড়ি কথা পাল্টে বলল- আচ্ছা ঠিক আছে, যাও যাও রান্না ঘরে যাও, এই বাইত আইছো, সব কাজ করবা, সবার কাজই, যাও…
বুকটা নিমিষেই ফেটে যাচ্ছে। চুপচাপ রান্না ঘরে গেলাম। রেহানা ভাবী আমাকে তার কাছে নিয়ে বলল- কান্না করতে নেই, যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছে, সব ঠিক হয়ে যাবে।
কি বলব, কিছুই বলার নেই। চুপচাপ কাজ করতে লাগলাম….
_______
হাতে খাবার নিয়ে রাজের ঘরের দিকে রওনা হলাম, কালকের ঘটনায় আজ আমার খুবই ভয় করছে। তবু ও ক্ষৃন মনে চুপচাপ এগিয়ে যাচ্ছি। দরজার সামনে দাঁড়ালাম, মনে মনে আয়াতুল কুরসি পাঠ করে ভেতরে প্রবেশ করলাম।
রাজ এখন ও ঘুমিয়ে আছে। কী অপরূপ তার ঘুমন্ত চেহারা। আচ্ছা!! আমি তার স্ত্রী বলেই কি তার চেহারা আমার কাছে এতো পবিত্র লাগে? নাকি সে আসলেই সুন্দর!!
এগুলো ভাবতে ভাবতে কখন যে রাজের সন্নিকটে পৌঁছে গেলাম, খুব ই সন্নিকটে, অজান্তেই রাজের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। মিনিট খানেক মধ্যে ই রাজ ঘুমের ঘোরে বলে উঠল – বিহারিনী, এই অভ্যাস কবে ছাড়বি বল তো!!
বিহারিনী কথাটা মাথায় আসতেই, চোখের পলকে হাত সরিয়ে নিলাম। বুকে ধক করে চিনচিনে ব্যথা উঠল, নিশ্চয়ই কোন নারী তার শখের পুরুষের মুখ থেকে অন্য নারীর কথা শুনতে পারে না!!
আমার মস্তিষ্ক আমায় বলছে, মনকে কন্ট্রোল করতে, এটাতো শর্ত মোতাবেক বিয়ে, যদিও পুরোপুরি হালাল ভাবে, তবুও কেন একদিনে ই রাজ কে আমার এতো ভালো লাগছে?
হয়তো আমার এই অষ্টাদোষী পাড়ায় প্রথম রাজের আগমন, তার ই বসন্তে মাতাল হচ্ছি আমি….(চোখের কোণে থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো রাজের মুখে…..)
রাজ লাফ দিয়ে উঠে বসে পড়লো, ঝাপটে ধরল আমাকে, চিন্তাময় কন্ঠে বলল- তুই কাঁদছিস কেন বিহারিনী!! তুই কাঁদছিস কেন? আমি কি কিছু বলেছি? বলিনি তো, কিছু লাগবে তোর, বলনা কি লাগবে, আমি এনে দিব, আমি আবরার হাওলাদার রাজ, এই পৃথিবীর সবকিছু তোকে এনে দিব….
হালকা ধাক্কা দিয়ে, দূরে সরে দাঁড়ালাম, বড় বড় দম নিতে নিতে বললাম – এইভাবে কেউ কাউকে সাপের মতো জড়িয়ে ধরে, বলেনতো!! আর একটু হলেই তো আমি পিষ্ট হয়ে বষ্ম হয়ে যেতাম (ঠোঁট গুলো ফুলিয়ে, চোখ গুলো পিটপিট করে তাকিয়ে…)
রাজ সেকেন্ড খানেক অবাক হয়েই তাকিয়ে রইল, তারপর ফিক করে হেসে উঠলো, বলল- নতুন বউ!! তোমাকে একদম বাচ্চা বাচ্চা কার্টুন লাগছে!! আসো!! আমার কাছে আসো, গাল টিপে একটু আদুর করে দেই…(বলেই বাচ্চাদের মতো কুটকুট করে হেসে উঠলো)
হুম!! তা না হয় দিয়েন পরে!! আগে খাবার খেয়ে নেন। চলেন…
রাজ বাচ্চাদের মতো মুখটা ফুলিয়ে, বলল- আমি সকালে খাই না, তুমি খাবার নিয়ে যাও, চলে যাও, না হয় আমি তোমাকে মারব, এই হাতের পাশে ফুলদানিটা দিয়ে কালকের মতো মারব!!
মনটা খারাপ করে বললাম – সমস্যা নেই! আমার তো বাবা মা কেউ নেই, এই ঘরের নতুন বউ!! আপনি আমার কথা শুনেন না, আমাকে মারবেন, ঘরের সবাই মারবে… থাক আপনার খেতে হবে না, আমি যাই সবার হাতে মার খেয়ে আসি!!
রাজ দৌড়ে খাট থেকে নেমে আমার হাত খপ করে ধরল, বলল- নাআআআআআ!! নতুন বউ, তুমি আমার মতো মার খেও না, না হয় তুমি ও পাগল হয়ে যাবে!! আমার মতো!!
এটা বলেই রাজ আমার হাত থেকে খাবার নিয়ে খেতে থাকল। রাজের কথাটায় আমি বেশি একটা পাত্তা দিলাম না, মনে মনে শুকরিয়া জানালাম আল্লাহ কে, রাজ খাবার গুলো খেয়ে নিচ্ছে।
______
রাজের খাবার খাওয়া শেষ ই নিচে নামলাম, নামতেই রাজের বাবা বলল – মা মায়া…!! রাজ কী খেয়েছে?
আমি হাঁসি মুখে হা সূচক উত্তর দিলাম। রাজের বাবা খুব খুশি হয়ে বলল – আলহামদুলিল্লাহ। রাজ কখনো সকালের খাবার খায় না, আমার ছেলেটার যত্ন নিও….
_______
চেয়েছিলাম রাজের রুমে সিফ্ট হতে, কিন্তু রাজের রুম রাজ পাগলা গারদ করে রেখেছে, তাই পাশের একটা ফাঁকা রুমে সিফ্ট হলাম। চিন্তা করলাম, এক দুই সপ্তাহ রাজের সাথে মিশি, রাজ কে চিনি , তারপর না হয় রাজের রুমে সিফ্ট হলাম….
রাজ কে রেডি করিয়ে দিলাম। মারিয়া, আর মাহিয়া রাজের দুই চাচতো বোন। ওরা আমার থেকে বছর খানেক ছোট। চাচি শাশুড়ির অগোচরে পরিচয় হয়েছে ওদের সাথে। খুব ই ভালো মেয়ে ওরা…
চলবে….