#মায়াবন_বিহারিনী_হরিণী
(রাজ_বিহারিনী_রুদ্র পর্ব২)
৯
#writer_Neel_Noor
এতো বছর পর ছেলে বাড়ি ফিরে এসেছে সবাই যেন আনন্দে চাঁন চাঁন ভাব। হাওলাদার বাড়ি পূর্ন। এখানে শোরগোল তো সেখানে শোরগোল। সবাই রুদ্র কে আপ্পায়ন করতে ব্যাস্ত। বিহারিনী আড় চোখে বারবার রুদ্রের দিকে তাকাচ্ছে। রুদ্র দেখতে খারাপ না। ছয় ফুটের লম্বা ছেলে, ধবধবে ফর্সা, গাঢ় বাদামী চোখের মনি, চাপা দাড়ি…সব মিলিয়ে এককথায় অসাধারণ। একদম ইংরেজ। বিহারিনী মনে মনে রুদ্র কে নাম দিলো, ইংরেজদের বংশধর।
এই দিকে রুদ্র আর বিহারিনীর এই চোখের মিলন আরেকজন দূর থেকে লক্ষ করলেও পাত্তা না দিয়ে ই উড়িয়ে দেয়। এই উড়িয়ে দেওয়া টাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়…..
____
সন্ধ্যা বেলা, হাওলাদার বাড়ির সব মহিলারা রান্না বান্না করছে। বলতে গেলে হাওলাদার বাড়ি পূর্ন আজ। বিহারিনী কে তার দাদী খুব ই ভালোবাসেন। নাতনি এখানে এসেছে এতো বছর পর, তাই সে বিহারিনী কে চোখে হারায়। বিহারিনীর খুব পছন্দ হচ্ছে আইসক্রিম। একটা আইসক্রিম এর বাটি সে একলাই খেতে বসেছে সোফার এক কোনায়। দাদি পাশেই বসে সে নিজ মনে খাচ্ছে…
ফ্রেশ হয়ে রুদ্র নিচে নামছে। এর মধ্যে ই রাজ বাহিরে থেকে এলো। রুদ্র কে দেখে রাজ অবাক হয়ে গেল। অবাক তো হওয়ার ই কথা, কারন রাজ তো জানত না, রুদ্র আসবে। দৌড়ে রুদ্রকে জড়িয়ে ধরল। রাজ আর রুদ্র ছোট বেলা থেকেই বন্ধুর মতো। তাদের মধ্যে খোশগল্প শুরু হয়ে যায়…
বিহারিনী এখনো বুঝে উঠতে পারছে না, রুদ্র কে? তাই সে দাদির কানে ফিসফিস করে বলল – দাদুন, এই রুদ্র কে?
দাদী হো হো করে হেসে উঠলো। দাদির হাঁসির আওয়াজ এ রুদ্র ও রাজের ধ্যান ভাঙল। বাড়ির বউরা ও রান্না ঘর থেকে বাহিরে বেড়িয়ে এলো।
বিহারিনী প্রশ্ন টা করে থমকে গেছে, লজ্জায় লাল হয়ে গেছে তার গাল দুটো। রুদ্র আড় চোখে তাকালো, মনে মনে হেসে বলল – টমেটো!!
রাজ দাদির দিকে এগিয়ে এসে বললো – তা বুড়ি আজ মনে খুব রং লাগছে, তাই এমনে হাসতেছো!! আজ কিন্তু জামাই একটা না দুটো, সামলাবে কি করে। (টুপ করে বিহারিনীর হাত থেকে আইসক্রিম এর বাটিটা নিয়ে, রাজ আইসক্রিম খেতে শুরু করলো..)
বিহারিনী কিছু বলবে তার আগেই, দাদী বিহারিনী কে জড়িয়ে ধরে বলল- রুদ্র কে তুই চিনস না? আরে ও ই হচ্ছে আদরিশ, তোর মেজ চাচার ছেলে।
বিহারিনী একবার রুদ্রের দিকে তাকায়, তো একবার সবার দিকে তাকায়। সবার হাসি দেখে সে লজ্জা পেয়ে নিচু মাথায় বসে থাকে।
রুদ্রের মা মানে বিহারিনীর মেজো চাচি তার শাশুড়ি কে বলে উঠল – আপনি ও মা আছেন বটে। ও কি রুদ্র কে চিনে নাকি!! আমার রুদ্র ও তো বিহারিনী কে চিনবে না। আসলে ই পরিস্থিতি টা ই এমন হয়েছে, আমাদের বাড়ির ছেলে মেয়ে রা ই ছিটকে ছিল এতো দিন। এখন সবাই একসাথে, চিনবে জানবেই…
রাজ বিহারিনীর আইসক্রিম নিয়ে খাচ্ছিলো। বিহারিনীর মোটেও সহ্য হচ্ছিল না। কারন বিহারিনী সবার ভাগ দিতে পারবে, নিজের আইসক্রিম এর ভাগ না….যেই বিহারিনী রাজ থেকে আইসক্রিম এর বাটি নিতে হাত বাড়িয়ে দিলো…ঠিক তখন ই রুদ্র রাজের আইসক্রিম এর বাটি টা ইচ্ছে করে ফেলে দিল….
ঝনঝন শব্দে কাঁচের বাটি টা ভেঙে গেল। রাজের মা দৌড়ে এলো এদিক। রাজ কে দেখে বলল- খাবার খাওয়ার সময় কি একটু হুশ থাকে না তোমার!! সবসময় ঘরে কোন না কোন কিছু নষ্ট করবেই… কেন?
রহিমা বেগম (দাদী) চেঁচিয়ে উঠলো বলল- তাতে তোমার কি!! তুমি তোমার কাজে যাও, (এক কাজের মেয়ে কে ইশারায় পরিস্কার করতে বলল)
রাজ রেগে, ধুমধাম পায়ে বাহিরে চলে গেল।
রহিমা বেগম (দাদী)- শান্ত হয়েছো, তুমি (রাজের মা কে উদ্দেশ্য করে) , তোমার জন্য আজ আমার বংশের ছেলেটা এমন। কেন ওর কাজে কর্মে বা হাত, ডান হাত ঢোকাও,….(বলেই বিহারিনী কে সাথে নিয়ে উপরের দিকে রওনা দিল)
বিহারিনী এখনো ছল ছল চোখে তার আইসক্রিম এর বাটির দিকে তাকিয়ে রইলো। রুদ্র আনমনে তাকিয়ে হাসলো… আইসক্রিম খাওয়া বিহারিনীর প্রতিদিনের কাজ, তাই সন্ধ্যা হলেই আইসক্রিম নিয়ে বসে।
_____
রাতে সবার খাওয়া শেষ। রাজ রাগ করে যে বাহিরে বেড়িয়ে গেছে এখন ও ফিরে নাই। বিহারিনী নিজের রুমে বসে আছে। আজ তার খুব মন খারাপ। এখানে এসে সে বুঝেছে, মা বাবা থাকা কত জরুরি। মারিয়া আর মাহিয়া কতো আদর খায় তার মা বাবার হাতে। তার ও লোভ হয়… কিন্তু দিন শেষে…সে সব কিছু থেকে বঞ্ছিত!!
বিহারিনীর খুব ভালো একটা গুন সে ছবি আঁকতে পারে। বারান্দায় জোৎস্না রাতে একবার আকাশের দিকে তাকায়, কখনো চোখের পানি মুছে, থরথর কেঁপে উঠে, কাঁপা কাঁপা চোখে ছবি আঁকে, সে সবসময় তার পুরোনো বাবা মায়ের সাথে কাটানো স্মৃতি মনে করে আঁকতে চেষ্টা করে!!
আজ ও তার ব্যাতিক্রম নয়। তার মন খুব খারাপ। রাজ কে সে পছন্দ করে, কারন রাজ প্রতি মাসে একবার তার সাথে দেখা করতে যেত, অনেক গুলো আইসক্রিম নিয়ে, তারপর তার সাথে ঘন্টা খানেক কথা বলতো, বিহারিনী মুচকি মুচকি হেসে হু হাঁ বলতো।
হঠাৎ করেই নিচের ড্রইংরোম থেকে কিছু ভাঙচুর এর শব্দ শোনা যাচ্ছে। বিহারিনী তার পেইন্টিং ছেড়ে ই, দৌড়ে সিঁড়িতে গিয়ে দাঁড়াল। আগে থেকেই সবাই সেখানে উপস্থিত। রুদ্র রাজকে সামলাচ্ছে। কিন্তু রাজ মদ খেয়ে মাতাল হয়ে আছে। বিহারিনী রাজের এমন রুপ কখনো দেখবে বলে ভাবে নাই। রাজ একটা মেয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই মেয়েটাকে চলে যেতে বলতেছে, কিন্তু রাজ মদের নেশায় টুল টুল, তবুও সে ঐ মেয়েকে ছাড়বে না, হাত ধরে আছে। কি বিশ্রী ভাষায় একথা ওকথা বলছে…
রাজ এর এই অবস্থা দেখে বিহারিনীর মন আরো বেশি খারাপ হয়ে উঠল। বিহারিনী আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই, রাজের নজর বিহারিনীর দিকে পড়লো।
বিহারিনীর খেয়াল ছিল না, যে সে এলোমেলো অবস্থায় ই নিচে নেমে এসেছে। রাজ বাঁকা হেঁসে বলল, তুই যা, টাকা পেয়ে যাবি..(মেয়েকে ইশারা দিয়ে) …
সবাইকে এড়িয়ে বিহারিনীর সামনে এসে দাঁড়ায়, বিহারিনী মদের গন্ধ সহ্য করতে না পেরে নাক মুখ চেপে ধরল। রাজ হালকা হেসে বলল – তুই এতো সুন্দর কেন!! যেদিন থেকে আমি তোকে দেখেছি, সেদিন থেকে কত সুন্দরীদের কাছে গিয়েছি, কিন্তু তোর নেশা আমার কাটে নাই!!
(বলেই বিহারিনীর উপর ঢলে পড়তেই রুদ্র রাজকে সামলে নিল)
রাজের মা মুখ ভেংচে বলে উঠল – দুদিন এর মেয়ে, এখন ই এমন!! (আর কিছু বলার আগেই রাজের বড় নামমাত্র ভাই তার মাকে খোঁচা মেরে থামিয়ে দিল)
রহিমা বেগম আড়চোখে তাকালে ও, এই পরিস্থিতিতে আর কথা ও ঝগড়া বাড়াতে চাইলেন না….
_____
গভীর রাত!! বিহারিনীর ঘুম ই আসছে না। একের পর এক ছবি ছিঁড়ে ফেলছে। কিছু তেই মন বসছে না। রাজের কথা, তার মনে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। যদিও পুরোপুরি বুঝে নাই, রাজের কথা!! তবুও আজ তার কর্মকাণ্ড প্রেমিকা মনকে বিষিয়ে তুলেছে…..
বিহারিনীর খুব খারাপ লাগছে, কি করবে, কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। একে তো নিজেকে বুঝতে পারছে না, আরেকদিকে সব কিছু তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে… ডুকরে কেঁদে ওঠে সে, রঙ পেন্সিল নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল, বলল- আমাকে একা রেখে কেন চলে গেলে তোমরা!! নিয়ে যেতে কি ক্ষতি ছিল….
হঠাৎ একটা মিষ্টি কথার স্বর এলো, বলল-
নারীরা কাঁদে বেশি!
পান থেকে চুন খসলেই কাঁদে!
সামান্য আঘাতে কাঁদে…..
বিহারিনী বুঝতে পারলো কন্ঠ টা রুদ্রের। কিন্তু রুদ্র কোথায়। মাথা উঁচু করে আশেপাশে আড়চোখে তাকাতেই দেখে, তার পাশের বেলকোনি তে, হাতে একটা বাটিতে আইসক্রিম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে….
বিহারিনী নিজেকে শান্ত করে, হাত উল্টে চোখ মুছে মাথা নিচু করে দাঁড়াল। রুদ্রের বেলকোনি আর বিহারিনীর বেলকোনি খুব কাছেই, রুদ্র ইচ্ছে করলেই এখানে চলে আসতে পারত, তবে সে বিহারিনী কে শক্ত বিহারিনী হিসেবে দেখতে চায়!!
রুদ্র – আমাদের তো পরিচয় ই হলো না। প্রথম ছোঁয়া, পরিচয়ে কতো নট্য কাহিনী । তবে পরিচয় হলে ( আইসক্রিম এর বাটিটা এগিয়ে দিয়ে) দিতাম তোমাকে….
বিহারিনী আড়চোখে আইসক্রিম এর বাটি টা দেখলো। আজ তার মনমতো আইসক্রিম খাওয়া হয় নাই, তাই সে, রুদ্র থেকে আইসক্রিম এর বাটি টা টুপ করে নিয়ে রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে, খিলখিল করে হাসতে লাগলো!!
রুদ্র জানত এমন টা হতো। এখানে আসার আগেই সে বিহারিনীর সবকিছু ই, জেনেছিল, তাইতো আজ অবিনব কায়দায় কথা বলা, এক কদম এগিয়ে আসা… মুচকি হেসে সে চলে গেল…
চলবে….