মায়াবন_বিহারিনী_হরিণী ১৫ #writer_Neel_Noor

0
506

#মায়াবন_বিহারিনী_হরিণী
১৫
#writer_Neel_Noor

হঠাৎ ঐ লকেট টার কথা মনে পড়লো। রাজ তো ঘুমিয়ে ই আছে , তাই রাজকে একা রেখেই, আমি আমার রুমে গেলাম!! আলমারি টা খুলে রকেট টা হাতে নিলাম। তারপর রাজের রুমের দিকে ফিরতেই রাজের চিৎকার ভেসে এলো। রাজ চিৎকার করে বলছে – তুই বিহারিনী কে ও মেরে ফেলেছিস, আমাকে ও মেরে ফেলবি?…. আমার বিহারিনী….

এই অদ্ভুত কথা শুনে আমি নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। কারন বিহারিনীর খোঁজ পাওয়া যায় নাই। সে আজো বেঁচে আছে কি নেই। তার উপর রাজ এতোদিন জোর দিয়ে বলত, তার বিহারিনী বেঁচে আছে, আজ কি হলো….

আমি রাজের রুমে প্রবেশ করতেই, বারান্দার দেওয়ালের আড়ালে একটা ছায়া মিইয়ে গেল। আমার তৃক্ষ নজর এ তা এড়ালো না। রাজ নিজেকে বিছানার এক কোনে গুটিসুটি করে রেখেছে, ভয়ে চোখ বুজে আছে, এই হাল্কা শীতে ও সে ঘেমে একাকার….

রাজের কাঁদে হাত রাখতে ই রাজ কেঁপে উঠল, আমাকে দেখে যেন সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। মূহুর্তে ই আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি রাজকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করলাম না। তাই, রাজকে আমি ও জড়িয়ে ধরলাম….

আমাদের মিলন মনে হয় বিধাতা ও এক করে রাখে নাই। তাইতো, যখন রাজের একটু আশেপাশে আসি, তখনই কেউ না কেউ আসবেই, হঠাৎ করেই বাবার আগমন। বাবা রুমে ঢুকেই রাজকে আর আমাকে জড়িয়ে ধরায় দেখতে পেয়ে একটু বিষম খেল। হাল্কা কাশিতে, আমার ধ্যান ভাঙল, আমি রাজ থেকে ছিটকে দূরে সরে গেলাম….

মাথা নিচু করে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। বাবা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য বলল- তোমাদের পার্সপোর্ট রেডি। আর কাল ই তোমরা সুইজারল্যান্ড এর জন্য তৈরি হয়ে নাও।

______

আজ ছয় মাস পর দেশে ফিরছি। রাজ আর আমি বিমানবন্দরে আসতেই বাবা, চাচা এগিয়ে এলো। রাজ কে জড়িয়ে ধরল। রাজ এখন আগের থেকে সুস্থ। বাবা আমাকে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল – তোকে যে কি বলে শুকরিয়া জানাই রে মা! আজ তোর এই পরিশ্রম এ ই আমি আমার ছেলে ফিরে পাইছি।

আমি বাবার হাত ধরে মুচকি হেসে বললাম – বাবা এটা তো আমার রিসপন্সেবিলিটি ছিল। আমি তা পুরোপুরি পুর্ন করেছি।

বাড়ির দিকে যাচ্ছি। গড়ি নিজ গন্তব্যে চলছে। আমার মনে পড়ে গেল, সেদিন এর কথা, যেদিন রাজ পুরোপুরি তার হুঁশে ফিরেছিল। আমাকে প্রশ্ন করেছিল ? কে আমি? কোথায় সে? বিহারিনী ঠিক আছে? পরিবার কেমন আছে?

রাজ কে সেদিন সব কিছু ই খুলে বলেছিলাম। কে আমি, কি আমার পরিচয়। আমাদের বিয়ে/ বিয়ের শর্ত গুলো। রাজ সেদিন চুপচাপ ছিলো। কিছু ই বলে নি। যতবার ই রাজের সামনে যেতাম, সে শুধু তাকিয়ে থাকত, হু হা এর বেশি কিছু বলতো না।

দেখতে দেখতে আবার ও হাওলাদার বাড়ির গেটের সামনে। কত দিন পর দেখা বাড়িটা। গেইটের সামনে ই দাদী শাশুড়ি, চাচি শাশুড়ি সহ পরিবারের সবাই দাঁড়িয়ে আছে। রাজ কে দেখে সবাই খুশী জড়িয়ে ধরল। যদিও রাজের মায়ের খুশি ভাব খুশি খুশি লাগল না। মনেই মনে প্রশ্ন জাগল – সৎ মা বলে কি , ছেলের প্রতি মায়া থাকবে না!! ইনি কি সেই, যে রাজের বউ করার আগে রাজের জন্য উতলে পরা মায়া দেখাইছিলো!! হয়তো তাই? যেমনটা আমার প্রতি আমার মায়ের ২য় স্বামী করত। সবার সামনে ভালোবাসা, কিন্তু আড়ালে কুনজর!!

______
দুই দিন কেটে গেল। সবার সাথে ই সবকিছু নরমাল ভাবেই চলতে থাকল। রাজ আর আমার কথা হয় না বল্লেই চলে। রাজ থাকে এক রুমে আমি অন্য রুমে। তাছাড়া রাজ সকাল সকাল বের হয়, সেই রাতে ফিরে। বুঝতে ই পারছি না, আসলেই কি রাজ ঠিক হয়েছে, নাকি আবার ও অসুস্থ পরিবেশ এ নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে।

রাতের বেলা, সবাই একসাথে খেতে বসেছি। আজ লাগছে পরিবার পূর্ণ। রাজ ও আছে খাবারের টেবিলে….কিন্তু আমার মনে এক আকাশ সমান বিষন্নতা, কালো মেঘ, হাজার ও ভয়ের অনুভূতি। রাজ ঠিক হয়ে গেছে, মনেই মনে খুব ই খুশি আমি। আমি আমার কর্তব্য থেকে মুক্তি। কিন্তু এই বাড়িতে কি আমার বেশিদিন টিকা হবে?

এর মধ্যে ই আমি চাচি শাশুড়ি, দাদী শাশুড়ির অনেক টাই প্রিয় হয়ে উঠেছি। সুইজারল্যান্ড থাকতে, এমন কোন দিন নেই, তারা ভিডিও কলে আমার খোঁজ খবর না নিয়েছে। কিন্তু সেই সাথে আমার শাশুড়ি, মহন ভাই মোহিনী ভাবি থেকে দূরত্ব বেড়েছে। যদিও আমার সন্দেহ হয় তাদের উপর, রাজের ক্ষতির জন্য তারাই দাই। তবে প্রমান কোথায়….

খাবার তো গলায় যাচ্ছে ই না। এক রহস্য থেকে বের হতেই আরেক রহস্য। এই বাড়িটা এতো রহস্য কেন?

আমার ভাবনায় ফোরন কেটে আমার শাশুড়ি বলে উঠল – রাজের আব্বা, রাজ আর মায়ার যখন বিয়ে হয় তখন রাজের অবস্থা ভালো ছিল না, তা ঐ অবস্থায় বিয়ে… তাছাড়া বিয়ের শর্ত অনুযায়ী তো মায়ার….

রাজ খুব ই গম্ভীর ভাবে উত্তর দিল – বিয়ে যেহেতু একবার হয়েছে, তাহলে মায়া ই আমার বউ। তাছাড়া আমি হুট করে এখন মায়াকে মেনে নিতে পারব না আমাকে আরো কিছুদিন সময় দিতে হবে। আর আমি বিদেশে থাকাকালীন অনেক কিছুর সিদ্ধান্ত নিয়েছি… আমি দেশে ফেরার পর অফিসের ব্যবসায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চাই।যদি বাবা আর চাচা তোমরা অনুমতি দেও আর কি…আর তোমরা রাজি থাকলে, কাল হালকা সাদামাটা অনুষ্ঠান করে আমি মায়া কে হুঁশ জ্ঞান এ বিয়ে করতে চাই।

উপস্থিত সবাই কেমন প্রতিক্রিয়া করলো জানা নেই। কিন্তু এক মেয়ে তার স্বামীর অধিকার পাচ্ছে, এতেই যেন সে আবেগ এ শতশত আপ্লুত হয়ে পড়েছে….

_____

মধ্যে রাত। ঘুম পাচ্ছে না। আজ আমার বাগানে সত্যি সত্যি ই রাজের কথায় বসন্ত বইছে। তবুও ঘুম আসছে না। পানি পিপাসা পেয়েছে অনেক। টি টেবিলে রাখা বোতল টা হাতে নিলাম। কিন্তু ফাঁকা। তাই, বাধ্য হয়ে দরজা খুলে পানি আনতে বের হলাম।

গুন গুন করে গাইছি আর হাঁটছি। হঠাৎ করেই চোখ গেল বন্ধ থাকা একটা রুমের দিকে। রুমটা সবসময় বন্ধ ই থাকত। কিন্তু আবছা আলোয় রুমটা যে খোলা আছে, আমি বুঝতে পারছি। ছোট বেলা থেকেই আমার সব কিছু তেই কৌতুহল। অন্যকেউ হলে হয়তো ভাববে, ভুত পেত্নী আছে, ধরতে আসবে, ঘাড় মটকাবে, কিন্তু আমার ভিন্নমত।

ধীরে ধীরে হেঁটে রুমের দরজার সামনে দাঁড়ালাম। একটা ছায়ামূর্তি হাতে মোবাইল এর ফ্লাস জ্বলিয়ে এটা সেটা ছুঁয়ে দেখছে। এই ছায়া মূর্তি টা খুব ই কাছের, খুব ই চেনা। সামনে রাজ কিছু ছুঁইছুঁই করে দেখছে আর চোখের পানি মুছছে।

আমি রুমের ভেতর এ এসে লাইট জ্বালিয়ে দিলাম। রাজ অপ্রস্তুত হয়ে গেল। আমার দিকে তাকিয়ে, চোখের পানি, ব্যাকুলতা আড়াল করতে চেষ্টা করে বলল- এত রাতে তুমি এখানে?

যদিও আমি চাইনা রাজ আমার সামনে অপ্রস্তুত হোক। তাই বললাম, পানি নিতে এসে যখন ভুতের ভয় পাইতে হয়, তখন তো দেখতেই হয় কোন ভুত /পেত্নী ঘাড় মটকাতে আসছে….(মুখ দুহাত দিয়ে চেপে হাসি আটকালাম)

রাজ খুব ই অবাক হয়ে মায়া কে দেখছে। এক অদ্ভুত অনুভূতি, চেনা জানা, ঠিক বিহারিনীর মতো অনুভূতি। আচ্ছা মানুষ কি প্রমথ ভালোবাসা হারিয়ে ও ২য়া বার ভালোবেসে বাঁচতে পারে, টিকে থাকতে পারে?

…….ভালোবাসা নাকি ভালোবাসা
…. তোমার মুখে শুনেছিলাম,
যার ১ মা,২য়া,৩য়া, হয় না!….

…. প্রেম নাকি ভালোবাসার আরেক নাম
প্রতি লগ্নে নাকি প্রেমে পড়া যায়…..!!

কিন্তু!! সব ভালোবাসা ভালোবাসা হয়না…
…. কিছু ভালোবাসায় থাকে অবাধ্য মায়া,
চাঁপা আর্তনাদ, খনে খনে রাগ ,
কিছু অনুভব, মিষ্টি ভালোলাগা…
…. কিছু নোংরামি, নিদারুণ এক যন্ত্রণা!!

তাহলে, আমার অনুভূতি কে কি বলবো?
…. ভালোবাসা নাকি আমার মনের অপারগতার দোষ?

#Noor

______

আজ রাত টা সত্যিই অন্যরকম ভাবে কাটলো। রাজ আর আমি আমাদের নিজেদের দুঃখের কথা বললাম। রাজ এখনো বিহারিনী বলতে পাগল। আচ্ছা থাক না সে পাগল, কিন্তু আমাকে না হয় একটু মন বাগানে ঠাঁই দিক! ক্ষতি কি। আমার পোষ মানতে আপত্তি নেই। এই তো আমি ই বলছি কোন আপত্তি নেই আমার, খুব ই ভালোবাসি আমি রাজ কে।

আমি তো ভালোবাসার কাঙাল। মা থেকে ও মায়ের ভালোবাসা পেলাম না। বাবা তো নেই, সব অধিকার পেয়ে ও আমি গোপনে হয়েছি নির্যাতিত, কেন চাইব না একজন ভালোবাসার মানুষ, সুরক্ষিত একটা নীড়।

_____

রাজ খুব গভীর চিন্তা ভাবনায় আছে। সে আর মায়া এই ফাস্ট অনেক সময় ধরে একসাথে কত কথা বলেছে। বহুবছর পর সে যেন মায়ার মাঝে তার মায়ের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেল। সেই বিচক্ষণতা, গুন, বুদ্ধি সব কিছু তে মায়া অতুলনীয় একটা মেয়ে।
রাজ জানে সে বিহারিনী কে হয়তো আর কখনো ই দেখতে পাবে না। একবছর হয়ে গেছে তারই অগোচরে… বিহারিনী কি বেঁচে আছে? কোন চিহ্ন নেই, না নেই!! আশেপাশে শুধু ধোঁয়াশা আর ধোঁয়াশা!!
তার মনে যে বিহারিনীর বসবাস, সে কিভাবে ঠাঁই দিবে মায়া কে।

তবে তার জন্য মায়া যে ফিল করে, সেটা মায়ার আচরণ এ বুঝতে পারে সে। তাছাড়া তার অজ্ঞাত দিনগুলো ও তার স্মৃতিচারণ করেই বেড়ায়। মনে পড়ে মায়াবন_মানবীর আকুলতা, ব্যাকুলতা, তার প্রতি ভালোবাসা।

সবকিছু শেষ এ..সে ভাবলো, সে মায়াকে আপন করেই নিবে। বিহারিনীর জায়গা সে নিজেই কাউকে দিতে পারবে না, কিন্তু এ জীবনে মায়াকে নেওয়া যায়। সে ভালোবাসা পায় নাই, যে ভালোবাসার কাঙাল, খুঁজছে আপন নীড়, তাকে তার প্রাপ্ত হক তো দেওয়া ই যায়।

_____

পরের দিন, আজ এক বছর পর হাওলাদার বাড়িতে খুশির ছোঁয়া পেয়েছে। রাজ আর মায়ার বিয়ে। খুব ই সাদামাটা অনুষ্ঠানে_অল্প মেহমান, আত্নীয় স্বজন নিয়ে এই অনুষ্ঠান। রাজ অনেক কষ্টে রুদ্রর নম্বর নিয়েছে, মেজ চাচির থেকে। রুদ্রের সাথে কি কথা হয়েছে, কেউ ই জানে না, তবে এই আনন্দ সোরগোল এর মধ্যে রুদ্র আসছে হাওলাদার বাড়িতে, এটা যেন খুশির ঠিকানায় চানচান উত্তেজনা সৃষ্টি করছে….

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here