#মায়াবন_বিহারিনী_হরিণী
১৬
#writer_Neel_Noor
আমি বাসর ঘরে বসে আছি। আজ রাজ সারাদিন কেমন কেমন করছিল!! কিন্তু কেন? প্রথমে বুঝতে না পারলেও, পরে বুঝতে পারলাম আজ নাকি রুদ্রের আসার কথা ছিল।
খানিকের মধ্যে ই হৃৎপিণ্ডে ব্যাথা অনুভব করলাম। ঐ চিঠি টা যদি রুদ্র লিখে থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই রাজের উপর প্রতিশোধ নিবে রুদ্র।
প্রেমিকা মন !! ভয়ের মাদকতায় আচ্ছন্ন হয়ে বার বার সৃষ্টিকর্তার কাছে আকুল আকাঙ্ক্ষায় দোয়া করছিল, রুদ্র যেন না আসে!!
ঠিক তাই ই হলো!! রুদ্র আসে নাই।
আমার ভাবনায় ফোরন কেটে কেউ রুমে প্রবেশ করলো। ঘোমটার আড়ালে আড়চোখে দেখলাম, রাজ এসেছে। যদিও, অন্যান্য বিয়ের মতো আমাদের বিয়ে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে হয় নাই, তাই এতো রিচুয়াল ও করা হয় নাই। রাজ যে আমাকে কাজগ কলমে শর্তহীন ভাবে তিন কবুলে আপন করে নিয়েছে, তাতে ই তো আমার সাত ভাগ্য!!
আজ মনে প্রচুর বাসনা, যদি রাজ আমাকে পূর্নতা দেয়!! আবার ও রাজের কথাগুলো মাথায় আসলো, এতো সহযে তো সে আমাকে মেনে নিবে না, হয়তো সমাজকুল এর চোখে আমাকে সম্মান দিতে বিয়ে করেছে, আমার করা কর্মগুলোর জন্য, হয়তো বা কখনো ই আমাকে পূর্ণ করে স্ত্রীর অধিকার দিবে না!!
হঠাৎ হাতের সুক্ষ স্পর্শে শিউরে উঠলাম। রাজ ঘোমটা টেনে দিল। আমার সামনে বসে, হালকা মৃদু হাসি দিয়ে বলল – তুমি জানো আমার মন গহীনে অন্যজনের বসবাস!! তোমাকে অস্বীকার করতে পারব না, তবে তাকে ও ভুলে যাতে পারব না!! আমি তোমার হক সম্পূর্ণ দেওয়ার চেষ্টা করব, আমাকে ও সময় দিতে হবে, তোমাকে নতুন করে ভালোবাসার, গ্রহন করে নেওয়ার!!(হঠাৎ কপালে একটা হালকা পরশ দিতেই আমি কেঁপে উঠলাম!! মন মৃদুলে প্রজাপতিরা ডানা মেলেছে, বসন্তের ফুল ফুটেছে, মনে অন্য রকম দোল খাচ্ছে…)
পূর্নতার এক সাগরে ভাসছি আমি। আজ আমি পূর্ণ, রাজের ছোঁয়ায় পূর্ণ।
______
দেখতে দেখতে কেটে গেল আরো এক বছর। আমি আজ আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। নরী তখন ই পূর্ণ হয়, যখন তার স্বামী তাকে পূর্ণ করে!! আর সেই পূর্ণতাই, তখন সে মা হয়। রাজ হাওলাদার বাড়ির ব্যবসা সামলাচ্ছে। আগে থেকে রাজ অনেক টাই পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু মাঝ রাতে এখনো, বিহারিনীর ঘরে যেতে ভুলে না।
এর মাঝে আমার মা ও এ বাড়িতে দাদি শাশুড়ির অনুভুতি তে এসেছিল বেশ কয়েকবার। সেদিন মা আমাকে বিয়ে দিয়েছিল আমার ভালোর জন্যই। না হয় আমার মায়ের ২য় স্বামী আমার উপর কুনজর রেখেছিল, মা বুঝতে পেরেছিল। হাজার হোক সে তো মা, এটা মেনে নিতে পারছিলো না। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই, আমাকে বিয়ে দেয়। আর তাছাড়া, মায়ের সাথে তার ভাইদের আরো আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল। তাই মায়ের স্বামীকে টাকা দিয়ে আমাকে…..যাক আর নাই বলি!!
এই বাড়িতে আমি সুখে ই আছি। আল্লাহ যে আমার কপালে এমন সুখ রাখতে পারে আমি কখনো ই ভাবি নাই।যদিও আমার শাশুড়ি মা আমাকে তেমন একটা পছন্দ করে না, ততটা মোহিনী ভাবি কে করে। যাক গে… জীবনে তো সবাই ভালোবাসে না, কেউ কেউ অপছন্দ করবেই!!
____
রুদ্রের সাথে ইদানিং কারো ই বেশি একটা কথা হয় না। রুদ্র আসবে আসবে বলে ও আসে নাই। রাজ আজও আফসোস এর সুরে বলে – আমার জন্য আজ রুদ্র এরকম হয়ে গেছে। তাছাড়া, রুদ্র কেন যেন বার বার বলে, সে আসবে যখন, রাজের রাজ্য এলোমেলো হয়ে যাবে!!রাজ ও মুচকি হেসে বলে, আমি আগে থেকেই এলোমেলো!!
রুদ্র!!! এই নামটাই আমার এখন ভয় করে। আসলেই, হাওলাদার বাড়ির এক ছেলে সবার অগোচরে আড়ালে থাকে, যেন কারো এই ব্যাপারে মাথাব্যথা ই নেই!! খুব ই অদ্ভুত এই রুদ্রের চরিত্র।
আমি রুদ্র আর বিহারিনীর ছবি দেখেছি। বিহারিনী সত্যি ই অপূর্ব সুন্দরী। আমি যেদিন রাজের আলমারি তে ছবি দেখেছি, আমি মেয়ে হয়েও শুধু মুগ্ধ হয়েছি। একটা ষোড়শী বয়সের মেয়ে এতো অপরুপা কী করে হতে পারে!! পেটে হাত দিয়ে কতবার যে বলেছি, আল্লাহ আমার যদি কখনো মেয়ে হয় তাহলে বিহারিনীর মতো অপরুপা যেন হয়।
তবে রুদ্র!! সে কিন্তু কম নয়। রাজ থেকে ও আকর্ষণীয়। কিন্তু অদ্ভুত তার চোখ, চাহনি। ছবির মধ্যেও রুদ্র কে রহস্যময় লেগেছে খুব।
_____
এর মধ্যে ই নিচ থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শুনা যাচ্ছে। আমি ভারী পেট নিয়ে নিচে যাচ্ছি আস্তে আস্তে। আওয়াজ টা বাড়ির বাগান থেকে আসছে। আমি ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই, রাজ আমার হাত ধরল, আচমকা রাজ হাত ধরতেই ভয় পেয়ে গেলাম। রাজ মুচকি হেসে বলল – আমি!! তোমার সোয়ামি (চোখ টিপে বলল) ভয় পেয়ো না।
আর নিচে বাড়ির সবাই তো আছেই, চিৎকার চেঁচামেচি শুনলেই তোমাকে যেতে হবে কেন!!
রাজ আর আমার মাঝে সম্পর্ক আগের থেকে অনেক বেশি ই গাঢ়। অন্য সাদামাটা স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যেমন ঠিক আমাদের মাঝে ও তেমন।বলতে বলতে নিচে নেমে এসেছি। খুব ই হাঁপিয়ে গেছি। রাজ আমাকে নিয়ে সোফায় বসালো।
আমি একটু চিন্তাময় কন্ঠে বললাম – আমি এখানে বসবো না, খুব পানি তেষ্টা পেয়েছে, একটু পানি দিন।আর বাহিরে কি হয়েছে, জানতে হবে তো?
রাজ পানি গ্লাসে ঢালতে ঢালতে বলল- আহ্!! তোমাকে বলেছি না, এখন শুধু তোমার আর বাবুর যত্ন নিতে, তেমন কিছু ই হয় নাই, বাবা চাচ আছে, মা আছে… তুমি চিন্তা করো না।
আমাকে পানির গ্লাস টা দিয়ে, দরজার দিকে তাকিয়ে বলল- ঐ তো বাবা, চাচা আসছে!! আর রুদদদদদ…….রো….
আমি প্রায় বিষম খেয়ে ও খাই নাই। পানি একটু খেয়ে, গ্লাসটা রেখে উঠে দাড়ালাম। পিছু ফিরে তাকাতেই, আমার ও রাজের মতো অবস্থা!!
সামনে সুদর্শন একটা যুবক দাঁড়িয়ে আছে বয়স হয়তো আঠাশ বা ঊনত্রিশ এ ছুই ছুই। শ্যামসুন্দর, গাঢ় বাদামী চোখ, চুলগুলো এলোমেলো একটু বড়, তবে এটাতেই যেন, এই পুরুষটিকে আরো মায়াবী মানব করে তুলেছে। রাইটার -নীলনূর।
ছবি থেকে ও বাস্তবতায় রুদ্র অনেক সুন্দর। রাজ রুদ্র কে দেখে একটু আত্নহারা হয়ে এগিয়ে গেল… হঠাৎ দাদি আর চাচি শাশুড়ি একটা মেয়েকে খুব আদর করে, মায়াভরা নজরে, এটা সেটা জিজ্ঞাসা করতে করতে বাড়ির ভিতর নিয়ে আসলো!!
রাজ যেন আকাশ থেকে পড়ল। শুধু রাজ নয়, এই ভরা পেটে আমার নিঃশ্বাস নিতে ই কষ্ট হচ্ছে। সামনে দাঁড়িয়ে আছে, সত্যি ই কি দাঁড়িয়ে আছে?
এটা কি বিহারিনী। পা দুটো যেন চলতেই চাচ্ছে না…স্তব্ধ!!কথা যেন মুখ থেকে বের হচ্ছে না!! রিয়াকশন দিতে ভুলে গেছি, শুধু তাকিয়ে আছি!!পেটে হাত রেখে, খুব কষ্টে রাজের কাঁদে হাত রাখলাম….
আমার হাত রাখতেই রাজ যেন হুঁশে ফিরলো, কিন্তু হুঁশে ফিরেও সে যেন অন্য জগতে চলে গেল!! রাজ দৌড়ে গিয়ে বিহারিনীর সামনে দাঁড়ালো, বিহারিনী কে হাত দিয়ে ছুয়ে দিতে ই, বিহারিনী দু’পা পিছনে গেল…
চোখের সামনে রাজ অন্য একটি মেয়েকে ছুঁয়েছে, এটা মন মোটেও সহ্য করছে না, আমি সোফায় ধপ করে ই সবার অজান্তে বসে পড়লাম।
রাজ হাঁটু গেড়ে বসে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো। বলল- তুই কোথায় ছিলি এতদিন। আমি ভুল করে ফেলেছি, আজ আমার জন্য এতো কিছু হয়েছে, সেদিন আমার মোটেও উচিত হয় নাই, তোকে একলা ঐ খানে ছেড়ে আসা। আমাকে মাফ করে দে, আমি তোকে খুব ই ভালোবাসি, সেটা অনেক আগে থেকে, কিন্তু সেদিন রুদ্র কে নিয়ে তোর জবাব আমাকে, আমার মন কে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিল, আমি!!(চোখের পানি মুছে) আমি সেদিন তোর সামনে থাকলে, অন্য কিছু হয়ে যেত। রাগ কমানোর জন্য আমি তোকে একা ছেড়ে গিয়েছিলাম। বিশ্বাস কর, আমি এখন ও পুড়ছি, প্রতিনিয়ত দহনে প্রজ্বলিত হচ্ছি…. আমার প্রথম…
রুদ্রের বাঁকা হাসি টা!! ইশ্ কি ভয়ংকর। সবার চোখ আড়াল হলেও আমার হলো না। সে রাজ কে বলল – তোর সামনে শুধু তোর চাচাতো বোন বিহারিনী দাঁড়িয়ে আছে না, তোর ছোট ভাইয়ের বউ দাঁড়িয়ে আছে। তাই ছোট ভাইয়ের বউ কে ভালোবাসি বলাটা পাপ। তার উপর, এখানে তোর আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা বউ ও আছে!!
রাজ নিজেকে সামলাতে পারছেন না। আমি স্পস্ট দেখছি তার মনের মন্দিরের যন্ত্রনা। ইশ্ তার প্রতিটি কষ্টের সাক্ষী আমি ছিলাম। কিভাবে ভুলতে পারি, আমি তো অনুভব করছি!!
কিন্তু নিজের মনের ব্যাথা…..
হঠাৎ রুদ্র রাজকে জড়িয়ে ধরল। কানের কাছে ফিসফিস করে কিছু বলল। রাজ, সোজা দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল….
কী বলেছিল রুদ্র। রাজ কোথায় গেল। ঠিক ই বলেছিলাম, আমার কপালে সুখ নেই, অভাগা যেদিকে যায় সেদিকে ই সাগর শুকায়!!
চলবে…..