#মায়াবন_বিহারিনী_হরিণী
২১
#writer_Neel_Noor
হাওলাদার বাড়ি!! কান্না মুখর হয়ে উঠেছে পরিবেশ। অভাগীর বিদায়ে সবার চোখে ই যেন পানি। মায়েদা হাওলাদার (মায়ার মা) মেয়ের নিথর দেহের উপর হুমরি খেয়ে পড়েছে। যেন কত আপন, কত ভালোবাসা!! সব আজ প্রকাশ পাচ্ছে…কী লাভ, বেঁচে থেকে যে পায়নি মূল্য_চলে যাওয়ার পর তা প্রকাশ করে লাভ কি?
বিহারিনীর কোলে সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া ফুটফুটে কন্যা সন্তানটি ঘুমিয়ে আছে। বিহারিনী ঘরের দরজায় বসে আছে। মায়ার নিথর দেহ টি আজ বাগানের লাশবাহী খাটে পরে আছে… বিহারিনী এক ধ্যানমগ্ন অবস্থায় শুধু তাকিয়ে ই আছে….
লগ্নে, দশ ঘটিকা পার হয়ে যাওয়ার পরও অভাগীর স্বামীর খোঁজ নেই। যার অনুমতি ছাড়া লাশ মাটি দেওয়া ও যাবে না।
আজ প্রকৃতি ও যেন কান্না করছে, বসন্তের শুরুতে ই আকাশ কালো মেঘে ঢাকা, কনকনে ঠান্ডা বাতাস,এক গম্ভীর পরিস্থিতির জানান দিচ্ছে….
রাজ গাড়ি নিয়ে নিজ বাড়ির রাস্তায় ই থেমে গেল। অনেক মানুষের সমাগম তাদের গেইট পর্যন্ত। খুবই ভাবনায় পড়ে গেল, এতো মানুষ কেন? সে তার মায়ের মৃত্যুর পর এরকম ভীর কখনো তাদের বাড়িতে দেখে নাই!!
মূহুর্তে ই চিন্তা করল, বাড়িতে কি কিছু হয়েছে কি না। দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে গেল। পকেটে চাবিটা রাখতেই, কাল রাতের ঘটনা মনে পড়লো। সে মায়া কে চড় দিয়েছিল, সাথে সাথে ই তার বক্ষপিঞ্জর কেঁপে উঠলো….
মনই মন জপছে, মায়ার যেন কিছু না হয়। বাচ্চার ও যেন কিছু না হয়। সে আর কখনো এরকম কিছু করবে না…. এগুলো ভাবতে ভাবতে ই মানুষ জন ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল….
বাড়ির আঙিনায় ঢুকে ই সে প্রথমে একটা ধাক্কা খেল। পরিবারের সবাই, কেমন যেন থমকে আছে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, দাদির মাথায় কেউ পানি ঢালছে, তো কেউ চাচির মাথায় তেল দিয়ে শান্ত করছে, তার বাবাকে চাচাকে কেউ ধরে রেখেছে। বিহারিনীর একটা কাপড় পেঁচানো কিছু কোলে নিয়ে কোন একদিকে তাকিয়ে ধ্যানমগ্ন হয়ে বিদ্ধস্ত অবস্থায় বসে আছে…..এ কেমন পরিবেশ চারদিকে!!
রাজ হঠাৎ করেই কারো আহাজারি শুনতে পেল। চমকে তাকালো, সেদিকে….তার শাশুড়ি মা উরফে ফুফু মায়েদা হাওলাদার কান্না করছে। এটা দেখে রাজ বিহারিনীর তাকানো থাকা দিকটায় নিজেও তাকালো। লাশের খাটিয়া দেখতে পেয়ে একটু পিছিয়ে গেল….
লাশের খাটিয়া!! কে সেখানে!! মায়া কোথায়!! রুদ্র!! চিন্তা করতেই পারছে না রাজ। নিভু নিভু পায়ে এগিয়ে গেল খাটিয়ার কাছে, সাদা কাপড় টা একটু সরিয়ে দিতেই, রাজ যেন দু_ইঞ্চি ছিটকে দূরে পড়লো, ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো।
রাজ খনিকের জন্য পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক হয়ে গেল। মাথা টা চক্কর দিয়ে উঠলো, দম নিতে কষ্ট হচ্ছে, দুচোখ ভর্তি পানি, হাত বুক এমনকি সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে…
মিনিট দুয়েক পর রাজ হুমড়ি খেয়ে পড়লো মায়ার উপর। মায়াআআআআ…..বলে আর্তনাদ এর চিৎকারে, উপস্থিত সবাই থমকে উঠলো…. পাগলের মত মায়াকে লাশের খাটিয়া থেকেই রাজ নিচে নামিয়ে বুকে চেপে ধরল…. চিৎকার আর হাহাকার..যেন থামছেই না…..
রাজ – মায়া!! ও মায়া !! আমার মায়াবিনী…চোখ মেলো!! একটি বার চোখ খুইলা তাকাওওওও…. আমি তোমাকে ছাড়া অচল….মায়াআআআআ!! আমি চেষ্টা করতেছিলাম তো!! একটু সময় আর সুযোগ কি আমাকে দেওয়া যাইতো না…. তুমি তো জেনেই আমার জীবনে এসেছিলে…তাহলে এমন অভিমান কেন করলে!! মায়াআআআ (মায়ার লাশের সাথে কথা বলে, একবার চুমু খায়, জড়িয়ে ধরে…..)
রুদ্র রাজের কন্ঠ শুনতে পেয়ে ই হুমড়ি খেয়ে ঘরের বাইরে বের হয়। তার রাজের উপর অনেক ক্ষোভ। কিন্তু রাজকে দেখে সে যেন সবকিছু ই ভুলে গেছে। উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে রাজের দিকে তাকিয়ে আছে। রাজের মাথায় বেন্ডেজ করা, শরীরের শার্টে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ, যেন রক্তের হোলি খেলায় রাজ মেতে ছিল…..
রুদ্র সহ রাজের বাবা রাজকে জড়িয়ে ধরে, রাজ তার বাবাকে দেখে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো, কিন্তু সে কোনভাবেই মায়াকে বুক থেকে নামাচ্ছে না। আশেপাশের প্রতিবেশী মহিলারা আর রুদ্র মিলে রাজ আর মায়াকে অনেক কষ্ট করে দূরে সরাতে সক্ষম হলো!!
রাজ যেন পাগল প্রায়। কোন মতেই ছাড়তে রাজি না মায়াকে, বার বার বাবাকে বলতেছে, কী করে পারল মায়া, তাকে ছেড়ে চলে যেতে…মায়া ও কি তার মায়ের মতো ই, অসময়ে হাত ছাড়ল!! সে কি করে বেঁচে থাকবে, তাকে কি একটু সময় দিতে পারল না, সে তো মায়ার জন্য ই নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছিল, একটু সময় কি তার পাওয়ার অধিকার ছিল না? সে তো কোন পাপ করেনি, কেন দুঃখ আর ব্যার্থতার ছোয়া তাকে ছাড়ছে না!! বরং আগলে রাখার সঙ্গি ই তাকে ছেড়ে চলে গেল….
______
মায়াকে, হাওলাদার বাড়ির পেছনে শিউলি গাছের নিচে মাটি দেওয়া হয়েছে। যেটা মায়া_রাজের রুমের জানালার পাশে ই…..
সবাই বিদ্ধস্ত অবস্থায় বসে আছে ড্রইং রুমে। রাজ জ্ঞান হারিয়েছে কয়েক দফায়। রাজের মাথার আঘাতটা ও, অনেক গভীর। রুমে ঘুমিয়ে আছে রাজ।
কেটে গেল এক সপ্তাহ!! রাজ নিজেকে প্রায় রুমবন্ধি করে রাখে, মাঝ রাতে তাকে কখনো কখনো মায়ার কবরের পাশে দেখা যায়, সে কখন কি করে, বোঝা দায়!! এক ছন্নহীন পাগল সে…যে এখন পর্যন্ত নিজের বাচ্চার মুখটা পর্যন্ত দর্শন করে নাই!! দূর থেকে শুধু এক নজর দেখত বাচ্চাটা যখন কান্না করত, তারপর আবার চলে যেত…
সন্ধ্যা বেলা, এইদিকে বাচ্চা টি কান্না করছে। অবুঝ বিহারিনী দফায় দফায় বাচ্চাটির খেয়াল রাখছে। বিহারিনী বুঝতে পারছে না, সে কীভাবে যত্ন নিবে, এই বাচ্চাটার…এর মধ্যে ই, কাজের মেয়েটি দুধ ফিটার করে নিয়ে আসলো….
দুধ ফিটার মুখে দিতেই বাচ্চাটার কান্না খানিক কমলেও, আবার ও কান্না শুরু হয়ে গেল…. বিহারিনী, বুঝতে ও পারছে না, কি করবে!! পরিবারে সবাই কেমন ভেঙ্গে পড়ছে, বেহাল দশা!! রুদ্র ও নেই, এতোদিন সে ছিল বলেই, বাচ্চাটাকে সামলাতে হিমশিম খেতে হয় নাই, এখন সে কাজে ব্যস্ত, পরিবারের বিজনেস এর দায়িত্ব ও তার কাঁধে এসে পড়েছে…..
এখন কি করবে, একা একা বিহারিনী? বিহারিনী ও এই বিষয়ে পাক্কা না…. বিহারিনী বাচ্চা টা কে নিয়ে রুমের বাইরে আসতেই, কোথায় থেকে যেন রাজ হুমড়ি খেয়ে পড়লো বিহারিনীর সামনে!!
এতোক্ষণ এ রুদ্রের মা, রাজের মা বিহারিনীর রুমের দিকে আসছিল, বাচ্চার কান্না শুনে_বাচ্চার কান্না থামানোর জন্য, কিন্তু রাজ একপ্রকার জোর করেই বিহারিনী থেকে বাচ্চা টা টেনে নিল, নিজের কোলে!!
বাচ্চা টা চুপ হয়ে গেল। বিহারিনী ভয়ে কাঁপছে। সে জানে রাজ ঠিক নেই, রাজের পাগলামো সে নিজের চোখে দেখেছে, এখন ও কি বিদ্ধস্ত অবস্থায় দেখাচ্ছে তাকে….
মূহুর্তে ই রাজ বাচ্চাটার কপালে একটা চুমু আকঁল। রাজ নিজের অংশ টার দিকে তাকিয়ে আছে। মায়ার অংশ!! রাজ ডুকরে কেঁদে উঠলো….
বিহারিনীর হাত থেকে দুধের বোতল টা একপ্রকার জোর পূর্বক নিজের হাতে নিল। তারপর আস্তে আস্তে করে বাচ্চাটা নিয়ে নিজের রুমে চলে গেল….
_______
মায়া চলে গেছে, মাটিতে চিরনিদ্রায় শায়িত আছে। সপ্তাহ হয়ে গেছে……রাজ যেন তা মানতে ই নারাজ।
এইদিকে নয়টা বেজে গেছে। পরিবারের সদস্যদের মাঝে চিন্তা খেলা বাড়ছে। রাজ সন্ধ্যায় বাবুটাকে নিয়ে গেল, এখন পর্যন্ত বাবুর কান্না শুনে নাই। সবাই কে মানা করেছে, ওর রুমে যেতে, না হয় ভয়ংকর কিছু করে ফেলবে। হয়তো বাবার কোলে মায়ের আবেশ খুঁজছে।
কিন্তু পাগল বিহারিনীর মন উঁকি দিচ্ছে বাচ্চাটার টানে। রুদ্র ও আসতেছে না, বাড়ির কেউ ই রাজের রুমে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়ে ই সে রাজের রুমে গেল….
বাচ্চা টা খাটে ঘুমিয়ে আছে। রাজ ফ্লোরে বসে জানালার বাইরে উঁকি দেওয়া শিউলি গাছের দিকে তাকিয়ে আছে। ফ্লোরে এখন রক্তের মৃদু ছাপ স্পষ্ট হয়ে আছে… হঠাৎ বাচ্চা টা নড়ে উঠলো, বিহারিনী অঞ্জাত মনে ধীর ধীর পায়ে বাচ্চাটার দিকে এগিয়ে গেল, হাত দুটো নিজের উড়নায় পেঁচিয়ে বিহারিনী শুধু তাকিয়ে আছে বাচ্চার দিকে, মূহুর্তে ই তার কর্নপাশে একটা রুক্ষ কন্ঠ শুনতে পায়….
রাজ- তুই এই সময়ে এই রুমে কি করছিস!! এই রুম থেকে বেরিয়ে যা….!!শুনতে পাস নাই আমি কি বলেছিলাম, আমার রুমে আসতে মানা করেছি , যা…
বিহারিনীর হুঁশ ফিরল। রাজের দিকে তাকালো। রাজকে সত্যি ই এখন রাস্তার পাগল এর মতো দেখা যায়। কি অবস্থা করেছে নিজের, বাড়ির কারো কথা শুনে না….বিহারিনী ভয়ে ভয়ে বলল- আমি ঐ বাবুকে….
রাজ ধমক দিয়ে বলল – চুপ!! একদম চুপ। তুই আমার সামনে আসিস না, দয়া করে তুই চলে যা…না হয়…
এর মধ্যে ই বিহারিনী দু’পা পিছনে নিল। হঠাৎ বিহারিনী হাতের কাগজটা এগিয়ে দিয়ে বলল – মায়া তোমাকে দিতে বলেছে…!!
সে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। বিহারিনীর বাচ্চা সুলভ মন, বাচ্চাটার জন্য কান্না করছে…. কিন্তু সে অসহায়!!
চলবে….