#মেঘ_কুঁঞ্জের_ইলশেগুঁড়ি❤️🩹
#Mishka_Moon {লেখনীতে}
||পর্ব_২২||
আনোয়ারা বেগমের শরীরটা বেশ কিছুদিন যাবত ভালো যাচ্ছিল না। তাই তাকে নিয়ে শহরের এক হসপিটালে ডাক্তার দেখাতে যান শফিক সাহেব। সেখানেই দেখা হয় অনুপমার সাথে। একটা নার্স কোথা থেকে এসে তাদের বলে একটা মেয়ে ডাকছে। দুজনেই বেশ অবাক হয়ে মেয়েটার কাছে যায়। ভেতরে ঢুকতেই হুট করে একটা মেয়ে এসে ছোট্ট একটা পুতুলের মতো দেখতে বাচ্চাটাকে আনোয়ারা বেগমের কোলে তুলে দেয়। দুজনেই বেশ চমকে উঠে। মেয়েটা তাদের আরও চমকে দিয়ে বলে,”ওকে কি আপনারা রাখবেন?”
অনুপমার কথা না বুঝতে পেরে শফিক সাহেব বললেন,”তুমি এসব কি বলছো মা??
“ঠিকই বলেছি। আমি চাই আমার মেয়েটা ভালো থাকুক। কারো করুনার পাত্র না হোক। আপনি বোধহয় আমাকে চিনেন না তবে আমি কিন্তু আপনাকে চিনি মাষ্টারমশাই।”
আনোয়ারা বেগম শুধু চেয়েছিলেন বাচ্চাটার মুখ পানে। কি সুন্দর ফুটফুটে একটা মেয়ে আর অবাক করা বিষয় তার দিকে চেয়ে চেয়ে হাসছে।
শফিক সাহেব মুচকি হেসে বললেন,”তা নাহয় বুঝলাম তুমি আমায় চিনো। কিন্তু মেয়েকে কেনো দিয়ে দিতে চাচ্ছো?
অনুপমা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলতে শুরু করে,
আমি গরীব ঘরের মেয়ে। অভাবের সংসার হলেও সুখের অভাব ছিল না। একদিন মস্ত বড় বাড়ি থেকে আমার বিয়ে আসে। তবে সেই লোকের নাকি আগেও একবার বিয়ে হয়েছিল। এ কথা জানার সাথে সাথে আমি বিয়েতে অমত পোষন করি। কিন্তু বাবা মা আমায় বুঝায় সেই লোকের দোষ নেই তার বউ আরেকজনের সাথে চলে গেছে। তবুও আমার মন টান ছিল না। কিন্তু বাবা অসুস্থতার দোহায় দিয়ে মা রাজি করায়। অবশেষে বাধ্য হয়ে রাজি হয়ে গেলাম। তার আরেকটা অপছন্দের জিনিস ছিল রাজনীতি। বিয়ের দিন সকালে জানতে পারলাম আমার স্বামীর নাম ইশতিয়াক পাঠান। তিনি নাকি গম্ভীর ধরনের রাগী মানুষ। এখন আর ভাবার সময় নেই তাই কারো কথায় কান দিলাম না। বিয়েটা হয়েই গেলো। লোকটা পাঁচ মিনিট ভালো ব্যবহার করলে দশ মিনিট খারাপ ব্যবহার করত। তবুও মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। বাড়িতে একটা শাশুড়ি আর একটা ফুপি শাশুড়ি তাদের কথাতেই সারাক্ষণ চলতে হয়। মেয়ে মানুষের সে বাড়িতে কোনো কদর নেই।
আমার প্রথম সন্তান ছেলে হয়। তাকে আমি গ্রামের স্কুলেই ভর্তি করে দিতে চাই কিন্তু আমার স্বামী রাজি হয়না সে বলে তার ছেলেকে বেস্ট স্কুলে পড়াবে। আমার ছোট ছেলেটাকে আমার থেকে আলাদা করে শহরে তার ভাইয়ের বাসায় পাঠিয়ে দিলো। ছেলেটা আমার কি যে কান্না! মা ছাড়া সে যাবে না। তারা কেউ বুঝলো না। যদিও প্রতিদিন সে আমাকে কল দিতো অনেক সময় কথা বলতো। কিন্তু মায়ের মন কি তা মানে? সেই বাড়িতে আমার মন টিকে না। তারা আমাকে কোনো কিছু অভাব দিতো না এটা ঠিক কিন্তু আমার ছেলে তাকে তো আলাদা করেছিল। দীর্ঘ দিন এভাবেই কেটে গেলো। ছেলে বড় হচ্ছিল। সৃষ্টি কর্তার কাছে অনেক কাকুতি মিনতি করে একটা মেয়ে চাইলাম। আল্লাহ নিরাশ করলেন না। আরেকটা সন্তান পেটে আসলো আমার। আমার মন বলতো মেয়েই হবে।”
শফিক সাহেব অনেক সময় পরে কথা বললেন জিজ্ঞেস করলেন, “তাহলে কেনো এখন দিয়ে দিতে চাচ্ছো?
আমার স্বামীর জন্য সে চায়না তার কন্যা সন্তান হোক তাদের বাড়ির কেউই চায়না। আমাকে বলেছে যদি মেয়ে হয় তাহলে কাউকে দত্তক দিয়ে দিবে। আমি চাইনা আমার মেয়ে কোনো বড় ঘরে যাক। আমি চাই সে একজন আদর্শবান মানুষের কাছে মানুষ হোক।”
আনোয়ারা বেগম এবার মুখ খুললেন বললেন, “কিন্তু তার কন্যা সন্তানের উপর এতো রাগ কেনো??
অনুপমা চোখ বন্ধ করে ফেললো একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করল,
” ইশতিয়াক ভালোবেসে রত্না নামের একটা মেয়েকে বিয়ে করেছিল। তাদের সুখের সংসার ছিল বেশ ভালোই চলছিল হঠাৎ একদিন জানা যায় তার স্ত্রী কখনো মা হতে পারবে না। এটা নিয়ে বাড়ির আর সবার আপত্তি থাকলেও ইশতিয়াক কিছু বলেনি। রত্না অনেক কান্না কাটি করে তাকে জিজ্ঞেস করে তুমি কি আমাকে ছেড়ে দিবে? ইশতিয়াক অনেক বার বোঝানোর পরেরও সে যখন বিশ্বাস করছিল না। তখন নিজেই জিজ্ঞেস করে কি করলে সে বিশ্বাস করবে? রত্না তার থেকে অর্ধেক সম্পত্তি লিখে চায়। তবে তা তো সম্ভব নয় কারণ তখনো সব কিছু ইশতিয়াকের মা সুচিত্রার নামে ছিল। তাকে অবশ্য অল্প কিছু আগেই দিয়েছিল তা থেকে ঢাকার বাসাটা আর গ্রামের ফসলি কয়েক বিঘা জমি লিখে চায়। ইশতিয়াক কোনো বাক্য ছাড়াই লিখে দেয়। তার কিছু দিন পরে একটা ছেলে দত্তক এনে দেয়। কিন্তু এতে রত্না মোটেও খুশি হয়না। না জানিয়ে একটা ছেলেকে আনায় রেগে যায়।
আর তার এক বছরের মাথাতেই রত্না তারই স্বামীর প্রিয় বন্ধুর সাথে পালিয়ে যায়। আর তখনই জানা যায় সে মা হতে পারবে শাশুড়ি বাচ্চা নেওয়ার জন্য জোর জবরদস্তি করায় এমন নাটক করেছিল। ইশতিয়াক ভীষণ বড় একটা ধাক্কা খায়।
কয়েকবছর পর যখন এ ঘটনা সে ভুলে থাকতে শিখে যায় তখনই ঘটে আরেক ঘটনা। ইশতিয়াকের এক মাত্র বোন ঈশিতা। তাকে প্রচন্ড ভালোবাসতো। কিন্তু সেই মেয়েও সবাইকে ধোঁকা দিয়ে বাড়ির গহনা গাটি নিয়ে বিয়ের দিন সকালে অন্য ছেলের সাথে পালিয়ে যায়। তাকে যাওয়ার সময় আমার ফুপি শাশুড়ি দেখে ফেলায় তাকে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে দৌঁড় দেয়। তার পরে থেকে সে আর মেয়েদের সহ্য করতে পারে না। আরো মাঝখানে জমিজমা নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়।
আমাকেও সহ্য করতে পারেনা। আমার মুখ দেখলে নাকি তার রত্নার কথা মনেহয়। আগে মারধরও করতো। আগে প্রচুর কাঁদতাম এখন সয়ে গিয়েছে।”
শফিক সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,” তাকে ডক্টর দেখাও নি কেনো?
আমি একবার বলেছিলাম তাকে ডক্টর দেখানো উচিত কিন্তু আমার শাশুড়ি মা প্রচন্ড রেগে যায়। আমি নাকি তার ছেলেকে পাগল বানাতে চাচ্ছি। আমার মন বলে এ পৃথিবীতে আর মাত্র কিছু দিনে অতিথী হাতে বেশি সময় নেই।
শফিক সাহেব স্ত্রীর মুখের দিকে তাকান। তার মনোভাব বুঝতে বেশি সময় লাগলো না।
!!
রঙ্গন ছাদে বসে আছে। এক হাতে চা অন্য হাতে সিগারেট। এটা তার নিত্যদিনের কাজ। এখানে বসে বসে সে স্মৃতি চারন করে। তার জীবনটা এতো কমপ্লিকেটেড তার বাবার জন্য। ভেবেই দীর্ঘ শ্বাস ফেললো।
হঠাৎ রাস্তায় দুটো ছেলেকে কাঁধে হাত রেখে যেতে দেখে অনুভবের কথা বড্ড মনে পড়ল। এভাবে তো একদিন তারাও চলাফেরা করতো।
একদিনের একটা কথা মনে পরে গেলো। তাদের সাথেই পড়াশোনা করতো রুশা নামের একটা মেয়ে। হুট করে একদিন রঙ্গনকে প্রপোজ করে বসে। বেশ কিছু দিন পিছু পিছু ঘুরে কিন্তু শেষ পর্যন্ত রঙ্গনের থেকে পাত্তা না পেয়ে অনুভবকে প্রপোজ করে বসলো।
দুই বন্ধু ক্যাম্পাসে গল্প করছিল কোথা থেকে রুশা এসে তার মাঝে বসে পড়ল। অতঃপর কাউকে কিছু বলার সুযোগই না দিয়ে অনুভবের দিকে একটা রোজ এগিয়ে দিয়ে বলল,
“অনুভব আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
অনুভব প্রচন্ড অবাক হয়। এ মেয়ে দুদিন আগেও তার বন্ধুর পেছনে ঘুরলো আর এখন এসে তাকে এসব বলছে! একবার রঙ্গনের দিকে তাকালো আরেকবার মেয়েটার দিকে তাকালো অতঃপর উঠে দাঁড়াল। কিছু বলবে এমন সময় রঙ্গন হাসতে হাসতে মাঠের মধ্যেই গড়াগড়ি খেতে থাকলো। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে রুশাকে বলল,
“কি রে আমি পাত্তা দেইনি জন্য আমার বন্ধুর সাথে লাইন মারার চেষ্টা করছিস?
রুশা মুখ ঘুরিয়ে অনুভবকে আবার বলল,
” আমি আসলেও তোমাকেই ভালোবাসি অনুভব। রঙ্গনকে প্রপোজ করেছিলাম শুধু তোমার মনোভাব বোঝার জন্য। সত্যি বিশ্বাস করো।”
রঙ্গন কাত হয়ে হাতে উপর ভর দিয়ে শুয়ে থেকেই বলল,”ধরেক আমরা দুজনেই রাজি হয়ে গেলাম কাকে কখন সময় দিবি?
রুশা কিছু সময় তাকিয়ে থেকে বলল,” তোমাকে সকালে সময় দিবো আর অনুভবকে বিকালে।”
রঙ্গন তৎক্ষনাৎ পায়ে থেকে জুতা খুলতে লাগলো। রুশা তা দেখে দৌড়ে পালালো। সে চলে যেতেই অনুভবও হেসে ফেললো। রঙ্গন তাকে হাসতে দেখে বলল, ” কি রে প্রেম করবি নাকি??
অনুভব থমথমে গলায় বলল,
” তোর শখ হলে তুই কর এসব গায়ে পরা মেয়ে আমার পছন্দ নয়।
“আমি করবো মানে? চুপ শা’লা আমি তোর বোনকে বিয়ে করবো।
” সে আশায় থাক। আমার বোন বড় হতে হতে তুই বুড়ো হয়ে যাবি।”
” তাতে কি তোর বোনই দেখবি একদিন আমার জন্য পাগল হবে।
অনুভব ভ্রু কুঁচকালো। তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল, ” শোন আমার বোন বড্ড শান্ত শিষ্ট আর তুই যে বিচ্ছু। তোকে সে কোনো কালেই পছন্দ করবে না।”
“করবে করবে এই জন্যই তো কোনো দিন বাড়িতে নিয়ে যাস না।”
“নিয়ে যাবোও না।”
রঙ্গন মাথায় হাত দিয়ে বলল, “তুই দেখছি আমার আর তোর বোনের প্রেমের ভিলেন হবি।”
অনুভব রেগে গেলো। এসব কথা তার পছন্দ নয়। তবুও ঘুরে ফিরে এই বাঁদরটা এগুলোই বলে। কিছু না বলে বড় বড় ধাপ ফেলে চলে গেলো। রঙ্গনও তার পিছু নিলো।
!!
ইচ্ছের গাড়িতে চলাচল করা পছন্দ নয়। রিকশাই তার কাছে ভালো লাগে। কিন্তু রিকশা করে তো আর এতো দূর আসা যায় না।
অহি বায়না ধরেছিল কিছু কেনাকাটা করবে। তাই অনুভব তাদের নিয়ে শপিংমলে ঢুকেছে।
অহি ড্রেস দেখছিল আর ইচ্ছে ঘুরে ঘুরে এটা ওটা দেখছিল। হঠাৎ একটা শাড়ি দেখে হাতে তুলে নিয়ে বেশ কিছু সময় নাড়াচাড়া করলো। তা দেখে অনুভব এগিয়ে এসে বলল, “পছন্দ হয়েছে নিবে?
ইচ্ছে অনুভবের দিকে তাকিয়ে বলল, “না না।
” পছন্দ না হলে এভাবে দেখছিলে কেনো?
“আমার জন্য না তো আমি দেখছিলাম শাড়িটা পড়লে আপনাকে কেমনে লাগবে। দেখি একটু ধরুন তো!
বলেই অনুভবের হাতে ধরিয়ে দিলো। বেচারা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে রইল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা মুখে হাত দিয়ে মিটিমিটি হাসছে।
তা দেখে অনুভবের মেজাজ বিগড়ে গেলো ইচ্ছের দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করে বলল,
“একটা থাপ্পড় দিয়ে কাকে কোনটা পড়তে হয় শিখিয়ে
দিবো ফাজিল মেয়ে।”
ইচ্ছে দৌড়ে গিয়ে অহির পাশে বসে পড়ল। এমন ভান ধরলো সে কিছু জানে না।
!!
রঙ্গন অহিকে বার বার কল দিচ্ছে কিন্তু ধরছে না। মেজাজ বিগড়ে গেলো। অনুভবের নাম্বারে টাইপিং করে লিখলো,
“তোর বোনকে গিয়ে কল ধরতে বল!”
কিন্তু সেন্ড করল না আবার কেটে দিলো। আবার অহির নাম্বারে কল দিতে থাকলো। অহি বিরক্ত হয়ে এবার ধরে বলল,”
“কি সমস্যা? কি চাই?
“তোকে খু’ন করতে চাই! দিবি খু’ন করতে?”
অহি থতমত খেয়ে গেলো। শুকনো ঢোক গিলে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইল।
রঙ্গন রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” কিছু হয়েছে ফোন ধরছিস না কেনো? না বললে কি করে বুঝবো কি হয়েছে।
অহি মুখ ফুলিয়ে বলল,
” কিছু হয়নি।
“তাহলে কথা বলছিস না কেনো?
” জানি না।”
রঙ্গন গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” মাইয়া মানুষ মাঝে মাঝে নিজেরাও বুঝে না তাদের কি হয়েছে। সমস্যা নেই তোর একার দোষ নেই।”
“আপনার অনেক অভিজ্ঞতা না?”
সে কথার উত্তর না দিয়ে রঙ্গন গুনগুন করে উঠলো,
” আকাশে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা
কারা যে ডাকিল পিছে! বসন্ত এসে গেছে
মধুর অমৃত বাণী, বেলা গেল সহজেই
মরমে উঠিল বাজি; বসন্ত এসে গেছে
থাক তব ভুবনের ধুলিমাখা চরণে
মথা নত করে রব, বসন্ত এসে গেছে
বসন্ত এসে গেছে। ”
#চলবে….
|| কালকে গল্প লিখতে লিখতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আর সারাদিন প্রচুর ব্যস্ত ছিলাম। মন ভালো নেই এর থেকে বেশি লিখতে পারিনাই। মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। 🙂||