#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩৮||
৭৬।
একে একে তিনটা গাড়ি ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতেই সবার দৃষ্টি সেদিকে আটকে গেলো। ক্যাম্পাসের মাঠে হট্টগোলের শব্দ শুনে রাদ নিচে নেমে দেখলো তাজওয়ার খান দাঁড়িয়ে আছে। তাজওয়ারকে দেখে রাদ দ্রুত পায়ে আহির ডিপার্টমেন্টের সামনে চলে এলো। এদিকে তাজওয়ার হাতে একটা মাইক নিয়ে বলল,
“আহি কাল যা হয়েছে তার জন্য সরি। তুমি একবার আমার সামনে এসে দাঁড়াও, প্লিজ।”
আহি ক্লাস থেকে বেরিয়ে চার তলা থেকে নিচে তাকিয়ে দেখলো তাজওয়ার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। তাজওয়ারকে দেখে আহি রেগে গেলো। দ্রুত পায়ে নিচে নেমে তাজওয়ারের সামনে এসে দাঁড়ালো। তাজওয়ার মাইক রেখে আহির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“আই এম সরি, আহি। আমার জন্য কাল রাতে তোমার অনেক সমস্যা হয়েছে।”
আহি ভ্রূ কুঁচকে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে রইলো। সে বুঝতে পারছে না, তাজওয়ার এতোগুলো মানুষের সামনে কীভাবে তার কাছে ক্ষমা চায়ছে! যার কাছে নিজের আত্মসম্মানবোধ সবার উপরে, তার কাছ থেকে এমন ব্যবহার আশা করাও অকল্পনীয়। আহি তাজওয়ারের হাত ধরে উঠিয়ে বলল,
“আমার ক্যাম্পাসে এসেই তোমাকে এই তামাশা করতে হলো!”
“কি করবো বলো? তুমি কাল পার্টি থেকে চলে যাওয়ার পর আমি বুঝতে পেরেছি, আমার কতো বড় ভুল হয়েছিল।”
(***)
গতকাল রাতে আফিফ আহিকে নিয়ে চলে যাওয়ার পর তাজওয়ার রাগী দৃষ্টিতে অর্ণবের দিকে তাকালো। অর্ণব কাঁপা কন্ঠে বললো,
“তোর কি মনে হয় আমি আহির সাথে বাজে ব্যবহার করবো?”
তাজওয়ার ধীর পায়ে অর্ণবের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। আর অর্ণব পেছাতে লাগলো। সজিব আর জিলান তাজওয়ারকে থামানোর জন্য বলল,
“তাজ, তোর হয়তো ভুল হচ্ছে, অর্ণব এই কাজ করবে না। এক কাজ করি, আমরা ফুটেজ দেখে আসি।”
তাজওয়ার গম্ভীরমুখে বলল,
“তার কোনো প্রয়োজন নেই। অর্ণব কি কি করতে পারে, তা তো তোরা ভালো করেই জানিস। আর আহি কেমন মেয়ে তা আমি ভালো করে জানি।”
কথাটি বলেই তাজওয়ার অর্ণবের নাক বরাবর একটা ঘুষি মারলো। অর্ণব তাজওয়ারের পা ধরে বসে পড়লো। ভীত কন্ঠে বললো,
“আমাকে ক্ষমা করে দে, দোস্ত। আমি নেশা করে ফেলেছিলাম। আমার হুঁশ ছিলো না।”
তাজওয়ার অর্ণবের কলার ধরে তাকে উঠিয়ে বলল,
“এটা তো জাস্ট ট্রেলার, মুভি তো আগামীকাল রিলিজ হবে। আর এরপর বোঝা যাবে আমার মুভি হিট হয়েছে, না-কি ফ্লপ।”
(***)
তাজওয়ার আহির হাত ধরে বলল,
“আহি, সত্যিই আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম, কিন্তু অর্ণব আমার অনেক কাছের বন্ধু। ও যখন বলেছে আফিফ তোমার সাথে বাজে ব্যবহার করতে চেয়েছে, আমি না হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিলাম। তারপর যখন মাথা ঠান্ডা করে ভাবলাম, তখনই বুঝলাম আহি তো আফিফকে বাঁচাতে এসেছিল। কারণ আহি সবসময় তার পক্ষেই থাকে, যা সত্য। অর্ণব যদি সত্য বলতো, তাহলে তো তুমি অর্ণবের পক্ষে দাঁড়াতে।”
আহি চোখ ছোট করে বলল,
“ব্রেনওয়াশ করছো আমার? তুমি ভালো করেই জানো, তোমার বন্ধু কেমন।”
“এজন্যই তো শাস্তি দিয়েছি।”
তাজওয়ার এবার গাড়ির কাছে গেলো। গাড়ির দরজা খুলে অর্ণবকে টেনে বের করলো। আহি অর্ণবকে দেখে অবাক হলো। অর্ণবের চেহারা পালটে গেছে। নাক-মুখ রক্তে মাখামাখি। ক্যাম্পাসে উপস্থিত শিক্ষার্থীরা ভয়ে পিছিয়ে গেলো। কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন দৃশ্য দেখা ভয়ংকর।
এদিকে তাজওয়ার অর্ণবের ঘাড় ধরে টেনে এনে তাকে আহির পায়ের কাছে ফেললো। সবাই অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। রাদ এবার আহির পাশে এসে দাঁড়ালো। চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে, আহি?”
“পরে বলছি।”
(***)
অর্ণব আহির পা ধরে কান্নাকাটি করতে লাগলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে। তাজওয়ার কয়েক পা পিছিয়ে গেলো। গাড়ির উপর থেকে মাইকটা আবার হাতে নিলো। মলিন মুখে বললো,
“আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি, আহি। সেই প্রথম দেখাতেই তোমার প্রেমে পড়েছিলাম আমি। এরপর আমার স্বপ্ন সত্যি হলো তোমার আর আমার এনগেজমেন্টের পর। মনে হতে লাগলো তোমাকে পাওয়ার পথ খুলে গেছে। কিন্তু তখনই আমার প্রিয় বন্ধু, যাকে আমি এতো বিশ্বাস করি, সে-ই আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো। তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করলো, তোমার চরিত্রে আঙ্গুল তুলে কথা বললো। কিন্তু আমি সেই মুহূর্তে তোমাকে বিশ্বাস করলেও চুপ ছিলাম। তার জন্য সরি। কিন্তু এখন আমি অপরাধীকে শাস্তি দিয়েছি। এবার আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি জানি তুমিও আমাকে ভালোবাসো। একটাবার আমার হাত ধরে বলো, ভালোবাসি।”
আহি অবাক চোখে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে। রাদ বলল,
“আহি, কি বলছেন উনি? তুই ভালোবাসিস উনাকে? আর তোর সাথে খারাপ ব্যবহার কখন করলো? তুই আমাকে এসব বলিস নি কেন?”
“রাদ, আমি তোকে সবটা জানাবো। প্লিজ এখন একটু চুপ কর।”
রাদের এই মুহূর্তে ভীষণ অস্থির লাগছে। তাজওয়ার কেন বললো, আহি তাকে ভালোবাসে? আহি কি তবে তাজওয়ারকে ভালোবেসে ফেলেছে? না, এটা অসম্ভব। আহি যেখানে আফিফকেই ভুলতে পারে নি, সেখানে এতো তাড়াতাড়ি যাকে ঘৃণা করে, তাকে ভালোবেসে ফেলবে, এটা কখনোই হতে পারে না।
এদিকে এখনো আহি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আর তাজওয়ার হতাশ চোখে আহির দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ ক্যাম্পাসে উপস্থিত একটা ছেলে জোরে বলে উঠল,
“আহি, ভাইয়াকে ক্ষমা করে দাও। আর ভালোবাসি বলে দাও।”
আহি ভ্রূ কুঁচকে ছেলেটির দিকে তাকালো। এই ছেলেকে আহি চেনেও না, অথচ ছেলেটা তার নাম ধরে ডেকে তাকে এমন কথা বললো! ছেলেটা যেন শুরুটাই করে দিলো, সাথে সাথেই ক্যাম্পাসে উপস্থিত সবাই জোরে জোরে একই কথা বলতে লাগল। আহি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। এবার সে বুঝতে পারলো, তাজওয়ার কেন এমন করেছে। আহি বাধ্য হয়ে তাজওয়ারের সামনে এসে বলল,
“ক্ষমা করলাম। এখন যাও।”
তাজওয়ার মৃদু হেসে বলল,
“ভালোবাসি বলে দাও না!”
“ভালোবাসি।”
তাজওয়ার মাইকটা রেখে আহিকে জড়িয়ে ধরলো। আহিও তাজওয়ারকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“এই কাজটা না করলেও পারতে।”
তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“তোমার মুখ থেকে ভালোবাসি শব্দটা শোনার চান্স মিস করলাম না। আর এখন সবাই জেনে গেছে, তাজওয়ার খান কতোটা রোমান্টিক আর অনেস্ট লাইফ পার্টনার। আর সে আহিকে কতোটা ভালোবাসে।”
আহি বলল,
“আর সেই সুযোগে তুমি মেয়েদের সাথে নোংরামি করবে, আর এই কথা কেউ বিশ্বাসই করবে না। কারণ তুমি তো দেখিয়ে দিয়েছো, তোমার আত্মসম্মানবোধ ভালোবাসার কাছে কিছুই না। তুমি আহির জন্য সব করতে পারো, সেখানে একটা মেয়ের সাথে নোংরামি করা তো অসম্ভব।”
“ইউ আ’র টু ইন্টেলিজেন্ট।”
তাজওয়ার এবার অর্ণবকে ইশারায় গাড়িতে বসতে বলল। অর্ণবও ধীর পায়ে গাড়িতে উঠে গেলো। এরপর তাজওয়ার আহির কপালে চুমু খেয়ে ক্যাম্পাসে ভীড় জমানো ছাত্র-ছাত্রীদের হাত দেখিয়ে বিদায় দিয়ে গাড়িতে উঠে গেলো। গাড়ি বেরিয়ে গেলো ক্যাম্পাসের বাইরে। কিন্তু তাজওয়ারের গাড়িটা থেমে গেলো কিছুদূর গিয়েই। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো সেই গাড়ি। হঠাৎ কাঁধে ব্যাগ ঝুলানো একটি ছেলে হাঁপাতে হাঁপাতে তাজওয়রের গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালো। তাজওয়ার গাড়ির গ্লাস নামিয়ে তার হাতে এক হাজার টাকার দুইটা বান্ডেল ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“থ্যাংকস।”
ছেলেটা হাসলো। এটা সেই ছেলে, যে সবার প্রথমে চেঁচিয়ে আহিকে বলেছিলো তাজওয়ারকে ক্ষমা করে দিয়ে ভালোবাসি কথাটা বলতে। ছেলেটা চলে যেতেই তাজওয়ার গাড়ির গ্লাস উঠিয়ে শিস বাজাতে লাগলো। অর্ণব মলিন মুখে বলল,
“আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছিস?”
তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“আহি শুধু আমার। আহিকে স্পর্শ করার অধিকারও আমার। কেউ যদি ভুলেও আহিকে স্পর্শ করতে চায়, আমি তাকে ক্ষমা করি না।”
কথাটি বলেই তাজওয়ার পকেট থেকে তার রিভলবারটা বের করে অর্ণবের মাথায় ঠেকালো। তাজওয়ার বলল,
“আমাকে ক্ষমা করে দিস বন্ধু। তোকে ক্ষমা করার মতো উদার মন আমার নেই।”
(***)
গুলির শব্দ গুঞ্জন করে উঠল শূন্য রাস্তায়। গাড়ির সিটে অর্ণবের মৃত শরীরটা পড়ে আছে। গুলি মাথায় আঘাত করতেই সেকেন্ডের মধ্যে অর্ণবের প্রাণটা উড়ে গেলো। তাজওয়ার গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বিদায় বন্ধু। পরকালে আবার দেখা হবে।”
তাজওয়ারের বডিগার্ড সিগারেট ধরিয়ে তাজওয়ারের ঠোঁটে পুরে দিলো। তাজওয়ার ফুঁ দিয়ে ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে হাতটা ভালোভাবে ধুয়ে নিলো। পেছন ফিরে একনজর অর্ণবের মৃতদেহটার দিকে তাকিয়ে বলল,
“পাঁচ মিনিটের অপেক্ষা। এরপর একটা ট্রাক এসে সজোরে ধাক্কা দেবে গাড়িটিকে। সেই ধাক্কায় গাড়িটা গিয়ে পড়বে পাশের খাদে। এরপর তোমরা নিচে গিয়ে গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেবে। এরপর আসবে ব্রেকিং নিউজ, নিয়ন্ত্রণহীন ট্রাকের ধাক্কায় তাজওয়ার খানের গাড়ি ছিঁটকে পড়লো খাদে। দুর্ভাগ্যক্রমে গাড়িতে থাকা তাজওয়ার খানের প্রিয় বন্ধু অর্ণব ইন্তেকাল করেছে। ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না-ইলিহির রাজিউন। টগবগ যুবক অর্ণব সবে একটা কোম্পানি চালু করেছিল। বেশ লাভ হচ্ছিলো, কিন্তু সবটাই শেষ হয়ে গেলো। ভাগ্যক্রমে খানস গ্রুপের এমডি তাজওয়ার খান বেঁচে ফিরেছেন। তিনি এই মুহূর্তে আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। তার জ্ঞান ফিরলে পুলিশ তাকে দুর্ঘটনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। অন্যদিকে ট্রাক ড্রাইভার পলাতক।”
কথাটি বলেই তাজওয়ার হাসলো। তার বিদঘুটে হাসির শব্দ থামলো পাঁচ মিনিট পর তারই পূর্ব পরিকল্পিত পরিকল্পনা সমাপ্ত হতেই। তাজওয়ার অন্য গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে বলল,
“আমাকে একটু মেকাপ করতে হবে। আফটার অল অনেক বড় অভিনয়ের জন্য আমি সিলেক্ট হয়েছি। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগে আমাকে আমার সিক্রেট বাড়িতে নিয়ে চলো।”
৭৭।
রাদ আহির হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে গেলো ক্যান্টিনে। আহি মলিন মুখে বসে আছে। রাদ ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“কাহিনী কি!”
আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রথমেই উজ্জ্বলের পরিকল্পনার ব্যাপারে জানালো। এরপর গত কয়েকদিনে ঘটা সব ঘটনা রাদকে খুলে বললো। রাদ সব শুনে বলল,
“আহি, তোর সাহস কেমন, তুই ওই পার্টিতে চলে গেলি!”
আহি মুখ ছোট করে বসে রইলো। রাদ আবার বলল,
“আফিফ কি এখনো আন্টির বাসায়?”
“হুম, মা ফোন করে বললো, আফিফের না-কি খুব জ্বর এসেছে। পদ্মকে এখনো জানানো হয় নি। মেয়েটা জানলে এখন আমাকেই বকবে। সব আফিফের দোষ! পদ্মকে সব জানিয়ে দিলেই হতো।”
“আফিফ পদ্মকে কি বলেছে?”
“বলেছে কাজের কারণে কক্সবাজার গেছে। আসতে সময় লাগবে।”
“এতো বড় মিথ্যে কথা!”
“সেটাই তো। আফিফ মিথ্যা না বলে অন্তত পদ্মকে জানিয়ে দিতো, ও এসে দেখাশুনা করতো। মা তো এখন অফিসে চলে গেছে। নানুর বয়স হয়েছে। আফিফকে এখন কে দেখবে? ওর তো জ্বর।”
আহি রাদের দিকে তাকালো। রাদ বলল,
“আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?”
“চল না একটু। বেস্টু না তুই আমার!”
“এখন আমি বেস্টু আর রইলাম কোথায়? আপনার প্রাণের বান্ধবী লিনাশা এসে আমার জায়গা কেঁড়ে নিয়েছে।”
“ভাই, ও আর তুই আলাদা।”
“তাই, আলাদাটা কেমন!”
“আরেহ, তুই ছেলে, আর ও মেয়ে।”
কথাটি বলেই আহি মুখ চেপে হাসলো। রাদ আহির হাতে হালকা ঘুষি মেরে বলল,
“চল, দেখে আসি ওই তেলাপোকাটাকে। আর একটা লাল হিট নিয়ে যাই সাথে করে। মুখের সামনে স্প্রে করে দেবো।”
“চুপ কর তো!”
(***)
দুপুরে আহি আর রাদ সালমা ফাওজিয়ার বাসায় এলো। আহি বাসায় ঢুকতেই রোকেয়া ফাওজিয়া বললেন,
“আহি, ছেলেটার তো খুব জ্বর। সালমা তো অফিসে চলে গেছে। আমি ছেলেটাকে একবার দেখে এসেছি। বেচারা জ্বরে কাঁপছে! সালমা কাকে যেন ফোন করে বলেছিল ওষুধ নিয়ে আসতে, কেউ তো এলোই না।”
আহি বলল,
“নানু, তুমি চিন্তা করো না। আমরা দেখছি।”
রাদ রোকেয়া ফাওজিয়াকে সালাম দিলো। রোকেয়া ফাওজিয়া রাদের থুতনি ধরে বললেন,
“রাদ, তোমাকে আমি প্রথমে চিনতেই পারি নি। তুমি এখানে বসো। আহি যাক। তুমি আমার সাথে কথা বলো, নানু। তোমার মা-বাবা, চাচারা কেমন আছে?”
“জ্বি ভালো।”
রাদ রোকেয়া ফাওজিয়ার প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যস্ত। অন্যদিকে আহি আফিফের ঘরে গিয়ে দেখলো আফিফ কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে আছে। আহি আফিফের পাশে বসে বলল,
“আফিফ, জেগে আছো?”
আফিফ ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “হুম, পদ্ম!’
আহি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বলল,
“আফিফ, তোমার কি বেশি খারাপ লাগছে? ব্যথা আছে এখনো?”
আফিফ বিড়বিড় করে কি যেন বললো। আহি বুঝলো না। সে আফিফের দিকে ঝুঁকে তার মুখ দেখার চেষ্টা করলো। দেখলো আফিফের নিভু নিভু চোখ দু’টিও কাঁপছে। আহি কাঁপা হাতে আফিফের কপাল স্পর্শ করতেই চমকে উঠল। সে চকিত দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকালো। ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“তোমার তো ভীষণ জ্বর।”
আশেপাশে থার্মোমিটার খুঁজতে লাগলো আহি। এরপর ড্রয়ার খুলতেই পেয়ে গেলো। থার্মোমিটারটি ধুয়ে আফিফের মুখে ঢুকিয়ে দিলো। আফিফ আহির হাতটা শক্ত করে ধরলো, আর মিনমিনিয়ে বলতে লাগলো,
“পদ্ম! কাঁদছো কেন? কাঁদে না পদ্ম!”
আহি ভ্রূ কুঁচকে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। এক মিনিট হতেই থার্মোমিটার বের করে এনে দেখলো ১০৩ ডিগ্রী জ্বর। আহি ব্যস্ত হয়ে রাদকে ডাকলো। রাদ আহির ডাকে রুমে ঢুকে বলল,
“কি হয়েছে, আহি?”
“আফিফের তো অনেক জ্বর! আমার মনে হয় ওকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া উচিত।”
“উনার বাসার কাউকে বলবি না?”
“আমি তো পদ্মকে জানাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু উনি বারণ করেছিল। এখন হয়তো জানাতেই হবে।”
আহি ফোন হাতে নিয়ে আফিফের পাশে এসে বসলো। পদ্মের নম্বরে ডায়াল করতে যাবে তখনই কলিংবেলের শব্দ হলো। রোকেয়া ফাওজিয়া আহিকে ডেকে বললেন,
“আহি, সালমা ওষুধ নিয়ে যাকে আসতে বলেছিল, সে হয়তো এসে গেছে।”
আহি ফোনটা টেবিলের উপর রেখে দরজা খুলে দিলো। প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী রাদের সাহায্য নিয়ে আফিফকে ওষুধ খাইয়ে দিলো। সালমা ফাওজিয়া’র পাশের ফ্ল্যাটেই একজন মেডিসিনের ডাক্তার থাকেন। নাম রোকন আহমেদ। তিনিই সেই প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়েছিলেন।
……..
সকালে ঘুম ভেঙেই সালমা ফাওজিয়া যখন আফিফকে ডাকলেন তখন সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখলেন, আফিফ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে, আর ঠান্ডায় জড়োসড়ো হয়ে আছে। এরপর সালমা ফাওজিয়া আফিফকে কয়েকবার ডেকেও যখন সাড়া পেলেন না, তখন পাশ থেকে কাঁথাটা উঠিয়ে নিজেই আফিফের গায়ে জড়িয়ে দিলেন। আর তখনই তিনি অনুভব করলেন আফিফের শরীরের তাপমাত্রা বেশি। তিনি যখন জ্বর মেপেছিলেন, তখন ১০১ ডিগ্রী জ্বর ছিল। সালমা ফাওজিয়া দেরী না করে তখনই পাশের ফ্ল্যাটে গিয়ে রোকন আহমেদকে আফিফের ব্যাপারে জানালেন। রোকন আহমেদ সেই মুহূর্তে নিজের চেম্বারের উদ্দেশ্যেই বেরুচ্ছিলেন। তিনি তবুও আফিফকে এসে দেখে গেলেন। সেই অনুযায়ী ওষুধও লিখে দিলেন। গতদিনের প্রেসক্রিপশনও দেখলেন, যেখানে আফিফকে এক্স-রে করার জন্য বলা হয়েছিল। তিনি আফিফকে ভালোভাবে দেখে বললেন, যাতে আজই এক্স-রে করিয়ে ফেলে। এরপর তিনি যাওয়ার পর সালমা ফাওজিয়া একজনকে ফোন করে ওষুধগুলো বাসায় এনে দিতে বললেন, কারণ তাকেও অফিসে যেতে হবে। আর আহিও সেই মুহূর্তে ক্যাম্পাসে ছিল।
…………
আফিফকে ওষুধ খাইয়ে দিয়ে আহি তার পাশে এসে বসলো। এক গামলা পানি নিয়ে সে আফিফের মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। রাদ আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“তাজওয়ার মানুষটা যে কতোটা ভয়ংকর, আফিফের এই অবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছে!”
আহি ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“এজন্যই তো ভয় পাই আমি।”
“মনে হয় না আফিফের এই জবটা থাকবে।”
“না থাকলেই ভালো। যখন ওর কোম্পানিতে কাজ নিয়েছিল, তখনই আমি ভাবছিলাম, আফিফের ওখানে কীভাবে চাকরি হলো! তাজওয়ার নিজেও ওমেনাইজার। তার আন্ডারে কাজ করে ওরাও ওমেনাইজার। হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া। সোহাগ নামের যেই ছেলেটা তাজওয়ারের এসিস্ট্যান্ট ছিল, আমি সেই ছেলেকে দুইবার রাস্তায় দেখেছি। তাও আবার আলাদা আলাদা মেয়ের সাথে। কেমন চিপকু কিসিমের! রিকশায় বসে….”
আহি মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“ইয়ু বলতেও চাচ্ছি না।”
“আমার মনে হয় ও জেনে-বুঝে আফিফকে পারসোনাল এসিস্ট্যান্ট বানিয়েছে। ও যখন জানতে পারলো, আফিফ পদ্মের হাসবেন্ড তখন তোকে অন্যদিকে কোণঠাসা করে রাখার জন্য এই কাজ করেছে।”
“ঠিক বলেছিস।”
আহির হঠাৎ মনে পড়লো সে পদ্মকে কল করবে ভেবেছিল। বেল বাজায় সেটা ভুলেই গিয়েছিলো। আহি রাদকে বলল,
“ওপাশ থেকে আমার ফোনটা দে তো! পদ্মকে জানিয়ে দেই।”
পদ্মের নাম শুনে আফিফ ঘুম ঘুম চোখে আহির দিকে তাকালো। বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতে লাগলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কিছু বলবে?”
“হুম।”
“আমি পদ্মকে ফোন করছি।”
“উহুম।”
“কি উহুম!”
রাদ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“জ্বরের ঘোরে উনি তোকে কি আর বলবে! কিছু জিজ্ঞেস করিস না তো!”
আহি এবার পদ্মের নম্বরে ডায়াল করতে যাবে, তখনই আফিফ কাঁপা কন্ঠে বললো,
“পদ্মকে বলো না প্লিজ।”
আহি কল কেটে দিয়ে বলল, “কেন?”
আফিফ চোখ বন্ধ করে রাখলো। রাদ আহির দিকে তাকিয়ে আছে। আফিফ কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে বলল,
“তোমাকে আমি ঝামেলায় ফেলে দিয়েছি!”
“আরেহ না। আমার জন্যই তো তোমার এই অবস্থা হলো। আর পদ্মকে জানানো আমার দায়িত্ব। ও তোমার ওয়াইফ। পরে কখনো জানলে উলটো বুঝে বসে থাকবে। আমি চাই না পদ্ম আমাকে ভুল বুঝুক।”
আফিফ চুপ করে রইলো। কিছুক্ষণ পর কাঁপা কন্ঠে বলল,
“আমি এই মুহূর্তে এক্সপ্লেইন করতে চাচ্ছি না। একটা রিকুয়েস্ট। পদ্মকে কিছু বলো না।”
রাদ আহিকে ইশারায় ফোনটা রেখে দিতে বললো। আহি ফোন রেখে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। রাদ বলল,
“এক্স-রে কয়টাই?”
“চারটায় সময় দিয়েছিল। ভাবছি আজ এখানেই থাকি। বাসায় কি বলবো বুঝতে পারছি না। মিসেস লাবণি তো সারাক্ষণ ফণা তোলে বসে থাকে।”
রাদ হেসে বলল,
“তোর লাইফের ট্রাজেডি দেখে একটা ফিল্ম বানাতে ইচ্ছে করছে।”
“বানিয়ে ফেল, দেখবি ফ্লপ হবে। এতো প্যারা নিয়ে কে বাঁচে ভাই? যারা মুভিটা দেখতে আসবে তাদের নাকের পানি, চোখের পানি মোছা টিস্যু পেপারে সিনেমা হল ভর্তি হয়ে যাবে।”
“তোর আজ পর্যন্ত ক’টা টিস্যু বক্স শেষ হয়েছে?”
“ধুর এতো ঢং করে কাঁদি না আমি। ওড়না আর হাত দিয়ে কাজ চালিয়ে ফেলি।”
রাদ হাসলো। হাসতে হাসতে মেঝেতে বসে পড়লো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তুই কাউকে বলিস না আবার।”
“তেলাপোকাটা… আই মিন আফিফ শুনছে না।”
আহি আফিফের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে বলল,
“না, ঘুমিয়ে গেছে হয়তো।”
রাদ হেসে বলল,
“পুষ্পকে বলবো অন্তত তোর কাছ থেকে যাতে ওড়না ধার না নেয়। আর তোর হাতে বানানো কিছুই খাওয়া যাবে না।”
আহি মুখ ফুলিয়ে রাদের দিকে বালিশ ছুঁড়ে দিয়ে বলল,
“হ্যান্ডওয়াশ বলেও কিছু একটা আছে। আর শোন, মানুষ ইমোশনাল হলে টিস্যু হাতে নিয়ে বসে থাকে না। আমার প্যারাগুলো খেয়ে দেখিস, টিস্যু কোথায় সেটা দেখার সময় পাবি না, তখন পৃথিবীটাই অন্ধকার লাগবে।”
রাদ চুপ করে রইল। আহির চোখে অশ্রু টলমল করছে। রাদ আহির পাশে বসে বলল,
“সরি, মজা করছিলাম।”
“রাদ প্লিজ, আমি অনেক ঝামেলায় আছি। আমার ফিউচার এমন এক জায়গায় এসে আটকে গেছে, যেখানে আমি কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছি না। সেখানে এসব পরিহাস, আমার জন্য অনেক কষ্টের।”
রাদ মাথা নিচু করে বসে রইলো। আহি রাদকে হালকা ধাক্কা দিতেই রাদ উঠে চলে গেলো। আহি অবাক দৃষ্টিতে রাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো।
চলবে-
আগের পর্ব
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/950432380011868/?mibextid=Nif5oz