#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩৯||
৭৮।
শূণ্য দৃষ্টিতে নভোমণ্ডলের কোমলরূপ দেখছে রাদ। আহি বারান্দায় এসেই রাদের পাশে এসে দাঁড়ালো। রাদ আহির দিকে না তাকিয়েই বলল,
“তোর কষ্ট হলে আমারও কষ্ট হয়।”
আহি রাদের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“তোর কথায় আমি কষ্ট পাই নি, রাদ। তুই আমার মেডিসিন। মেডিসিন রোগ সারায়, রোগ বাড়ায় না।”
“একটা কথা বলি তোকে?”
“বল না। ”
“যখন তোর বিয়ে হয়ে যাবে, তখন কি আমার আর প্রয়োজন হবে না?”
আহি রাদের চোখের দিকে তাকালো। রাদ বলল,
“এখন আমারই মনে হচ্ছে, তুই আমার ভালো থাকার মেডিসিন।”
আহি ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। রাদের হাত ধরে বলল,
“কি হয়েছে তোর?”
রাদ বিরক্তির সুরে বলল,
“তোকে আমি তাজওয়ারের সাথে সহ্য করতে পারি না, আহি।”
“জানি আমি।”
“আহি, তুই যেভাবে বুঝেছিস ওটা না।”
“তাহলে কি? আচ্ছা, বস তুই। আমাকে খুলে বল, কি হয়েছে।”
“আমি তোকে হারাতে চাই না, ব্যস।”
“আমি তোকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না।”
“আহি, আমি ওটা মিন করি নি।”
“তো!”
রাদ আহির চোখের দিকে তাকালো। আহি কিছুক্ষণ রাদের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,
“আচ্ছা, তোকে এখন কিছু বলতে হবে না। তুই এই মুহূর্তে টায়ার্ড। বিশ্রাম কর। ইফতারের পর ঠান্ডা মেজাজে কথা বলবো। এখন ভেতরে চল।”
“তুই যা, আমি আসছি।”
আহি চলে যেতেই রাদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বুকে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে বলল,
“আজ যা হওয়ার হোক, আমি তোকে আমার মনের কথা জানিয়ে দেবোই। সহ্য হচ্ছে না আর আহি। আমি কখনোই এতো চাপা স্বভাবের ছিলাম না। কিন্তু তোর ভালোর জন্য আমার মনের কথা এতোদিন আড়াল করে রেখেছি। এখন আর পারছি না আমি।”
এদিকে আহি রাদের অদ্ভুত আচরণের কারণ খোঁজার চেষ্টা করছে। আহির মনে হাজারও প্রশ্ন!
“রাদ কি আমার জন্য বিরক্তবোধ করছে? বার-বার আমার সব সমস্যার সমাধানে ওকে জড়াচ্ছি, তাই? না-কি তাজওয়ারের সাথে বিয়ে হবে ভেবে উদ্বিগ্ন? না-কি রাদ আমাকে অন্য দৃষ্টিতে দেখছে! না, না, না। কি ভাবছি আমি?”
আহি নিজের মাথায় ঠোকা মেরে বিড়বিড় করে বলল,
“এভাবে কেন ভাবছি আমি? রাদ শুনলে আমার উপরই কৌতূক করবে।”
আহি আফিফের পাশে বসে তার কপালে হাত রাখলো। আফিফ নিভু নিভু দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকালো। আহি হাত সরিয়ে নিতেই আফিফ তার হাত ধরলো। আহি কিছুটা অবাক হলো। আফিফ কাঁপা কন্ঠে বললো,
“পদ্মফুল, তুমি অনেক ভালো। কে বলেছে তুমি অলুক্ষণে? তোমার কোনো দোষ নেই। সব আমার দোষ। আমি অপরাধী। আমি সবাইকে কষ্ট দিয়েছি। তুমি, আপা, রেনু, মা আর আহি….”
রাদ রুমে ঢুকেই দেখলো আফিফ আহির হাত ধরে রেখেছে। রাদকে দেখে আহি বলল,
“আফিফ জ্বরের ঘোরে আমাকে পদ্ম ভাবছে।”
আফিফ মিনমিনিয়ে বলল, “পদ্ম, সরি।”
রাদ আহিকে সরিয়ে আফিফের পাশে বসে বলল,
“তুই যা। রেস্ট কর। নানুকে দেখছি রান্নাঘরে কি যেন করছে। গিয়ে হ্যাল্প কর। আমি উনার খেয়াল রাখবো, সমস্যা হবে না আমার।”
আহি মাথা নেড়ে চলে গেলো। আফিফ এখনো প্রলাপ বকছে। রাদ ভ্রূ কুঁচকে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। আফিফ বলতে লাগলো,
“আমি কি ছিলাম! আমাকে কি বানিয়ে দিয়েছে।”
রাদ এবার ভ্রূ কুঁচকে আফিফের দিকে তাকালো। সে আফিফের কাছাকাছি গিয়ে তার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করছে। আফিফ বলতে লাগলো,
“পদ্ম, তুমি আমার সাথে রাগ করোনা। সব দোষ আমার। আমি যদি একবার জানতাম আমার খেয়াল, আমার কল্পনা আমার বর্তমানে আসবে, আমি কখনোই তোমার হাত ধরতাম না। আমি তোমার অজান্তে তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি, আমি আহিকে কষ্ট দিচ্ছি।”
রাদ সোজা হয়ে বসলো। কিছুক্ষণ স্থির হয়ে আফিফের দিকে তাকিয়ে উঠে রুমের দরজা লাগিয়ে দিলো। দরজা লাগিয়ে আবার আফিফের পাশে বসে বলল,
“পদ্মের সাথে কি করেছেন? কীভাবে কষ্ট দিলেন ওকে? আপনি সবচেয়ে বেশি আহিকে কষ্ট দিয়েছেন। আপনার জন্য আহি রাত-দিন কেঁদেছে। আর আপনার মনে এতো সহজে পদ্ম জায়গা করে নিলো।”
আফিফ চুপ করে রইলো। রাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কে তুমি? পদ্ম কোথায়?”
“পদ্ম আমার পাশেই আছে। বলুন না কি করেছেন আপনি? আহিকে কেন কষ্ট দিয়েছিলেন?”
আফিফ ভেজা কন্ঠে বলল,
“ইচ্ছে করে দেই নি আমি। আমারই তো অনেক কষ্ট হয়েছে। ভীষণ কষ্ট পেয়েছি আমি।”
রাদ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“আপনি কষ্ট পেয়েছেন!”
“তাজওয়ার খান… আমার সব কেঁড়ে নিয়েছে। আহিকে বাঁচাতে হবে। আমি তো পারবো না। আমি একদম অসহায়? আমি অপদার্থ। আমি আমার আপাকেই বাঁচাতে পারি নি।”
“কি হয়েছে আপার সাথে?”
“আপা…!”
“হ্যাঁ বলুন না।”
“তাজওয়ার খান আমার আপাকে খুন করেছে। আমার আপাকে মেরে ফেলেছে ওরা। ওরা রেনুকেও মেরে ফেলবে। তখন আমি কি করবো?”
রাদ স্তব্ধ হয়ে গেলো আফিফের কথা শুনে। আফিফ বার-বার সেই একটি বাক্যই আওড়াতে লাগলো। তার চোখ বেয়েও অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। রাদ টিস্যু দিয়ে তার চোখ মুছে দিয়ে বলল,
“কেন খুন করেছে তাজওয়ার!”
“জানি না, আমার কি দোষ ছিল! আমার কিছু করতে পারি নি। আপাকে বাঁচাতে পারি নি আমি।”
আফিফ বিড়বিড় করতে করতে ঘুমিয়ে গেলো। রাদ থম মেরে বসে আছে। তার মনে হাজারও প্রশ্ন। আর এই প্রশ্নগুলোর উত্তর একমাত্র আফিফই দিতে পারবে।
(***)
ইফতারির পর আহি লাবণিকে ফোন করে জানালো, সে পুষ্পের বাসায় থাকবে। পুষ্পকে আগে থেকেই শিখিয়ে দিয়েছে সব। এরপর আহি লাবণির সাথে কথা বলে একবার আফিফকে দেখে এলো। আফিফের এখন জ্বর নেই। সে ঘুমাচ্ছে। রাদ তার পাশেই শুয়ে আছে। রাদ বলেছিল আহির সাথে কথা বলবে। তাই আহি রাদের পাশে বসে তাকে ডাকলো। রাদ সাড়া দেয় নি। আহি ভাবলো, রাদ ঘুমিয়ে গেছে। তাই আর বিরক্ত না করে বাতি নিভিয়ে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। এরপর সে সালমা ফাওজিয়ার রুমে এসে শুয়ে পড়লো।
এদিকে আহি চলে যেতেই রাদ উঠে বসলো। এই অস্থিরতা নিয়ে ঘুম হবে না তার। সে এতো বছর আহির অংশটাই শুনে এসেছে। আজ তাকে জানতেই হবে আফিফের অংশটা। কেন আফিফ আহিকে ছেড়ে এসেছিল? রাদ বাতি জ্বালিয়ে আফিফের সামনে এসে বসলো। আফিফ ঘুম। তার ইচ্ছে করছে আফিফকে উঠিয়ে দিতে। কিন্তু অসুস্থ মানুষকে এভাবে ডেকে উঠানো ভালো হবে না। তাই রাদ আফিফের ঘুম ভাঙার অপেক্ষায় আছে।
(***)
রাদকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। আফিফ নড়েচড়ে উঠতেই রাদ বলল,
“এখন কেমন লাগছে আপনার?”
আফিফ পুরুষালি কন্ঠ শুনে চোখ খুললো। রাদকে দেখে একনজর আশেপাশে চোখ বোলালো। রাদ বলল,
“আপনি আহির মায়ের বাসায়। আমি আপনাকে দেখতে এসেছি।”
আফিফ উঠে বসলো। রাদ বলল,
“আপনার জ্বর বেশি ছিল, তাই এক্স-রে করাতে পারি নি। এখন কেমন লাগছে?”
“ভালো।”
“সরি, কিন্তু আপনাকে এই মুহূর্তে আমি অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করবো। যদিও এই প্রশ্নটা এই সময়ে করা উপযুক্ত না। কিন্তু আমার কৌতূহল আমি আটকে রাখতে পারছি না।”
আফিফ ভ্রূ কুঁচকে রাদের দিকে তাকালো। রাদ বলল,
“তাজওয়ার খান আপনার আপাকে কেন খুন করেছিল? আহিকে আপনি কেন কষ্ট দিয়েছিলেন?”
আফিফ অবাক হয়ে রাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমাকে এসব কে বলেছে?”
“আপনি নিজেই জ্বরের ঘোরে এসব বলেছেন।”
আফিফ চুপ করে রইলো। চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়লো তার। রাদ বলল,
“প্লিজ, কি হয়েছিল বলুন!”
“এসব জেনে লাভ নেই। আমি এসব বলতে চাচ্ছি না।”
“প্লিজ, আমি কাউকে এই বিষয়ে জানাবো না। অন্তত আমাকে বলবেন প্লিজ। আহির সাথে সংশ্লিষ্ট সবকিছু আমার জানতে হবে। কারণ….”
আফিফ রাদকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“জানি, তুমি আহিকে ভালোবাসো।”
রাদ চুপ হয়ে গেলো। আফিফ বলল,
“ভালোবাসা সুন্দর। কিন্তু ত্যাগ মানেই যন্ত্রণা আর জেদ তেমনিই ভয়ংকর। আমার জীবনে এই কয়েকটা শব্দ আমার অগোচরেই এসেছে। আর আমাকে না জানিয়ে আমার সব কেঁড়ে নিয়ে গেছে।”
(***)
আফিফ থেমে রাদের দিকে তাকালো। ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“আহি জানেই না, ওর ভালোবাসা আমাকে কি দিয়ে গেছে। আমি যদি ওকে জানিয়ে দেই, ও অনেক কষ্ট পাবে। আর আমি ওকে কষ্ট দিতে চাই না।”
রাদ বলল, “কি হয়েছিল?”
আফিফ আজ আবার অতীতের ফেলে আসা অংশটা পুনরায় স্মরণ করলো।
“গ্রামেই বড় হয়েছি আমি। স্কুল-কলেজ ওখানেই শেষ করেছি। পড়াশুনায় ওতো আগ্রহ ছিলো না। ইচ্ছে ছিলো চিত্রশিল্পী হবো। আমার যোগ্যতাও ছিল। বাবা এসব পছন্দ করতেন না। কিন্তু আপা আমাকে খুব সাপোর্ট করতো। সচ্ছল পরিবারেই ছিলাম আমরা। কিন্তু একদিন রোড এক্সিডেন্টে বাবা মারা গেলো। আর এরপর আমার পুরো পৃথিবীটাই উলটপালট গেলো। আমি ছোট ছিলাম। মাকে অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাই আমার মাও বেশিদূর পড়াশুনা করেন নি। বাবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতো, তাই কোনো পেনশেন ছিল না। ব্যাংকে যে ক’টা টাকা ছিল, সেই টাকায় আমরা শুধু খেতে পারবো। আমার স্কুল বন্ধ। আপা ভাগ্যিস কলেজ পাশ করে ফেলেছিল। এরপর এক চাচার সাহায্যে শহরের মার্কেটে সেলস গার্লের চাকরি নেয়। এরপর আপা আমাকে পড়াশুনা করাবে সিদ্ধান্ত নেয়। এমনও দিন গিয়েছিল আমরা দু’বেলা ভাত খেতে পারিনি। আমরা মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির ছিলাম তাই কারো কাছে হাত পাততে পারি নি। আর আপা সব ঠিক করে দিয়েছিল। গ্রামের সবাই মাকে প্রশ্ন করতো, শহরে গিয়ে আপা কি কাজ করে? মা বলতো দোকানে কাজ করে। আমিও তাই বলতাম। কিন্তু মানুষের চিন্তা-ভাবনা এতো নোংরা ছিল, তারা আমাদের আড়ালেই ফিসফিস করতো। আমি বুঝতাম না। বয়স কম ছিল তাই। কিন্তু মা বুঝতো। আপার উপরই রাগ ঝাড়তো। কাজ ছেড়ে ভিক্ষা করতে বলতো। আপা কাঁদতো। কিন্তু কাজ ছাড়ে নি। এরপর একদিন আপা আমাকে গ্রামের কলেজে ভর্তি করিয়ে শহরে নিয়ে এলো। এখানে এসে চারুশিল্পে ভর্তি করিয়ে দিলো। কারণ আপার স্বপ্ন ছিল, আমার স্বপ্ন পূরণ করা। আমি কলেজে ক্লাস করতাম না। শুধু পরীক্ষা দেওয়ার জন্যই গ্রামে যেতাম। কিন্তু ওখানে মা আর রেনু ভালো ছিল না। গ্রামের মানুষগুলো বাবা জীবিত থাকাবস্থায় যতোটা ভদ্র আচরণ করেছিল, বাবার মৃত্যুর পর ততোটাই খারাপ হয়ে পড়লো। আপা বাধ্য হয়ে আমাদের শহরে নিয়ে আসে। এরপর খরচ আরো বেড়ে যায়। দিন-রাত আপা বাইরে কাজ করতো। দোকানে বসতো, এরপর স্কুলের আয়া হিসেবে কাজ নিয়েছিল। সব করেছে আপা, শুধু আমাদের জন্য। আর একদিন সেই আপাকেই নিজের সম্মান বিক্রি করে দিতে হলো, আমার জন্য।”
আফিফ এতোটুকু বলেই শার্টের হাতায় চোখ মুছলো। রাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আহি আমাকে কখন ভালোবেসেছে আমি জানি না। কেন ভালোবেসেছে আমি জানি না। কি দেখেছে আমার মধ্যে আমি সেটাও জানি না। কিন্তু যখন ও আমাকে চিঠি লিখে জানিয়েছিল, আমি ওকে ফিরিয়ে দেই নি। কারণ আমি ওর প্রতি কখনোই বিরক্ত ছিলাম না। আমি জানতামও না, আহি কে? আমি তো ওকে দেখিই নি। আমি শুধু অনুভব করেছি।”
রাদ ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“আপনি আহিকে ভালোবাসতেন?”
“ভালোবাসতাম কি-না জানি না। ও আমার আঠারো বছর বয়সের অনুভূতি ছিল। আমি তখন কিশোর মাত্র। কিন্তু ভালো লাগতো সেই চিঠিগুলো। আমি সবগুলো চিঠি যত্ন করে রেখে দিতাম। হয়তো ভালোবাসতাম। আমি জানি না, অনুভূতিটা কেমন ছিল। কিন্তু কখনো আহির মতো করে আহিকে ভালোবাসি নি।”
“আহিকে পছন্দ করলে, ওকে ফিরিয়ে দেওয়ার কারণ!”
“অনেক বড় কারণ। ছোটখাটো বিষয় না। আহির ভালোবাসা আমার পুরো জীবনটাই এলোমেলো করে দিয়েছিল। তাজওয়ার আহিকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করতো। ও আহিকে ফলো করতো। আমি জানি না, ও কি দেখেছিল। কিন্তু ও আপাকে বলেছিল, আহি যেই পরিমাণ আমাকে ভালোবাসে, সেই পরিমাণ ঘৃণা আমার কাছ থেকে পাবে।”
“মানে?”
“একদিন আপা কাজ থেকে ফিরে এসে আমাকে বলেছিল-”
-আফিফ, তোর সাথে আমার জরুরি কথা আছে।
-হ্যাঁ বলো আপা।
-চারুশিল্পে কি কোনো মেয়ে আছে, যে তোকে পছন্দ করে?
আফিফ রাদকে বলল,
“আমি আপাকে চিঠিগুলোর কথা বলতে চাই নি। তাই মিথ্যে বলেছিলাম সেদিন। বলেছিলাম-”
-না আপা।
-দেখ, মেয়েটার কাছ থেকে দূরত্ব রাখবি। যে মেয়েটা তোকে চিঠি দেয়, সেই মেয়েটাকে এখানকার প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর ছেলে পছন্দ করে। ছেলেটা না-কি প্রতিদিন মেয়েটাকে ফলো করে। তোকেও দেখেছে। কি দেখেছে আমি জানি না। আমার মালিক বললো আমাকে। ওই ব্যবসায়ীর ছেলে হুমকি দিয়েছে, যেই মেয়েটা তোকে পছন্দ করে, তার পছন্দের মাত্রা যতো বেশি হবে, সে তোর কাছ থেকে ততোটুকু ঘৃণা ফেরত পাবে।
-মানে?
-মানে আমি জানি না। তুই শুধু মেয়েটার সাথে কথা বলিস না।
আফিফ আবার রাদের দিকে তাকালো আর বলল,
“এর মানে কি ছিল, তা আমি সেদিন একটুও বুঝি নি। আবেগের বয়স ছিল। তখনও না করি নি আহিকে। উলটো তাকে আমার দেখার আগ্রহ জন্মালো। আমি জানতে চাইছিলাম চিঠির মেয়েটা আসলে কে? আহিকে আমি দেখেছি, কিন্তু জানতেই পারি নি, আহি আসলে সেই মেয়েটা। মা ভীষণ পছন্দ করতো আহিকে। মায়ের হয়তো আহির চেহারা এখন আর মনেই নেই। আমার একবার এক্সিডেন্ট হয়েছিল। আহির মা আমার চিকিৎসা বাবদ খরচ দিয়েছিলেন। তখন আহি রোজ মাকে ফোন করতো। আমার খোঁজ নিতো। মায়ের কাছেই শুনেছিলাম এসব। এজন্য আমার আর পদ্মের বিয়েতে মা তেমন একটা খুশি ছিল না। মায়ের মনে হয়েছিল, সেই ফোনে কথা বলা মেয়েটিই আমার জন্য বেস্ট হবে। পদ্ম এখনও এসব জানে না। সে জানে না, মা আমাদের বিয়েতে রাজি ছিল না। আমার যখন এক্সিডেন্ট হয়েছিল তখন আপা বেঁচে ছিল না। আমি তখনও জানতাম না আপা কেন এতো বড় স্টেপ নিয়েছিল।”
রাদ জিজ্ঞেস করলো,
“উনি আত্মহত্যা করেছিলেন?”
“হুম।”
“তাহলে খুন করেছে কেন বললেন?”
“কারণ জানতাম না আত্মহত্যার মূল কারণ কে!”
“কে!”
“আপা একজনকে ভালোবাসতো। জানি না ছেলেটা কে। শুনেছি দোকানের মালিক। অনেকে বলে আপার সাথেই দোকানে বসতো। অনেকে বলে গ্রামে আপার এক প্রেমিক ছিল সে। আসলে আপা একজনকে ভালোবাসতো এটা সত্য। ফোনে কথা বলতো। এমন অনেক কিছুই খেয়াল করেছিলাম আমি। আমি এখনো জানি না সে কে। এতোটুকু জেনেছি, সে আমার আপার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল।”
আফিফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“আপার সাথে দেখা করার বাহানায় কিছু ব্যক্তিগত ভিডিও ধারণ করেছিল। আমি ভিডিও দেখি নি। মা দেখেছিল। আমি তখন জানতাম না, আপার কোনো অপরাধ ছিল কি-না। এদিকে ভিডিওটা সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ার পর মা অনেক ভেঙে পড়েছিল। আমি এসব জানার আগেই আপাকে দেখেছিলাম। আপা আমার মুখোমুখি দাঁড়াতে চায় নি। সেদিন রাতেই আত্মহত্যা করে ফেললো। আমি আবার এতিম হয়ে গেলাম। আপার মৃত্যুর পর বুঝলাম, আসলে কি হয়েছিল। যেই নম্বর থেকে এসব ভিডিও ছাড়া হয়েছিল, তাকে খুঁজে বের করার জন্য টাকা জোগাড় করতে ব্যস্ত ছিলাম আমি। যাতে অন্তত ভিডিওগুলা ডিলিট করে দেয়। এরপর অনেকদিন কেটে গেলো। একদিন সেই মানুষটা আমার সামনে এলো, যে আমার জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছিলো।”
“তাজওয়ার খান?”
“হুম। তাজওয়ার নিজেই সব স্বীকার করেছে। বললো, আহিকে পাওয়ার জন্যই এমন করেছে। আহি আমাকে ভালোবাসে এটাই আমার অপরাধ ছিল। এরপর আমাকে হুমকি দিয়ে বলল, আমি যদি এখনই আহিকে নিয়ে ভাবা বন্ধ না করি, আহিকে সুযোগ দেই, একই কাজ সে রেনুর সাথে ঘটাবে। আমি দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। এসব পরিস্থিতি সামলানোর জন্য আমার বয়স খুব কম ছিল। নিজেকে বোকা মনে হচ্ছিলো তখন। ভাবছিলাম, কি করলাম আমি? একটা কল্পনার জন্য আমার আপাকে মরে যেতে হলো? আমি রেনুর বড় ভাই। ওর দায়িত্ব আমার। কিন্তু তাজওয়ার বেশ চালাক। সে নিয়াজীর জন্য প্রস্তাব নিয়ে বাড়ি চলে গেলো। মাও রাজি হয়ে গেলো। আমাকে সারাজীবনের জন্য নিজের হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করার তার এই একটাই পথ খোলা ছিল, রেনু আর নিয়াজীর বিয়ে। বিয়েটা হয়েও গেলো। এটাও আমি পরে জানতে পারলাম যে তাজওয়ারই নিয়াজীকে বলেছিল রেনুকে বিয়ে করার জন্য। আর এরপর আহিকে না করা ছাড়া আমার কোনো উপায় ছিল না। আমি ভেবেছি ও আমাকে ভুলে যাবে। কিন্তু ভুলে নি। এরপর যেদিন আহিকে সামনা-সামনি দেখলাম, সেদিন পদ্ম আর আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। আমি যদি জানতাম তারা দু’জন বান্ধবী, আমি পদ্মকে বিয়ে করতাম না। পদ্ম অনেক ভালো একটা মেয়ে। আমি ওকে কষ্ট দিতে চাই না। আমি পদ্মকে ভীষণ ভালোবাসি। অতীত সবার জীবনে থাকে। আহি আমার ফেলে আসা অতীত। পদ্ম আমার বর্তমান। দু’জনই ভালো। হয়তো তাদের ভাগ্য খারাপ। কারণ আমি তাদের জীবনে এসেছিলাম।”
রাদ আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। কি বলবে সে বুঝতে পারছে না। এতোদিন সে আফিফের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, এই মানুষটাই সবচেয়ে বেশি অসহায়।
চলবে-
আগের পর্ব
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/951582796563493/?mibextid=Nif5oz