#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৮।
ভেতর থেকে কোনোপ্রকার সাড়া না পেয়ে ঘাবড়ে গেলেন দিলরুবা বেগম। তিনি দরজায় জোরে জোরে শব্দ করতে আরম্ভ করলেন। প্রিয়তা প্রিয়তা বলে ডাকলেন খুব। প্রিয়তা নিশ্চুপ, ভেতরে সে কী করছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। দরজায় এহেন করাঘাতের শব্দে ফারজাদ তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। তার মা আর বোনকে গেস্ট রুমের দরজায় সমানে আঘাত করতে দেখে চিন্তায় পড়ে সে। জিজ্ঞেস করে,
‘কী হয়েছে, আম্মি। এভাবে দরজা ধাক্কাচ্ছেন কেন?’
দিলরুবা বেগম অস্থির হয়ে বললেন,
‘দেখ না, বাবা, মেয়েটা ভেতরে গিয়ে আর দরজা খুলছে না। আমার ভয় করছে খুব, ও না আবার কোনো উল্টা পাল্টা কাজ করে বসে।’
ফারজাদ কপাল কুঁচকে এগিয়ে এসে বলল,
‘সরুন, আমি দেখছি।’
ফারজাদ দরজায় আওয়াজ করে। বলে,
‘প্রিয়তা, আপনি দরজা খুলছেন না কেন?’
এতক্ষণে উত্তর এল। অতি ক্ষীণ সুরে প্রিয়তা জানাল,
‘আমি ঘুমাচ্ছি।’
প্রিয়তার গলার স্বর ফারজাদের স্বাভাবিক মনে হলো না মোটেও। সে ফের দরজায় শব্দ করে বলল,
‘দরজাটা একবার খুলুন তো।’
‘না, আমি ঘুমাচ্ছি বললাম না।’
ফারজাদ রেগে গেল। গলার স্বর চওড়া করে বলল,
‘ঘুমাবেন পড়ে। আগে আপনি দরজা খুলুন।’
এবার আর প্রত্যুত্তর এল না। ফারজাদ বুঝে নিল, ভেতরে কিছু একটা অবশ্যই ঘটেছে। সে তাই বলল,
‘প্রিয়তা, দরজাটা না খুললে আমি কিন্তু দরজা ভাঙতে বাধ্য হব।’
তাও উত্তর এল না কোনো। দিলরুবা বেগম বললেন,
‘লকটা ভেঙে ফেলো, ফারজাদ। আমার মোটেও কিছু স্বাভাবিক লাগছে না। মেয়েটা নিশ্চয়ই কিছু একটা করে বসেছে।’
ফারজাদ বিলম্ব না করে দরজার লক ভাঙার প্রস্তুতি নিল। নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিল তাতে। বেশ কয়েকটা ধাক্কার পর লকটা ছুটল। ফারজাদ সহ ভেতরে প্রবেশ করল সবাই। গিয়ে দেখল, প্রিয়তার নিশ্চল শরীরটা পড়ে আছে বিছানায়। বাম হাত দিয়ে র ক্ত পড়ছে অনর্গল। অন্যহাতে কাচের টুকরো। দিলরুবা বেগম দেখলেন, তার ফুলের টবটা ভেঙে পড়ে আছে নিচে। তিনি যা সন্দেহ করেছেন তাই হয়েছে। ফারজাদ দ্রুত প্রিয়তার কাছে যায়। নাকের কাছে দুই আঙ্গুল ধরে বলে,
‘বেঁচে আছে। হসপিটালে নিতে হবে এক্ষুনি।’
দিলরুবা বেগমের যেন শরীর কাঁপছে এত র ক্ত দেখে। তিনি ভীত সুরে বললেন,
‘বাঁচিয়ে আন ওকে। ওর কিছু হয়ে গেলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।’
ফারজাদ দ্রুত এম্বুলেন্স ডাকল। এর আগে সে নিজেই প্রিয়তার কাটা জায়গাটা পরিষ্কার করে দিয়েছে। এম্বুলেন্স চলে আসে কিছুক্ষণের মাঝেই। স্ট্রেচারে করে গাড়িতে তোলা হয় তাকে। ফারজাদ একাই যায়। মৌমিকে রেখে যায় মায়ের কাছে। দিলরুবা বেগম এসব দেখে স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। মেয়েটার এমন করুণ দশা তিনি সহ্য করতে পারছেন না যেন।
________
এত রাতে ইমারজেন্সিতে নিয়ে যাওয়া হলো প্রিয়তাকে। ডাক্তার প্রথমে দেখেই বললেন,
‘পুলিশ কেইস, পুলিশকে জানাতে হবে আগে।’
ফারজাদ কোনোরকমে বুঝিয়ে বলল,
‘আগে মেয়েটাকে বাঁচিয়ে দিন। আমি সব ফর্মালিটি করে নিব।’
ফারজাদের অনুরোধে ডাক্তার রাজী হলেন। প্রিয়তাকে নিয়ে যাওয়া হলো অপারেশন থিয়েটারে। বেশ র ক্ত গিয়েছে তার। শিরা না কাটলেও হাতটা কেটেছে বেশ গভীর ভাবেই। সেলাই লেগেছে তিনটা।
ঘন্টা খানিক বাদে তাকে কেবিনে দিয়ে ডাক্তার এসে বললেন,
‘রোগীর জ্ঞান ফিরলেই আমরা পুলিশকে খবর দিব। এর আগে আপনি রিসিপশনের সব ফর্মালিটি পূরণ করে আসুন।’
ফারজাদ তাই করল। সব শেষ করে গেল প্রিয়তার কেবিনের ভেতর। নার্স একজন কেবিন ছাড়ল ফারজাদকে দেখে। তার কেবিন ছাড়ার কারণ ফারজাদ বুঝতে পারল না। সেও কি ঐ দোকানদারের মতো তাদের স্বামী স্ত্রী ভাবছে?
প্রিয়তার মুখটা শুকনো। চোখের নিচে কালি পড়েছে অনেক আগেই। শুভ্র সাদা জামাটাতে র ক্তের লাল দাগ। এক হাতে সাদা বেন্ডেজ আর অন্য হাতে চলছে স্যালাইন। এক মুহুর্তের জন্য ফারজাদের মনে তার প্রতি বড্ড মায়া জন্মাল যেন। আকস্মিক মনে হলো, মেয়েটার এই করুণ অবস্থার জন্য সে দায় নয়তো? আজকে কি সে একটু বেশিই রাগ দেখিয়ে ফেলেছিল?
ফারজাদ নিজের উপর ক্ষিপ্ত হলো খুব। কেন রাগকে কন্ট্রোল করতে পারে না। এত কথা না বললেও তো হতো। তাহলে হয়তো মেয়েটা আর এমন কাজ করতো না। ফারজাদ নিজের চুলে আঙ্গুল চালিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে। বড়ো বড়ো নিশ্বাস ছাড়ে সে। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে।
হাঁটু ভেঙে প্রিয়তার সামনে বসে। ঢোক গিলে। শুকনো ঠোঁট যুগল নাড়িয়ে বলে,
‘আমি দুঃখিত, প্রিয়তা। আমি আপনাকে ওভাবে বলতে চাইনি। কিন্তু, আপনি আসার পর থেকেই ঘটে যাওয়া ঝামেলাগুলো আমাকে ভীষণ অশান্ত করে তুলেছিল, তাই না পেরে একটু বেশিই রাগ দেখিয়ে ফেলেছি। আমার উচিত হয়নি এমনটা করা। আমাকে ক্ষমা করবেন।’
ফারজাদ উঠে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। আজ এক অদ্ভুত রকম অনুভূতি হচ্ছে যেন। মেয়েটার জন্য একটু বেশিই মায়া হচ্ছে। এমনটা হওয়া মোটেও উচিত নয়। সে বিরক্ত হলো নিজের মনের উপর। শুধু শুধু অদ্ভুত সব চিন্তা ভাবনায় তাকে অস্থির করে তুলছে। সে অস্থিরতা কমাতে দিলরুবা বেগমকে কল দেয়। তাঁকে জানায়, প্রিয়তা এখন ঠিক আছে। দিলরুবা বেগম মেয়েটার জন্য নামাজে বসেছিলেন। ফারজাদের কাছ থেকে খবর পেয়ে খুশিতে কেঁদে ফেললেন তিনি।
কিছুক্ষণের মাঝেই পুলিশ এসে হাজির হলেন। পুলিশের সম্মুখে ফারজাদ এখন কী বলবে বুঝতে পারছে না। তখন নার্স এসে জানাল, প্রিয়তার জ্ঞান ফিরেছে। প্রিয়তার জ্ঞান ফেরার খবর খেয়ে শান্ত হলো ফারজাদ। অফিসারকে বলল,
‘প্রিয়তার কাছেই আপনি আপনার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন, অফিসার। চলুন।’
পুলিশ অফিসারকে সাথে নিয়েই কেবিনে প্রবেশ করে ফারজাদ। প্রিয়তা নিভু নিভু চোখে দেখল চেয়ে। অফিসার গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘আপনি কি কথা বলার অবস্থায় আছেন? আমাদের কিছু প্রশ্ন ছিল।'(উর্দু)
প্রিয়তা ঢোক গিলল। ক্ষীণ সুরে বলল,
‘জি, বলুন।’
‘আপনি আত্মহ ত্যা করতে চেয়েছেন কেন?’
প্রিয়তা ফারজাদের দিকে চাইল। ফারজাদের চোখের দৃষ্টি আজ ঘোলাটে। প্রিয়তা কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে চোখ নামিয়ে বলল,
‘আমি অনেক বড়ো ভুল করে ফেলেছি, আর নিজেকে এই ভুলের শাস্তি দিতেই এই পথটা বেছে নিয়েছিলাম।’
অফিসার ভ্রু কুঁচকে একবার প্রিয়তাকে দেখে আরেকবার ফারজাদকে। তারপর ফারজাদকে জিজ্ঞেস করে,
‘উনি কে হয় আপনার?’
ফারজাদ জবাব দেওয়ার আগেই প্রিয়তা বলে উঠে,
‘উনার বাড়ির আশ্রিতা আমি। উনি আমাকে দয়া করে উনার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন বলেই আমি এখন অবধি বেঁচে আছি, নয়তো কবেই ম রে যেতাম।’
অফিসার ঘটনার আগা মাথা কিছু বুঝলেন না। বললেন,
‘মিস্টার, আপনি আমাকে খুলে বলুন তো সবকিছু।’
ফারজাদ খুলে বলল সবটা। একদম শুরু থেকে এই অবধি। সব শুনে অফিসার বললেন,
‘আচ্ছা, আপনিই সেই মেয়ে? আপনাকে নিয়েই তো প্রতিটা থানায় কথা হচ্ছে। প্রতিটা থানায় হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে, ঐ নারী চক্রকে খুঁজে বের করার জন্য। আপনি তো ভীষণ সাহসী, তবে এমন একটা কাজ করলেন কেন?’
প্রিয়তা আর জবাব দিল না। অন্যদিকে ঘুরে চোখ বুজল। অফিসার বুঝলেন তার মানসিক অবস্থাটা। তিনি ফারজাদের দিকে চেয়ে বললেন,
‘উনার বাড়ির লোকদের এখানে আনার ব্যবস্থা করুন, নয়তো উনি নিজেকে এই ট্রমা থেকে বের করতে পারবেন না।’
‘জি, আমি চেষ্টা করব।’
অফিসার আর নতুন কোনো কেইস লিখলেন না। চলে গেলেন। ফারজাদ কেবিনেই দাঁড়ান। জ্ঞানহীন প্রিয়তার সামনে অনেক কিছু বলে ফেললেও এখন সে নীরব, নির্বাক। মুখ থেকে রা আসছে না কোনো। প্রিয়তাকেএখন একবার “দুঃখিত” বলতে পারলে মনে শান্তি পেত ভীষণ। কিন্তু তা না করে উল্টো ক্ষুব্ধ হয়ে সে বলল,
‘এতটা বাড়াবাড়ি না করলেও পারতেন। আজ যদি আপনার কিছু একটা হয়ে যেত, তবে আজীবন আমাদের কেবল থানা পুলিশ করেই পার করতে হতো। কিছু করার আগে ভেবে করেন না বলেই আজ আপনার এই অবস্থা। আর কবে শিক্ষা হবে আপনার? আর কত ভুলের পর?’
চলবে…..
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/