অলিখিত_অধ্যায় #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ১৯।

0
648

#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৯।

ফারজাদের চওড়া গলার স্বরে প্রিয়তার চোখ ভিজে ওঠল।মেয়েটা কথায় কথায় এত কাঁদে কেন কে জানে। ফারজাদ নিজেকে ধাতস্ত করে। সে চায় একটা আর করে একটা। সে এখনই উঁচু গলায় কথা বলতে চাইনি, কিন্তু বলে ফেলেছে।
প্রিয়তা মৃদু ভেজা স্বরে বলল,

‘আমাকে কেন বাঁচালেন? আমি ম রে গেলেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত।’

ফারজাদ বিরক্ত চোখে চাইল। প্রিয়তার কাছে এগিয়ে এসে বেডের পাশের চেয়ারটাতে বসল সে। শান্ত গলায় বলল,

‘ম রে গেলে কী করে সমাধান হতো, বলুন তো? এত অবুঝের মতো কাজ করেন কেন? আপনার কিছু হলে আপনার পরিবারের কী হতো, এই চিন্তাটা একবারও মাথায় আসল না? আগেও একবার ভুলে করেছেন, আজ আবার। এত ভুল করলে কী করে হবে?’

প্রিয়তা ঢোক গিলল। গলাটা যেন কেমন শুকিয়ে এসেছে। সে বিনয়ের সুরে বলল,

‘একটু পানি দিবেন।’

ফারজাদ উঠে আশেপাশে চেয়ে দেখল পানির কোনো ব্যবস্থা নেই। সে বলল,

‘একটু অপেক্ষা করুন, আমি ক্যান্টিন থেকে কিনে আনছি।’

ফারজাদ পানি আনতে গেল। প্রিয়তা নিরেট শূণ্য অক্ষি মেলে চেয়ে রইল তার ব্যান্ডেজ করা হাতের দিকে। নিজেকে আঘাত করার কথা আগে কল্পনাতেও আনত না কখনো। অথচ আজ এমন এক ভয়ানক কাজ করে বসেছে সে। নিজের ভুলের জন্যই আজ তার এই দশা। নিজের উপর যে ঘৃণা জন্মেছে, সেই ঘৃণা মোটেও এত সহজে তার পিছু ছাড়বে না। তাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্ম করে দিয়ে তবেই ক্ষান্ত হবে।

রিসিপশনে বসে থাকা লোকটা মাথা তুলে চাইল। সামনে দাঁড়ানো নার্স দুজনের কথাবার্তা শুনতে কান খাঁড়া করল সে। তার পাশেই বোরকা পরা এক মহিলা, কোলে তার পাঁচ বছরের ছেলে। ছেলেটার হঠাৎই শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ায় ইমারজেন্সি ডাক্তার দেখাতে এসেছে। ডাক্তার দেখানো শেষ। ডাক্তার তাকে ইনজেকশন দিয়েছেন। ছেলেটা কেঁদেছে অনেক। এই তো মিনিট দুয়েক আগে কান্না থেমেছে তার। এরই মাঝে লোকটি উঠে দাঁড়াল। পাশের বোরকা পরিহিতা মহিলাটিকে বলল,

‘তুমি বসো, আমি ফোনে একটু জরুরি কথা বলে আসছি।'(উর্দু)

লোকটি উঠে এক পার্শ্বে যায়। ফোন লাগায় কোনো এক নাম্বারে। জনৈক ব্যক্তি ফোন তুলে বলে,

‘কিরে, এত রাতে কল দিলি যে?'(উর্দু)

‘ভাই, ঐ মেয়েটার নাম প্রিয়তা ছিল না?'(উর্দু)

ওপাশের ব্যক্তিটি ততক্ষণাৎ লাফিয়ে উঠে বসে। বলে,

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, কোনো খোঁজ পেয়েছিস?'(উর্দু)

‘মনে হয় পেয়ে গিয়েছি, ভাই। আপনি একবার এক্ষুনি আগা খান বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চলে আসেন।'(উর্দু)

‘আচ্ছা, আসছি আমি।'(উর্দু)

কল কেটে লোকটি তার পূর্বের জায়গায় ফিরে আসে। মহিলাটিকে বলে,

‘চলো, তোমায় বাসায় দিয়ে আসি।'(উর্দু)

‘আপনি কি অন্য কোথায় যাবেন আবার?'(উর্দু)

‘হ্যাঁ, জরুরি কাজ আছে একটা।'(উর্দু)

মহিলাটি নিকাবের নিচ দিয়েও ঘৃণ্য চোখে চাইল। তার স্বামীর জরুরি কাজ সম্পর্কে বেশ ভালো ভাবেই অবগত সে। তাই আর কথা বাড়াল না। গম্ভীর স্বরে বলল,

‘চলুন।'(উর্দু)

ফারজাদ কেবিনে প্রবেশ করে। প্রিয়তার চোখ বোজা, ঘুমে বোধ হয়। সে আস্তে করে একবার ডাকল,

‘প্রিয়তা।’

প্রিয়তা চাইল। বোতল থেকে পানিটা গ্লাসে নিয়ে তার দিকে এগিয়ে দিল ফারজাদ। প্রিয়তার এক হাতে স্যালাইন, অন্যহাতে শক্তি পাচ্ছে না পানির গ্লাস ধরার মতো। সে কোনোরকমে উঠে বসে। ফারজাদ তার অবস্থাটা বুঝতে পেরে বলে,

‘আপনাকে কষ্ট করতে হবে না, আমি খাইয়ে দিচ্ছি।’

ফারজাদ পানির গ্লাসটা প্রিয়তার মুখ বরাবর ধরে। প্রিয়তা পানিটুকু পান করে শান্তি পায় যেন। ফারজাদের দিকে চেয়ে বলে,

‘ধন্যবাদ।’

‘ঠিক আছে, শুয়ে পড়ুন এবার।’

প্রিয়তা শু’ল না। মিইয়ে যাওয়া সুরে বলল,

‘স্যরি। আমি আপনাদের ভীষণ সমস্যায় ফেলে দিয়েছি তাই না? ভাইয়া আসলেই আমি চলে যাব। আর কয়টা দিন একটু আমাকে সহ্য করে নিন।’

ফারজাদ তার এই কথার বিপরীতে আর জবাব দিল না কোনো। কেবিনের একপাশে রাখা সোফাতে গা এলিয়ে বসে ফোনটা বের করল। প্রিয়তা তার দিকে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। হয়তো উত্তরের আশায়, নয়তো এমনি। কিছুক্ষণের মাঝে ঘুম আসলে ঘুমিয়ে পড়ে ওভাবেই।

ফোনটা সাইডে রেখে ওঠে দাঁড়ায় ফারজাদ। প্রিয়তা হেলান দিয়েই ঘাড় কাত করে ঘুমিয়ে আছে। সে এগিয়ে যায়, প্রিয়তাকে স্পর্শ করতে নিয়েও হাত ফিরিয়ে আনে। কেবিনের বাইরে গিয়ে নার্সের খোঁজ করে সে। কিন্তু এইদিকে কাউকে দেখতে পায়না। তাই হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা সামনে যায়।

‘এই কেবিনটার কথা’ই বলেছিল, তাই না?'(উর্দু)

‘জি, ভাই।'(উর্দু)

অজ্ঞাত লোকটা এগিয়ে এসে কেবিনের ভেতরে উঁকি দেয়। শয্যায় শায়িত মেয়েটাকে দেখে চোখ চকমক করে উঠে যেন। অস্থির গলায় বলে,

‘পেয়ে গিয়েছি, পেয়ে গিয়েছি।'(উর্দু)

আচমকা কারোর গলার স্বরে চমকে তাকায় প্রিয়তা। চোখের সামনে দৃশ্যমান মুখটা দেখে সারা শরীরে ঝাঁকুনি দেয় যেন। বক্ষঃস্থলের কম্পন তীব্র হয়। শরীর অবশ হয়ে আসে। ছেলেটা তার দিকে চেয়ে ক্রূর হেসে বলে,

‘এখন আর কোথায় পালাবে, সুইটহার্ট? অনেক ঘুরিয়েছ আমায়। তোমাকে পাগলের মতো খুঁজে বেরিয়েছি। অবশেষে পেলাম। এবার আর হাতছাড়া করব না, কোনো মতেই না।'(উর্দু)

প্রিয়তা আদ্যোপান্ত না ভেবেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে। প্রথমেই উচ্চারণ করে “ফারজাদের” নাম।

‘ফারজাদ, ফারজাদ, কোথায় আপনি? ফারজাদ?’

তার চিৎকার শুনে লোক দুটি গায়েব হয়ে যায় ততক্ষণাৎ। হন্তদন্ত হয়ে কেবিনে প্রবেশ করে ফারজাদ। প্রিয়তার আচমকা এত বেশি অস্থিরতা দেখে সে ঘাবড়ে যায়। এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,

‘কী হয়েছে, আপনি চিৎকার করছিলেন কেন?’

প্রিয়তা বড়ো বড়ো শ্বাস নেয়। দরজার দিকে আঙ্গুল তাক করে ভীত সুরে বলে,

‘ওয়াদি, ওয়াদি এসেছিল। ও আবার আমাকে নিতে এসেছে। আবার আমাকে বিক্রি করে দিবে। আমি যাব না ওর সাথে। আমি যাব না।’

প্রিয়তা ভয়ে হাঁসফাঁস করছে। ফারজাদ তার কথা শুনে অবাক। এখানে ওয়াদি আসবে কোথ থেকে। সে নরম সুরে বলে,

‘আপনি হয়তো ভুল দেখেছেন, প্রিয়তা। এখানে কী করে ওয়াদি আসবে?’

‘না না, এসেছিল। এই যে মাত্রই চলে গিয়েছে। আমি নিজের চোখে দেখেছি, নিজের কানে শুনেছি ওর কন্ঠস্বর; বিশ্বাস করুন।’

ফারজাদ চেয়েও বিশ্বাস করতে পারছে না যেন। প্রিয়তার খোঁজ ওয়াদি পাবে কোথায়? এত বড়ো একটা শহরে কাউকে এভাবে খুঁজে বের করা যায় না-কি? মেয়েটা নিশ্চয়ই মানসিক চাপে পড়ে এসব বলছে।

সে নার্সকে বলে,

‘উনাকে কি কোনোভাবে শান্ত করানো যায় না? এমন করলে তো আরো অসুস্থ হয়ে পড়বেন।'(উর্দু)

‘জি, আমি উনাকে ইনজেকশন দিয়ে দিচ্ছি। পরিপূর্ণ ঘুম হলে ঠিক হয়ে যাবেন।'(উর্দু)

প্রিয়তা বিচলিত হয়ে বলল,

‘আরে আপনারা বুঝতে চাইছেন না কেন, আমি ভুল বলছি না। সত্যি ওয়াদি এসেছিল। বিশ্বাস করুন, ও আমাকে হুমকি দিয়ে গিয়েছে। আমি অসুস্থ বলে এসব উল্টা পাল্টা কথা বলছি, ব্যাপারটা মোটেও এমন নয়। এটা সত্যি, বিশ্বাস করুন।’

ফারজাদ তার পাশের চেয়ারে বসল। বলল,

‘জি, করলাম বিশ্বাস। আমি পুলিশের সাথে কথা বলব। উনারা আপনার সুরক্ষার ব্যবস্থা করবেন। আপনি আগে কিছু দিন একটু বিশ্রাম নিন।’

প্রিয়তার অস্থিরতা কমল না। এই তো কয়দিন আগেও যেই মানুষটার মুখ দেখে মন সবথেকে খুশী হতো, মনে শান্তি পেত, আজ তাকে দেখেই অশান্তিতে ভুগছে সে, ভয় পাচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে। কী নিদারুণ গতিতে সবকিছু পাল্টে গিয়েছে! কী নিদারুণ গতিতে বদলে গিয়েছে মানুষটা! তার এখন আফসোস হয়, নিজের উপর আফসোস হয়, এটা ভেবে যে, সে কত বোকা!

নার্স ইনজেকশন তৈরি করার আগেই প্রিয়তা বলল,

‘ইনজেকশন লাগবে না, আমি এমনিই ঘুমিয়ে যাব।’

নার্স ইনজেকশন রেখে দিয়ে বলল,

‘ঠিক আছে। ঘুমিয়ে পড়ুন তাহলে।’

প্রিয়তা শোয়ার চেষ্টা করল। তবে সেলাইয়ের জায়গা আর স্যালাইনে টান পড়ল যেন। ফারজাদ এগিয়ে এসেও থেমে নার্সকে বলল,

‘উনাকে সাহায্য করুন।’

নার্স প্রিয়তাকে শুইয়ে দিয়ে সবকিছু ভালো মতো দেখে নিয়ে বেরিয়ে যায়। ফারজাদ আর প্রিয়তা একাই কেবিনে। প্রিয়তার চোখের পাতা নিমীলিত। ফারজাদ সোফায় গিয়ে বসল। চোখ বন্ধ থাকলেও সে জানে, মেয়েটা ঘুমাচ্ছে না। ফারজাদ ভেবেই নিল, প্রিয়তার বলা সবটা কথা তার মনের ভুল ছাড়া আর কিছুই না; কিন্তু তার অবচেতন মন পরক্ষণেই যুক্তি দাঁড় করিয়ে বলল,

‘যদি তার বলা কথা সত্যি হয়? যদি সত্যি সত্যিই ওয়াদি এসে থাকে, তবে কী হবে মেয়েটার?’

চলবে….
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here