#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২১।
ফারজাদ প্রিয়তার কাছে গেল। বলল,
‘শুনুন, আমার বসের মেয়ে হাসপাতালে আসছেন। আমি উনাকে আপনার ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানাইনি। শুধু বলেছি অসুস্থ, তাই হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। আপনিও উনার সামনে স্বাভাবিক থাকবেন। যদিও আপনার ব্যান্ডেজ করা হাত’ই অনেক কিছু বলে দিবে, তাও আপনাকে নিজ থেকে কিছু বলার দরকার নেই। যা বলার আমিই বলব।’
প্রিয়তা মাথা হেলিয়ে বলল,
‘আচ্ছা।’
__________
ধা’রালো ছু’ড়িটা পেটের পাশে পেন্টে গুঁজে হাসপাতাল অবধি চলে এল লোকটা। ওয়াদিকে খুঁজে বের করল। তার কাছে গিয়ে বলল,
‘ভাই, নিয়ে এসেছি।’
ওয়াদির চোখ মুখ শক্ত। কপালের চামড়া কুঁচকানো। সে বলল,
‘কী এনেছিস, দেখি।’
‘এখানেই বের করব?’
সতর্ক দৃষ্টিতে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে ওয়াদি বলল,
‘বের কর, এইদিকে কেউ নেই।’
লোকটা বের করল অস্ত্রটা। ওয়াদি বৃদ্ধা আঙ্গুল ঘষে দেখল, ধার ঠিক আছে কিনা। যথেষ্ঠ ধারালো বুঝতে পেরে সে ক্ষিপ্ত সুরে বলে উঠল,
‘এই ছু’ড়ি আজকে ঐ হারাম’জাদার পেট চিরে বের করব।’
ওয়াদির চোখের অগ্নি শিখা জ্বলজ্বল করছে। প্রচন্ড ক্ষোভে কাঁপছে সে। ফারজাদের বলা কথা কোনোভাবেই সে হজম করতে পারছে না। সে ছু’ড়িটা যত্ন করে তার পেটের কাছ’টাই গুঁজল। তারপর আবার হাঁটা ধরল প্রিয়তার কেবিনের দিকে।
কিছুটা দূরত্বে আঁড়াল হয়ে দাঁড়াল সে। ঠিক সময়ে হামলা করবে।
এর মাঝেই ফারজাদের কল আসে। জারা কল দিচ্ছে। তার অফিসটা হাসপাতাল থেকে কাছে খুব। জারা কি তবে অফিস থেকেই এসেছে? সে কল রিসিভ করতেই জারা জিজ্ঞেস করল,
‘কত তলায় আছেন, আর কেবিন নাম্বার কত?’
ফারজাদ সৌজন্যতার খাতিরে বলল,
‘আপনি দাঁড়ান, ম্যাম। আমি আসছি।’
নার্সকে কেবিনে রেখে ফারজাদ বেরিয়ে গেল। ফারজাদকে কেবিন থেকে বের হতে দেখে ওয়াদি এগিয়ে যেতে নিয়েও আবার কী ভেবে যেন থেমে যায়। ফারজাদ চলে যায় অনেকটাই দূরে। ওয়াদি তার লোককে ইশারা দেয়। দুজনেই চট করে ঢুকে পড়ে কেবিনে। ফের আচমকা ওয়াদিকে দেখে চেঁচিয়ে উঠে প্রিয়তা। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে তার। নার্স ব্যাপারটা বুঝে উঠার আগেই ওয়াদির সাথের লোকটা তাকে ধরে দেয়ালের সাথে আঘাত করে। মাথায় ভীষণ আঘাত পাওয়ায় জ্ঞান হারিয়ে বসে সে। প্রিয়তা বিচলিত হয়ে উঠে। কী করবে বুঝতে পারে না। ওয়াদি গিয়ে এক টানে তার স্যালাইনটা খুলে দেয়। প্রিয়তার হাত চেপে টেনে বেড থেমে নামায়। তাকে সবটুকু শক্তি দিয়ে আটকানোর চেষ্টা চালাচ্ছে প্রিয়তা। কিন্তু, পারছে কই? সে ব্যর্থ। ওয়াদি দু হাতে চেপে ধরে তাকে। এমনিতেই শরীরের অবস্থা তার ভালো নেই। ওয়াদির সাথে লড়ার মতো এইটুকুও শক্তি নেই গায়ে। সে গলা ফাটিয়ে ফারজাদকে ডাকে। কিন্তু, অতদূর অবধি কি আর তার স্বর পৌঁছাবে? ওয়াদি ক্ষেপে যায়। প্রিয়তার চুলের মুঠি ধরে বলে,
‘চুপ, একদম চুপ। সারাদিন শুধু ফারজাদ আর ফারজাদ। নতুন নাগর পেয়ে আমাকে ভুলে গেলি? এই তোর ভালোবাসা?’
মাথায় ব্যথা পাচ্ছে ভীষণ প্রিয়তা। ওয়াদির হাত থেকে চুল ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,
‘ভালোবাসার কথা বলতে তোমার লজ্জা করছে না? এত জঘন্য একটা মানুষ কী করে হতে পারে? অবশ্য আমি মানুষ বলছি কাকে? তুমি তো মানুষের কাতারেই পড়ো না, তুমি হলে গিয়ে জানো’য়ার।’
ওয়াদির রাগ আকাশ ছুঁলো যেন। একবার এই মেয়েকে হাসপাতাল থেকে বের করে নেক, তারপর এর বিষ দাঁত ভাঙবে সে। সে তার লোকের দিকে চেয়ে বলল,
‘ইনজেকশনটা দে দ্রুত।’
ইনজেকশনের কথা শুনে আরো বেশি ঘাবড়ে গেল প্রিয়তা। এবার ছটফটের মাত্রা বাড়ল তার। নিজেকে ছাড়ানোর সবটুকু চেষ্টা জারি রাখল। কিন্তু অত বিশাল দেহী পুরুষের সাথে কি এই দূর্বল, নির্জীব, ছোট্ট প্রাণটার পেরে উঠা আদৌ সম্ভব!
ওয়াদি প্রস্তুতি নিল ইনজেকশন দেওয়ার। প্রিয়তা উপায়ান্তর না পেয়ে তার মাথা দিয়ে পেছন দিকে সজোরে আঘাত করল। আঘাতটা কাজে দিয়েছে। ওয়াদির নাক বরাবর গিয়ে লাগে সেটা। অকস্মাৎ আঘাতের তাল সামলাতে না পেরে পিছিয়ে যায় সে। প্রিয়তা ছাড়া পায়। দ্রুত ছুট লাগায় দরজার দিকে। ওয়াদির লোকটা প্রিয়তাকে ধরার কথা না ভেবে উল্টো ছুটে আসে ওয়াদির দিকে। ওয়াদি গর্জে উঠে বলে,
‘শা’লা, আগে ওকে ধর।’
লোকটার টনক নড়তেই দরজার দিকে দৌড় লাগায়। ততক্ষণে প্রিয়তা অনেকটাই দূরে চলে এসেছে। এইদিকে মানুষ অনেক। এখান থেকে কেউ এসে তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে পারবে না নিশ্চয়। সে সবার মাঝখানে ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল। শরীরে আর এক বিন্দু শক্তি অবশিষ্ট নেই দাঁড়িয়ে থাকার মতো। ভিড় জমে গেল সেখানে। নার্স একজন ছুটে এসে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে তাকে। এরই মাঝে লিফট থেকে নামল ফারজাদ আর জারা। ঠিক তাদের সামনেই কোলাহল। জারা ভ্র কুঁচকে বলল,
‘ঐখানে কী হচ্ছে, এত মানুষ যে?’
ফারজাদ একপলক চেয়ে বলল,
‘হয়তো কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছে।’
তারা এগুতে থাকল। জারার হাতে বিশাল এক ফুলের তোড়া। ফারজাদের হাতে ফলের ব্যাগ। সবকিছু জারা’ই কিনেছে।
এত ভিড়ের মাঝেও প্রিয়তা দেখতে পারল ফারজাদকে।
ফারজাদকে দেখা মাত্রই দম ফেলল সে। রুদ্ধশ্বাস কন্ঠে ডাকল,
‘ফারজাদ।’
ফারজাদের কান অবধি গেল না তা। সে গলার স্বর বাড়াল। ডাকল ফের,
‘ফারজাদ।’
এবার ফারজাদ থামল। পেছন ফিরে চাইল সে। মানুষের ফাঁক দিয়েও স্পষ্ট সে দেখল প্রিয়তাকে। প্রিয়তাকে ওভাবে দেখে সে ঘাবড়াল। ছুটে এল। মানুষজন সাইড হয়ে দাঁড়াল। হাঁটু ভেঙে বসল ফারজাদ। উদ্বিগ্ন সুরে জিজ্ঞেস করল,
‘কী হলো, প্রিয়তা? আপনি এখানে এভাবে কেন বসে আছেন?’
প্রিয়তা কম্পিত সুরে বলল,
‘ও-ওয়াদি।’
এইটুকু বলেই জ্ঞান হারাল সে। ফারজাদের অস্থিরতা বেড়ে গেল। এইটুকু সময়ের মাঝে কী হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারছে না সে। নার্স বললেন,
‘উনার কেবিন কোনটা? উনাকে এক্ষুনি কেবিনে নিতে হবে। শরীরের অবস্থা ভালো নয়।’
ফারজাদ হাতের ব্যাগ নিচে রেখে অতশত না ভেবেই কোলে তুলে নিল প্রিয়তাকে। জারা বিস্মিত হলো। প্রথমেই মনে মনে আওড়াল, “মেয়েটা কে?”
প্রিয়তাকে কোলে নিয়ে কেবিনের দিকে গেল ফারজাদ। কেবিনে প্রবেশ করতেই আরেকদফা চমকাল সে। নার্সকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে হতভম্ব হয়ে যায়। মেঝেতে র ক্তের দাগ। ফারজাদ ঢোক গিলল। দ্রুত প্রিয়তাকে বেডে শুইয়ে দেয়। ততক্ষণে পুরো হৈ চৈ লেগে গিয়েছে। ডাক্তারসহ বাকি নার্স সবাই প্রিয়তার কেবিনে হাজির। ঘটনার কোনো আদ্যোপান্ত বুঝতে না পেরে সকলেই নির্বাক। একজন ডাক্তার গিয়ে আহত নার্সকে ড্রেসিং করে দিলেন। সেখানের সিনিয়র ডাক্তার ফারজাদকে এসে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কী হয়েছে এখানে?’
ফারজাদ নিজেও হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে আছে। সে ক্ষীণ সুরে বলল,
‘আমিও নিজেও কিছু বুঝতে পারছি না, ডক্টর। আমি নিচে গিয়েছিলাম, এই কয়েক মিনিটের ভেতর এত কিছু কী করে হয়ে গেল!’
ডাক্তার আর বিলম্ব না করে পুলিশকে কল করে আসতে বললেন। অন্যদিকে প্রিয়তাকে পুনরায় স্যালাইন দেওয়া হলো। তার জ্ঞান ফেরেনি এখনো। কাল থেকে পাওয়া একের পর এক আতঙ্কে মেয়েটা এখন নির্জীব, নিস্তেজ হয়ে পড়েছে।
ফারজাদ জারার কাছে গেল। নরম গলায় বলল,
‘আমি দুঃখিত, ম্যাম। আমার জন্য আপনিও ভীষণ বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গিয়েছেন।’
জারা তাকে আশ্বস্ত করে বলল,
‘না না, ফারজাদ। আমি বিব্রতবোধ করছি না, তবে এখানের ঘটনাগুলো ভীত করেছে আমায়। কী হয়েছে আমাকে বলবেন?’
‘বলব। ঝামেলাগুলো মিটে যাক, আমি সব বলব আপনাকে। এখন আপনি চলুন ম্যাম, আমি আপনাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিচ্ছি।’
জারা থাকতে চাইলেও ফারজাদের অস্বস্তিটা বুঝতে পেরে বলল,
‘আপনি এখানেই থাকুন, ফারজাদ। আমি একা চলে যেতে পারব। আর অবশ্যই, কোনোপ্রকার সাহায্য লাগলে আমাকে জানাবেন। কোনোপ্রকার দ্বিধা করবেন না।’
ফারজাদ নিশ্বাস ফেলল। বলল,
‘জি, অবশ্যই।’
জারা বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে। তার কিছুক্ষণ পরেই পুলিশ আসে।
চলবে….