#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২২।
প্রিয়তার জ্ঞান ফিরেছে। তবে সে নিশ্চল, নির্বাক হয়ে চেয়ে আছে কেবল। মুখে রা নেই কোনো। মাথাটা চিনচিন করছে এখনো। তার কেবিন জুড়ে ডাক্তার নার্সসহ হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ লোকদের আনাগোনা। পুলিশও এসেছেন। সবাই উদগ্রীব হয়ে বসে আছে প্রিয়তার মুখের বুলির জন্য। অথচ মেয়েটা কথা বলছে না। হয়তো সে এখনো সেই আতঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না, নয়তো ভয়, চিন্তা আর অস্থিরতায় সে শব্দ হারিয়েছে সব।
অফিসার ডাক্তারের দিকে চেয়ে বললেন,
‘উনার ঠিক হতে কতক্ষণ লাগবে?’
ডাক্তার বললেন,
‘উনি এখন একটা ট্রমার মধ্যে আছেন, প্রচন্ড ভয়ে আছেন। আশা করছি কিছু সময়ের মধ্যেই স্বাভাবিক হয়ে উঠবেন।’
অফিসার সেই কিছু সময় অপেক্ষা করলেন। ফারজাদ প্রিয়তার পাশে বসে আছে। তাকে আশ্বস্ত করছে, সাহস দিচ্ছে। এভাবেই প্রায় ঘন্টা খানিক বাদে প্রিয়তা কিছুটা স্বাভাবিক হয়। সে স্বাভাবিক হতেই ঢুকরে কেঁদে ওঠে।
সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে চেয়ে আছে তার দিকে। ফারজাদ আলতো করে হাত রাখে প্রিয়তার মাথার উপর। নরম সুরে বলে,
‘কাঁদবেন না, নয়তো আরো অসুস্থ হয়ে পড়বেন।’
প্রিয়তা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে তাকায় ফারজাদের দিকে। তার ক্লান্ত, নিস্তেজ, ফ্যাকাশে মুখটা দেখে ফারজাদের মায়া হয় বড্ড। প্রিয়তা জোরে নিশ্বাস নেয়। ভেজা স্বরে বলে,
‘আমি ওয়াদিকে জঘন্য বলেছিলাম, কিন্তু সত্যিকার অর্থে জঘন্য তো আমি। এই আমার জন্য আজ এত কিছু হয়েছে। আমার জেদের জন্য, আমার ইচ্ছের জন্য, আমার ভালোবাসার জন্য। না আজ আমি দেশ ছেড়ে এখানে আসতাম, আর না আজ এত কিছু হতো। আমার জন্য আপনাদেরও এত কষ্ট। সব দোষ আমার। বিশ্বাস করুন, আমার ম রে যেতে ইচ্ছে করছে। নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে প্রচন্ড। আমার জন্য একটা অসহায় মানুষ আজ এতটা আঘাত প্রাপ্ত। আমার জন্য আজ এই হাসপাতালের পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। সব দোষ আমার। আমার আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না, একটুও না।’
প্রিয়তা শব্দ করে কাঁদতে থাকে। তাকে কেউ থামায় না। সবাই চেয়ে দেখছে কেবল। অনেকক্ষণ কাঁদে প্রিয়তা। তারপর ক্লান্ত হয়ে নিজে নিজেই থেমে যায়। ফারজাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে,
‘কী হয়েছিল, প্রিয়তা?’
কাঁদতে কাঁদতে প্রিয়তার চোখ ফুলে গিয়েছে ভীষণ ভাবে। তার যেন এখন তাকিয়ে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে। কেমন যেন চোখ জোড়া জ্বলছেও। সে ঢোক গিলে। ক্ষীণ সুরে বলে,
‘ওয়াদি আবার এসেছিল। নার্সকে আঘাত করে আমাকে তার সাথে নিতে চাইছিল। আমি কোনোরকমে পালিয়ে বাইরে গিয়েছি।’
প্রিয়তা থামে। সে বড়ো বড়ো করে নিশ্বাস ফেলছে। ফারজাদ চিন্তিত সুরে জিজ্ঞেস করে,
‘আপনার কি শ্বাস কষ্ট হচ্ছে, প্রিয়তা?’
প্রিয়তা জবাব দেয় না কোনো। কেবল শ্বাস ফেলছে বড়ো বড়ো। ডাক্তার এগিয়ে আসেন। প্রিয়তার পালস্ চেক করেন। নার্সকে ডেকে বলেন, দ্রুত অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা করতে।
প্রিয়তাকে জরুরি ভাবে অক্সিজেন দেওয়া হলো। ফারজাদ চেয়ে রইল নিষ্পলক। মেয়েটা কী দারুণ যন্ত্রণায় ছটফট করছে। ভালোবাসা যে কী ভয়ানক যন্ত্রণাদায়ক, আজ তার আরো একটা প্রমাণ দেখল সে।
বিকেল থেকে দিলরুবা বেগম কল করছেন ক্রমাগত। ফারজাদ এখনই কিছু মা’কে জানাতে চাইছে না। তাই ফোন রিসিভ করে বলেছে, আজকের রাতটাও হাসপাতালেই কাটাতে হবে। দিলরুবা বেগম খুব করে বলছিলেন, তিনি আসবেন। কিন্তু, ফারজাদের এক কথা, আসা যাবে না। এখানে আসলে তিনি অযথাই দুশ্চিন্তায় ভুগবেন, তাই ফারজাদের কড়া নিষেধ, তিনি কোনোভাবেই হাসপাতালে আসতে পারবেন না।
দুপুরে কারোর খাওয়া হলো না।
সন্ধ্যার পর এখন কিছুটা সুস্থ প্রিয়তা। নার্স তাকে স্যুপ দিয়েছে, খাওয়ার জন্য। প্রিয়তা দু চামচ খেয়ে ফারজাদের দিকে চাইল। ফারজাদ সোফায় বসা। তাকেও এলোমেলো লাগছে খুব। প্রিয়তা মৃদু সুরে জিজ্ঞেস করল,
‘আপনি এখনো খাননি, তাই না?’
ফারজাদ চেয়ে বলল,
‘খাব আমি, আপনি আগে খেয়ে নিন।’
প্রিয়তা অসহায় সুরে বলল,
‘আমার জন্য আপনাকে অযথা এত কষ্ট করতে হচ্ছে। আমাকে ক্ষমা করবেন।’
‘এসব কথা থাক এখন প্রিয়তা, স্যুপটা শেষ করুন আগে।’
প্রিয়তার খাওয়ার মাঝেই কেবিনে পুলিশ অফিসার এলেন। উনারা এতক্ষণ সিসিটিভি কন্ট্রোল রুমে ছিলেন। সেখানেই কালকে রাত থেকে সমস্ত ফুটেজ দেখেছেন উনারা। অফিসার বললেন,
‘উনার কথা মিথ্যে নয়, ওয়াদি নামের লোকটা এসেছিল; এবং তার কাছে খুব ধারালো একটা অস্ত্রও ছিল। তবে সে একা ছিল না, আরো একজন ছিল তার সাথে। যে তাকে কাল রাত থেকে এসব কাজে সাহায্য করে এসেছে। আমরা সমস্ত ফুটেজ দেখে এসেছি, আপাতত দুজন পেছনের গেইট দিয়ে পালিয়েছে। তবে আমার মনে তারা আবার আসবে। প্রিয়তাকে তাদের প্রয়োজন। উনাকে নেওয়ার জন্য হলেও তারা আবার নিশ্চয় আসবে।’
অফিসারের কথা শুনে ভয় পায় প্রিয়তা। বাকি স্যুপটুকু আর খেতে পারে না। অফিসার বলেন,
‘আমাদের আজকের রাতটা সতর্ক থাকতে হবে, কৌশলে থাকতে হবে। একবার ঐ ওয়াদিকে ধরতে পারলেই এই নারী চক্রের পুরো গ্যাং’টা আমার হাতের মুঠোয় চলে আসবে।’
প্রিয়তা বলল,
‘আর ওয়াদি যদি কোনোভাবে আমাকে এখান থেকে নিয়ে যায়?’
‘না, পারবে না। আমার লোক আছে আশেপাশে। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।’
ফারজাদ কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো। তার সাথে অনুতপ্ত হলো এই ভেবে যে, কাল সে প্রিয়তার কথা বিশ্বাস করতে চায়নি। কাল যদি তাকে বিশ্বাস করে আরেকটু সতর্ক থাকত, তাহলে আজ হয়তো আর এমন কিছু হতো না।
পুলিশ সহ হাসপাতালের কর্তৃপক্ষও আজ বেশ সতর্ক। এই ব্যাপারটা সন্তর্পনে চেপে রেখেছেন তারা। হাসপাতালের বাইরে গেলেই মিডিয়া এসে হাজির হবে নিশ্চিত। আর হাসপাতালে মিডিয়া আসা মানেই হাসপাতালের নাম খারাপ হওয়া। বাইরের যেই কয়জন ব্যাপারটা দেখেছেন, তাদের কোনোরকমে বোঝ দিয়ে ব্যাপারটাকে সেখানেই সমাধান করে ফেলেছেন।
প্রিয়তা ফারজাদের দিকে চেয়ে আছে। ফারজাদ কথা বলছে ফোনে। দিলরুবা বেগম কল করছেন কিছুক্ষণ পরপর। রাতের খাবার নিয়ে আসতে চাইছেন তিনি। কিন্তু, ফারজাদ রাজি না কোনোমতেই। প্রিয়তার নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হলো। তার জন্য এই সহজ সরল, ঝামেলা বিহীন মানুষগুলোকেও আজ কত ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে। নিজেকে সে কখনোই ক্ষমা করতে পারবে না হয়তো। তার একটা ছোট্ট ভুলের জন্যই আজ এতকিছু।
ঘড়িতে সাতটা বেজে ত্রিশ। ফারজাদের দুপুরের খাওয়া হয়নি এখনো। প্রিয়তাকে কেবিনে রেখে সে এখন কোনোভাবেই আর নিচে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। যদিও এখন কেবিনের বাইরে দুজন পুলিশ আছেন, তাও ঠিক সাহস করে উঠতে পারছে না সে।
ওয়াশরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে বেরিয়ে আসে ফারজাদ। প্রিয়তা ডেকে বলে,
‘টেবিলে খাবার আছে, খেয়ে নিন।’
ফারজাদ সোফার সাথে লাগানো টেবিলে চাইল। খাবারের প্যাকেট দেখে অবাক হলো সে। জিজ্ঞেস করল,
‘এগুলো কে এনেছে?’
‘বাইরের একজন পুলিশকে দিয়ে আমি আনিয়েছি। আপনি তো যাচ্ছেন না খেতে, তাই। খেয়ে নিন। আর আমি না খাবারের টাকাটা দিতে পারিনি, আসলে ..’
ফারজাদ বলল,
‘আমি দিয়ে দিব। কিন্তু, আপনাকে এসব করতে কে বলেছে। অযথা আমাকে নিয়ে ভেবে নিজের দুশ্চিন্তা আর বাড়াবেন না।’
‘আপনিও তো আমাকে নিয়ে ভাবছেন। আমার জন্য সেই দুপুর থেকে না খাওয়া, আমার অপরাধবোধ কাজ করছে ভীষণ।’
‘এখানে অপরাধবোধের কিছু নেই, প্রিয়তা। আর যতদিন পাকিস্তানে আছেন, আপনি আমাদের দায়িত্ব। এই দায়িত্ব আমাদের পালন করতেই হবে।’
প্রিয়তা মাথা নুইয়ে বলল,
‘আচ্ছা, খেয়ে নিন এবার।’
ফারজাদ খেতে বসার আগে ঐ পুলিশকে গিয়ে খাবারের টাকাটা দিয়ে আসল। তারপর বসল খেতে। এক লোকমা খাবার মুখে তুলে উপরে তাকাতেই প্রিয়তার চোখে চোখ পড়ল তার। মেয়েটা তাকিয়ে ছিল এতক্ষণ। ফারজাদের চোখে চোখ পড়তেই চোখে নামিয়ে ফেলে অন্যদিকে তাকায়। ফারজাদ একপল চেয়ে থেকে মনে মনে ভাবে,
“ওয়াদি বড্ড দুর্ভাগা, নয়তো এমন একটা মেয়ের ভালোবাসা কেউ এভাবে অগ্রাহ্য করতে পারে!”
চলবে….
আগের পর্বের লিংক :
https://www.facebook.com/share/p/xTAxQTJeqrFUhyQE/?mibextid=Nif5oz