#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৪১
১২৩.
পরের দিন সকালে পুতুল ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে ঘর ছেড়ে উঠোনে পা রাখতেই মামা,মামীর কথা শুনে দাঁড়িয়ে যায়।মামার কথা মতে কাল মাঝরাতে রমিজ মেম্বার গ্রামে ঢুকতেই মাথায় কালো কাপড় পেচিয়ে কারা যেনো খুব মেরেছে?মারের চোটে তার এক হাত,এক পা ভেঙে গেছে।সুস্থ হতে না-কি দুই,তিন মাস লাগবে।শুধু তাই নয় তার ধানের ঘরে আগুন,এমনকি শুকনো মুজুত খাবার যেগুলো পুরো দুই বছরের অনাহাসে ব্যবহার করে কাটিয়ে দেওয়া যাবে।সেসব খাদ্য নষ্ট হয়েছে।কে করেছে?আর কেনো করেছে জানা চায়নি?এইদিকে দুই বছর খাবার নষ্ট এমনকি ধান আগুনে পোড়ায়।গ্রামে খাদ্য সংকট হবে।বিপদে আজ তাঁরাই পড়েছে।যারা কয়েকদিন আগেই পুতুলকে আগুনে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিলো।সেইসব গ্রামবাসীর ঘরে আজ আহার নেই।গ্রামের লোকের সব রাসায়ন পুড়ে ছাই।কি হবে এখন?এসব শুনে পুতুল হতবাক।রমিজ মেম্বারের সবকিছু সাথে সাথে ওইসব পাঁজি লোকেদের খাবার একসাথে মজুত ছিল।যা আজ পুড়ে ছাই।পুতুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরে চলে যায়।পুরনো ঘা সে ভুলে নিই।তার সবকিছুই মনে আছে।সে তবুও চুপ ছিল।তার স্বপ্নটা একবার পূরণ হোক।তারপর বাকিসব দেখা যাবে।পুতুল নিজে তাদের শাস্তি দিতে চেয়েছে।অথচ আজ না চাইতেও তাদের কষ্ট দেখতে পাচ্ছে।গ্রামের ময়-মুড়োবীদের একটা কথা আছে।পরের জন্য গর্ত খুঁড়লে
সেই গর্তে নিজেরাই পড়ে।আজ তার প্রমাণ পাচ্ছে।এরা পুতুলের জন্য গর্ত খুঁড়ে এখন নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে আনলো।বেশ হয়েছে।যেমন কর্ম তেমন ফল ভোগ করুক।
বাঁশবাগানে মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই। চাঁদ তো তার জাগায়াই আছে
বাঁশগুলো গেল কই?ওই অর্পণ ভাই আপনাদের বাঁশগুলো কই?
অর্পণ ডান দিকে তাকাতেই মিলন,সাজু তার দেখাদেখি ঘুরে তাকিয়ে হা হয়ে গেলো।কাচা কব্জিরবাশগুলো একটাও আস্ত নেই।সবগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে।
কি শালা সাহেব চাঁদ তার জায়গায় ছিল?বাঁশগুলো ঠাঁই রমিজ মেম্বারের শরীরে।এবার ঠিক আছে না!এমন শিক্ষা দিয়েছি না।দ্বিতীয় বার কোনো মেয়ের গায়ে কলঙ্ক দাগ লাগানোর সাহস করবে না।ওর সাহসটা কত বড়।ওহ কার কলিজা হাত দিয়েছে।সেটা আস্তে আস্তে টের পাবে।এটাতো একটু ছোট খাটো নমুনা দেখিয়েছি।পরবর্তী এমন কিছু করলে ওই কু’ত্তার বাচ্চার লা*শ পড়বে।শেষের কথাটুকু বিরবির করে বলায় মিলন,সাজু শুনতে পায় নিই।
অর্পণ নতুন বাটন ফোন কিনে সেটাতে নতুন সিম লাগিয়ে দিয়েছে।
এই ফোনটা রাখ।আগের ফোনটা পুরো নষ্ট হয়ে গেছে।
হুম,ভাইয়া।আসলে আপুর সাথে গ্রামের লোক,আর মেম্বার ওমন করায়,আপনাকে ফোন দিতে বাটন ফোন বের করে হাতে নেই।আর তখন ওতো লোকের ভীরে ফোনটা কখন হাত থেকে ছুটে কার পায়ের নিচে গেছিলো বুঝে উঠতে পারিনি।ফোনটা বেশ কয়েকবার খুঁজেছি।কিন্তু পাওয়া যায় নিই।তার ওপর বোনের সাথে গ্রামের মানুষের ওমন ব্যবহার দেখে কি করব বুঝতে পারছিলাম না।শুধু এতটুকুই মনে ছিল আপনি অবধি পৌছাতে হবে।কারণ আপনি ছাড়া আমাদের বোনকে কেউ অতটা নিরাপত্তা দিতে পারবে না।বাবার গায়ে আঘাত করতেই ভেতরটা কাঁদছিল।কিন্তু ভাই হয়ে আপুর অসম্মান দেখতে পারব না।তাই ভীতুর মতো আপনার কাছে যাই।আজ আমরা বড় হলে হয়তো আমাদের সামনে কেউ আপুর দিকে বাজে আঙুল তুলে দেখতে পারতো না।আপনাকে নিয়ে যখন আমাদের বাসায় ফিরে আসি।তখন কতটা অসহায় হয়ে যাই।মনে হয়েছিলো,আমরা আমাদের আপুকে হারিয়ে ফেলেছি।আর কোনোদিন তাঁকে দেখতে পাবো না।তার মতো করে কেউ আমাদের এত আদর,ভালোবাসবে না।এখনো সেসব ভাবলে খুব কান্না পায়।আপুকে ছাড়া কখনো থাকি নিই।সে চলে গেলে আমরা কি নিয়ে থাকতাম?মিলন,সাজু কথাগুলো বলতে বলতে কাঁদছে।তাদের কান্না করা মুখগুলো কি মিষ্টি?একদম পাকা লাল টমেটোর মতো গাল দু’টো লাল হয়েছে।বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টো করে কাঁদছে।এই দৃশ্যটা অর্পণ তার ফোনে ক্যাপচার করে নিলো।বোনের প্রতি ভাইদের এত টান তাকে অন্য রকম শান্তি দিচ্ছে।অর্পণ দুই শালার চোখের পানি মুছে বুকে টেনে নিলো।
হয়েছে।এবার থামো।আর কান্না নয়।আমার দশটা না পাঁচটা একমাত্ত বউয়ের দুইটা ভাই।তারা যদিও মেয়ে মানুষের মতো কান্না করে।তাহলে ভবিষ্যৎ দুলাভাই এর কষ্ট লাগে।চল এখন বাসায় পৌঁছে দেই।তোমাদের পৌঁছে দিয়ে সবুর মিয়া ঘন্টা বাজাবো!
এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া
কত যত্নে গড়াইয়াছেন কারিগর।
এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া
কত যত্নে গড়াইয়াছেন কারিগর
এই যে দুনিয়া।
ছায়াবাজী পুতুল-রূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনে নাচাও তেমনেই নাচি
পুতুলের কী দোষ?
যেমনে নাচাও তেমনি নাচি
যেমনে নাচাও তেমনে নাচি
তুমি খাওয়াইলে আমি খাই
আল্লাহ, তুমি খাওয়াইলে আমি খাই
এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া
এত যত্নে গড়াইয়াছেন কারিগর
এই যে দুনিয়া
চামারদ গ্রামে সবুর মিয়া লুকিয়ে আছে।কাশেম মাজারের সামনে দিয়ে পাঁচ কদম হাঁটতেই যাত্রাপালার মঞ্চ দেখা যায়।সেখানে বসে যাত্রা দেখছে সবুর মিয়া।অর্পণ যাত্রাপালা ঢুকার আগেই রুমাল দিয়ে মুখ বেধে নিয়ে সামনে এগিয়ে যায়।
বলছিলাম কি ভাই সিগারেট হবে?অপরিচিত কারো গন্ঠ শুনে সবুর মিয়া পাশে তাকিয়ে বলল,
তুমি মিয়া কেডা?তোমারে তোও চিনলাম না।গ্রামে নতুন নাকি।
হুম।এখানে নতুন।তা আপনি কি এই গায়ের?
না,যাত্রা দেখতে মধুপুর থেকে আসছি।আমার গ্রাম রোহিতপুর।
ওহ।বাহিরে চলুন।
কেন?বাহিরে যাব কেন?
আরে চলুন তো?একটা জিনিস দেখাবো।
জিনিস। কি জিনিস?
আছে।
থাকুক পরে যামু।যাত্রা দেইখা লই।
অর্পণের কথায় সবুর লড়তে নারাজ।কিন্তু অর্পণ তার কথায় কানে না নিয়ে টেনে ধরে নিয়ে গেলো।ততখনে মঞ্চের গান শেষের পথে।
১২৪.
বিদেশে পড়তে গিয়েছিল তালুকদার বাড়ির ছোট মেয়ে তন্নী তালুকদার।আজ দেশের মাটিতে পা রেখেছে।সাফিন তালুকদার,এবং মাসুদা তালুকদার মেয়ে কে এতদিন পরে কাছে পেয়ে ভীষণ খুশি।জিহান,রিহান খবর পেয়ে বোনকে দেখতে ছুটে আসে।রাবেয়া হাসপাতালে।এইদিকে অসীম তালুকদারের কাজ পরে যাওয়া গ্রামের বাহিরে আছে।সবার সাথে দেখে করে নিজের রুমে না গিয়ে অর্পণের রুমের দরজায় নক করলো।কিন্তু ভিতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজা খুলে ভিতরে উঁকিঝুকি মারতে লাগল।কিন্তু তার পচ্ছন্দের মানুষটি নেই।তাকে না পেয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেলো।ঘুরে ঘুরে রুমটা দেখতে দেখতে বেডের পাশে দেয়ালে বড় করে অর্পণের ছবি দেওয়া।সেটা দেখে তন্নী খুশি হয়ে গেলো।হাত দিয়ে তার ছবিটি ছুয়ে ডাকলো
ভা.ই.য়া!আমি এসে গেছি।এবার তোমাকে আমার মনের কথাটা ব’লে দিব।বাংলাদেশে এসে তোমাকে আগে খুঁজেছি।কিন্তু তুমি এর্য়ারপোর্টে রিসিভ করতে গেলে না।তুমি না যাওয়া মন খারাপ হয়েছিল।কি এত সারাদিন কাজ কর।যে আমাকে আনতে যাওয়ার সময় হলো না।কিন্তু এখন আমি যেহেতু এসে গেছি তখন কোনো দূরত্ব আর থাকবে না।
এইদিকে পুতুল নিজের হাতের কাপড়ে ব্লকপ্রিন্ট তুলছে।একটা জামাতেই অনেকটা পরিশ্রম যাচ্ছে।এইদিকে নতুন ভার্রসিটিতে এডমিশন নিতে হবে।মামা বই এনে দিবে।পড়াশোনা করতে তার খুব ভালো লাগে।পাশাপাশি রান্না করাটা সে ভালোবেসে পরিবারের জন্য করে।আজও করেছে গিলা,কলিজা,ভুনা।আর কর্ক মুরগীর চামড়া ডাল দিয়ে চড়চড়ি।তরকারির মাখা মাখা হওয়া আলাদা সুন্দর হয়েছে।পুতুলের গিলা,কলিজা খুব পচ্ছন্দের ছিলো।এখনো আছে।কিন্তু ছোট দুই ভাই গিলা,কলিজা খুব পচ্ছন্দ করে।তাই ভাইদের জন্য সে এসব নিজের পাতে এখন আর নেয় না।ওদের জন্য আলাদা তুলে রাখে।সে সামন্য ঝোল দিয়ে তৃপ্তির করে ভাত খেতে পারে।আগে কষ্ট হলেও এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।ভাই’রা খেয়ে খুশি হলেই সে খুব খুশি হয়।
এইদিকে আজ বোনের করা রান্না চুরি করে অর্পণের জন্য আলাদা করে তরকারি বাটিতে তুলে বাগান সাইডে নিয়ে দিয়ে আসে।ভালোবাসার মানুষটির রান্না দেখে যত খুশি হয়েছিল।তরকারি দেখে তার হাওয়া ফুঁস। সে এর আগে এমন তরকারি খায়নি।এসব কলিজা,গিলা,মোটা চামড়া তার ইহকালে পছন্দ নয়।কিন্তু প্রিয় মানুষটি যত্ন করে রান্না করছে।তাই ডান হাতটা ধুয়ে অল্প একটু মুখে নিলো।মুখে দিতেই অর্পণ বুঝতে পারলো।রান্নাটা খারাপ নয়।খেতে ভালোই লাগছে।মিলন লাল চালের ভাত আর তরকারি দিয়ে খেতে বলল,মোটা মোটা লাল চালের ভাত দেখে অবস্থা খারাপ।এমন চাল এই প্রথম দেখছে।তবুও দিদাগ্রস্ত হয়ে এক লোকমা ভাত তকরারি সাথে মিক্সি করে মুখে দিতেই মোটা লাল চালের ভাত তার গলা দিয়ে নামাতে কষ্ট হচ্ছে।বাড়ির আদরের ছেলে চিকন চালের ভাত একটু নরম হলে খেতে পারতো না।আজ সেই ছেলে মোটা চালের লাল ভাত গিলছে।সত্যি অদ্ভুত।
পিড়িতে কাঁঠালের আঠা।লাগলে পড়ে ছাড়ে না।
চলবে…