#তোমার_মনের_মধ্যিখানি 🌼
মিমি_মুসকান
#পর্ব_৩৭
৩ টা বাজতেই দেওয়াল ঘড়ি থেকে টুং টুং করে ঘন্টা বাজার শব্দ ভেসে এলো। আহনাফ তার ঘরের বেলকনিতেই বসে ছিল। তার মনটা ভালো নাকি খারাপ বোঝার এখন কোন উপায় নেই। তবে আকাশের এক টুকরো চাঁদ টা আজ অসম্ভব সুন্দর। আহনাফ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সেই চাঁদের দিকে। সামনে থাকা বিয়ারের ক্যানে চুমুক দিল সে। ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রইল নিশ্চুপ হয়ে। হুট করেই মনটা খারাপ হয়ে আছে তার। কিন্তু কেন?
ফোনটা অন করে ওয়ালপেপারে থাকা ছবিটার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে। ভুল ছিল সে, নিজেকে চিনতে ভুল করেছে। এতোটাও সহজ না তিশা কে ভুলে যাওয়া। যাকে ভুলার জন্য এতো চেষ্টা সে কিছুতেই হৃদয় থেকে মুছতে যেতে রাজি না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে নিল। এতোবার নিজের মনটা ঠিক করা সত্ত্বেও এই ছবিটা বদলানো হলো না। পারে নি সে করতে। নিজেকে সবসময় অনেকটা একা মনে হয় তার। একমাত্র কমতি শুধু তিশা, এতোটাই কি ভালোবেসে ফেলেছিল সে তিশা কে। যখন তখন তিশা’র ভালোবাসা, তার স্মৃতি যেন আগলে ধরে তাকে থাকে। তবুও এক ধরণের অদ্ভুত অনুভূতি হয় নিঝুমের সাথে থাকলে। মেয়েটার কি অলৌকিক শক্তি আছে নাকি , ভেবে পায় না আহনাফ। নিঝুমের সাথে থাকলে তিশা কে নিয়ে সব ভাবনা চিন্তা মুছে যায় তার। মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেয় তার। প্রথম যখন নিঝুমের লেখা সেই কার্ড হাতে পেয়েছিল তখন এক সুপ্ত অনুভূতি লুকিয়ে রেখেছিল সে। চায় নি কখনো এমন কিছু হোক। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেই সুপ্ত অনুভূতি আবার উঁকি দিচ্ছে তার মনে। কারণ কি? নিঝুম কে দেখলে তিশা কে মনে পড়ে না কেন এর কারণ আহনাফ বের করেছে। কারণ নিঝুম কেই তার তিশা মনে হয়। বার বার মনে নিঝুমের সাথে কথা বললে এই বুঝি তিশার সাথে কথা বলছে সে। নিঝুম নয়, তার সামনে বুঝি সত্যি সত্যি তিশা দাঁড়ানো। সে হাসছে, তার সাথে কথা বলছে। কেমন সুখের ঠিকানা খুঁজে পায় সে। এইজন্য নিঝুমের সাথে থাকতে চায় সে, কিন্তু এখন বড্ড স্বার্থপর বলে মনে হচ্ছে নিজেকে। না! স্বার্থপর নয় সে, হ্যাঁ হয়তো নিজের সুখের জন্যে’ই নিঝুমের সাথে থাকতে চায় কিন্তু সেটা মোটেও নিঝুম অনিচ্ছায় নয়। নিঝুম যদি না থাকতে চায় তাহলে সত্যি সে জোড় করবে না। করার প্রশ্নই উঠে না। হঠাৎ তার কানে ভেসে এলো তিশার আওয়াজ। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তাকে ডেকে যাচ্ছে তিশা। আহনাফ একবার সেদিকে তাকাল। তিশাকে চাঁদের আলোয় দেখতে কতোটা মিষ্টি লাগছে তিশা কি সেটা জানে? কিন্তু এটা পুরোটাই তার কল্পনা! কল্পনার জগত থেকে দ্রুত বের হয়ে এলো আহনাফ। অদৃশ্য হয়ে গেল তিশা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারো বিয়ারের ক্যানে মুখ দিল। হঠাৎ মনে হলো তার পাশে কেউ দাঁড়ানো। দুটো পা দেখা যাচ্ছে, আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে নিল। মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল নিঝুম হেসে তাকিয়ে আছে তার দিকে। দুই হাত পিছনে নিয়ে তার দিকে ঝুঁকে বলল, “আহনাফ, আপনার কি মন খারাপ!
আহনাফ কিঞ্চিত হাসল, তার কল্পনা গুলো অদ্ভুত বটে। হঠাৎ লক্ষ্য করল, নিঝুমের কানের গুঁজে থাকা কাঠগোলাপ ফুলটার দিকে। এই ফুলটা একদিন সেইই নিঝুমের কানে গুঁজে দিয়েছিল। এই ফুলটার জন্য হঠাৎ আজ নিঝুম কে অসম্ভব সুন্দর লাগছে তার কাছে। কাল এমন আরেকটা ফুল দেবে নিঝুম কে সে। আবার নিঝুম ও অদৃশ্য হয়ে গেল। আহনাফ চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে বসে রইল।
—-
শান্ত ফোন হাতে দাঁড়িয়ে কথা বলছে নানাজানের সাথে। খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে। নানাজান হসপিটাল থেকে বাড়ি চলে এসেছে। শান্ত’র এটা মোটেও পছন্দ হলো না। ক্যাম্পাসে বটগাছের নিচে বসে বক বক করে যাচ্ছে একনাগাড়ে। “তুমি একটু আমার কথা শুনতে চাও না। এখনো পুরোপুরি সুস্থ নও তুমি। যদি কিছুদিন পর আবার একটা কিছু হয়ে যায় তখন কে দেখবে। এতো বলছি দেশে চলে আসতে এটাও শুনতে রাজি না তুমি। কি চাও কি তুমি!”
শান্ত’র এতো বকবাকানি শুনতে ভালো লাগে না নানাজানের। তাই ফোনটা এসিস্ট্যান্ট’র হাতে রেখে অফিসের ফাইল দেখে যাচ্ছে সে। এসিস্ট্যান্ট সাহেব হা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফোনটা তার হাতে, শান্ত স্যার কথা বলছে অথচ বড় স্যার কোন পাত্তাই নেই। এমনটা হয় না কখনো।
শান্ত বলে উঠল, “কি হলো কি? এখন কথা বলছো না কেন? হার্ট অ্যাটাক হয়ে শুয়ে রইলে নাকি। ভালোই হবে, প্রেসার বাড়বে, সুগার বাড়বে শুয়ে থাকবে। আমার কি? কি হচ্ছে টা কি কথ বলছো না কেন?
এসিস্ট্যান্ট সাহেব আমতা আমতা করে বলল, “স্যার! শান্ত স্যার আপনাকে খুঁজছে?
“দাও দাও এদিকে দাও!
“কি হচ্ছে টা কি?
“হ্যাঁ বল!
“কি বলবো, কথা বলছো না কেন?
“হুম বলছি তো, কি হয়েছে?
“কি আবার হবে ? আমি জানতে চাইছি তুমি কি করতে চাও। আমার কথা তো শুনতে চাও না, এখন কি করবে?
নানাজান সামনে তাকালেন। মৃদু হেসে বললেন, “এলিসার সাথে কথা বলবো, বাই!
“এলিসা! মানে, নানা, নানা আমি.. যা কেটে দিল!
বলেই পাশ ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখল নিঝুম বসা। সে কান খাড়া করে এতোক্ষণ তার আর নানাজানের ফোনের আলাপ শুনছিল। শান্ত তাকে দেখেই বিরক্ত একটা ভাব করল। নিঝুম মুখ টিপে হেসে বলল, “এলিসা কে?
“এভাবে লুকিয়ে অন্যের কথা শোনা কি ভালো কাজ?
“আমি কোথায় আপনার কথা শোনার বসে ছিলাম, আমি তো এভাবেই এখানে বসে ছিলাম।
“কেন ছিলে?
নিঝুম রেগে নাক ফুলিয়ে চোখের চশমা ঠিক করে বলল, “এটা কি আপনার দলিল করা জায়গা যে বসে থাকতে পারবো না। আমার ইচ্ছে আমি বসে থাকবো। আপনি কে বলার?
“তাই তো, আমিই বরং উঠে যাচ্ছি।
অতঃপর শান্ত উঠে চলে যেতে নিলে, নিঝুম দৌড়ে তার সামনে এসে দাড়িয়ে বলল, “এই এই অশান্ত!
“কি হলো?
“সমস্যা কি আপনার?
শান্ত সামান্য কপাল কুচকালো! নিঝুম ঠোঁট উল্টে বলল, “আপনি কেন সারাক্ষণ আমার সাথে ঝগড়া করবার ধান্দায় থাকেন।
শান্ত শব্দ করে শ্বাস ফেলে বলল, ” কিহ! কি বললে তুমি। আমি ধান্দায় থাকি তোমার সাথে ঝগড়া করতে। চশমিস পুরো ভার্সিটি জানে তুমি কতোটা ঝগড়ুটে।
“কচু! আপনি ঝগড়ুটে। ঝগড়ুটে অশান্ত কোথাকার।
“এই এই এভাবেই আমার নামের বারোটা বাজিয়ে যাচ্ছো। তার মাঝে এসব কি। কিছু বলি না বলে সাহস বেড়ে যাচ্ছে তোমার।
“নিঝুমের সাহস আগে থেকেই ছিল আর আছে।
শান্ত বাঁকা হেসে বলল, “ঝুম ঝুমাঝুম ঝুম!
“অশান্ত!
বলেই শান্ত’র চুল টেনে ধরল। শান্ত হতভম্ব। কোনমতে চুল ঠিক করে বলল, “তুমি জানো আমি আধঘন্টা করে নিজের চুল ঠিক করেছিলাম। আর তুমি কোথথেকে এসে দুই সেকেন্ডে সব ভন্ড করে দিলে।
“ইশ,যেই না চুল সেগুলো আবার আধঘন্টা লাগে ঠিক করতে।
“কি বললে! অমনি শান্ত হাত বাড়িয়ে নিঝুমের চুল টানতে গেলে তৎক্ষণাৎ নিঝুম নিচু হয়ে বসে পড়ল। সাইড কেটে ছুটে এসে বলল, “বোকা অশান্ত! চোখ ত্যাড়া আর জিহ্ব খানিকটা বের করে ভেঙিয়ে দিল শান্ত কে। শান্ত বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। রাগে তার পুরো শরীর কাঁপছে। সে ছুটল নিঝুমের পিছনে। নিঝুম ছুটছে , শান্ত ও ছুটছে। ছুটতে ছুটতে গেলো ক্যান্টিনে। তানিশা, দিয়া, রিয়া, আহিম, তিথি, ইফা, নীলাভ্র আর আফিন সবাই ছিল সেখানে। নিঝুম তাদের চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে , পিছন পিছন ঘুরছে শান্ত। এক পর্যায়ে নিঝুম হাঁপিয়ে তানিশা’র পিছন এসে দাঁড়াল। তানিশার হাতের সিঙ্গাড়া পড়ে গেল নিচে। সে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইল নিঝুমের দিকে। নিঝুম দুই হাত চেপে ধরে তানিশার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। শান্ত তার সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। এদিকে নিঝুম ও হাফাচ্ছে। শান্ত বলে উঠল, “এই তানিশা সর তো.
তানিশা রেগে বলল, “এই মেয়ে ছাড়ো আমায়!
“দিচ্ছি দিচ্ছি ছেড়ে দিচ্ছি!
বলা মাত্র নিঝুম আবার ভাগল। শান্ত ও তার পিছন পিছন ছুটল। ওদের কান্ড দেখে বাকিরা মুখ টিপে হাসতে লাগল। অন্যান্য ছাত্ররা হাঁ হয়ে তাকিয়ে আছে শান্ত’র দিকে। ইদানিং শান্ত’র সাথে নিঝুম নামের মেয়েটার মেলামেশা একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে।
করিডোর দিয়ে দৌড়ে ছুটতে নিঝুম। বার বার পিছনে উঁকি মেরে দেখে যাচ্ছে শান্ত কে। শান্ত ও ছুটছে তার পিছন। নিঝুম সামনে থেকে সবাইকে সরে যেতে বলছে, “এই সরো, সরো!
পেছন তাকিয়ে অশান্ত কে দেখে আবারো হাসছে, অতঃপর সামনে ফিরতেই কারো সাথে খুব জোড়ে ধাক্কা লাগল তার। কোমর ধরে কোনমতে পড়া থেকে সামলে নিল সে, নিঝুম তার হাত আঁকড়ে ধরে রইল। চোখের চশমা টা নিচে পড়ে গেল। শান্তও থমকে গেল আহনাফ কে দেখে! আহনাফ আর নিঝুম একসাথে, আহনাফ মোহিত হয়ে তাকিয়ে আছে নিঝুমের দিকে। শান্ত’র চোখে থেকে আড়াল হলো না তা। আহনাফের দৃষ্টিতে নিঝুমের জন্য ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছে সে। শান্ত হঠাৎ করেই কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে গেল। সবকিছু পিছনে ফেলে, পা পিছিয়ে নিল সে। সামনে এগিয়ে আসার আর সাহস হলো না তার। মন বলছে পিছিয়ে যেতে, আর সেটাই করল। পিছিয়ে গেল সে..
নিঝুম দেখার খুব চেষ্টা করছে কে তার সামনে কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না। আহনাফ কিঞ্চিত হেসে দাঁড় করালো তাকে। ধন্যবাদ আর সরি দুটোই বলে চশমা খুঁজতে ব্যস্ত হলো নিঝুম। আহনাফ নিচ থেকে চশমাটা উঠিয়ে হাতে দিল নিঝুমের। চশমা পড়তে পড়তে বলল, “আপনাকে আরো একবার ধন্যব..
“ধন্যবাদ!
“আহনাফ আপনি!
“হুম, আমিই ছিলাম তোমার সামনে দাঁড়ানো। আফসোস তুমি চিনতে পারলে না আমায়।
নিঝুম হেসে বলল, “এটা সবাই জানে নিঝুম চশমা ছাড়া অন্ধ!
নিঝুমের মাথায় হাত বুলিয়ে আহনাফ বলল, “সেই জন্যই তো বাচ্চাদের মতো এমন ছোটাছুটি করো না। কিছু একটা হয়ে গেলে তখন!
নিঝুম হা হয়ে তাকিয়ে রইল আহনাফের দিকে। আহনাফ কে আজ অনেক সুন্দর লাগছে তার কাছে। চোখ দুটো উপড় করে দেখছে আহনাফ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, হঠাৎ করেই খুশি হয়ে গেল সে। লজ্জায় তার গাল লাল হয়ে যেতে নিল। মাথা নিচু করে মুখ টিপে হাসতে লাগলো। হঠাৎ চমকে উঠল সে। আহনাফ ও হতচকিয়ে গেল। এক পা পিছনে গিয়ে নিচ থেকে কাঠগোলাপ টা উঠিয়ে আহনাফের মুখের সামনে ধরল। কাঠগোলাপ টা পা দিয়ে মাড়িয়ে দিল সে। নিমিষেই চেহারায় বিষণ্ণতার ছাপ চলে এলো। আহনাফের মনটা ক্ষুদ্ধ হলেও নিঝুম কে সামলানোর জন্য দ্রুত সামলিয়ে উঠে বলল, “ব্যাপার না, এতো মন খারাপের কিছু নেই।
“ফুলটা অনেক কষ্ট পেলো।
“পেয়েছে, তবে বেশি না। তুমি তো আর ইচ্ছে করে কিছু করো নি।
“কিন্তু..
আহনাফ চোঁখের ইশারায় তাকে থামতে বলল। হাতের বইটার একটা পেজ বের করে ফুলটাকে লুকিয়ে রেখে দিল তার মাঝে। মৃদু হেসে বলল, “নাও! এবার খুশি তো।
নিঝুম মাথা দুলাল।
——–
পরিকল্পনা মাফিক সব কাজ হয় না। কখনো নিজের শ’ত্রুকে নিজের চেয়ে বোকা কিংবা দুর্বল ভাবা উচিত নয়। যদি এমন কিছু হয়ে যায় তাহলে এই ভুলের খুব বড়সড়ো মাসুল গুনতে হয় তাকে। শান্ত’র সাথেও এর ব্যতীক্রম কিছু হলো না। তার কথামতো ঈশান কে মারা’বার জন্য প্রস্তুত থাকা লোকের আগেই ঈশান ভাড়া করে রাখে তার লোক! অতঃপর শান্ত আর আহনাফের উপর জমিয়ে রাখা ক্ষোপের বশীভূত হয়ে তাদের মার’বার জন্য পাঠিয়ে দেয় তাদের। দিনের বেলায় একদল পিছু করে আহনাফ কে। তবে বিফল হলো সেই কাজে কিন্তু রাতের বেলায় সেই ভুল আর করলো না তারা।
রাতের বেলায় শান্ত তার বাসার পাশের কফিশপ থেকে বের হতেই একদল লোক এসে ঘিড়ে ধরল তাকে। শান্ত মুখের কাছ থেকে কোল্ডকফি টা নামিয়ে রাখল। কিছু বোঝার আগেই লাঠি দিয়ে মা’র চলতে লাগল তার উপর। একা এতোজনের সাথে পেরে উঠা কোনভাবেই সম্ভব ছিল না তার পক্ষে। বাইরে গ’ন্ডগলের আওয়াজ পেয়ে কফিশপের লোকজন ছুটে চলে আসে। তারা আসতেই ছোকড়া গুলো ভয়ে পালিয়ে যায়। রাস্তার পড়ে থাকে শান্ত’র দেহ’টি। নিজেই উঠে দাঁড়াল শান্ত। ঘাড়ের কাছে অসম্ভব ব্যাথা, বা হাত উঠিয়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। ডান হাতের কনুইয়ের দিকেই ছি’লে গেটে খানিকটা। প্রায় অনেকক্ষণ পর বুঝতে পারল ঠোঁট কেঁ’টে র’ক্ত পড়ছে তার। ম্যানেজার সাহেব ছুটে এলেন শান্ত’র এই খবর শুনে। আগে থেকেই চেনাজানা ছিল। হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য তড়িখড়ি করতে লাগলেন তিনি নিজেই। শান্ত কোনমতে ফোনটা বের করে ডায়াল করল আহনাফের নাম্বার!
এতোটাও আহত ছিল না কিন্তু যা ছিল তাও কম কিসে।বা হাত টা ভেঙ্গে গেছে তার, প্লাস্টার করিয়ে দেওয়া হয়েছে। ডান হাতে কনুইয়ের দিক ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে ডাক্তার। লাঠি’র আঘাত ঘাড়ের দিকে স্পষ্ট! ঠোঁটের দিকটা র’ক্ত জমে আছে এখনো। ডাক্তার বলেছে আজকের রাতটা হাসপাতালেই থাকতে কিন্তু শান্ত দ্বিমত পোষণ করল। ডাক্তার আরো বলে গেল, ঔষধ গুলো ঠিক মতো কয়েকদিন খেলে আর বিশ্রাম নিলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
শান্ত মুখ তুলে তাকাল। চেহারায় কোন আঘাতের চিহ্ন থাকলে একটু ভালো লাগে না তার। বিরক্ত আর রাগ দুটোই জড়িয়ে ধরল তাকে। ঠোঁটের কাঁটা দাগটা যেন রাগ বাড়িয়ে তুলছে। ঠিক তার সামনে বসে আহনাফ ঢকঢক করে পানি খাচ্ছে। এপাশে বসে থাকা ইফা গালে হাত দিয়ে শান্ত কে দেখছে। ব্যাপারটা এখন অবদি কাউকে জানানো হয় নি, সকালে সবাইকে বলবে। শান্ত রুঢ় দৃষ্টিতে ইফার দিকে ফিরে বলল, “এভাবে তাকিয়ে কি দেখছিস?
“তোমাকে?
“কেন দেখার কি হলো?
“দেখছি, কারো হাতে বেধর ভাবে মা’র খাওয়ার পর তাকে দেখতে কেমন লাগে!
“মজা করছিস?
“আরে যাহ, মজা করবো কেন? ছোট থেকে দেখে আসছি, তুমি সবাইকে মে’রে হাসপাতালে পাঠাতে। আজ তোমায় দেখছি। দোষ কি এতে?
“এতো জন একসাথে থাকলে আমি কি করবো?
“তাই তো, তুমি কি আর জানতে ওরা তোমায় মে’রে হাত ভে’ঙে দেবে!
“ফাজলামো করিস না, হাত ভা’ঙে নি। ডাক্তার বলেছে একমাস এভাবে থাকলে ঠিক হয়ে যাবে।
“ওই আর কি পুরোপুরি ভাবে না ভাঙ’লেও অর্ধকে তো ভে’ঙেছে। এক কাজ কর, তাদের নাম্বার আমায় দাও, ফোন করে এসে বাকি কাজটা সারতে বলি।
“আহনাফ তুই কি থামতে বলবি ওকে!
চোয়াল শক্ত করে কথাখানা বলল শান্ত। এতো একটা প্রভাব পড়ল না ইফা’র উপর। আহনাফ কে এখন যতটা শান্ত দেখাচ্ছে ভেতর থেকে রাগে ততোটা পুড়ছে সে। রাগটা বোধহয় এখন জমিয়ে রাখাই ভালো। হুড়মুড় করে দৌড়ে ভেতর এলো রায়ান আংকেল। অনেকটা চিন্তিত মনে হচ্ছে তাকে, শান্ত কে দেখামাত্র’ই চিন্তা যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেল। শান্তও কম অবাক হয় নি রায়ান আংকেল কে এভাবে দেখে। বড় ধাক্কা টা তখন খেলো যখন দেখল দরজার সামনে কবীর চৌধুরী দাঁড়িয়ে আছে। রীতিমতো তাকে দেখে শান্ত’র চেহারার রঙ বদল হয়ে গেল। আহনাফ ও যথেষ্ট রেগে গেল। শুধু শান্ত’র বাবা বলে কিছু বলতে পারছে না, নাহলে এই লোককে দুচোখে সহ্য হয় না তার। রায়ান আংকেল বিচলিত কণ্ঠে বলে উঠল, “শান্ত বাবা! তোমার এই হাল হলো কিভাবে? কে করলো?
“কেউ না, তুমি এখন এখানে কি করছো? আর তোমাকে খবর দিল কে?
কবীর চৌধুরী গম্ভীর স্বরে বলে উঠেন, “তুমি কবীর চৌধুরী’র ছেলে, এসব ব্যাপার লুকিয়ে থাকবার কথাও না। কে করল এমনটা?
“সেসব আমি তোমাকে কেন বলবো ? কে তুমি!
কবীর চৌধুরী চোয়াল শক্ত করে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ধমক দিতে গিয়েও থেমে গেলেন। শান্ত কে হঠাৎ করেই ছোট বাচ্চা ছেলে মনে হতে লাগল তার কাছে। আহনাফ পানির বোতলটাকে শক্ত করে ধরল। রায়ান আংকেল শীতল গলায় বলল, “শান্ত উনি তোমার বাবা হন! এভাবে কথা বলো না, তোমার মা খুব চিন্তিত!
শান্ত উপহাস করে হেসে বলল, “মা বাবা!
কবির চৌধুরী যথেষ্ট রাগ নিবারণ করে রায়ান আংকেল কে বললেন, “ডাক্তার কি বলেছে খোঁজ নিয়ে জানাও আমায়। আমি গাড়ি নিয়ে নিচে অপেক্ষা করছি।
“আমি তোমার সাথে যাচ্ছি না।
রায়ান আংকেল বলে উঠল, “বাবা শান্ত আমি বলি কি…
কথা শেষে হবার আগেই কবীর চৌধুরী ছেলের চোখের দিকে চোখ রেখে বললেন, “তাহলে এই অসুস্থ শরীর নিয়ে কোথায় থাকবে তুমি?
আহনাফ এই পর্যায়ে মুখ খুলল। কবীর চৌধুরীর দৃষ্টি উপেক্ষা করে বলল, “আগে যেখানে ছিল এখনো সেখানেই থাকবে, শান্ত চল আমার সাথে!
কবীর চৌধুরী চেয়েও আর কোন কথা বলতে পারলেন না। কোন মতে রাগ সংবরণ করে বের হয়ে চলে গেলেন। রায়ান আংকেল দ্বিধা করতে করতে কবীর চৌধুরীর পিছন পিছন গেলেন। আহনাফ শান্ত কে নিয়ে বের হয়ে গেল। নিরব দর্শক হয়ে থেকে গেল ইফা!
আহনাফ শান্ত কে ধরে নিজের গাড়িতে বসাচ্ছে। দূরের গাড়িতে বসে আছে কবীর চৌধুরী! হাতের সিগারেট ধরিয়ে দেখছেন শান্ত কে! এতোটা রাগী তো তিনিও নন তার ছেলে হলো কি করে? রায়ান আংকেল’র খারাপ লাগছে শান্ত কে দেখে। ছেলেটা কেন এতো রাগী বুঝে উঠতে পারেন না তিনি। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। কবীর চৌধুরী বলে উঠেন, “রায়ান!
“জি স্যার!
“শান্ত’র দিকে নজর রাখতে বলেছিলাম, রেখেছিল!
“জি স্যার, কয়েকমাস ধরে আমি নিজেই নজর রেখেছি।
“শুনলাম, ওর মাও নাকি লোক লাগিয়েছে ওর পিছনে।
“চিন্তা করবেন না স্যার, ব্যাপারটা আমি দেখছি। ম্যাম কখনো শান্ত বাবা’র খোঁজ পাবে না।
“আচ্ছা, কাল সকালে শান্ত’র কয়েকমাসের কাজ কর্মের রেকড দিবে আমায়।
“জি স্যার।
“একটা কথা বলো তো রায়ান, শান্ত কার মতো হয়েছে।
“কেন স্যার, আপনার মতো!
“না, ওর চেহারার সাথে আমার মিল থাকলেও আমার স্বভাব পায় নি ও!
“ঠিক বলেছেন। স্বভাবের দিক থেকে বড় ম্যামের মতো হয়েছেন তিনি। বড় ম্যাম ও যথেষ্ট রাগী ছিলেন।
“কি করা যায় বলো ওকে নিয়ে।
“সময় দিন স্যার, সব ঠিক হয়ে যাবে।
কবীর চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। সিগারেট ঠোঁটে রেখে মনে মনে ভাবলেন, “সময় দিতে দিতে আজ এতো গুলো বছর। কিছুই তো বদলালো না, বরং আরো বিগড়ে গেল! এমনটা হওয়ার কি খুব দরকার ছিল।
——
“শান্ত তুই বরং আবার বাড়িতে চল!
গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে কথাটা বলল আহনাফ। শান্ত মাথা নেড়ে বলল, “না! আমার ফ্লাটে চল!
“ওখানে একা কি করে থাকবি তুই?
“এমন ভাবে বলছিস তোর বাড়িতে বিয়ে করা বউ রেখেছিস আমার সেবাযত্ন করার জন্যে।
আহনাফ শব্দ করে হেসে দিল। ইফা বলে উঠল, “আরে আমি তো আছি, আংকেলও আছেন। তুমি জানো আংকেল কতো চিন্তা করছে তোমার জন্য!
“থাম তুই, তোর সাথে থাকলে আমি আরো অসুস্থ হয়ে যাবো, সুস্থ হবার দরকার নেই। আমি আমার ঘরেই কমফোর্টেবল।
ইফা চুপ হয়ে গেল, কথা বাড়াল না। আজ পর্যন্ত শান্ত যা বলেছে তাই হয়েছে, কথার কোন নড়বড় হয় নি।
#চলবে….