#নিশীভাতি
#৪০তম_পর্ব
“আর আপনার তৃষ্ণাটা? সেটা কিভাবে মিটবে?”
নির্ভার, জড়তাহীন প্রশ্ন। হুমায়রা প্রস্তুত ছিলো না এমন প্রশ্নের জন্য। দৃষ্টি নত হলো লজ্জায়। ফর্সা গালজোড়ায় রক্ত জমে গেলো। এমন প্রশ্নের কি উত্তর দেওয়া যায়! নিন্মোষ্ঠ ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে। হাতটা কাঁপছে ঈষৎ। ফাইজানের কণ্ঠ গাঢ় হলো,
“উত্তর দিবেন না?”
“জা…নি না”
ফাইজান মৃদু হাসলো। দূরত্ব ঘুচিয়ে দিলো। দু হাত দিয়ে কোমড় জড়িয়ে ধরলো খুব আলতো করে। সমস্ত শরীরে শিহরণ বয়ে গেলো। হুমায়রার নিঃশ্বাস প্রগাঢ় হলো। জড়োসড়ো হয়ে গেলো মেয়েটি। হৃদস্পন্দন মাত্রা ছাড়ালো। ত্রস্ত চোখজোড়া ঠায় নিবদ্ধ হলো শান্ত, শীতল চোখের দিকে। পোঁড়া ঠোঁটজোড়া বিস্তৃত হলো অষ্টাদশীর লাজুককতায়। স্নিগ্ধতা মন ছুঁয়ে যায়। মেয়েটির টসটসে লাল গালটায় একটা চুমু দিলে কি সে রাগ করবে! ঘাবড়ে যাবে! তব্দা খাবে! প্রশ্নের উত্তর জানার ইচ্ছে হলো। ফলে হুমায়রার দিকে ঝুকলো সে। শীতল অধরজোড়া ছুলো নরম গাল। চোখ বুঝে নিলো সাথে সাথে হুমায়রা। হৃদপিন্ডের গতি আরোও তীব্র হলো। অনুভূতিটি পরিচিত, কিন্তু যতবার অনুভূতিটির সম্মুখীন হয় ততবা কম্পিত হয় সমস্ত শরীর। নিঃশ্বাস ঘন হয়। ফাইজান বিমুগ্ধ হয়ে স্ত্রীকে দেখে। একটা সময় কাঁধে কপাল ঠেকায়। অসহায় স্বরে বললো,
“আপনি কি জাদু টোনা জানেন হুমায়রা?”
“কেনো?”
“এই যে ক্রমশ আমাকে বশ করছেন, কিভাবে বলুন তো?”
“আমি তো কিছু করছি না”
“সমস্যাটা এখানেই, আপনি কিছুই করছেন না। অথচ আমি ক্রমশ আপনার প্রতি ধাবিত হচ্ছি। এটা শারীরিক আকর্ষণ নয়। শরীরের আকর্ষণ এতোটা প্রবল হয় না। ক্ষণ সময়ের জন্য হয়, এরপর ক্ষয়ে যায়। কিন্তু আমার আকর্ষণ ক্ষণ মুহূর্তের নয়। বরং এটাকে আকর্ষণও বলা চলে না”
“তাহলে?”
দলা পাকানো স্বরে শুধালো হুমায়রা। আলিঙ্গন প্রগাঢ় করলো ফাইজান। তপ্ত নিঃশ্বাস চিরে যাচ্ছে ত্বক। না দেখলেও হুমায়রার মনে হলো মানুষটি হাসছে। নিঃশব্দ হাসি। ভারী স্বরে বললো,
“আমার সাথে কোথাও যাবেন?”
“এতো রাতে কই যাবো?”
চমকে প্রশ্ন করলো হুমায়রা। ফাইজান মাথা তুলে চাইলো। মৃদু স্বরে বললো,
“কৃষ্ণকলির জ্যোৎস্না দেখতে”
*****
গাঢ় রাত, প্রকৃতি তখন শান্ত। মেঘহীন আকাশ অলংকৃত হয়ে আছে তারকারাজি। মধ্যিমনি রুপী বাঁকা চাঁদটি জেদী কিশোরীর ন্যায় উঁকি দিচ্ছে। মৃদু সেই আলো। দুপাশে শুকিয়ে আসা শীতল পানিতে প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে সুন্দরী চন্দ্রমার। দীঘির ঠিক মধ্যিখানে ছোট্ট ডিঙ্গি। ফাইজানের হাতে বৌঠা। তার অপর দিকে বসে আছে হুমায়রা। তার কোল ভর্তি গন্ধরাজ। মিষ্টি গন্ধ। মন ভরে গন্ধ উপভোগ করছে হুমায়রা। নিরেট ফাইজানের মাঝে এমন স্বভাবও থাকতে পারে কল্পনাও করে নি হুমায়রা। এই যে সে তাকে নিয়ে এসেছে। এখনো মুখখানা নিরেট।কোনো কথা নেই। শুধু ঘনঘন তার দিকে চাইছে। আপাদমস্তক দেখছে। নিপুন ভাবে, ক্লান্তিহীন। হুমায়রা হাটুতে মাথা এলিয়ে স্মিত স্বরে শুধালো,
“আপনার পানি খুব ভালো লাগে তাই না?”
“কিভাবে বুঝলেন?”
“আপনাদের ওই বাড়িতেও ঘাটলায় বসে ছিলেন। এখানেও মাঝরাতে নৌকা চালাচ্ছেন”
“ভুল, আমি বলেছিলাম না আমার প্রকৃতি ভালো লাগে না। একাকীত্ব ভালো লাগে। আর সরোবরের থেকে একাকীত্ব কোথাও পাবেন না। ফুলগুলো ভালো লেগেছে”
“কোথায় পেলেন এগুলো?”
“আপনার জন্য খুঁজে এনেছি”
আবার মৌন হলো পরিবেশ। আলোআঁধারীতে হুমায়রার লাজুক মুখখানা না কল্পনা করতেও আনন্দ লাগছে ফাইজানের। অপার্থীব সুখ যেনো এই অনুভূতিতে। নিজের এমন পরিবর্তন অবাক লাগে ফাইজানের কাছে। বিয়ের আগে ভেবেছিলো, ছোট একটি মেয়ে ঘরে এক কোনেতে থাকবে। তার ভরণপোষণ, দায়িত্ব পূরণ করাটা খুব কঠিন হয় না। বিয়ের পর ভেবেছিলো, মেয়েটি তার অন্ধকার জীবনের মাঝে এক মুঠো স্বস্তির নিঃশ্বাস। এখন মনে হয়, এই মেয়েটি তার বেঁচে থাকার খোড়াক। অনুভুতিগুলো তো মরে গিয়েছিলো বহু পূর্বেই। তাহলে কিভাবে আবার সেই অনুভূতিগুলো মনের এক কোনে রোপিত হলো। শাখা প্রশাখা মেললো। ছড়িয়ে পড়লো অন্তস্থলে। আনমনেই হাসে ফাইজান। হুমায়রা শুধায়,
“হাসছেন কেনো?”
ফাইজান বৈঠা তুলে রাখে, হাটুতে হাত ভর করে বললো,
“নিজের উপর হাসি”
“নিজের উপর কেউ হাসে নাকি? তাহলে তো বলতে হয় আপনি পাগল”
“হতে পারি, তবে সেখানে আপনার হাত বেশি”
“আবার আমাকে দোষাচ্ছেন?”
“উহু, আপনি তো কিছুই করেন নি। ভাবছি, কিছু করেন নি, তাই আমি এতোটা বশ হয়েছি। করলে বোধহয় পাগলাগারদ যেতে হবে নয়তো মৃত্যু”
“ছিঃ এগুলো বলবেন না”
শক্ত গলায় কথাটা বললো হুমায়রা। ফাইজান হাসলো শব্দ করে। ধ্বনিত হলো সেই হাসি। গুঞ্জন সৃষ্টি করলো নিস্তব্ধ নগরীতে৷ হাসতে হাসতে বললো,
“জন্মিলে মরিতে হবে। এটা বদলানোর উপায় নেই”
“জানি, তবুও বলবেন না”
“আচ্ছা হুমায়রা, আপনার কৌতুহল হয় না?”
“কি নিয়ে?”
“আমাকে নিয়ে। যার সাথে থাকছেন, ঘুমাচ্ছেন তাকে জানতে ইচ্ছে করে না?”
“যাকে বুঝতে পারি না, তাকে জেনে কি হবে?”
সরল স্বীকারোক্তি হুমায়রা। সে হাতের ফুলগুলো সুতোয় বাঁধছে। ফাইজানের কন্ঠ খানিকটা বদলালো, বিচিত্র স্বরে বললো,
“আবার ভুল বললেন”
“কি ভুল বললাম?”
“আপনি আমাকে আমার থেকে ভালো করে বুঝেন। তাই তো এতোরাতে আমার সাথে এক বাক্যে বের হয়েছেন”
হুমায়রা উত্তর দিলো না। ফাইজানের স্থির দৃষ্টি তার দিকেই আবদ্ধ। ফাইজানের কন্ঠ নরম হলো৷ খুব মোলায়েম স্বরে বলল,
“একদিন বলেছিলেন, যেদিন আমি লুকোচুরি খেলার ইতি টানবো সেদিনের প্রতীক্ষায় থাকবেন। আমিও লুকোচুরি খেলার ইতি টানতে চাই। আমাদের মাঝেই অদৃশ্য দেওয়ালটাকে গুড়িয়ে দিতে চাই। আপনি থেকে তুমিতে পদার্পণ করতে চাই। আমার প্রতিটি ব্যস্ত, নোংরা, ষড়যন্ত্রময়, চতুরতায় ঘেরা দিনের সমাপ্তি তোমার বাহুতে করতে চাই। জড়তাহীনভাবে আপনাকে পেতে চাই। যেখানে কোনো বাঁধা থাকবে না”
হুমায়রা সংকোচহীন স্বরে শুধালো,
“নেতাদের কথায় কতটুকু ভরসা করা যায়? আদোপি ভরসা করা যায়?”
“আপনার সামনে আমি নেতা নই, শুধু ফাইজান”
“পালটে যাবেন না তো? মানুষের গিরগিটি স্বভাবটি গিরগিটি থেকেও প্রগাঢ়”
“মৃত্যু অবধি না”
বিলম্বহীন উত্তর। হুমায়রা তাচ্ছিল্য করে শুধালো,
“বহুদূরের পরিকল্পনা করে ফেলেছেন”
“নেতা ফাইজান হোক কিংবা শুধু ফাইজান, কথার নড়চড় করি না আমি”
হুমায়রা মৃদু হাসলো৷ তেজস্বী স্বরে বললো,
“বেশ, লুকোচুরিহীন সম্পর্কটির শুভারম্ভ করা যাক তবে”………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
৩৯তম পর্ব
https://www.facebook.com/share/p/CjQykihNsTRq9Sav/?mibextid=oFDknk