নিশীভাতি #৪২তম_পর্ব

0
658

#নিশীভাতি
#৪২তম_পর্ব

“প্রথমবার খু/ন করতেই ভয়, একবার তা হয়ে গেলেই ভয় কেটে যায়। তোমার বরকে বলো, আমার কিন্তু ভয় কেটে গেছে।”

আমানের শীতল বাক্যটি শুনতেই বিবর্ণ হয়ে গেলো হুমায়রার মুখখানা। শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেলো হিম প্রবাহ। রক্তশূন্য চোখে তাকিয়ে রইল আমানের পানে। আজ সেই মাতাল, আলাভোলাকে আমান ভাইকে অচেনা লাগছে৷ তার চিরচেনা মুখভাব আজ নেই, বরং বিভৎসতা ঘিরে আছে প্রচন্ডভাবে। হুমায়রা গলা শুকিয়ে আসছে। ছটফট করছে মনটা। তার ছটফটানি সমস্ত দেহে ছড়িয়ে যাচ্ছে। সামনের মানুষটা তাতে পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে৷ গলার স্বর খাঁদে নামিয়ে বললো,
“এক খু/নে যে শাস্তি, সাত খু/নে একই শাস্তি। তাই সাবধান করছি। ফাইজান ইকবালের লাফালাফি দেখে একটা প্রবাদ মনে পড়লো, “পীপিলিকার পাখা গজে মরিবার তরে”— ঠিক বলছি না?

হুমায়রার বুক কাঁপছে। ত্রস্ত চোখজোড়া তাকিয়ে আছে আমানের দিকে। শব্দরা ভাষাহীন হয়েছে। আমান তার হাত ছেড়ে দিলো। অপ্রকৃতস্থ হাসি তার ঠোঁটে। খুব স্বাভাবিকভাবে বললো,
“আসি হুমায়রা। আবার দেখা হবে”

হুমায়রা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। পিপাসায় গলা কাঠ হয়ে আছে। ভীত চোখ চেয়ে আছে আমানের যাবার পথে। মস্তিষ্ক কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। চিন্তাচেতনাগুলো ভীষণ বিক্ষিপ্ত। ঠিক তখনই ভরাট স্বর কানে এলো,
“হুমায়রা”

কেঁপে উঠলো হুমায়রা। পেছনে চাইতেই ভাইজানের দেখা মিললো। রাশাদ তার দিকেই আসছে। হাতে বড় টর্চ লাইট। আঁধারের গাঢ়ত্ব বেড়েছে। শুনশান নীরবতায় ঝিঁঝিঁপোকাদের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে কেবল। সন্ধ্যার গন্ধ মিলিয়ে গেছে সেই কখন। রাশাদ কাছে আসতেই দেখলো হুমায়রার শরীর কাঁপছে ঈষৎ। তরতর করে ঘামছে। কিছু শুধানোর পূর্বেই সে বললো,
“পানি খাবো, ভাইজান”

******

দোকানটা মসজিদের সংলগ্নে। মুসল্লিরা নামায শেষে বাড়ি ফিরছে। হুমায়রা এখন খানিকটা স্বাভাবিক। তার হাতে উষ্ণ চায়ের কাপ। ধোঁয়া কুন্ডলিত হচ্ছে কুয়াশায়। রাশাদ একটা পাউরুটি কিনলো। বিয়ের পর বোনের সাথে একান্ত সময় কাটানোর সুযোগ হয় নি তার। কখনো জিজ্ঞেস করা হয় নি, সে কি আদৌও সুখী কি না! পরিস্থিতি হয় নি তেমন। যাও ফোনে কথা হয়েছে স্বল্প সময়ের জন্য। সেখানে হুমায়রা একটি উত্তর ই দিতো,
“আমি ভালো আছি ভাইজান। আম্মা খুব ভালো।”

রাশাদ রুটিটা বোনের দিকে এগিয়ে দিলো। কোমল আদুরে স্বরে বললো,
“চায়ে ডুবিয়ে রুটিটা খা, মজা লাগবে”

ভাইজানের কথামতই রুটিটুকু খেলো হুমায়রা। চায়ে ভিজিয়ে পাউরুটি খুবই সুস্বাদু লাগে হুমায়রার কাছে। এই আবদারটা শুধু ভাইজানের কাছেই সে করে। এখনো মনে আছে, যখন হুমায়রা ছোট ছিলো তার ভাইজান কলেজ থেকে ফেরার পথে নান রুটি বা বনরুটি নিয়ে আসতো হুমায়রার জন্য। বিকেলে ধোঁয়া উঠা চায়ে ভিজিয়ে খেত ভাইবোন। যুবাইদা অবশ্য এ নিয়ে খুব রাগারাগি করতো রাশাদকে। কারণ রাশাদ তার যাতায়াতের টাকা জমিয়ে বোনের জন্য খাবার আনতো। এর জন্য মাইলের পর মাইল হেটে আসতেও তার আপত্তি নেই। হুমায়রার এখন ভালো লাগছে। ভয়গুলো ক্ষীন হয়ে এসেছে। প্রশান্ত হাওয়ার স্পর্শ ছুয়েছে মনে। রাশাদ বোনের প্রফুল্ল মুখখানা মন ভরে দেখে। তারপর শুধায়,
“মেলা যাবি? শীতের জন্য পাশের গ্রামে মেলা হচ্ছে।”
“মেলা শুরু হয়ে গেছে?”
“হ্যা, সেই কবে। যাবি?”
“ভাবিকে বলবে না?”
“সে বলেছে তার অনেক কাজ। বোনকে নিয়ে ঘুরে আসতে। শুনেছি ওখানে অনেক বাহারি জিনিসও উঠেছে”

হুমায়রার চোখজোড়া চকচক করলো। বিচক্ষণ, পরিপক্ক মেয়েটির মাঝে সুপ্ত কিশোরী সত্তা উঁকি দিলো। মাথা নাড়িয়ে বললো,
“যাবো”

*******

সন্ধ্যার পর মেলার ভিড় যেনো বেড়েছে। দুপাশে নিজেদের শিল্পকলা নিয়ে বসেছে সবাই। কোথায় কারুকাজ সম্পন্ন কাপড় তো কোথাও মাটির শিল্পকলা। হুমায়রার চোখ আটকালো রঙ্গবেরঙ্গের চুড়ির পানে। অসম্ভব সুন্দর সেই কাঁচের চুড়ি। রাশাদ সাধলো,
“নিবি?”
“অনেক দাম”
“তোর ভাইজানের অঢেল নেই, কিন্তু দেড়শ টাকার চুড়ি কেনার সামর্থ্য আছে”

বলেই একগাছি চুড়ি কিনলো রাশাদ। হুমায়রা বাধা দিলো না। ভাইজানের অকৃত্রিম স্নেহগুলো এই ক’মাস খুব মনে পড়েছে। চুড়ি কেনা শেষে দু ভাইবোন দুটো হাওয়াই মিঠাই নিয়ে হাটতে লাগলো। রাশাদ তখন শুধালো,
“সত্যি করে বল তো কেমন আছিস?”

হুমায়রা ভাইজানের দিকে তাকালো। তার দৃষ্টি শান্ত, তবে সে উৎসুকভাবে চেয়ে আছে হুমায়রার উত্তরের প্রতীক্ষায়। হুমায়রা মৃদু হেসে বললো,
“খুব ভালো আছি, আলহামদুলিল্লাহ”
“আর ওদিকের মানুষ?”
“আম্মা খুব ভালো মানুষ। একটু বেশি কথা বললেও তিনি খুব ভালো। আর চামেলী আপা সে তো একটা ফুলঝুড়ি। সময় কখন কেটে যায় টের ই পাই না। ফরিদ ভাই কম কথা বলেন। তাকে বুঝে উঠতে পারছি না। হয়তো নেতার সাথে থাকেন বলেই এমন শত স্তর”
“আমি এদের কথা জানতে চাই নি। আসল মানুষটা কেমন?”

হুমায়রা একটু থামলো। খানিকটা লজ্জা পেলো। ভাইয়ের সামনে কথাগুলো সাজাতে সময় নিলো। তারপর খুব নিপুন ভাবে পরিবেশন করলো,
“আমার মানুষটি খুব বিচিত্র ভাইজান। মাঝে মাঝে বেকুব বনতে হয় তার মস্তিষ্ক বুঝতে। তবে সে আমাকে খুব স্নেহ করেন, আমার অনাদর করেন না। আমাকে আগলে রাখেন। বিয়ের সময় যে ভয়টা পেতাম, সে আমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে। আমাকে মানুষ বলেই গন্য করবে না, সম্মান তো ছাড়। মানুষটি তেমন না। আমার দাম তার কাছে আছে এটুকুতে আমার সন্দেহ নেই। তাহলে ভালো না থেকে উপায় আছে?”

রাশাদ বোনের কথায় যেনো নিশ্চিন্ত হলো। দীর্ঘশ্বাস ফেললো গোপনে। ভরাট কন্ঠে বললো,
“ভাই হিসেবে আমি সবসময়ে ডাহা ফেল। বিয়েতে তোর মত ছিলো না। অথচ আমি কিচ্ছু করতে পারি নি। তাই সবসময় কাটার মতো গ্লানিটা বুকে বিঁধে। আজ একটু নিশ্চিন্ত হলাম। দোয়া করি এভাবেই সুখে থাক। তবে একটা জিনিস মাথায় রাখবি..”
“পৃথিবী তছনছ হয়ে গেলেও আমার ভাইজান আছে।”

হুমায়রার কথায় হেসে দিলো রাশাদ৷ মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলো বোনকে। তারপর পা বাড়ালো বাড়ির উদ্দেশ্যে।

******

রাত নয়টার পর সকলের কাছ থেকে বিদায় নিলো ফাইজান এবং হুমায়রা। ফাইজানের মুখটা খানিকটা গম্ভীর লাগলো। মেকি হাসি ঠোঁটে এঁটে লাগলেও সেটা যে মিথ্যে তা হুমায়রা টের পেলো। রাস্তাতেও খুব একটা কথা হল না। আমানের ব্যাপারটা ইতোমধ্যে ক্ষীণ হয়ে এলো স্মৃতিতে। হুমায়রা তার দিকে বারবার তাকালো। কিন্তু জিজ্ঞেস করার সাহস পেলো না। বাড়িতে পৌছালো রাত বারোটা নাগাদ। কেঁচি গেটের সামনে গাড়ি থামলো বেশ শব্দ করে। ফাইজান ধীর স্বরে বললো,
“হুমায়রা আপনি বাড়ি যান, আমি হাসপাতালে যাবো?”
“অবস্থা কি গুরুতর?”
“হু”

ফাইজান ছোট করে উত্তর দিলো। পরিবেশ গম্ভীর। তাই হুমায়রা কথা বাড়ালো না। শুধু বললো,
“সাবধানে যাবেন”

হুমায়রাকে নামিয়েই তীব্র বেগে গাড়ি ছোটালো ফাইজান। হুমায়রার মনটা অস্থির লাগছে। একটু ঘুমোতে পারলে হয়তো ভালো লাগবে।

******

অন্ধকার গলি, শুনশান নীরবতা। ফাইজান অপেক্ষারত। বারবার ঘড়ি দেখছে সে। কারোর অপেক্ষা করছে সে। হঠাৎ পেছন থেকে পায়ের শব্দ শোনা গেলো। ঘষে ঘষে চলছে সে। হাতে চকচকে ছু/রি। ফাইজানের নজর তখন সামনে, পেছন থেকেই অতর্কিতে আক্রমণ করলো সে। ফিনকি দিয়ে পড়তে লাগলো লহু। রক্তাক্ত বর্ণে রক্তিম হলো পিচের রাস্তা। সাথে সাথেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো হুমায়রার। লাফ দিয়ে উঠে বসলো সে। গলা শুকিয়ে এসেছে। কপালে ঘামের আস্তরণ। রীতিমতো কাঁপছে শরীর। বুকের স্পন্দন বাড়া। সাথে সাথেই পাশের মানুষটি তাকে আগলে ধরলো,
“কি হয়েছে? বাজে কোনো স্বপ্ন দেখেছো?”

অপ্রকৃতস্থের মতো এলোমেলো দৃষ্টিতে চাইলো হুমায়রা। তার পাশেই ফাইজান বসে রয়েছে। মস্তিষ্ক নিষ্ক্রিয়। কিছু না ভেবেই বিদ্যুৎ বেগে জড়িয়ে ধরলো সে মানুষটিকে। হু হু করে কেঁদে উঠলো অবচেতনমনেই। ফাইজান বুঝে উঠলো না। অপ্রস্তুত হলো। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে হুমায়রার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
“বাজে স্বপ্ন দেখেছো? ভুলে যাও। স্বপ্নই তো। পানি খাবে?”

হুমায়রা তাকে ছাড়লো না। এখনো কাঁপছে তার শরীর। ফাইজান বেশী জোর করলো না। সময় দিলো স্ত্রীকে। বেশ খানিকক্ষণ বাদে কান্নার দমক কমলো। শান্ত হলো হুমায়রা। পানি খেলো। চোখে এখনো নোনা জল লেপ্টে আছে। ফাইজান টেবিল ল্যাম্পটা বন্ধ করলো না। বুকে আগলে রাখলো তাকে। মাথায় আস্তে আস্তে বিলি কাটলো। হুমায়রা স্বপ্নের কথাটা বলতে চাইলো। কিন্তু ফাইজান বললো,
“এসব স্বপ্ন। তাই ভুলে যাও”

হুমায়রা জড়িয়ে ধরলো ফাইজানকে। হাতের বাধন দৃঢ়। যেনো ছাড় দিলেই মানুষটি হারিয়ে যাবে। রাতটা এভাবেই কেটে গেলো।

********
রাস্তার ধার দিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে হাটছিলো হুমায়রা। মস্তিষ্ককোষগুলো ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে আছে। স্বপ্নটা মাথা থেকে যাচ্ছে না। তার থেকেও স্মৃতিতে সতেজ হয়েছে আমানের হুমকি। ফাইজানের সাথে কথা বলার উপায় হচ্ছে না। কারণ সে ফিরছে গভীর রাতে। এসেই ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে শুয়ে পড়ছে। আবার ভোরের আগেই সে বেড়িয়ে পড়ছে। হুমায়রা মোটেই শান্ত হতে পারছে না। এর মাঝেই চামেলী বললো,
“ভাবীসাব, একটু খাঁড়ান৷ আমি মোবাইলে টেহা ভইরে আসতেছি”

কথাটা খেয়াল করলো না হুমায়রা। বেপরোয়াভাবেই উত্তর দিলো,
“আচ্ছা”

চামেলী চলে গেলে রাস্তার কোনে দাঁড়িয়ে রইলো হুমায়রা। তার দৃষ্টি অবচেতনভাবে চেয়ে আছে প্রসস্থ রাজপথের দিকে। হঠাৎ অক্ষিগোলক বড় হলো। বিস্ফারিত হলো নয়ন। ঠোঁটজোড়া ফাঁক হলো কিঞ্চিত৷ অস্পষ্ট স্বরে একটা শব্দই বের হলো,
“আম্মা”

চোখকে বিশ্বাস করতে চাইলো না হুমায়রা। রাস্তার ওপারে যুবাইদা দাঁড়িয়ে আছে। কমলা কিনছে দাম দর করে। চুলগুলো খোঁপায় বাঁধা। পড়নে বেশ দামী শাড়ি। হুমায়রা পাগলের মতো ডাকলো,
“আম্মা, আম্মা”

কিন্তু মানুষটি শুনলো না। সে কমলা কিনেই হাটা দিলো। হুমায়রার মনে হলো এইটাই সুযোগ৷ এখন আম্মাকে না ধরলে কখনোই আর সুযোগ পাওয়া যাবে না। কত প্রশ্ন তার। প্রশ্নগুলোর উত্তর যে চাই। সব বোধবুদ্ধি লোপ পেলো যেন। ঘোরের মাঝেই ছুটলো সে রাজপথে। গাড়ি, ঘোড়ার দিকে নজর নেই। সে শুধু ডাকছে,
“আম্মা, আম্মা”

হঠাৎ কেউ চিৎকার করে তাকে ডাকলো। মুহূর্তের মাঝেই তাকে ধাক্কা দিলো। হুমায়রা ছিটকে পড়লো ফুটপাতের দিকে। কনুই ছিলে গেছে পড়ে যাওয়ায়। ব্যাথায় সম্বিৎ ফিরলো। যখন আশপাশে দেখলো তখন মানুষের হট্টগোল। আজ রাস্তার পাশে অচেতন পড়ে আছে চামেলী। গলগলিয়ে রক্ত পড়ছে তার শরীর থেকে। আর কালো গাড়ির চাকাটা তাকে পিষে সজোড়ে ছুটে চলে গেলো দৃষ্টির ওপাড়ে…….

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

৪১তম পর্ব
https://www.facebook.com/share/p/tE8JayLMouu8sgdm/?mibextid=2JQ9oc

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here