#নিশীভাতি
#৪৪তম_পর্ব
“কালাম, হুন। আজকের বাজারে কি ওই কয় টেহায় চিনি গলে! আরোও টেহা লাগবে। তুই আমারে আর দু লাখ টেহা দে”
কাওছারের কথা শোনামাত্র কালামের চোখ মুখ শক্ত হলো, এর পূর্বেই তাকে লাখ দেড়েক টাকা দিয়েছে এই আশায় যে ছেলেটার একটা গতি হবে। সরকারী চাকরী এখন হাতে চাঁদ পাবার মতো অবিশ্বাস্য অকল্পনীয় বস্তু। যদি লাখ দেড়েক টাকায় ছেলেটা এই অকল্পনীয় বস্তুটি পায় ক্ষতি কি! এই টাকাটা যোগাঢ় করতেই তার অবস্থা বেগতিক হয়ে গিয়েছে। জমি বন্দক রেখেছে চেয়ারম্যানের কাছে। এখন আবার টাকা চাইছে। কাওছারের লোভ সম্পর্কে অজানা নয় কালাম। তাই শক্ত স্বরে বললো,
“কাওছাইড়া, হত্য করে ক। আমার পোলার চাকরিখান হইবো নি? আমি তোরে মেলা টেহা দিছি। তুই কইছিলি ওইডায় হইবো। এহন অন্য কথা কতা কস। তোর মতলব কি?”
কাওছারের কপালে ভাঁজ পড়লো। চোখ মুখ খিঁচিয়ে কর্কশ স্বরে বললো,
“তাইলে যা, অন্যখানে যা। আমি পারুম না কিছু করতে। এত্তোসোজা নি! তোর পোলার তো মেলা মুরদ, যা একা একাই ক চাকরী নিতে। মুই পারুম না কিছু করতে। শালা ছুডুলোক। চাকরী পাইবো মাগ্না।”
“কাওছাইড়া, মুখ সামলা।”
“রাখ তোর, শালা ফকির। ছেড়া খেতা পিন্দা স্বপ্ন দেহে প্রাসাদের। লাগবো না পয়সা ওই পয়সায় আমি মুতি। এ যা তো। যা”
“তাইলে আমার টেহা ফেরত দে”
“কোন টেহা?”
কাওছারের এমন কথায় ব্রহ্মতালু জ্বলে উঠলো কালামের। এতো কষ্টের টাকা তার হাতে তুলে দিয়েছিলো আর ও কি না এভাবে পাল্টি খেলো। কালামের ক্রোধ বাড়লো। রাগান্বিত স্বরে শুধালো,
“যে টেহা আমি তোরে দিছি। আমার টেহা দিবি না তুই?”
“না দিবো না। যা ভাগ”
কালাম সাথে সাথে কলার চেপে ধরলো কাওছারের। তার দৃষ্টি শানিত। কালামের রাগ দেখে কিছুটা চমকালো কাওছার। ভয়ও পেলো। কালাম ক্রোধ উগরাতে উগরাতে বললো,
“কাওছাইড়া, আমার টেহা ফেরত দে। এক্কন দিবি”
“প… পরমান কি আমি টেহা নিছি? সাক্ষী কোয়ানে”
কালাম ঘামছে। সে কাউকে না জানিয়ে, কোনো প্রমাণ বাদেই কাওছারকে টাকা দিয়েছে। ফলে কাওছার যদি অস্বীকারও করে তার কিছু করার নেই। কিন্তু হাল ছাড়বে না সে। এর শেষ দেখে ছাড়বে। যতই হোক কষ্টের টাকা। কাওছারের কলারটাকে ছেড়ে তাকে ধাক্কা মে/রে রাগে, ক্রোধে গজরাতে গজরাতে বেরিয়ে গেলো কালাম। মেঝেতে বসে পড়লো কাওছার। কলারটা কুচকে গেছে। মেজাজ খারাপ হচ্ছে প্রচন্ড, ভেবেছিলো কালামকে পটিয়ে পাটিয়ে আরেকটু টাকা বের করবে। কিন্তু হলো না। কালাম চটে গেলো। তাকে মারতে উদ্ধত হয়েছে উলটো। কাওছারের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো। কালাম গ্রামে কথাটা ছড়িয়ে দিলে আবার বিপাকে পড়বে কাওছার। বাড়ির মানুষও তাকে ছেড়ে কথা বলবে না। বিশেষ করে রাশাদ। প্রতিটা সময় সে তাকে ঘৃণার চোখে দেখে৷ বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার কম চেষ্টা করে না সে। এমন কি শামসু মিঞাও তাকে দু চোখে সহ্য করতে পারেন না। শুধু আতিয়া খাতুনের কারণে তার ঠাঁই হয়েছে এই বাড়িতে। নয়তো শেয়াল কুকুরের মতো ঘুরে ঘুরে বেড়াতে হতো। কথাগুলো ভাবতেই ভয়ে শিউরে উঠলো কাওছার। এদিকে কালাম বের হবার সময় রাশাদের সাথে দেখা হলো। রাগে সে গজগজ করছে। রাশাদ কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে তার কাঁধে ধাক্কা মে/রে বেড়িয়ে গেলো। কালাম এমন কাজে অবাক হলো রাশাদ। তার দৃষ্টি কাওছারের ঘরের পানে গেলো। কালাম কি কাওছারের কাছে এসেছিলো?
****
বিকালের সূর্যের আলোর তাপ ক্ষীন হয়ে এসেছে। হুমায়রাকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছে ফাইজান। শরীফা বেশ চিন্তায় ছিলেন। খবর শোনার পর থেকেই উতলা হয়ে উঠেছিলেন। হুমায়রা ফিরতেই প্রশ্নবান ছুড়তে লাগলেন। হুমায়রা উত্তর দিতে পারলো না। শুষ্ক চোখজোড়া শুধু ভিজে আসছে বারবার। ফাইজান তাকে শান্ত করলো। বললো,
“চামেলী ঠিক আছে। হুমায়রা কিছু খায় নি। ওকে খাইয়ে দিও”
“তুই খাবি না?”
“আমার একটি বের হতে হবে”
ফাইজান অপেক্ষা করলো না। হুমায়রাকে মায়ের হাতে রেখেই বেরিয়ে গেলো সে। তার ফোন বাজছে। কাজ হয়েছে আশা করা যায়।
হুমায়রা ঘরে এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। শরীরটার প্রতিটা রন্ধ্রে ক্লান্তিগুলো তাকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। চামেলীর জ্ঞান ফিরে নি, সে এখনো আইসিউ তে আছে। ডাক্তার বলেছে, “সময় লাগবে”। একবার চোখের দেখার সুযোগ হয়েছে। কি শান্ত ভাবে শুয়ে আছে মেয়েটি। মুখখানা মলিন। মাথায় সফেদ ব্যান্ডেজ। হাতে নাকে নল। জ্ঞান আসার অপেক্ষা করতে দিলো না ফাইজান। হুমায়রাকে একা হাসপাতালে রেখে সে বের হয়ে পারবে না। তাই তাকে জোর করেই নিয়ে এসেছে। যদিও হুমায়রার আসার ইচ্ছে ছিলো না। হুমায়রার ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিয়েছে একটা নার্স। ক্ষতস্থানটা ক্ষণে ক্ষণে নিজেকে জানান দিচ্ছে। কিন্তু অন্তরের জ্বলন তার থেকে অধিক বিধায় সেই বোধটুকু হচ্ছে না। শরীফা খাবার দিয়ে আসলো হুমায়রার ঘরে। তাকে দেখতেই উঠে বসলো হুমায়রা। শরীফা মৃদু এসে তার পাশে বসলো। ধীর গলায় বললো,
” হাত মুখ ধুয়ে আয়”
“আম্মা, খাইতে ইচ্ছে করতেছে না”
“তা বললে তো হয় নারে মা। জীবনটা এমনই। বিচিত্র। জীবনকে কখনো নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। অনিয়ন্ত্রিত ঘটনাগুলো গোছানো আমাদেরও অগোছালো করে দেয়। এর সাথেই আমাদের মানিয়ে নিতে হয়। যে মানিয়ে নিতে পারে সে জয়ী, আর সে পারে না সে হারিয়ে যায় জীবনের স্রোতের প্রখরতায়”
হুমায়রা তাকালো শরীফার পানে। তার মুখখানা মলিন। মুখে মরা হাসি। শরীফা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মলিন গলায় বললো,
“ইকবাল সাহেব যখন মা/রা যান আমার বয়স কম। ফাইজান তখন ছোট। আমার সাজানো জীবনটা ওই একটা ঘটনাতেই এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো। আমার মনে হয়েছিলো আমার জীবন শেষ। মনে হচ্ছিলো আমাদের কথা তো শেষ হয় নি, আমাদের একসাথে চলাই হয় নি। এই তো গতকাল ই না উনি আমার খোঁপায় কাঠগোলাপ গুজলেন। সেই ফুলের সৌরভ তো এখনো মিলায় নি। অথচ মানুষটি নেই। আমার জীবনটা ক্ষণিকের মধ্যেই পালটে গেলো। আমি কি বেঁচে নেই। আছি। তাকে হৃদয়ে আগলে বেঁচে আছি। বুঝলি রে পাগলী, জীবন নামক এই যাত্রাটা খুব কঠিন, অনিয়ন্ত্রিত, এবড়োখেবড়ো। তবুও আমাদের চলতে হবে, নিয়তি”
হুমায়রা চুপ করে কথাগুলো শুনলো। শরীফার বোঝানো কাজে দিলো। সে হাত মুখ ধুয়ে নামায পড়লো। তারপর চুপচাপ খেয়ে নিলো। শরীফা মৃদু হাসলো। মাথায় আলতো পরশ ছুয়ে আদর করলো। হুমায়রা শুষ্ক চোখজোড়া টলমল করে উঠলো। চোখের কোনায় জমলো নোনা অশ্রু। কিছু না বলেই জড়িয়ে ধরলো সে শরীফাকে। শরীফাও তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। ফলে কিশোরীর মন শান্ত হলো।
***
গাড়ি চালককে খুজে পাওয়া গেলো। পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে এসেছে। থানার অসি সম্মুখে বসে আছে ফাইজান। ছেলেটি পার্টির ছেলে। ফাইজানের ছেলেদের কিছুদিন পূর্বে যে ছেলেগুলোর সাথে মারপিট হয়েছে, ছেলেটি তাদের একজন। আশ্চর্যজনক ব্যাপার, এই ছেলেটি ই আফসানের উপর হামলা করেছিলো। ছেলেটির ভাষ্য, সে দ্রুত গাড়ি চালাচ্ছিলো। চামেলী তার গাড়ির সামনে এসে পড়েছে। ব্যাপারটি কাকতালীয়। পুলিশ নিজেও সেটাই বলছে। কিন্তু ফাইজানের সামনে খুব একটা বলার সুযোগ হলো না। ফরিদ তখন বললো,
“ফাইজান, আমাদের কাছে প্রমাণ নেই। প্রমাণ ছাড়া তো কাউকে ফাঁ/সিতে ঝোলাতে পারবে না”
“ও আফসানকে মে/রেছে সাক্ষী তো তুমি। আর তোমার সত্যি মনে হয় এটা কাকতালীয়। আমার কিন্তু মনে হচ্ছে না”
কঠিন স্বরে উত্তর দিলো ফাইজান। ফরিদ কিছুটা মিয়ে গেলো। আমতা আমতা করে বললো,
“তাহলে কি করবে?”
“ভোটের রেজাল্ট পর্যন্ত এখানেই থাকুক। রেজাল্টের পর ম্যাটারটা আমি সলভ করবো।”
ফরিদ কথা বাড়ালো না। ফাইজান পুলিশের সাথে কথা বলে উঠে দাঁড়ালো। থানা থেকে বের হবার সময় খুব ধীরে বললো,
“একটা ব্যাপার আমাকে অবাক করছে ফরিদ ভাই”
“কি?”
“তুমি কি সত্যিই জানতে না ওরা আমাদের ছেলেদের উপর এট্যাক করবে?”
ফরিদ কিছুটা বিস্মিত হলো। জড়তাহীন স্বরে বলল,
“তুমি কি আমাকে অবিশ্বাস করছো?”
“উহু, জিজ্ঞেস করছি। আমার ছেলেদের উপর আক্রমণ হয়েছে ফরিদ ভাই। একটা ছেলে এখন হাসপাতালে। বিষয়টা গম্ভীর। আমার বউকেও ওরা মারতে চেয়েছে। আমি কিন্তু পাঁচ বছর আগের ফাইজান নই। কেউ আমার দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে পার পেয়ে যাবে, ধারণাটা ভুল। ওদের ভাগ্য ভালো, হুমায়রার কিছু হয় নি। নয়তো ওদের কাল ভোরের সকাল দেখতে হতো না”
ফরিদ কিছু বলার সুযোগ পেলো না। ফাইজান হনহন করে হেটে গাড়িতে উঠলো। শরীরটা এখন হুমায়রাকে চায়।
*****
হাসপাতাল থেকে রাত নয়টা নাগাদ ফোন এসেছে। চামেলীর জ্ঞান ফিরেছে। সে এখন ঘুমাচ্ছে। কথাটা শোনামাত্র হুমায়রার মনের ভার হালকা হলো। পাথরটা নেমে গেলো। ঠিক সেই সময় বাসায় ডুকলো ফাইজান। ফাইজানের কাছে ছুটে যেয়ে কথাটা জানালো হুমায়রা। ফাইজানের ক্লিষ্ট মুখশ্রীতে হাসি ফুটলো। সে নরম গলায় বললো,
“বলেছিলাম না, সব ঠিক হয়ে যাবে”
খাওয়া দাওয়া শেষে সবগুছিয়ে নিজ ঘরে গেলো হুমায়রা। ফাইজান তখন বিছানায় হেলান দিয়ে বই পড়ছিলো। কালো চশমার নিচের ধারালো চোখগুলো মগ্ন ছিলো পাতার শব্দমালায়। হুমায়রা তার খোঁপাটা খুললো। চুলগুলো নেমে এলো কোমড়ে। বেনী করলো সময় নিয়ে। ফাইজান তখন নরম গলায় বললো,
“হুমায়রা এদিকে আসো”
ডাক শুনে চোখ তুলে তাকালো হুমায়রা। উঠে গিয়ে দাঁড়ালো ফাইজানের পাশে। ফাইজান বইটা বন্ধ করে ছোট টেবিলে রেখে দিলো। তারপর তার কোমল হাতটা আলতো করে ধরলো। হালকা টানে নিজের কোলে বসালো। ফাইজানের এমন কাজে প্রথমে কিঞ্চিত কেঁপে উঠলেও নিজেকে সামলে নিলো হুমায়রা। ফাইজানের আঙ্গুলের রুক্ষ্ণ ডগা তখন বিস্তরণ করছে হুমায়রা নরম গালে। কাঁপা স্বরে হুমায়রা শুধালো,
“ডাকলেন যে?”
ফাইজানের দৃষ্টি তখন অসংযত, নেশাতুর। দুরত্বখানা কমিয়ে নিয়ে গলঃদেশে চুমু খেলো আলতো করে। গাঢ় স্বরে বললো,
“তোমাকে কাছে পাবার আবেদন জানাতে ডেকেছি…..
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
৪৩তম পর্ব
https://www.facebook.com/share/p/EVP8P8R8Q4RHYuPw/?mibextid=oFDknk