ফ্লুজি #অনুপ্রভা_মেহেরিন [পর্ব ১২ বাকি অংশ]

0
490

#ফ্লুজি
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ১২ বাকি অংশ]

” ছেলে চলে গেছে এই ছেলে আর ফিরবে কি না কে জানে।এখন রুমের দরজা আটকে শোক পালন করে কী হবে?”

” আহ চুপ করবে তুমি।মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে কথা বলা এবার ছাড়ো।”

” আমি কষ্ট দিচ্ছি?ওই আরশাদকে বিয়ে করতে তুমি নিজেই তো উষ্কে দিয়েছিলে অনিমা।”

” আমি উষ্কেছি?তুমি যদি রোহানের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি না হতে আমি কখনোই মেয়ের বিয়ে আরশাদের সাথে দিতাম না।তুমি নিজের মতামতের জোর খাটালে আমিও খাটালাম।”

বাহারুল হক প্রত্যুত্তর করলেন না।তবে আপন মনে বকতে বকতে চলে গেলেন নিজের কক্ষে।বাবা মায়ের ঝগড়া খুশবু সবটাই শুনলো।আরশাদ এভাবে চলে যাওয়ায় তার ভেতরটা যে কতটা পুড়ছে কেউ কি বুঝতে পারছেনা?না চাইতেও মনের কোনে উকি দিচ্ছে একটাই কথা আরশাদ কি আমায় ঠকালো?নাকি আরশাদ প্রতিশোধ নিল।আমি তো আরশাদের সেই প্রেমিকা নই আমি কেন সব দায় মাথায় নেব। অঝরে কাঁদলো খুশবু।হাতে থাকা ফোনটার দিকে তাকিয়ে তার অপেক্ষা কখন আরশাদ যোগাযোগ করবে তার সাথে!
.
টানা ১৪ ঘন্টা জার্নি শেষে বাসায় ফিরলো আরশাদ।মন মেজাজ সবটাই তার বিক্ষিপ্ত।গ্র‍্যানির চিন্তায় ছেলেটার পা গ ল পা গ ল অবস্থা।আরিবের দু’চোখ ফুলে আছে, সর্বদা হাস্যজ্বল ছেলেটা যে আজ সারাটা রাস্তায় কেঁদেছে এই কথা কি কেউ মানবে!

দুই ভাই বাড়ি ফিরে দেখা পেল বাবা ইমরান ইহসানের। দুই ছেলেকে বুকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদলেন তিনি।তার শ্বেত মুখখানি রক্তিম বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে।কান্নার আওয়াজে এগিয়ে এলেন আরশাদের মা আফরোজা।বাঙালি মায়ের দিকে তাকিয়ে আরশাদের মনে পড়ে গেল তার ফ্লুজির কথা।মেয়েটা এখন কেমন আছে?

” মম কি করে হলো এসব?”

” তোমার গ্র‍্যানির শ্বাস কষ্ট আছে সেটা তো জানোই হঠাৎ বেড়ে গেল কি থেকে কি হলো নিজেও বুঝলাম না।হাসপাতাল নেওয়া হয়েছে অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে আরশাদ।”

” তোমরা আমাকে আগে জানাওনি কেন?”

” তোমার গ্র‍্যানি অসুস্থ হয়েছেন দুইদিন হলো আমরা ভেবেছি সবটা ঠিক ঠাক হয়ে যাবে।উনার তো মাঝে মাঝেই এমন হয়।”

” গ্র‍্যানির সাথে আমি দেখা করতে চাই।”

” এখন গিয়েও লাভ নেই দেখা করা যাবে না।কাল যেও।”

আরশাদ মাথা দুলালো।ইমরান ছেলের দিকে তাকিয়ে কাধে হাত দিয়ে বলেন,

” খুশবু কেমন আছে?”

” ভালো।”

” তাকে বলে এসেছো?”

” না।ফ্লুজির এক্সাম ছিল।আমার শাশুড়ীকে বলে এসেছি।”

” যাও বিশ্রাম করো।আরিব তুমিও তোমার ঘরে যাও।”

আরশাদ এবং আরিব দুজনে লাগেজ হাতে তুললো।আরশাদ উলটো দিকে হাটা দিতে আফরোজা বলেন,

” আরশাদ আজ আরিবের সাথে থাকো।আর না হয় গেস্টরুম ফাঁকা আছে সেখানে থাক। তোমার ভিলা পরিষ্কার করা হয়নি।”

” আমি যাওয়ার পর সব কি গোছগাছ করা হয়নি?”

” তা হয়েছে।তবে আজ আর পরিষ্কার করিনি।”

” আমি পারবো সমস্যা নেই।”

আরশাদ পুনরায় লাগেজ নিয়ে হাটা শুরু করলো।
সিড়ি ঘর পেরিয়ে নিচে তাদের স্টোর হাউজ।স্টোর হাউজের মাধ্যমে আরশাদের ভিলায় যাওয়ার শটকাট মাধ্যম।ভিলার দরজা খুলে গহীন অন্ধকারের গহ্বরে হারিয়ে গেল আরশাদ।

কতদিন পর এসেছে সে নিজের নীড়ে।তার বয়স যখন সতেরো তখন এই বাড়িটা নতুন কেনা হয়।আরশাদের অনেক ইচ্ছা নিজের মতো করে একটি ভিলা সাজাবে সেখানে তার পছন্দে সব হবে।আরশাদের প্রতিটা চাওয়া পাওয়া রাখার চেষ্টা করে তার বাবা ইমরান ইহসান।যেহেতু আরশাদের চাওয়া খুব কম আর সেই কম টুকুকে অধিক গুরুত্ব দেয় তার বাবা মা।মোবাইলের ফ্লাশ অন করে সুইচ বোর্ড খুঁজে বের করলো আরশাদ।আফরোজা প্রতিটা আসবাবপত্রে আলগা কাপড় বিছিয়ে রেখেছে যেন ধুলো জমে নষ্ট না হয়।

এসব ফেলে আরশাদ চললো দোতলায় নিজের কক্ষে।যতটা পারা যায় পরিষ্কার করে শাওয়ার নিতে প্রস্তুত হলো।একটা লম্বা শাওয়ার শেষে মোবাইল হাতে জানলা খুলে বসলো সে।বর্তমানে গরম পড়লেও মৃদু বাতাসে গায়ে কাটা তুলছে তার।বিন্দু বিন্দু জলকণা এখনো দখল করে আছে আরশাদের দেহের প্রতিটা ভাজে।আরশাদ ঘড়িতে তাকালো সময় এখন রাত বারোটা তাহলে বাংলাদেশে এখন নিশ্চয়ই ভোর চারটা।ফ্লুজি নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছে।তিমিরে ঢাকা আকাশটায় তাকিয়ে মনটা হুহু করে কেঁদে উঠে আরশাদের।আকাশের নিরবতা যেন আজ তার দুঃখ বুঝে।

আকাশকে সাক্ষি রেখে আরশাদ বার বার বলতে চায়, আমি ফিরবো ফ্লুজি আমি ফিরবো।আমি ফিরবো তোমার কাছে,আমি তোমার সহিত থাকতে চাই যেমনটা অশ্রু মিশে থাকে দু’লোচনে।

আরশাদ ফোন তুলে ফ্লুজিকে মেসেজ করলো ভেবে রেখেছিল মেয়েটা ঘুমে নিশ্চয়ই এখন মেসেজ দেখবে না।কিন্তু আশ্চর্যের ব্যপার ম্যাসেজটি সাথে সাথে সিন হলো।আরশাদ তৎক্ষনাৎ ফোন করলো তার ফ্লুজিকে।অপর পাশ থেকে ফোন রিসিভ করে নিরব হয়ে রইল মেয়েটা।

” ফ্লুজি আমার জান।”

” আমাকে একা ফেলে কেন চলে গেলেন?”

” আমি আসবো।”

” জানি।”

” বিশ্বাস করো আমায়?”

” খুব বেশি।”

” তাহলে ভয় কিসের?”

” নিঃসঙ্গতার।”

আরশাদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।হিম বাতাসে তার গায়ে কাটা তুললেও বসে থাকতে মন্দ লাগছে না।

” গ্র‍্যানি কেমন আছে আরশাদ?”

” আমি দেখতে যাইনি।কাল যাবো।”

” আঙ্কেল আন্টি ভালো আছেন?”

” এই সময়ে আর কতটা ভালো থাকতে পারে।”

” ভয় পাবেন না।ইনশাআল্লাহ খুব শীঘ্রই সুস্থ হয়ে যাবে।”

” গ্র‍্যানির তোমায় নিয়ে কতটা আহ্লাদ ছিল তুমি ভাবতেও পারবে না।আমি চাই না গ্র‍্যানি এই অসময়ে আমাদের ছেড়ে চলে যাক।”

” মনোবল রাখুন।”

” তুমি ঘুমাওনি কেন?গলা ভাঙা লাগছে কেন?”

” ঘুম আসেনি তাই ঘুমাইনি।”

” এই মেয়ে তুমি কাঁদছিলে?”

” ক..কই একদম না।আমি তো মুভি দেখছিলাম।”

” মিথ্যা বলছো আমায়?আগে পরে যা করেছো এবার আমি তোমায় সামনা সামনি দেখেছি চিনেছি বুঝেছি।কখন তোমার নিশ্বাসের তাল ঘন হয় কখন হালকা হয় আমি সবটাই জানি।পুরো তোমাকেই চিনে ফেলেছি।”

” কিন্তু আমি আপনাকে চিনতে পারিনি আরশাদ।”

দুজনের মাঝে ছেয়ে যায় নিরবতা।আরশাদ জানলা বন্ধ করে শুয়ে পড়ে বিছানায়।

” আমি চলে যাওয়ার পর আঙ্কেল নিশ্চয়ই তোমাদের কথা শুনিয়েছে তাই না?”

” ক…কই..”

” মিথ্যা বলবে না।আঙ্কেল আমায় একটুও পছন্দ করেন না।তিনি নিশ্চয়ই ভেবে বসে আছেন আমি তোমাদের ঠকিয়ে এখানে চলে এসেছি।”

” হুম বলেছে।”

” যাও ঘুমাও ভিসাটা হয়ে যাক তুমিও আসবে আমার সাথে।”

খুশবু ফোন রাখলো।এই সম্পর্কের কোন নিশ্চয়তা সে পেল না।আদৌ কি আরশাদের ফেরা হবে?
.
সেই রাতে আরশাদের আর ঘুম হলো না।সকাল হতে তৈরি হয়ে সে আর আরিব মিলে চলে গেল গ্র‍্যানিকে দেখতে।সবচেয়ে খুশির ব্যপার ডাক্তাররা আশার আলো দেখিয়েছেন।গ্র‍্যানি ডেঞ্জার জোন থেকে ফিরে এসেছেন সুস্থ হতে সময় লাগলেও আশা করা যায় তিনি খুব শীঘ্রই আগের মতো ফিরবেন।

আরিবকে হসপিটালে রেখে আরশাদ তার রেস্টুরেন্টে ঘুরতে এলো।সম্পূর্ণ নিজের জমানো টাকা দিয়ে আরশাদ একটি বাঙালিয়ানা রেস্টুরেন্ট দিয়েছে।ইতালির রোমে অনেক বাংলাদেশির বসবাস।মাঝে মাঝে তাদেরো ইচ্ছে হয় কব্জি ডুবিয়ে বাঙালি খাবার খেতে।ব্যস্ততায় সব পদের খাবার সেভাবে রান্না করাও হয় না।বাঙালি মায়ের বুদ্ধিতে আরশাদ এই রেস্টুরেন্টের যাত্রা শুরু করে।শুরু থেকেই সে সফলতার মুখ দেখেছে।পুরোটা রেস্টুরেন্টের সব কর্মচারী বাঙালি।কেউ ইন্ডিয়ান কেউ বাংলাদেশের।

রেস্টুরেন্টের একজন হাস্যজ্বল কর্মচারীর নাম রিমি।মেয়েটা পড়াশোনার তাগিদে রোমে থাকছে।আরশাদের সাথে তার ভীষণ সখ্যতা।রেস্টুরেন্টে আরশাদকে দেখেই খুশিতে আত্মহারা রিমি।

” শুভ সকাল স্যার।কেমন আছেন আপনি?”

” ফাইন।সবটা কেমন চলছে?”

” বেশ ভালো।ইমরান স্যার মাঝে মাঝে এসে সবটা চেক করে যান।স্যার আপনার জন্য ব্রেকফাস্ট তৈরি করবো?”

” না চা নিয়ে এসো।”

রিমি কিছুটা অবাক হলো।আরশাদ রেস্টুরেন্টে এসে কখনো চা চায়নি।মূলত আরশাদ চা খুব একটা পছন্দ করে না।আরশাদ কফি লাভার।কিন্তু হঠাৎ চা চাওয়ার রসহ্যটা রিমি বুঝতে পারলো না।মেয়েটার মনে খেল গেল প্রশ্নেরা।

” স্যার চা?”

” অভ্যস হয়ে গেছে।আমার উনি চা টা ভিষণ ভালো বানায়।আগে পছন্দ করতাম না আর এখন…ভিষণ মিস করছি।”

” ম্যাডাম কেমন আছে স্যার?”

” ভালো আছে।”

” স্যার ম্যাডামকে খুঁজে পাওয়ার গল্পটা বলবেন কবে?”

আরশাদ শ্লেষ হাসলো।চেয়ারে বসে ফোন হাতে তুলে বলে,

” এক কাপ চা আনো।আর যারা যারা প্রেমের গল্প শুনতে চায় তাদের ধরে আনো আজ আমি আমার গল্প শোনাবো।”

মালিক হিসেবে আরশাদ ভীষণ অমায়িক একজন মানুষ।এত মাস সবারি কৌতূহল ছিল আরশাদকি সত্যি তার ফ্লুজিকে পেয়েছে?আজ বুঝি সেই কৌতূহলের অবসান ঘটলো।আরশাদ সবাইকে সামনে বসিয়ে তার গল্প শোনাতে ব্যস্ত।

অপরদিকে জ্বরে কাঁপছে খুশবু।শরীরে যেন আগুনের লাভা সৃষ্ট হচ্ছে।একেরপর এক জল পট্টি দিয়েও জ্বর কমাতে ব্যর্থ অনিমা।খুশবু কখনো প্রেম করেনি,ভালোবাসায় মজেনি।সে জানে না প্রিয় মানুষের দুরত্ব কতটুকু পোড়ায়।আজ আরশাদের শূন্যতা তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে বদ্ধ যন্ত্রণা কাকে বলে।কাউকে বলা যায় না বোঝানো যায় না।নিরবে সহ্য করার এক ব্যর্থ চেষ্টা।
চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here